ইসরাত জাহান
জিহ্বা উধাও
দিনের শুরুটা, মাসের বাকি উনত্রিশটা দিনের মতোই, ফ্যাসফ্যাসে রসহীন কষকষে আবহে শুরু হলেও রাতটা কেটেছিল অদ্ভুত এক স্বপ্নের ঘোরে। সেই ঘোরের অন্যরকম আনন্দের এক চঞ্চল চড়ুই ছুটে বেড়ায় জলিল সাহেবের সারা শরীর জুড়ে। যা তার মন ও মগজে এখনও গেঁথে আছে। একটু আয়েশের জন্য বাঁ-কাত থেকে ডান-কাতে মোড় নেয়ার সময় বাঁদিকের মাড়ির শেষ প্রান্তের দাঁতটা টনটন করে ওঠে। হয়তো গতকাল রাতের বাসি কোনো খাবারের টুকুরো আটকে আছে। আটকানোর কথা শুনলেই তার মনটা ফুরফুরিয়ে ওঠে। আজ খেয়াল করলেন আটকালে টনটনে ব্যাথাও হয়। দাঁতের টনটনটা ভাবটা একটু নিরাময়ের জন্য মুখের ভেতরের মাংসল অঙ্গটাকে খুঁজে, অনুভবের টান পড়ে, বিপত্তিটা সুপ্ত থেকে জাগ্রত হয়। লাফিয়ে ওঠেন ঘুম থেকে…
সামথিং মিসিং! মিসিং মানে উধাও!
কিন্তু উধাও বিষয়টা তো তার জন্য নতুন কিছু না,সরকারি অফিসে অনেককিছু উধাও হয়৷ সেটা একটা সময় হাওযায় মিলিয়ে যায়। মেলাতে হয়, নিজের স্বার্থে, অনেক সময় বসদের স্বার্থে। এ আর নতুন কি?
কিন্তু, এটা কি হলো!
আতংকে চিৎকার করতে গিয়ে পরিস্থিতি, বিষয়কর্ম আরো পরিস্কার হয় জলিল সাহেবের কাছে। ওদিকে চিৎকার থেকে অর্থবহ কোন শব্দ বের হয় না। আরো অস্বাভাবিক লাগে সবকিছু। তাড়াহুড়ো করে খাট থেকে নামতে গিয়ে দুই পায়ের মাঝে বিশেষ অঙ্গটা খাটের শক্ত দাসার সঙ্গে কিঞ্চিৎ কোলাহল বাধিয়ে ফেলেন। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠেন, কিন্ত উঠলে কি হবে, ব্যাথা অনুভবের শব্দটাও তার কান অবদি পৌঁছায় না। নরম, মাংসল অঙ্গটির অভাবে সঠিক অর্থপূণ শব্দ তরঙ্গ বাতাসে খেলতে পারে না। কিন্তু যন্ত্রনাটা মুখে সুস্পষ্ট ছাপ ফেলে দেয়। রাগে গজগজিয়ে একটু খুড়িয়ে স্ত্রীকে খুঁজতে শোবার ঘর থেকে বের হতেই চোখ নামক সিসি ক্যামেরাটা বুয়ার ঢেকে রাখা সম্পদে আটকে যায়। আহ…
ওমনি গজগজিয়ে ওঠা রাগটা নিমিষেই জলে হয়ে বুয়ার কপালে জমে থাকা ঘামের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। লাউ গাছের তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা কচি ডগার মতো এই মেয়েটাকে দেখলে তার সারাটা দিন বেশ রসালো কাটে। পশ্চাৎদেশের ডান বামের দোলা, আড়ালে লুকিয়ে রাখা সৌন্দর্য গুপ্ত সুখের উল্লাসটাকে ক্ষুধার্ত করে। হরহামেশাই এই সৌন্দর্য দেখেন স্ত্রীর আড়ালে।
তিথি , তিথি… ( জলিল সাহেবের সহধর্মিণী)
ডেকে ডেকে গলা ব্যাথা করেন, কিন্তু কোন সদুত্তর পায় না, পাবো কিভাবে! কোন অর্থপূর্ণ শব্দ তো বের হয় না। ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝার জন্য আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বোয়াল মাছের মতো হাঁ করতেই ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়, জিহ্বা গায়েব! চিৎকার করতে গিয়ে পরক্ষনে নিজেকে সামলে নেয় জলিল সাহেব। এই দেশে তো কতকিছুই উধাও হয়, কখনো ম্যানহোল, কখনো ফাইল, কখনো দলিল, কখন টাকা। হরহামেশা মানুষজন উধাও হয়, পত্রিকার পাতায় বেশ বড় হেড লাইনে তাজা সংবাদগুলো প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে সেই খবরগুলো বাসি পচা হয়ে একটা সময় হারিয়ে যায়। তারপরে আবারও নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয় ব্যস্ত নগরবাসী। সেগুলো মাঝে এটাতো সামান্য জিহ্বা গায়েব। দাঁত আছে, সেটা ভেবে শুকরিয়া আদায় করেন উপরের দিকে হাত দুটো তুলে। দাঁত আছে, তা দিয়ে কেটেকুটে রাখা যাবে খাবার, কিন্ত গিলতে তো জিহ্বা দরকার।
তখন?
জুস,পানি দিয়ে না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। জিহ্বা ছাড়া তো কথা বলা যাবে না। অফিসে তো কথার কারবার। ফাইল লুকানোর কাজ না হয় ইশারা ইঙ্গিতে করা যায়। কিন্তু সেই ফাইলের লগ্নিকারিদের সাথে কথোপকথন, সেগুলো কথা না বলে করা অসম্ভব। অফিসের অন্যান্য কাজও তো আছে। হাজারটা ভাবনা তাকে ঘিরে ধরে।
বেগতির দশা এড়াতে, সকালের নাস্তা না করেই ছোটে ডাক্তারের কাছে। ইশারা ইংগিতে সবাইকে বোঝায়, তিনি অঙ্গ হারা সঙ্গিন এখন।
ডাক্তার তার সমস্যার কথা শুনে চোখ দুটো কপালে তুলে ফেলেন। অনেকটা সময় পরীক্ষা করে বললেন, “এটি তো খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। মেডিক্যাল ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। আপনাকে বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।” কথাটা শুনে ডাক্তারের উপর প্রচন্ড রাগে যান, রাগটা ফোঁস ফোঁস করে কান দিয়ে বের হয়, অনুভব করেন।
মনে মনে ভাবেন,অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের কি বলবেন? তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এই ভাবনার মাঝে অফিসে পৌঁছে যান। অফিসে পৌঁছে পকেটের রুমালটি দিয়ে মুখটা ঢাকতেই, চারপাশ থেকে হাসির ডিগবাজিগুলো সামনে এসে হোঁচট খায়। পাশের টেবিলের সহকর্মী জানায়, বস তিনবার ডেকেছেন। সরু চোখে বাঁকা চাহনিতে তাকায় জলিল সাহেবের দিকে। দেরির কারণ জানতে চায়। কেননা দু’জনেই এই অফিসের মাসতুতো ভাই, সামনের অংশটুকু সবাই জানে।
জলিল সাহেব সরু চোখের বাঁকা চাহনির দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে স্যারে সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
“কী হলো, ? মুখে কাপড় কেন?”
পাশ থেকে একজন রসিকতা করে বলে ওঠেন,’ নতুন জামাই মনে হয়। মুখ থেকে খারাপ বানী বের করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাময়িক রূপভেদে কারণে শব্দগুলোকে নিরবে রাখেন । ইশারায় বসকে বলেন, “জিহ্বা গায়েব”। তার মাথা মোটা বস ইশারার ভাষা বুঝতে পারেন না। বরাবরের মতো গলা চড়িয়ে বলেন…
‘রসিকতা করছেন?
নাকি কি মাথায় কোন সমস্যা?’
জলিল সাহেব নিরবে নখ দিয়ে চেয়ার পুডিং খোটাখুটি করেন, চেয়ারের ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়টা আরো একটু ছেঁড়ার চেষ্টা করেন, আর ভাবেন, কিভাবে এই দুর্বোধ্য বিষয়টা বোধ্য করবে হাঁটুতে বুদ্ধি রাখা লোকটাকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিটে যায়, তিনি ভাবেন, মিনিট গড়িয়ে ঘন্টায় যায়, তিনি ভাবেন। পুরো অফিসের চুয়ান্নজন সহকর্মীর চুয়ান্ন জোড়া চোখ তখন তার পানে। খাবি খেয়ে ভাবতে থাকেন কেন এমনটা হলো? কোন বিশেষ ফাইল লুকানোর কারণে কি এমনটা হয়েছে? ঘটনার পেছনে কি কোনো গোপন রহস্য আছে? মাথায় হাত রেখে টেবিলে ঝুঁকে পড়েন জলিল সাহেব।
সারাদিনে ভাবনার তাঁর ছিড়ে বিকেলের দিকে হঠাৎ তার মনে পড়ে, গতকাল অফিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল লুকিয়েছিল, সেটার কারণে কি এমন কিছু ঘটেছে? ফাইলের ভেতরে কি এমন কিছু আছে যার কারণে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। মনে মনে সেই ফাইলটা উদ্ধার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। সন্ধ্যায় অফিসের সবাই চলে গেলে, আবারও অফিসে ঢুকে পড়েন অনেকটা সতর্কতার সঙ্গে, একা একাই সেই ফাইলটা খুঁজে বের করেন বসের টেবিল থেকে। অতি আনন্দে ফাইলটা তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে দেখেন, একটি কাগজে লেখা আছে ,
“যদি সত্য লুকাতে চাও, নিজের জিহ্বা হারাও।”
ওমনি পিছন থেকে তার অফিসের বিগ বস এসে পিঠে চাপঘাত করে, জলিল সাহেব লাফিয়ে উঠেন।
জলিল সাহেব ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেন । উঠে দেখেন ছোট মেয়েটা জোড়ে জোড়ে চিৎকার কারে তাকে ডাকছে,
ও বাবা সকাল সাতটা বাজে, অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো…
জলিল সাহেব কিছুসময় ভাবলেশহীন হয়ে শুয়ে থাকেন। ভাবতে বসেন,এই বিভ্রান্ত স্বপ্ন কেন দেখলেন! ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে বারান্দা এসে দাঁড়ান। দূরে সাদামাটা মেঘ, চারপাশটা রোদের ঔজ্জ্বল্য গায়ে জড়িয়ে বেশ চকচক করছে। হঠাৎ স্ত্রীর চিৎকার, ধীর ছন্দে আবহের মাঝে সংসারিক আবহ তার ভাবনায় ঢুকে পড়ে। মেজাজটা খিঁচে আসে, সকালটা তার লেজেগোবরে। চুপচাপ মাথা ঠান্ডা করে রোজকার কাজে মন দিয়, বৌয়ের চিৎকার চেঁচামেচি পাশ কাটিয়ে । রান্নাঘরে চিপায় ময়লা , বুয়ার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা অভিযানে নেমেছে, এ আর নতুন কিছু নয়, রোজকার রুটিন। জলিল সাহেব ওদিকে থেকে মনোযোগ সরিয়ে তার রুটিন মাফিক কাজ মন দেয়। তাছাড়া এই স্বপ্নের কথাটা আজ অফিসে গিয়ে সবাইকে আরো রসালো করে বলতে হবে।
সেদিন হয়তো জলিলের রসালে গল্পের আলাপচারিতা অফিসে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল, কেউকেউ হয়তো সেই গল্প ঘরের খাবার টেবিলে বসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন। তারপরে কেটে কেটে যায় অনেকটা দিন।
তারপরে হঠাৎ এক শুক্রবার সকালে…
একটি দৈনিক পত্রিকার দেশের পাতায় একেবারে শেষের কর্নারে অদ্ভুত শিরোনামের একটি খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য খবরে ভীড়ে বেশ অল্প জায়গা জুড়ে প্রকাশিত সংবাদটি তেমন কারো নজরে আসে না। এলেও কেউ হয়তো তেমন গুরুত্ব দেয় না। দিন শেষ খবরটি বাসি হয়ে যায়, নতুন খবরের চাপে পুরোনো খবরটি হারিয়ে যায়।
বেশকিছু দিন পরে সেই বাসি খবরটি ইস্ত্রী করা কাপড়ের মোড়ক হয়ে আলিম মাহাতাবের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। ষাটোর্ধ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানুষটা কাপড়গুলো গুছিয়ে, মোড়কটা ফেলে দেয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় পেপারের খন্ডংশটায়। তখনই ‘জিহ্বা উধাও’ শিরোনামের অদ্ভুত সংবাদটি তার নজরে আসে।
পুরোনো পেপার, ঠোঙ্গা, বইয়ের ফেলে দেয়া অংশ হাতে পেলে একটু পড়ে নেয়া আলিমের ছোটবেলাকার অভ্যাস । কৌতূহলী মন, এই পড়াশোনার নেশায় পরে তার কত রাত যে দিনের কড়া নেড়েছে, আর কত দিনে এসে থেমেছে সন্ধ্যায়,তা একমাত্র তার পরিবারের মানুষগুলো জানেন। জীবনে অসংখ্য অঘটনের জন্য দায়ী তার এই অনুসন্ধানী মন। প্রতিবারের মতো এবারও খবরটা দেখে প্রথমে তার কপালটা কুঁচকে আসে। তারপরে পত্রিকাটি সনাক্ত করার চেষ্টা করেন। অংশটুকু নিচের দিককার হওয়ায় অনেকটা সময় কেটে যায় পেপারের নাম বের করতে করতে। সামনে অথবা পিছনের পাতায় হলে বেশী বেগ পেতে হতো না। পত্রিকার নামটি বের করে আর অপেক্ষা করে না আলিম মাহাতাব। ফোন করেন পত্রিকার অফিসে। তিন চারবার ফোন করার পরে অবশেষে একজন ফোন ধরে। কিন্তু খবরটির বিষয় অজ্ঞতা প্রকাশ করেন সে-জন। অতি আগ্রহী মানুষটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অসহযোগিতার কারণে, তারপরে তিনিও ব্যস্ত হয়ে যায় অন্যকাজে।
এইভাবে কিছুদিন কেটে যায়। পত্রিকার পাতায় আরো অনেক চমকপ্রদ সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থিক অনিয়মের সংবাদ তো আজকাল ডালভাত। সব প্রতিষ্ঠানে এই অনিয়ম চলে, সবাই সেগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাই এইসব সংবাদে এখন আর তেমন কেউ বিচলিত হয় না। মাঝেমধ্যে দুই-একজনকে এই বিষয়গুলো নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে দেখা যায়, তারপরে সেই কন্ঠগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। অনেকটা সে কারণে আজকাল এই সব বিষয় নিয়ে কেউ তেমন কথা বলে না, হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা বা ভয়ে। আলিম মাহাতাবের মতো গুটি কয়েকজন এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। আবার হালে জলের অভাবে শুকনো পায়ে ফিরে আসেন। আড়ালে অনেকে আলিমকে পাগল বলেন। তার মতো সবাইকে এমনটাই শুনতে হয়। এবারের অদ্ভুত এই শিরোনামের খবরটিও হয়তো আলিম মাহাতাব ভুলে যেতেন। ফেসবুকের স্ক্রিনশটের বদৌলতে সেই খবরটি আবারও তার চোখে পড়ে। তার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড টাইমলাইনে ওই খবরটির স্ক্রিনশটি শেয়ার করেছেন। এবার তিনি বিষয়টি জানার জন্য একেবার আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়েন। প্রথম ফেসবুকে সেই বন্ধুকে নক করেন, বন্ধু তো তার এই প্রশ্ন শুনে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে পোস্টই ডিলেট করে দেয়। হাল ধরে রাখা মানুষ আলিম এবার যায় আগের সেই পত্রিকার অফিসে, পরিচিত একজনের সুবাদে। তিনি মাহাতবকে সেই পাতার সম্পাদকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সম্পাদক হাসি খুশী মানুষ, হাসতে হাসতে বলেন ‘
‘ আপনার এতো নিউজ থাকতে এই নিউজের প্রতি এতো আগ্রহ কেন? আপনার কি কিছু উধাও হয়েছে’
মাহাতাব সম্পাদকের কথার বিগলিত না হয়ে খবরের সত্যতা জানতে চায়। সম্পাদক তাকে একজন রিপোর্টারের ফোন নম্বর দিয়ে জানায়,
‘আপনি আশিষের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, রিপোর্টটা আশিষ করেছে’।
মাহাতাব আর সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে ফোন করেন। কিন্তু ফোন নম্বর বন্ধ থাকার বিফল হয়ে ফিরে আসেন। তারপরে বেশ কিছুদিন পরে আবারও যায় পত্রিকা অফিসে। তবে এবারে আর আগের মতো উষ্ণ অভ্যর্থনা পায় না। সামনের সোফায় বসে থাকেন দীর্ঘ সময়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে একজন অল্প বয়সী মেয়ে এসে আলিমকে ডেকে নেয় ভেতরে। চা খেতে দেয়, সাথে একটি ঠান্ডা সিঙারা। তারপরে আরো অনেকটা সময়ের অপেক্ষা । অবশেষে মাহাতাব সেই রিপোর্টারের সাক্ষাৎ পায়।
কথার পিঠে আর কথা না বাড়িয়ে রিপোর্টারের কাছে সেই সংবাদটির সত্যতার বিষয়টি জানতে চায়। রিপোর্টার কাজের তাড়া দেখিয়ে দুদিন পরে আসতে বলেন। সেই দুদিন চার দিনে গড়ায়। মাহাতাব আবারও সেই পত্রিকার অফিসে যায়। নাছোড়বান্দাকে নিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়েন রিপোর্টার। এবারে চা পানের ছলে রিপোর্টার মাহাতাবকে অফিসের বাহিরে নিয়ে আসেন। অনেকটা কাচুমাচু করে জানায়,
আসলে আংকেল, এই সংবাদের সত্যতার বিষয়ে আমার কোন সোর্স নেই। একদিন রাতে বাসায় ফিরছিলাম বাসে। যাত্রী কম হওয়ায় সেদিন বাসে শোরগোল কম ছিলেন। তখন রাত অনুমানিক এগারোটা, আমার পিছনের সিটে দুই বন্ধু গল্প করছিল, সেই গল্পলাপের কিছু কিছু অংশ আমার কানে এসে পৌঁছায় । গল্পের আলাপের মাঝে একজন বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে অন্য বন্ধুকে বলেছিল, জানিস আমার চাচার অফিসের একজনের’ জিহ্বা গায়েব’ হয়ে গেছে। তখন অপর বন্ধু আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে তার বাবার অফিসের একজনেরও জিহ্বা গায়েব। বেচারা এখন শয্যাশায়ী। এই কথাটুকু শুনে আমি পিছন ফিরে দুজনকে জিজ্ঞেস করার আগে যাত্রী দু’জন বাস থেকে নেমে পড়ে। আর জানা হয় না খবরের সত্যতা । গতানুগতিকের বাহিরে একটু আলাদা চমকের খবর প্রকাশকের জন্য একটু গুছিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এই সংবাদটি কারো নজরে আসবে না। গায়েবি জিনিস হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
রিপোর্টারের কাছে আসল ঘটনাটি জেনে মাহাতাব বেশ কিছুক্ষন আশাহত ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ‘জিহ্বা উধাও’ রিপোর্টকারী সংবাদিক লোকটার দিকে। ওয়ান টাইমের চায়ের কাপটা ময়লার বালতিতে ফেলে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ান। সেই মুহূর্তে মাহাতাবের মেজাজটা যে চরমে ছিল, সেটা আশপাশের সবাই বোঝে। অতি কৌতূহলী আলিম মাহাতাব এরপরে কিছুদিন সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে সরে আসেন। ঠিক করেন চোখ ছাড়া আর কোনকিছুকে বিশ্বাস করবেন না।
হঠাৎ একদিন, মাহাতাব বাসে চড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। পাশের সিটে রোগামতো একজন। বাকপটু মাহাতাব লোকটার সাথে গল্প জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু খেয়াল করেন লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছেন বেশ আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু কোন কথা বলছেন না। একটু পর পর কেঁপে উঠছেন। মাহাতাবের বেশ মায়া হয়। জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোথায়? লোকটা নিরবে বাসের পা দানিতে তাকিয়ে থাকেন। এইভাবে কিছু সময় পড়ে মাহাতাব কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
কি ভাই, সমস্যা কি? কথা কি বলতে পারেন না?
লোকটা, মাথা নাড়িয়ে আকার ইংগিতে কিছু বলার চেষ্টা করেন ? আলিমের বড্ড মায়া হয় লোকটার জন্য। বুঝতে পারে লোকটা বোবা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আলিম নিরব হয়ে বাহিরের দৃষ্টি দেয়। বাহিরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একটা সময় ঝিমুনি চলে আসে। ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙে কন্ট্রেটারে ডাকে। তাকিয়ে দেখেন গন্তব্য পৌঁছে গেছেন। পাশের যাত্রীটি নেই। বাস থেকে নেমে পকেটে হাত দেয় অভ্যাসবশত। খেয়াল করেন, পকেটে চাবির পাশাপাশি আরো কিছু আছে। বের করে এনে দেখেন কাগজ। কাগজটি খুলে হাতে নিয়ে দেখেন, সেখানে লেখা আছে,
আমার জিহ্বা নেই’ কথা বলতে পারি না। ঠিকানা দেয়া আছে আপনাকে আমার গল্পটা জানাতে চাই। আসবেন।
আলিম মাহাতাবকে আর কে ঠেকায়ে। বাড়ির কাজ দ্রুত শেষ করে বের হয়ে যান অনুসন্ধানে। ঠিকানা অনুসারে পৌঁছতে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় না আলিম মাহাতাবের। বেশ কাছেই লোকটার বসবাস। একতলা বাড়ি, চারপাশটা ইট ঘেরা, বাড়ির দরজাটা বড় হলেও আলিমকে ঢুকতে হয় পকেট গেট দিয়ে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে আলিম রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। এমন জায়গায় এইরকম দার্শনীয় বাড়ি সচরাচর দেখা যায় না। লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। লোকটা চোখে মুখে হাসির উচ্ছ্বাস আবেগ।আলিমকে ইশারায় ভেতরে আসতে বলেন। তখন বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন একজন ভদ্রমহিলা। মহিলাটি বেশ সুন্দরী, পোশাকআশাক বেশ মার্জিত। চা নিয়ে আসেন। আলিমের কাছাকাছি বসেন।
আসতে কি অনেক কষ্ট হলো? নারীটি জিজ্ঞেস করেন।
আলিম না -সূচক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়। আর চোখ দুটো লোকটার দিকে ঘুরেফিরে চলে যায়। ওনার জিহ্বা নেই কেন? আলিম রাখঢাক না করে জিজ্ঞেস করেন নারীটিকে। সপ্রতিভভাবে নারীটি উত্তর দেয় ‘মিথ্যার ছুরি’ কেটে নিয়ে গেছে। আলিম মাহাতাব কৌতুক সুলভ দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে ‘শুধু কি জিহ্বা? বাকি সবকিছু কি ঠিক আছে? ‘
নারীটি সেদিকে আমল না দিয়ে বলেন, আপনি ওনার জিহ্বা হারানোর বিষয়টি নিয়ে এতো আগ্রহী কেন? আলিম মাহাতাব এই কথাটির পিঠে শক্ত কোন উত্তর দিতে পারেন না। শুধু একটু হাসি দেয়।
আপনি কি জানেন, সেকারণে আপনার ক্ষতি হতে পারে, আপনার অবস্থা হয়তো ওর মতো হবে। প্রস্তুতি আছে আপনার? নারীটি বেশ দৃঢ়তা সাথে কথাগুলো বলে। আলিম মাহাতাব একটু ভয় পেয়ে যায়। বন্ধুমহলে সাহসী খেতাব পাওয়া আলিম কাচুমাচু করে বলেন, ‘না বললে বুঝবো কিভাবে কি হয়েছিল?
ওর জিহ্বা কেটে নেয়া হয়েছে, সত্যিটা প্রকাশ করার জন্য। উনি কাজ করতেন ভিটা-মাটি অফিসে। মানুষের ভিটা মাটির হিসাব রাখতে রাখতে নিজেও ভিটা মাটির লোভে পড়ে যায়। আশপাশ কত বেনামী ভিটা মাটির নথি বৈধ হয়ে অচেনা মানুষের দখলে চলে গেছে এই মানুষটা সাহায্য । ধীরে ধীরে এই সাহায্যের ধরন বদলাতে থাকে। অর্থের শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। হঠাৎ এই মানুষটার হাতে আসে একটি আশ্চর্যজনক নথি। সেই নথিপত্রে দেখা যায়, পরিত্যক্ত ভিটাটি পড়ে আছে শহরের মধ্যখানে। তখন সবার নজরে আসে সেটা। সবাই দখল করতে চায়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিটাটা একজন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা নারীর। জরাজীর্ণ বাড়িটা সবাই মোট অংকের টাকার বিনিময়ে কিনতে চায়, কিন্তু সেই বৃদ্ধা নারী পারিবারিক স্মৃতিটুকু রেখে দিতে চায় জীর্ণ আবহে। লোভাতুর চোখের কারণে অনেক চাপ আসতে থাকে। তারপরে বেদখল হয় বাড়িটি। মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সেই সাথে শুরু হয় উধাও কর্মসূচী। ধীরে ধীরে সব নথি গায়ের হয়ে যায়। নিশ্চিত হার জেনে বৃদ্ধা নারীটি একদিন ভিটা -মাটির অফিসে এসে অনেক কান্নাকাটি করেন। কিন্তু কারো মন নরম হয়না শুধু একজন ছাড়া। সেই একজন হলো এই জিহ্বা হারানো ভদ্রলোক। উনি সেই বৃদ্ধা নারীকে সাহায্য করেন গায়েবি ইশারায়। যুক্তি তর্ক -বির্তক করতে করতে একটা সময় জমিটা বৃদ্ধা নারীটি হাতে আসে, কিন্তু হঠাৎ একদিন জমিটি নামমাত্র মূল্য বিক্রি করে দুনিয়া ছাড়েন সেই বৃদ্ধা নারী। ষড়যন্ত্রের আভাস পায় স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন। প্রতিবাদ করে ভিটা-মাটির অফিসের কয়েকজন। তাদের ভেতরে দুই তিনজন গায়েবি ইশারায় জিহ্বা হারায়। বাকিরা শান্ত হয়ে যায় ভয়ে।
নারীটি তার কথা শেষ করে জিহ্বা হারানো লোকটার দিকে তাকায় করুণার দৃষ্টিতে। আলিম মাহাতাব তখন খেয়াল করেন লোকটার চোখে ভয়। করুণার দৃষ্টিটা ভয়টাকে উপহাস করছে যেন, আলিম মাহাতাব একটু অবাক হয়, সাথে রাগে উত্তেজিত হয়ে জানতে চায় সেই জমিটার অবস্থান। এ-ই বেলায় নারীটি নিঃশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন। ততক্ষণে আলিম মাহাতাবের খেয়াল হয়, ফেরা দরকার। বিদায় নেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই সুন্দরী নারী তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
হঠাৎ আলিম মাহাতাব খেয়াল করেন,কথা বলতে পারছেন না, তার ঠোঁট দুটো কেউ শক্ত সুতোয় সেলাই করে দিয়েছে। তিনি রাগে কাঁপতে থাকেন , কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তার, সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখেন তার সামনে এগিয়ে আসছে এক চোখা মাথাওয়ালা অক্টোপাস সাদৃশ্য এক দানব।
সময়কাল -০৪.০৯.২০২৪
**************************