শাহাব আহমেদ
প্রতীতির শূন্যালয়ে
জানালার বাইরে একটা হলুদ প্রজাপতি ওড়ে। প্রতিদিন। একটাই। হলুদ ও বেশ বড়-পাখার। ওড়ে না যেন ধীর নাচে।
অদ্ভুত জীবন্ত।
অথচ তুমি মরে গেছ। মরে গেছো আরো অনেকের সাথে জুলাই-আগস্টের কোনো এক দিনে। মেরে ওরা পালিয়ে চলে গেছে।
তোমাকে নয়?
আমার সামনে যে লাশটা সেটা আমার?
আমার?
তাইতো দেখছি, আমার!
রং-চায়ের বড় মগে একটুকরো লেবু ফেলে জানালায় তাকাও, দেখো প্রজাপতিটি উড়ছে। অধরা একটি রং সে, একটি মায়ার সম্মোহন, ওর পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে চলে যাও তাও চিয়েনের প্রস্ফুটিত পিচফুলের দেশে, মাছ ধরতে ধরতে তন্ময় মাঝি অনুকূল স্রোতে যে দেশটিতে পৌঁছে গিয়েছিল। কতটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে টেরই পায়নি। হঠাৎ দেখে নদীর দুই তীরে সারি সারি পিচগাছ ফুলে ফুলে উপচে পড়েছে। অন্য কোনো বৃক্ষ বা ফুল নেই, শুধু পিচ আর পিচ, বাতাসে পিচফুলের গন্ধ মৌ মৌ।
‘এই পিচ-বিথীর শেষ কোথায়?’ সে প্রশ্ন করে। কৌতুহল তাকে থামতে দেয় না।
এসে পৌঁছায় মাটির নিচ থেকে উঠে আসা স্বচ্ছ জলের এক ঝর্নার কাছে। পাশেই পাহাড় এবং তার পাশ ঘেঁষে চলে গেছে সরু মেঠো পথ।নৌকা থামিয়ে গাছপালা ও ছায়াঘন সেই পথ ধরে হাঁটতে থাকে সে নিশি পাওয়া সম্মোহিতের মত। কিছুদূর যেতেই উন্মুক্ত হয় আলো ঝলমলে উপত্যকা; শস্যে শস্যে পোয়াতি মুক্ত প্রান্তর, মালবেরি ও উইলোর ঝোপে ঝোপে শোভিত সুন্দর সুন্দর পুকুর, আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে বর্ণালী ও সুশোভন বাড়ি-ঘর। পথ বিভক্ত হয়ে চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। ছোট ছোট খামার, হাঁস মুরগি কুকুরের শব্দ ভেসে আসছে। ব্যস্ত সমস্ত কর্মরত লোকজন, কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে, কেউ ক্ষেতে কাজ করছে। তাদের মুখে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির অভিব্যক্তি।
তুমি ওই দেশটির স্বপ্ন দেখতে, ঘুমিয়ে নয়, জেগে, যেখানে মানুষ কাজ করে, সৃজন করে হেসে এবং তাদের ক্লান্তির ঘাম শান্তির বাতাসে শুকোয়। মানুষগুলো মাথাল মাথার বৃক্ষ, খাটো কিন্তু বিশাল, ধর্মপরায়ন কিন্তু উদার, চশমা না পরেও যা গূঢ়, দেখতে পায়, সরল ও সাবলীল। পিচ-বীথি নেই, আছে লাল সাদা পদ্মের বিল। আর লালন, হাছন রাজা, রাধারমন, আব্দুল করিম, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল।
সেই দেশের সন্ধানেই যাত্রা শুরু করেছিলাম। কনকসার, ঘৌড়দৌড় পার হয়ে দীঘলী বাজারে যে লঞ্চে চড়ে বসেছি তা বহু জায়গায় থেমেছে।
‘আমি নামবো’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছি কত বার।
‘না, এটা তোমার স্টেশন নয়।’ – ক্যাপ্টেন লঞ্চ থামায়নি।
ভাসছি।
শীতের অপরাহ্নের শেষ সময়, রোদের চোখ মুদে এসেছ, তার হালকা হলুদ মোলায়েম ত্বকে ক্লান্তির ছোঁয়া। দূরে সবুজ পাদপের রেখা ধরে পাখি ওড়ে। আকাশে এখানে ওখানে ছোট বড় টুকরো কয় মেঘ, কোনোটি ধূসর, কোনোটি সাদা। আর নিঁখুত গোলচাঁদ, হলুদ নয়, চিতল মাছের পেটের মত নয়, সাদামাটা সাদা। এখন অনুভূতি থিতু, কারো মুখের আদল চোখে ভেসে ওঠে না এবং যখন রাত নেমে আসে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত দূরের ওই জনপদে চাঁদ গোল কী হেলানো ডিঙি নাও, চোখেই পড়ে না। অথবা হয়তো চোখে পড়ে, রেটিনায় পৌঁছায় না, টান দেয় না গহীনের শেকড় ধরে, যেমন দিত আগে। তাও অনেক দিন আগে, কাল, পরশু বা তার পরের দিন নয়, মাস বা বছর নয়, বহু বহু বছর আগে।
তখন বড় বড় গাছ ছিল সেখানে যারা
মায়ের হাত দিয়ে আকাশের মাথায় হাত বুলাতো। কোমল হাত। বিল, হাওর, দীঘি, পুকুর আর ধানের ক্ষেত ছিল, নদী, পালের নাও ও ভাটিয়ালী গান ছিল, নেই। সাপ যেমন ছাল ছেড়ে পালিয়ে যায় নদীগুলো নিজের বিশাল শরীর থেকে এক-একটা বালুচর টেনে-হেঁছড়ে ছিড়ে ফেলে রেখে সরে গেছে।
আহা!
শুনতে পাচ্ছো?
কিছুই নেই। ক্ষুধা, অপরাধ, বস্তি, পায়খানা, এতিমখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা, গোরস্থান, আর সঙের মত দালান ও ইটের কংকরগুলো বাদ দিলে। অতীত আছে, বর্তমান নেই। ভবিষ্যত ওই দেশের পথ চেনেই না।
‘না। ভুল প্রতীতি, বাস্তবতা বিবর্জিত! বর্তমান আছে, ভবিষ্যতও আছে।’-ওরা ধারালো দাঁত কিড়মিড় করে।
‘চেতনার ও অচৈতন্য চেতনার নষ্টেরা সব গিলে খেয়েছে। গিলে খেয়েছে পবিত্রতম শব্দ, সুর, প্রতীক ও প্রতিশ্রুতিগুলো ব্যবহার করে। তাই, যা নেই তার কোনো বর্তমানও নেই, ভবিষ্যতও নেই, শুধু শকুন আছে, শকুন, অজস্র, web of mob হয়ে’, তুমি চিৎকার
করে ওঠো কিন্তু স্বর নেই।
তুমি এদের সবাইকে চেনো, চিনি আমিও।
এরা বন্ধু। বিদগ্ধ, সুস্মিত ও সুভাষ। সুমিষ্ট ঠোঁটের পেছনে দুর্গন্ধ মাড়িতে তাদের সারি সারি পিরানিয়া দাঁত।
‘তুমি মরুতে দলছুট উট। ঝাঁক ছাড়া পাখি, চেতনা বিভ্রান্ত।’-তর্জনি তুলে দেখায়। জোর দিয়ে বলে, ‘সবাই মিলে যে পথে যায়, তা ভুল পথ হয় কী করে? আর ভুল হলেও তা সঠিক কারণ মুখ লেট্রিন হলেও শ্লোগান আমাদের পবিত্র।’
তুমি মরে গেছো, নইলে তীব্র স্বরে বলতে, ‘হ্যামিলিয়নের বাঁশীওয়ালার বাঁশীর সুরে সবাই….।’ জানি বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু মুখভরা মাটি নয়, অনীহা, অনীহা বোয়াল মাছের মত তোমার মুখ কামড়ে ধরে।
‘সিমুর্গের সন্ধানে কতটি পাখি যাত্রা শুরু করেছিল, মনে আছে?’
‘কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি, কেউ গুনে দেখেনি। আমিও না।’
‘কতটি গন্তব্যে পৌঁছেছিল?’
‘ত্রিশজন।’ ত্রিশটি না বলে আমি ব্যকরণ- বেবোধ ত্রিশজন বলেছিলাম কিন্তু মাথায় ঘুর ঘুর করছিল প্রশ্নটি, ‘যদি একজনও পৌঁছাতো, তাহলেও কি তাদের যাত্রা ভুল ছিল, বলা যায়?’
‘কী হবে প্রশ্ন করে?’ -আমার সত্তা তোমার সত্তার পাশে এখন অনীহা ও ঔদাস্যের মর্গে মৃতদেহের পেশির মত খিঁচুনি-ধরা পাথর।
‘হাজার বছর ধরে মরে যে বেঁচে থাকে সেই পাথর? না হাজার বছর ধরে বেঁচে যে মরে থাকে সেই?‘
রক্তশূন্যতার রোগী ফ্যাকাশে চাঁদ প্রশ্নটি শেষ করতে না করতেই একটা বিশাল হাঙর এসে গিলে ফেলে।
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫
***********************