প্রদীপ আচার্য
মায়া
উত্তর-দক্ষিণমুখী করে শুইয়ে রাখা হয়েছে পরান আলীকে। প্রায় দু’দিন হতে চলল শরীরে কোন সাড়া-শব্দ নেই তার। আজরাইল ফেরেস্তা তার নিথর দেহ থেকে রুহ্ নিতে হয়তো বেশি সময় নেবে না আর। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে সুফিয়া পরান আলীর মাথার কাছে বসে কোরান পাঠ করে। পরের দু’জনের একজন জোনাকি তার মা বিলকিসের সঙ্গে বাজারে গেছে শাক বিক্রি করতে। সবার ছোট আবদুল্লাহ ঘর আর বাজারের সীমানার ভেতর নিজের মতো খেলছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিলকিস সুফিয়াকে বলে গেছে, তোর বাপের কিছু হইলে খবর দিস। ঘরে তো আর বইয়া থাকন যাইত না। গত তিনদিন থেকে পরান আলীর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, মৃতবৎ পড়ে আছে প্রায়। কিন্তু পরিবারের অন্যদের তো বেঁচে থাকতে হবে, তাদের মুখের গ্রাস যোগাড় করতে হবে একা বিলকিসকেই। লাওরার খেত থেকে কম দামে শাক কিনে এনে মিয়ার বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে তাই দিয়ে কোন রকমে হাঁড়িতে ভাত চড়ায় সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিলকিস শেখের টেকের দিকে হাঁটতে থাকে। মনে হাজার রকমের দুশ্চিন্তা ভর করে।সে মনে মনে ভাবে, একবার অন্তত বড় হুজুরের পানিপড়া এনে খাওয়াতে হবে এবার পরান আলীকে। সমিতি থেকে কিছু টাকা ধার করতে পারলে মাছ কিনে কিছু শুঁটকিও বানাবে সে। তাতে যদি বাচ্চাগুলো অন্তত একবেলা খেতে পায় দুমুঠো এবার। সুফিয়ার কোরান পাঠে বিঘ্ন ঘটে হঠাৎ। একমনেই কোরান পড়ছিল সুফিয়া, সহসা তার কানে বাজে, পানি। চমকে শব্দ লক্ষ করে তাকায় সুফিয়া। পরান আলী দুর্বল, অস্ফুটস্বরে পানি চাইছে। মাথার কাছে রাখা জগ থেকে ত্বরিতে গ্লাসে পানি ঢালে সুফিয়া। পরান আলির মাথাটা সযত্নে বাম হাতে তুলে নিয়ে তার মুখের কাছে সাবধানে এগিয়ে ধরে পানির গ্লাস। পরান আলী চোখ বন্ধ রেখেই কয়েক চুমুক পানি খায়, তারপর আবার আগের মতই নিস্তেজ, মৃতপ্রায় হয়ে শুয়ে পড়ে। সুফিয়া ব্যাকুল হয়ে ডকে, আব্বা, আব্বা… পরান আলী কোনো সাড়া দেয় না। আবার তলিয়ে যায় ঘুম আর জেগে থাকার মাঝামাঝি। ঘুমঘোরে স্বপ্ন তাকে নিয়ে যায় মহেশখালির বাঁকে। পরান আলী যখন ঘুম থেকে ওঠে তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। সাগরের ঢেউ পার ভাঙতে ভাঙতে কেবল মাটিই নয়, সঙ্গে করে আরো নিয়ে যায় জীবনের সব আশা, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ। বাপ-মার কবরটা কাল আর চোখের সামনে থাকবে না হয়তো। আজ দুপুরে জোয়ার শুরু হলে হয়তো এ ধাক্কায়ই ভেঙে নিয়ে যাবে। ফজরের নামায পড়ে বাপ-মার কবরটা জিয়ারত করে পরান আলী। মনে পড়ে, এক সপ্তারও কম সময়ে সাগরে গিলে খেয়েছিল তার ছোট্ট বাড়িটা। উপজেলা প্রশাসনে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সহসাই সহায়তার কোনো আশ্বাস মেলেনি তখন। বাসা ভাড়া করে বহু কষ্টে কয়েক মাস বেড়িবাঁধের ওপারে ছিল তারা। কিন্তু কোনোভাবেই জীবনের হিসাব তখন আর মেলাতে পারছিল না পরান আলী। অগত্যা জন্মভূমি ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে এসেছিল কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া এলাকায়। দেখতে দেখতে সেও প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। এখানে এসে মাছ ধরার ট্রলারে কাজ নিয়েছিল পরান আলী। সময়ের ব্যবধানে তাদের পরিবারে জন্ম নিয়েছে আরো দুটো সন্তান জোনাকি আর আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ সবার ছোট। আট বছর। আর জোনাকির দশ। তারা যখন মহেশখালি ছাড়ে তখন বিলকিস পরান আলীকে বলেছিল, চল আমরা চট্টগ্রাম চলে যাই। সেখানে কাজের অনেক সুযোগ। দু’জনে গার্মেন্টস এ চাকরি করব। আমাদের আর অভাব থাকবে না। বিলকিসের কথায় সাড়া দেয়নি পরান আলী। তার চোখে-মুখে ভাবনার গাঢ় রেখা বুঝতে তবু বাকি থাকেনি বিলকিসের। সাগরের বিশাল জলরাশি ছেড়ে কীভাবে থাকবে পরান আলী। জন্মের পর থেকে সাগরের অবাধ্য-উতরোল ঢেউ শরীরে জড়িয়ে একটু একটু করে বড় হয়েছে পরান আলী, তার দুরন্ত শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের কঠিন সংগ্রাম, সবই তো মিশে আছে সাগরের মায়ায়। এ এক অদ্ভুত প্রেম। কখনো ভাঙে, কখনো গড়ে। বুকের ভেতর সকলের অগোচরে বেড়ে ওঠা শূন্যতাকে বড় স্নেহে, বড় যত্নে আগলে রাখে পরান আলী। তার বাসর রাতের দিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। নববধুকে নিয়ে সে রাতের আকাশের নিচে ছোট এক নৌকায় বসে ছিল অনেকক্ষণ। পরের দিন সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরে এলে মহাজন তাকে অতিরিক্ত টাকা বকশিস দিয়েছিল। পরান আলী উপজেলা মার্কেট থেকে বিলকিসের জন্য একটি গলার হার কিনেছিল সেদিন। দেখতে একদম সোনার হারের মতো। বিলকিসকে কিনে দেওয়া সেই তার প্রথম ও শেষ উপহার। জেলে জীবনে সুখের মুহূর্ত খুঁজে নিতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় সাগরের সাথে। এ এক অদ্ভুত জীবন, অসম্ভব তার মায়া। এ জীবন ছেড়ে দেওয়া বড় কঠিন। দুই মাসেরও বেশি সময় সাগরে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। বন্ধের পর মহাজনের ট্রলার আবার সমুদ্রে নেমে পড়ে। সবাই খুশি। শ্রাবণ মাসের এক ভোরে পরান আলী ঘর থেকে বের হয়। আকাশে তখন ঘনকালো মেঘ স্থির হয়ে থাকে যেন এখনই মুষলধারায় ঝরবে। ট্রলারে সঙ্গী হওয়া জেলেদের আজ কালো মেঘ দেখার সময় নেই। নেই কোনো ভয়। সাগরের থইথই জলরাশি আর অগণিত মাছ তাদের হাতছানিতে ডাকে। তখন শেষ রাত। গভীর সমুদ্রে ট্রলার। তিনদিন ধরে তারা মাছ ধরে। অনেক মাছ। মহাজন নিশ্চয়ই সবাইকে ভালো বকশিস দেবে। এবার ফেরার পালা। চারদিনের সমুদ্র যাত্রা শেষ করে ট্রলার উপকূলের দিকে ফিরতে শুরু করে। দু’একজন ট্রলার চালানোর জন্য জেগে থাকে। বাকিরা ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় ট্রলারের জমিনে। ঠিক সে সময় দূরের একটি ট্রলার থেকে আলো দেখিয়ে নির্দেশ করে ট্রলার থামানোর জন্য। এমন অভিজ্ঞতা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের জন্য নতুন নয়। মাঝি চিৎকার করে বলে, ডাকাত পড়েছে। সে নির্দেশ দেয়, ট্রলার কিছুতেই থামানো যাবে না। নৌকায় অনেক টাকার মাছ। গভীর অন্ধকারে কারো মুখ ভালো করে দেখা যায় না। ডাকাত দলের ট্রলার পিছু নেয় পরান আলীদের ট্রলারের। তাদের ট্রলার থেকে বার বার বাঁশির শব্দ ভেসে আসে। না কিছুতেই ধরা দেওয়া যাবে না। ডাকাত দল যদি ধরতে পারে তাহলে ট্রলারের সবাইকে মেরে সাগরে ফেলে দিয়ে মাছ ভর্তি ট্রলার নিয়ে যাবে। হঠাৎ কানে আসে গুলির শব্দ। ডাকাতরা ট্রলারের দিকে গুলি করতে থাকে। ট্রলারে শুরু হয় চিৎকার। মাঝির সাফ জবাব, ডাকাতরা যতই গুলি চালাক কিছুতেই ধরা দেব না।
শান্ত জলরাশিতে হঠাৎ আতংক ভর করে। এভাবে মিনিট পাঁচ চলার পরও ডাকাত দল তাদের ট্রলার থামাতে পারে না। এবার হয়তো তারা খান্ত দেবে। ইতোমধ্যে তিনটা গুলি তারা করেছে ট্রলারকে উদ্দেশ্য করে। সাগরের বুকে হঠাৎ নেমে আসে স্তব্ধতা। গুলির শব্দ নেই, হুইস্যেলের শব্দ নেই, নেই কোনো চিৎকার। কেবল ট্রলারের একঘেয়ে, বিরক্তিকর শব্দ। ট্রলারের পেছনে তখনো তেড়ে আসতে থাকে ডাকাত দলের বোট। বোঝা যায় না তারা কী করতে চায়। ডাকাত দল কি ফিরে যাবে! নাকি তাদের অন্য কোনো মতলব আছে? হঠাৎ আবারও গুলির শব্দ। পরপর দুটো। তখনই পরান আলীর চিৎকারে কেঁপে উঠে পুরো আকাশ। সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। কিন্তু ট্রলারের অন্য কেউ যে তার কাছে যাবে সে সুযোগও নেই। প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্য দিয়ে মাছের ট্রলারটি শেষ পর্যন্ত ডাকাতদলের নাগালের বাইরে চলে আসে। ডাকাতদলের শত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তারা নিরাপদ সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ফিরে যায় ডাকাতদল। এবার দেখা যায় একটা গুলি পরান আলীর বাম হাতের ওপরের অংশ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেছে। ক্রমশ রক্তে ভিজে উঠছে তার শার্ট। যদিও অন্ধকারে রক্তের রং দেয়া যায় না। ব্যথায় কাতরাতে থাকে পরান আলী। ট্রলার ঘাটে ফিরে এলে তাকে তৎক্ষণাৎ পরান আলীকে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। সে দিনই মৃত্যু হতে পারত তার। কিন্তু না, মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে গত পনেরোদিন নিস্তেজ পড়ে আছে পরান আলী। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে তার। ডাক্তাররা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। অবস্থার এই কিছুটা ভালো হয়; তো আবার খানিক বাদেই যায় খারাপের দিকে। এইভাবেই সময়টা কাটে। মহাজন আর পাড়া সর্দারের পরামর্শে তাকে নিয়ে আসা হয় ঘরে। সমিতি পাড়ায় ঘর বলতে একটি মাত্র বড় কামরা। তারই একপাশে রান্নার ব্যবস্থা। বাঁশের বেড়া আর চালে লাগানো পুরোনো টিন। অনেক পরিবারের জন্য কাঁচা পায়খানা আর গোসলের ঘর পেছনের দিকে। মাসে ঘর ভাড়া দিতে হয় চার হাজার টাকা। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চলে স্থানীয় এক মাদ্রাসায়। সুফিয়া এখন আর লেখাপড়া করে না। ছোট মেয়েটা গলা ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে অনেক দিন। সমিতি পাড়া বাজারের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ানো হয় তাকে। কিন্তু ব্যাথা কমে না। তাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। ছেলেটাকে আগামী বছর এনজিও স্কুলে পাঠাবে তারা। বড় মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। সেয়ানা হয়ে গেছে সুফিয়া। এলাকার পরিবেশ ভালো না। তাকে বেশিদিন আর এখানে রাখা যাবে না। তার চেয়ে বয়সে বড় এলাকার কয়েকটা মেয়ে রাতে ঘরে থাকে না বলে কানাঘুষা শোনা । বুঝতে আর বাকী থাকে না রাতে তারা কোথায় যায়, আবার কোথা থেকেই-বা ফিরে আসে সকালে। বিলকিস বড় হুজুরের পানি পড়া নিয়ে ঘরে আসে। সুফিয়াকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলে একটু আগে পানি খেয়েছে পরান আলী। বিলকিস পরান আলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে তাকে মৃদুস্বরে ডাকে। পরান আলীর কোনো সাড়া নেই। বিলকিস তার মুখের ওপর নিজের হাতটি সস্নেহে বুলায়। অভাবের সাথে সংগ্রাম করতে করতে তার একসময়ের পেলব, কোমল হাতের তালু হয়ে উঠেছে শক্ত আর রুক্ষ। বিলকিসের দীর্ঘনিঃশ্বাস ঝরে পরান আলীর মুখে। সুফিয়া একটি চামচ নিয়ে হুজুরের পানিপড়া থেকে এক চামচ পানি পরান আলীর মুখের ভেতর দেওয়ার চেষ্টা করে। তবুও পরান আলী কোনো সাড়া দেয় না। হঠাৎ ঘরের টিনের চালের ওপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়। শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। সুফিয়ার কোরান পাঠের শব্দ আর বিলকিসের কানে আসে না। বিলকিস এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পরান আলীর দিকে। আর ভাবতে থাকে জোনাকীকে শাক বিক্রির জন্য বসিয়ে এসেছে বাজারে। ছেলেটা এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যে গেছে! সমিতি থেকে কিছু টাকা লোন নিতেই হবে এবার। এত সব ভাবতে ভাবতেই তার হাত গিয়ে পড়ে পরান আলীর শরীরের ক্ষতস্থানে। বৃষ্টির সাথে শুরু হয় ভারী বাতাস। কেউ যেন দরজায় ধাক্কা দিয়ে খুলতে চায়। বিলকিসের অন্তর কেঁপে ওঠে এক অজানা আতঙ্কে। আজরাইল ফেরেস্তা কি তবে দরজার কাছে! যদি তাই-ই হয়, তাহলে অনিশ্চিত জীবন সংগ্রামের এতবড় জাহাজটা সে একা কীভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবে! তার চোখের সামনে অসীম জলরাশি। কূল কি পাবে সে! কান্নায় তার দুচোখ উপচে পড়ে, দু’হাতে পরান আলীকে জড়িয়ে ধরে সে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার ফোঁপানি, বৃষ্টির অবিশ্রাম কান্না। কুলসুমের সঙ্গে প্রকৃতিও সহসা দারুণ একাত্ম হয়ে ওঠে।
***********************