You are currently viewing একগুচ্ছ কবিতা || লিপি নাসরিন

একগুচ্ছ কবিতা || লিপি নাসরিন

একগুচ্ছ কবিতা
লিপি নাসরিন

মরুগোলাপ ও ফসিল
————————-

মরুগোলাপের লাল পাপড়ি নিষ্কণ্টক দীপশিখার মতো উত্তাপ ছড়িয়ে দেয় মৃত্যুর পূর্বাপর ক্ষণে। সিঙ্কে আঁটকে থাকা মাছের আঁশে জানালার গরাদ বেয়ে নেমে আসে সূর্যশিখা, এবং রোমপায়ে হেঁটে বেড়ানো রেণু তখন স্থিত হয় কোন এক গর্ভমুণ্ডে আর পৃথিবীর অম্লত্ব বেড়ে পি-এইচ কমে গিয়ে মরে যায় সুবোধ মাইক্রবস। মেসোপটোমিয়া সভ্যতা ধংস হয়েছে কিছু আগে আর পারস্য সভ্যতা গিলে নিতে চাইছে প্রযুক্তির প্রহেলিকায় ফিরে আসা সহস্র বছরের ঘুমন্ত এক অতিকায় দানবের ফসিল। প্রবল বৃষ্টি আর এক নগরে বৃক্ষের মহাসমারোহের অপেক্ষায় আছে পৃথিবীর সব জীব। মেঘের ওপারে লুকোচুরি খেলা আর প্লবতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যন্ত্র বিনাশে পাখি আর মাছের দৃষ্টিহারি সঙ্গম মানবতার মূর্খতা মুছে দেয় জ্যোৎস্নায় ফুঁসে ওঠা প্রবল জোয়ারে।
কোন এক শুষ্ক প্রভাতে হয়তো দেখা যাবে অচেনা এক সভ্যতা পৃথিবীর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে।

একা পূর্ণচাঁদ
——————

বর্ষবলয় দেখি, সাইনবোর্ড দেখি, আকাশজলের নগ্নসুন্দর নৃত্য দেখি,উন্মত্ত জনতা দেখি, দুইটা সন্তান নিয়ে ধুলোর ভেতর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা পাগলি মাকে দেখি, কেবল দেখি না নিজেকে। চিরচেনা এক আমির পিছনে নৈঃশব্দ্যের নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে কেউ, সে বড় অরূপ, বড় অচেনা। মাঝে মাঝে হেসে ওঠে, কান্নার কিন্নর কণ্ঠে কখনো জেগে ওঠে হঠাৎ । সে পরিজনবিহীন বড় একা- একাকী ঝুলে থাকা শূন্যতা যেন, মুখকালো মেঘের মতো একা, দরুদ শেষে ফেলে রাখা তসবীহ দানার মতো একা, ঘনবাতাস কেটে প্রতিসারঙ্কে বেঁকে যাওয়া রঙিন আলোকরশ্মির মতো একা, জংলি ফুলের মতো একা, তবে তাকে বিমূর্ত সৌন্দর্য বলতে পারি না কারণ কখনো সে রূপ আমাকে ভীত করে তোলে। একদিন ঘন আঁধারে ঢেকে যাবে উৎসবের রঙ, উদযাপনের আনন্দ। তখন আঁশফলের জ্যাকেট খুলে বীজের অমাবস্যায় ডুবে যাবে পূর্ণচাদ।

বাবার পদরেখা
——————–

গলিত শব থেকে কেবল দুর্গন্ধ ছোটে। সৌগন্ধের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আনে এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতা। বিমূর্ত রাত্রিবাসের ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে কোলাহল, আমি কেঁপে উঠি। উন্মুক্ত বাহুর আহবান উষ্ণ করে তোলে পোড়া মাটির বুক, আমি কতোদিন পর ফিরে আসি তার কোমলকরপুঞ্জে স্বরূপে। ‘এখনো সময় আছে’ এই সাবধান বাণী ধ্বনিত হয় শূন্য থেকে শূন্যে, কচুপাতার টালমাটাল জলবিন্দু তখন কিনারা ঘেঁষে কম্পমান। তখন এক অদৃশ্য সুর জাগিয়ে রাখে জানালার কোলে অপক্ষেমান চাঁদ সত্যনিষ্ঠ গায়েবি ধ্বনির অপেক্ষায়। ঘুমন্ত শরীর থেকে ছুটে আসে কর্পূর নীল রঙে, আমি দাঁড়িয়ে থাকি শিয়রে বাবার জেগে ওঠার প্রতীক্ষায়। তার বাষ্পলোচনে আমার অঙ্গুলিশীর্ষ স্নেহ বুলিয়ে দিয়েছিল ভয়মোচনের নিমিত্ত। স্নেহের কোন দাম নেই মৃত্যুর কাছে বরং সব বন্ধকতা মাড়িয়ে প্রিয়হীন করে তোলাই তার অভিপ্রায়। তবুও বোধ-অবোধের নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমি যখন অননুধাবনের মাত্রাজ্ঞানে নিবিড় হতে থাকি তখন দূরাবেশিত গল্পগুঞ্জন ওঠে। ব্যথার ক্লান্ত ক্ষতে প্রলেপ মাখিয়ে দেয় বাস্তবের তাণ্ডব।
ক্রমাগত অতীত পর্যায়গত সোপানে পা রাখে আমি এগিয়ে চলি বাবার চলে যাবার পথরেখা বরাবর।

কুয়াশাকায়া
——————

কুয়াশা মিশ্র হতে থাকে গুচ্ছ স্বপ্নের সাথে
প্রলম্বিত উদ্বেগ কাটিয়ে ভোর নামে সোনালুর কচি শাখে
দূরের কোন মৃত্যুকূপে হুইসেল বাজে;
কঙ্কালগুলো ক্ষয়ে যায়, নিভৃত জারকে।
নিমজ্জন!
আমাদের পরাহত সমৃদ্ধি ফিরে আসে কোনদিন
খরাবৃত মাঠের ফসল হয়ে,
জলাভূমির মৃত ফসিলে জ্বলে ওঠে বারুদ
ধনচেমূলে রাইজোবিয়ামের আনাগোনা
অতঃপর নিদ্রায় নিমগ্ন।
পুরোনো ইতিহাস থেকে গন্ধ উড়ে আসে
হাটে-মাঠে অগণন ক্লিষ্ট মুখ চেয়ে থাকে কেবল,
অনাদিকাল ঘিরে থাকা এক অসুখ
মালতির ডালে।
উইয়ের ঢিবির ভেতর এক আশ্চর্য আশ্রয়ে
লুকানো সুখ মুখ তুলে চায়
আঘাতে আঘাতে তার ক্ষয়ে যাওয়া অন্ধ চোখ
পাতা খুলে দেখে পৃথিবীর রঙ শেষবার,
অন্ধকার !
সারারাত জেগে শোনে শিশিরের ডাক
দলবদ্ধ ঝিঁঝিঁ, ঝোপের আড়াল,
জীবনের সবগুলো ভুল দুলতে থাকে,
পেন্ডুলাম!
বাতাসে হেঁটে হেঁটে একদিন পৌঁছে অজানা গৃহে
কোথাও তার থাকে না ছায়া, কায়ার ভস্মটুকুও।
*************************************

Leave a Reply