পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা || শিল্পী নাজনীন
৯
মোবাইল ডাটা অফ ছিল কদিন ধরেই। আজ থেকে ওয়াইফাইও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জারি করা হয়েছে কারফিউ। শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের জেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিটিভি ভবন, আর্কাইভ বিল্ডিং, মেট্রোরেলের পুরো একটি স্টেশন। যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিবৃতি দিয়েছে এইসব নাশকতার সাথে তারা জড়িত নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ই তাদের লক্ষ্য। আন্দোলনের মুখে লাগাম টানতে আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মোবাইল ডাটা। এবার ডিবি পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে, আটকে রেখে, নির্যাতন করে, জোর করে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণাপত্র পাঠ করানোর কাঁচা নাটক করল সরকার, যদিও সেটা খায়নি জনগণ। ছাত্র সমন্বয়কদের মধ্য থেকে নতুন মুখ জানান দিয়েছে আন্দোলন চলমান। কার্যত এখন অন্ধকারে পুরো দেশ। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। সৌরভের ক্লাস শুরুর খবর নেই, সুদীপ্তর পরীক্ষা স্থগিত, অদিতির স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, ওয়াইফাই বন্ধ করে কাটফিউ জারি থাকায় অফিস-আদালতও বন্ধ, সবমিলিয়ে বেহাল দশা। নেট না থাকায় বাচ্চাদের অলস সময় কাটছেই না। পিঠোপিঠি ভাই-বোনদের মারামারিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল মিতু। ডিশ লাইন নেই বাসায়, এতদিন বাচ্চারা ওয়াইফাই লাইনে টিভি দেখত, এখন সেটাও বন্ধ করে দেওয়ায় কী করবে ভেবেই পাচ্ছে না তারা। খবর দেখার কোনো সুযোগ নাই, ফলে দেশের কোথায় কী হচ্ছে এই মুহূর্তে, তা জানারও কোনো সুযোগ নাই। ফোনেও টাকা নাই যে ফোন করবে কারো কাছে। টাকা বিকাশ করা বা ফ্লেক্সিলোড করা যাচ্ছে না আপাতত। কেমন স্থবির, অচল লাগছে জীবন। অবশ্য এই কয়দিন টিভি দেখা গেলেও দেশের প্রকৃত চিত্র তাতে বোঝা যায়নি মোটেই। চ্যানেলগুলো সরকারের গুণগানে মশগুল। দেশের অবস্থা একদম স্বাভাবিক, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে দেশ আর মুষ্টিমেয় কিছু জঙ্গিভাবাপন্ন শিক্ষার্থী জামাত-শিবিরের মদদে আন্দোলনের নামে অস্থির করতে চাইছে দেশের পরিস্থিতি, কদিন ধরে এই এক খবর শুনতে শুনতে কান পচে গেছিল প্রায়। আজ থেকে সেটুকুও বন্ধ। ফোনে এফএম রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা করে একটু পরেই বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল মিতু। তিন ভাই-বোনকে দাবা নইলে লুডু নিয়ে বসার পরামর্শ দিয়ে সংসারের কাজে মন দিল অতঃপর। সারাদিন অফিসে ব্যস্ততায় কাটে, বিকেলে বাসায় ফিরে যতটা পারে গুছিয়ে নেয় কাজ, ফলে অতিরিক্ত দুয়েকটাদিন ছুটি পেলে মন্দ কী! অনেক জমিয়ে রাখা কাজ সেরে নেওয়ার মওকা মেলে তাতে, ভেবে, রান্নাঘরে ঢুকল সে। মাহফুজ বাজারে গেছে সকালে উঠেই, তারও অলস সময় কাটছে না একদম। বাজারের নাম করে বেরোলেও আদতে সে বাইরের হালচাল বুঝতে গেছে। বাইরে থমথমে অবস্থা, সবার মুখেই দেশের হালচাল নিয়ে চটুল আলাপ, সবাই যার যার রাজনৈতিক জ্ঞানগম্যি উজাড় করতে ব্যস্ত, কারফিউ নিয়েও সবার মধ্যে বাড়তি কৌতূহল, উত্তেজনা। মাহফুজ নিজেও এসব নিয়ে মহা উত্তেজিত। মিতু অতকিছু ভাবে না, তার কাছে তিন সন্তান, মাহফুজ, সে নিজে আর তার অফিস, এগুলোই সব। তার পৃথিবী ছোট, সেখানে উটকো কোনো ঝামেলার প্রবেশাধিকার কঠিন হাতে রোধ করতে সে সদা তৎপর। কিন্তু এবার আর সেটি হচ্ছে কই! ভারি বিরক্ত হয়ে নিজের মনেই গজগজ করতে করতে সংসারের হাবিজাবি কাজ গোছাতে থাকে মিতু।
মূলত জলন্ত আন্দোলনে ঘি ঢেলেছিল প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিকের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি ওই রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরে সারাদেশের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ মিছিল করেছে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে স্যাটায়ার করে স্লোগান দিয়েছে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’!
স্লোগানটা যদিও স্যাটায়ার হিশেবে কিংবা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি অধিকাংশ মানুষ, তবু প্রধানমন্ত্রীর এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে এটাকে ছাত্রদের শ্লেষাত্মক স্লোগান বলে ধরে নিয়ে তারা নীরব থেকেছে। অনেকেই আবার এই স্লোগানের তীব্র বিরোধিতা করে ঘৃণাভরে এটাকে প্রত্যাখ্যানও করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্ররা শুধু বিক্ষোভ দেখিয়েই চুপ থাকেনি, বরং তারা প্রধানমন্ত্রীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার শর্ত দিয়ে নয় দফা দাবি পেশ করেছে। এর পর থেকেই দ্রুত বদলে যাচ্ছে প্রেক্ষাপট। মারমুখী আচরণ করছে পুলিশ, আর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। ওয়াইফাই বন্ধ করা আর কারফিউ জারি করার মধ্য দিয়ে নিজেদের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে সরকার, এমনটাই মনে হচ্ছে এখন।
ওয়াইফাই বন্ধ থাকায় সৌরভ আর সুদীপ্তকে ঘরে রাখতে রীতিমত ঘাম ঝরাতে হচ্ছে মিতুকে। সরকারের ডিসিশন মেকিং লেভেলের লোকগুলো নির্ঘাত সিদ্ধি খেয়ে চেয়ারে বসেছে! নইলে এই সময়ে ওয়াইফাই বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কেউ নেয়! তরুণদের রক্ত এমনিতেই গরম, তারপর সারাদেশ গুজবে সয়লাব। মোবাইল ডাটা অফ রাখায়, ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, ইমো সব বন্ধ থাকায় সেসব গুজবের ডালপালা ছড়াচ্ছে শতগুণ। ভিপিএন দিয়ে ফেসবুকে সারা দেশবাসী দেখেছে দেশের উত্তাল অবস্থা, ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাইদকে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে শহিদ হতে দেখেছে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে সেই ভিডিও। এখন ওয়াইফাই বন্ধ করে কী করতে চাইছে সরকার? পৃথিবী দেখেছে এই সরকার খুনী, নিরস্ত্র ছাত্রদের বুকে গুলি করে রক্ত মেখেছে তারা হাতে, এখন ওয়াইফাই বন্ধ করা মানে তো নিজেদের অপরাধটাকেই পক্ষান্তরে স্বীকার করে নেওয়া! তাছাড়া এখনকার তরুণেরা ভয়ানকভাবে অনলাইন আসক্ত। ওয়াইফাই বন্ধ করে দেওয়ায় যারা ঘরকুনো, বাইরের দুনিয়ার খবর রাখে না, তারাও এখন বের হবে ঘর থেকে। আর ঘর থেকে এখন বের হওয়া মানেই আন্দোলনে যোগ দেওয়া। এ তো শাপে বর হবে এখন আন্দোলনকারীদের জন্য। আন্দোলন দমনের নামে জুলাইয়ের ষোলো তারিখে আবু সাইদকে প্রকাশ্য রাজপথে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ, সারাদেশে পড়েছে আরো অনেক ছাত্রের লাশ, দেখে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ জনতা। একে একে তারাও রাস্তায় নামতে শুরু করেছে অতঃপর। ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামা সন্তানদের বুক তাদেরই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হতে দেখলে কী করে চুপ থাকা যায় আর! ফলে সাধারণ মানুষ একে একে নেমে পড়ছে রাস্তায়। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আন্দোলন। ছাত্রদের নয়দফা দাবি অবশেষে একদফায় গিয়ে ঠেকেছে। এখন তাদের একটাই দাবি, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। এই খুনী সরকারের সঙ্গে আর কোনো আলোচনায় তারা বসবে না, তাদের একটাই দাবি এখন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ।
এই ঘোষণায় জনগণ অনেকটাই দ্বিধান্বিত। তাদের মধ্যে সন্দেহ, সংশয়, ভয়। আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত হলে পুলিশি হয়রানির শঙ্কা, আবার আন্দোলন থেকে গা বাঁচিয়ে চললে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা, ভয়ানক দোটানায় জনগণ।
সন্ধ্যায় সৌরভ আর সুদীপ্ত কোনো কাজ না পেয়ে বই নিয়ে বসেছিল, অদিতি শুয়ে ছিল চুপচাপ, মাহফুজ পেপার নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিল আর মিতু রান্নাঘরে তাদের জন্য হালকা কিছু খাবারের আয়োজন করছিল, এমন সময় কলিংবেল বাজল। অবাক হল মিতু। এমন অসময়ে কেউ বাসায় আসে না সচরাচর। আজ হঠাৎ কে এল?
ভিউ মিররে চোখ রাখল মিতু। অপরিচিত কয়েকজন লোক, সবার পরনে সাদা পোশাক। তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে বাচ্চাদের সতর্ক করে ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে দরজা খুলল মিতু।
শান্ত, ধীরস্বরে বলল, আপনারা কারা?
মুহূর্তেই একজনের বাড়িয়ে দেওয়া কার্ডটায় নজর পড়ল তার। চমকটা নীরবে হজম করল সে, বুঝতে দিল না একদম। একই স্বরে বলল, কিন্তু আমার বাসায় আপনাদের আসার কারণটা কি জানতে পারি?
আপনার ছেলে কলেজে পড়ে, আমরা তার ফোনটা চেক করব।
কিন্তু আমার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী? আর কোন আইনবলে তার ফোন চেক করবেন আপনারা? তাছাড়া আমার ছেলে এবার এইচএসসি দিচ্ছে, তার নিজস্ব কোনো ফোন নাই।
এত কথার সময় নাই, যা বলছি করুন, আপনার ছেলেদের ডাকুন। বুঝতেই পারছেন আমার ডিবি পুলিশ।
এতক্ষণের কথোপকথনে কেউই ভেতরে ছিল না আর, সুদীপ্ত, সৌরভ, মাহফুজ সবাই এসে ভিড় করেছিল দরজায়। জেরার জবাবে সৌরভ-সুদীপ্ত দুজনেই বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দিল। ফোন চাইতেই বলল কোনো ফোন তারা ব্যবহার করে না, তাদের কোনো ফোন নাই। শেষে নিরাশ হয়ে অনেক সদুপদেশ দিয়ে বিদায় নিল লোকগুলো। তারা যাওয়ার পর ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মিতু।কী ভীষণ স্বেচ্ছাচারিতা আর আইনের অপব্যবহার শুরু হয়েছে দেশে, ভেবে গা গুলাল তার।
*********************************