You are currently viewing ইশিতা জেরীন : মাটির নিচে একজন মানুষ

ইশিতা জেরীন : মাটির নিচে একজন মানুষ

ইশিতা জেরীন
মাটির নিচে একজন মানুষ

উত্তরবঙ্গের এক নিঃসঙ্গ গ্রাম কালীদহে, নদীর পাশে, গাছের ছায়ায়, মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে। গ্রামটি ছোট, মোটের উপর তিরিশ-চল্লিশটা ঘর, তিন-চারটা গরুর পাল, আর একটা পুরনো মন্দির—যার ঘণ্টা না-কি একশো বছর আগে শেষবার বেজেছিল। মন্দিরের ঘণ্টায় এখন কাক বসে থাকে, আর এর প্রাঙ্গনে মানুষের বদলে উঁচু উঁচু ঘাস দোল খায়। এখানে এখনো লণ্ঠনের আলোয় রাত কাটে, আর চৈত্র মাসের দুপুরে হাঁসেরা ডুব দেয় ধানের গোড়ায়। গাছের ছায়ায় বসে থাকে বুড়রা—যাদের চোখে পৃথিবী অনেকবার ডুবেছে।
গ্রামের শেষপ্রান্তে ছোট এক কাঁচাঘর—সেখানে বাস করেন তেপানুদ্দীন। লোকটার বয়স পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়েছে, কিন্তু চোখে আজও ঝিকমিক করে কিশোরের কৌতুহল। ছোট এক কাঠের ঘর, সামান্য জমি, আর একজন স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। তিনি খুব বেশি কিছু চান না, কেবল খাবার জন্য ভাত, পানের জন্য জল, আর ঘুমোনোর সময় একটু নীরবতা।
কিন্তু লোকটা অদ্ভুত ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, এই মাটির নিচে কিছু একটা আছে। শোনো, গভীর রাতে একটা শব্দ ওঠে, ঠিক যেন কেউ নিঃশব্দে কাঁদছে, গভীর কোথাও।
তাঁর স্ত্রী মরিয়ম—একজন চুপচাপ, ধর্মভীরু রমণী। বিয়ের প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও তাঁরা এখনো নিঃসন্তান। বহুবার সৃষ্টিকর্তার কাছে কেঁদে কেঁদে সন্তান চেয়েছেন, কিন্তু কোনো জবাব আসে নি।
মাঝেমধ্যেই, গভীর রাতে, তেপানুদ্দীন ঘুম ভেঙে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনো কখনো বলেন, মরিয়ম, তুমি কি শুনছ?
মরিয়ম প্রশ্ন করেন, কী?
মাটির নিচে কেউ কাঁদছে।
মারিয়া বলেন, এসব তোমার কল্পনা। ঘুমোও।
কিন্তু তেপানুদ্দীন জানেন, তা কল্পনা নয়।
এক শরতের সন্ধ্যায়, গা ছমছমে বাতাস আর শুকনো পাতার মর্মরে যখন মাটি জমে যাচ্ছে, বাতাসে কুয়াশা গড়াচ্ছে, তখন তেপানুদ্দীন ঘরের পেছনে একটি কোদাল নিয়ে গর্ত খোঁড়ার কাজ শুরু করলেন। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম ভয় পেয়ে বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? এই ঠান্ডায়, মাঝরাতে?
তেপানিদ্দীন কেবল বললেন, আমি ডাক শুনেছি। কেউ সাহায্য চাইছে।
গ্রামের লোকেরা বিষয়টি লক্ষ্য করে হাসলো। কবির নামের এক মাতাল কৃষক বলল, ও তেপান, নিচে কি সোনা পেয়েছ না-কি, না ভূত ডেকেছে?
এমনই অনেকে অনেক কথা বলতে লাগলো। তেপানুদ্দীন উত্তরে কিছু বলতেন না, খুঁড়তেই থাকলেনন। দিন যায়, রাত যায় তিনি খনন করতেই থাকেন। মাটি, পাথর, গাছের শেকড়—সব সরিয়ে ফেললেন। তারপর চতুর্থ রাতে তিনি নিচে নেমে গেলেন। সেখানে অন্ধকার ছিল, কিন্তু তেপানুদ্দীনের চোখ ধীরে ধীরে দেখতে শুরু করল। অবশেষে তিনি পৌঁছে গেলেন একটা কাঠের দরজার কাছে, যা মাটির গভীরে। আশ্চর্য, যেন কেউ বহু বছর আগে এখানে কিছু বন্ধ করে রেখেছিল। দরজাটা খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন একট ঘর—ভেতরে ধূপের মতো গন্ধ, মোমবাতির আলো, আর এক মানুষ বসে আছে।
মানুষটা হুবহু তেপানুদ্দীনের মতো দেখতে, কিন্তু তার মুখে বয়সের রেখা নেই। চোখ দুটো গভীর, যেন আকাশ গিলে ফেলতে পারে। সে বলে ওঠে, তুই দেরি করেছিস, তেপান।
তেপানুদ্দীন কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
আমি তুই। আমি সেই তেপান, যে জন্মাবার আগেই সত্যকে জানতো। আমি সেই তেপান, যে পৃথিবীকে ভালোবাসতো, কিন্তু পাপ করতে ভয় পেতো। আমি তোরই ছায়া, যে সত্য জানে কিন্তু মুখ খোলে না। যে গরীবের চাল দেখে, কিন্তু নিজে ভাত খেয়ে ঘুমোয়।
এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে তেপানুদ্দীন নেমে যান নিচে, কথা বলেন নিজের ছায়ার সঙ্গে। মাটি ও আত্মার মধ্যে এক অলৌকিক আলাপ চলতে থাকে। তাঁরা কথা বলেন ঈমান নিয়ে, অভাব নিয়ে, গাঁয়ের লোভী মানুষদের নিয়ে, আর সেই বাচ্চাগুলোর কথা যারা ইশকুলে না গিয়ে মাঠে কাজ করে।
ছায়া-তেপান বলে, তোকে যদি মাফ চাইতে হয়, তবে কাজ দিয়ে কর। মুখে তসবিহ নয়, হাতে রক্ত লাগে মাফ পাবার আগে।
তেপানুদ্দীন নিজেকে প্রশ্ন করেন, আমি যা করছি, তা সঠিক তো? আমি পরিশ্রম করি, প্রার্থনা করি, কিন্তু এখনো কেন আমার অন্তরে শান্তি নেই?
ছায়া-তেপান যেন তাঁর মনের কথা পড়ে নিয়ে বলে ওঠে, কারণ তুই নিজের মধ্যেই বন্দী। পৃথিবীর ভার তুই টের পাস না। সৃষ্টিকর্তা তোকে পাঠিয়েছেন শুধু ধান ফলাতে নয়, বরং গভীর মাটির দিকে তাকাতে।
এরপর থেকে তেপানুদ্দীন বদলে গেলেন। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের জমিতে গিয়েও কাজ করতে লাগলেন বিনা মজুরিতে। বুড়দের কাঠ এনে দিতেন, শিশুদের গল্প শোনাতেন। লোকজন ভাবতে শুরু করলো, তিনি পাগল হয়ে গেছেন।
কিন্তু আশ্চর্য এক ব্যাপার ঘটলো—যার জমিতেই তিনি হাত দিলেন, সেই জমিই অবিশ্বাস্য ফসল দিতে শুরু করলো। ধান হতে লাগল আগের চেয়ে দ্বিগুণ। গরীবেরা ধনী হয়ে উঠল, আর ধনীরা তীর্থে যাওয়া শুরু করলো। কিন্তু লোকেরা বিভক্ত হয়ে গেলো। কেউ বলতে লাগলো, তেপানুদ্দীন পবিত্র হয়ে গিয়েছে। আবার কেউ বলত, ওর মাথা খারাপ। তবে একদিন গ্রামের এক শিশু বলল, তেপান চাচার ঘামের গন্ধে গাছেরা হাসে।
এক রাতে তেপানুদ্দীন ছায়া-তেপানকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাজ কি শেষ? আমি কি এখন সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়াতে পারি?
ছায়া বলল, তুই তখনই প্রস্তুত, যখন তুই নিজের মৃত্যুতে আনন্দ খুঁজে পাবি। মৃত্যুকে যদি তুই আলিঙ্গন করতে পারিস, তখনই তুই মুক্ত।
তেপানুদ্দীন পরদিন আর ঘুম থেকে আর উঠলেন না। তাঁর মুখে হাসি, বুকে রাখা একটা মাটির দলা, পাশে একটি ছোট চিরকুট। তাতে লেখা—
আমার জন্য প্রার্থনা করো না। বরং সেই মানুষটার জন্য করো, যার ভেতরেও একটা দরজা আছে, আর তা সে জানেই না। যেটা খুঁড়তে সাহস লাগে।
মরিয়ম কাঁদলেন, গ্রামের লোকেরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। তেপানুদ্দীনের কবরের পাশে, শীতের মাঝেও এক অদ্ভুত ফুল ফুটে উঠলো। যার ঘ্রাণে মনে হয়—মাটি শুধু মৃতের নয়, জীবনের গোপন সিঁড়িও।
মানুষেরা বলতে শুরু করলো, তেপানুদ্দীন আর মানুষ ছিল না, সে হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর নিচের সেই আত্মা—যে বোঝে প্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা, আর মানুষের নীরব লড়াই।
এরপর প্রায় এক যুগ পেরিয়েছে। কিন্তু তবু, আজও কালীদহের বাচ্চারা বলে, যে ফুল শীতেও ফোটে, সেইটা তেপান চাচার কবর থেকে উঠে আসে।
আর গাঁয়ের বুড়রা বলে, সেই মানুষটাই বড়, যে নিজের ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে।
***********************

Leave a Reply