হিমাদ্রি মৈত্র
তালকানা
জায়গাটা গ্ৰাম্য এলাকা হলে কি হবে, সরকারি বাবুদের ভাড়া দেবার জন্য দু’ একটা ঘর পাওয়াই যায়। হেমন্ত সেরকমই একটা ঘর পেয়ে গেল। একলা মানুষ, মা-বাবা-ভাই-বোনকে ছেড়ে এই দূরের গ্ৰামে চাকরী পেয়ে চলে এসেছে তো এমনি এমনি না! বড়ছেলের দায় নিয়েই এসেছে, বাবার বোঝাটা একটু কমাবে, মায়ের দুঃখটা একটু কমবে, ভাইবোনেরাও একটু ভাল থাকবে! বেশীদিন যে বেকার হয়ে বসতে হয়নি, সেটাই রক্ষা। গ্ৰ্যাজুয়েশনের ফাইনাল হতে না হতেই সে লেগে পড়েছিল চাকরীর পরীক্ষা দিতে। এটাই প্রথমে লেগে গিয়েছিল।
– চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা শুনছো!
সেরকম তো কাউকে যে বলবে, তার সে সুযোগও আসে নি। বন্ধুরা অবশ্য ওর আগ্ৰহের অভাবকেই দোষ দেয়। তা দোষ যে ছিল, সে হেমন্ত নিজেই জানে! সে ভালবেসে কাঙাল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চাইতে পারল না। সে ভেবেছিল, চেয়েচিন্তে যে ভালবাসা নেবে, সে তো ধার করা ভালবাসা। তার সুদ সে মিটাবে কি করে!
তার ঘরটা একেবারে গ্ৰামের শেষপ্রান্তে, তারপর একটা বিস্তীর্ণ মাঠ, ফসলের ক্ষেত, তারপর একফালি জঙ্গল। আশেপাশে দু’একটা বাড়ি আছে, এই যা। নইলে একা থাকার ব্যাথা শুধু না, ভয়টাও সঙ্গ দিত।
পরিবারগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছিল ইতিমধ্যে, কারো হয়তো বাজারে দোকান আছে, কেউ হয়তো দর্জির কাজ করেন। গ্ৰামের শেষ দিকটার জমি একটু সস্তা, তাই একটা বাড়ি বানাতে পেরেছেন এরা। হেমন্তর ঘরটা যার, তিনি গ্ৰামের বর্ধিষ্ণু অংশে থাকেন, এখানে একটা ঘর করে রেখেছেন বাড়তি রোজগারের জন্য।
শমিতের সঙ্গ দিতে গিয়েছিল সিনেমা দেখতে। তখন সবে উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে। সেখানে অনামিকার সাথে পরিচয়। শমিতের বান্ধবীকে সেও সঙ্গ দিতে এসেছিল। অনামিকা, পরে ওকে অনু বলেই ডাকত, শমিতের বান্ধবী তরুর পাশের বাড়ির বন্ধু। এরা সব এক সাথেই বিভিন্ন কলেজে ঢুকেছে। অনু আর তরু উওম্যানস্ কলেজে একই সাথে পড়ে।
– তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দি।
শমিত বলে।
– এ হল, মানে ইনি হলেন কুমারী অনামিকা, তরুর যাকে বলে বুজুম ফ্রেন্ড। আর ইনি হলেল, হেমন্তকে দেখিয়ে বলে, শ্রীমান হেমন্ত, আমার ন্যাংটো বেলার বন্ধু।
– যাহ্! তরু একটা জোরসে চিমটি কাটল শমিতকে। মুখের কোনো রাখঢাক নেই!
– আপনাকে আমি চিনি।
– আমি আবার কি দোষ করলাম যে চেনেন আমাকে!
– না, মানে ঐ যে শক্তিসংঘে ছবি এঁকে প্রাইজ পেয়েছিলেন। আমিও ছিলাম, পাত্তাই দিলেন না।
– উল্টোটা, ও ভয় পায় মেয়েদের সাথে মিশতে, যদি কেউ পাত্তা না দেয়! শমিত জানাল।
হেমন্ত সেটা নিশ্চুপ থেকেই সায় দিল। কি করে কি হল, এভাবেই শুরু হল হেমন্তের জীবনের একটা নতুন অধ্যায়।
তবে এই নতুন অধ্যায় তাকে একটু বিব্রত করে তুলেছিল। হয়তো জীবনে প্রথম কোনো নারীর তার প্রতি আগ্ৰহ, অথবা প্রথম দেখাতেই প্রেম, অথবা একটা মোহ কোনো প্রথম নারীর জন্য!
কলেজে ওঠার পর থেকে তার ব্যস্ততা অনেকটা বেড়ে গেছিল। এক তো ইউনিয়নের কাজ, তারপর দুটো টিউশনি, এর ফাঁকে পড়াশোনা, তারপর প্রেম করার মত সময় কোথায়! কিন্তু তাগিদটা ছিল, উভয় দিকেই। তরুর মাধ্যমে শমিত হয়ে তাগাদা আসত একটু দেখা করার, বা নিজের ভিতর থেকে তাগিদ আসত একটু দেখা করার। এটা তো স্রেফ ভাললাগা নয় যে খারাপও লাগতে পারে কোনোদিন! এটা কোনদিন বা ভালবাসা হয়ে গেছিল, ভালমন্দের শর্তে বাঁধা নয় যে মুছে দিলে হয়ে যাবে সাদা। একবার ভালবেসে ফেললে সেটার আর অতীত-ভবিষ্যৎ থাকে না, সেটা সবসময় বর্তমান হয়ে থাকে, সেটাই সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
আকাশে ইয়াব্বর একটা চাঁদ, বোধহয় পূর্ণিমা, বাড়ি ছাড়ার একমাস হতে চলল তাহলে! চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু দূরের রাস্তায় মাঝে মাঝে গাড়ি আসা যাওয়ার শব্দ, আর মালতীর চাকি বেলনের আওয়াজ। মাঝে মাঝে ফুস করে ফোলা রুটির বাষ্প বেরোনোর আওয়াজ। গ্ৰাম তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। কিছু ঘরে টিভি চলছে, কিছু ঘরে পড়াশোনা চলছে। আর এই প্রান্তে আসতে আসতে শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নিস্তব্ধতার অনন্ত শূণ্যে।
ওর দুই কামরার ঘর। একটার সাথে লাগোয়া রান্নাঘর, বাথরুমটা বাইরের দিকে; একটা টেপাকল আছে, সেটায় রান্নাঘর থেকেই যাওয়া যায়। হেমন্ত শোবার ঘর এদিকটাতে করেছে, সামনে ছোট বারান্দা আছে, ওটা দিয়ে সরাসরি ঘরে ঢুকে যাওয়া যায়। এ ঘর থেকে ও ঘরে। আবার রান্নাঘর দিয়েও পিছন দিক থেকেও ঘরে ঢোকা যায়। গ্ৰামের লোক ইচ্ছা করলে পিছন পথ দিয়ে এর বাড়ি ওর বাড়ি যাতায়াত করতে পারে।
নিজেই রান্না করে খাবার ব্যবস্থা মোটামুটি করে ফেলেছে। কিন্তু রুটি করাতেই সমস্যা। দিন পনেরো কুড়ি আগের কথা। সেদিন সেঁকতে গিয়ে রুটি পুড়িয়েছে, সামলাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা। হাতে ফুঁ দিতে দিতে রান্নাঘরের বাইরে। সেখানে ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল দর্জিবাড়ির বৌ আর মেয়ে, মালতী। তারা রুটি পোড়ার গন্ধ পেয়েছিল, তারপর হেমন্তের অবস্থা দেখে এগিয়ে এল। এদের সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচয় হয়ে গেছিল। একজায়গায় থাকলে তো আলাপসালাপ করেই নিতে হয়।
– কি হয়েছে কি ভাই, হাত পুড়িয়েছো!
ভদ্রমহিলা খুব স্বাভাবিক মাতৃস্নেহে কথাগুলো বলে উঠলেন।
– দেখি, চল।
বলে ভিতরে এসে হেমন্তর কান্ড দেখলেন। স্টোভটা তখনো জ্বলছে। সেটা নিভালেন। পোড়া রুটিটা সরালেন।
– ক’টা রুটি কর?
– গোটা চারেক।
– ওহ্, এই কটা! আই মালতী, রোজ চারটে রুটি করে দিয়ে যাবি দাদাকে।
– না, না, তা কি করে হয়!
– হয়না তো হাত পুড়িয়ে বসে থাক, আর গ্ৰামের বদনাম হোক! না কি, মালতীর হাতে গড়া রুটি খেতে অসুবিধা, আমরা তো তোমার মতো উঁচু জাত নই।
– না, না, কি যে বলেন। কিন্তু এতে তো মালতীর সময় নষ্ট হবে।
যাই হোক, সেই থেকে মালতী রুটি করে দিয়ে যায়। তবে টাকাপয়সার কথা সে বলতে পারে নি।
– কি বলে ডাকব? মামা না দাদা!
– কেন, মামা কেন!
– ঐ যে মা বলল, কি হয়েছে ভাই!
দু’জনের বয়সের তফাৎ কতই বা হবে! চার-পাঁচ বছরের বেশী না। সম্পর্কটা ইয়ার্কির বেশী অন্য কিছুতে যাতে না যায়, হেমন্ত সে ব্যাপারে সজাগ ও সচেষ্ট থাকল। সে নিজে দুঃখ পেতে পারে, কিন্তু তার জন্য অন্য কেউ যেন দুঃখ না পায়।
অনামিকার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হত, হয়তো টিউশন সেরে ফেরার পথে, হয়তো কলেজ যাবার পথে। সেদিন ওদের কলেজে গিয়েছিল সংগঠনের কাজে। ওর ছিল ছাত্র রাজনীতির উপর বক্তব্য রাখার কাজ। শ্রোতাদের মধ্যে ছিল অনু, তরু আর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা।
– তোমাকে বেশ প্রফেসর প্রফেসর লাগছিল। আমার বন্ধুগুলো হাঁ করে গিলছিল।
– আমাকে গিলছিল, না কথাগুলো!
– কে কাকে গিলছিল তার হিসেব পরে হবে।
এর চেয়ে বেশী কথা এগোয় নি, ওরা ওদের সংগঠনের তরফ থেকে একটা পুরোন সিনেমা ‘অঙ্কুর’ দেখাবে, তার আয়োজন করতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর হেমন্ত সিনেমাটা দেখবে বলে সীট খুঁজতে গিয়ে দেখল অনু হাতের ইশারায় ডাকছে, ওর পাশে সীটটা ধরে রেখেছে, যেন জানাই ছিল হেমন্ত ওর পাশে গিয়ে বসবে। অন্ধকার হলে পাশাপাশি দু’জনে, সিনেমা দেখবে কি, হাতটা যে কোথায় রাখবে, হাঁটুটা অজান্তেই ঠেকে যাবে কিনা, এই ভেবেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে সংগঠন করে, সেকারণে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়, পাশে বসে কথাও বলতে হয়। কিন্তু এখন কিরকম সব হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বিপদ এল অন্যদিক থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর, সিনেমার দিকে একটু মন গেছে, পায়ের আঙুলে অন্য পায়ের আঙুল এসে চাপল। হঠাৎ করে ঠেকে গেছে ভেবে সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু এরপর যখন একটু চাপ পড়ল পায়ের পাতায়, হেমন্ত বুঝল ইচ্ছাকৃত এবং আড়ষ্ট হয়ে গেল। একটা অন্য অনুভূতি, শুধু মনটাই যে ভালবাসায় জড়িয়ে থাকে, তা নয়, শরীরে শরীরে যে বিদ্যুৎ খেলে যায় আর সেই বিদ্যুতের শক্ শরীরের ভিতরের কোষগুলোকেও যেন অবশ করে দিল।
হল থেকে বেরিয়ে দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছে গেল, যেন কতকাল ধরে হাঁটছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, গলা যেন শুকিয়ে গেছে। দুজনে দুজনের বাড়ির দিকে রওনা দেবার সময় একে অপরের দিকে তাকালো, হেমন্তের মনে হল যেন একটা অতল জলের দিঘী, সেই অতলে সে ডুবে যাচ্ছে, কোনো কিছুরই নাগাল পাচ্ছে না, তবু যেন মনে হল ভাসছে। তাকে আজ অনু কাঙাল করে দিল।
এতোদিন যেটা মনে হত শুধু ওর গোপন ঘরের আলো, সেটা ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় ওর মাথায় যেন একটা ভার এসে পড়ল। অথচ কিছু বলা হল না, কিছু কথা হল না। এটুকুও বুঝতে পারল না ওর বয়সী একটা মেয়ে মনের দিক থেকে কতখানি জড়িয়ে গেলে এতটা চাইতে পারে। অথচ নিজে মুখ ফুটে তার আকাঙ্খার কথাটা বলতে পারল না। কিছু বলতে হবে সামনাসামনি হলে, সেটা ভাবতেই হেমন্ত নিজের ভিতর লুকিয়ে গেল।
শমিত অনেকবার বলেছিল, নিজেকে একটু খুলতে। আরো একটু এগোতে! কি আর এগোবে! এগোনোর কিই বা আছে! এটা কি ফুটবল খেলা নাকি, যে এগিয়ে খেলতে হবে, পিছিয়ে খেলতে হবে!
– দেখ! আমরা জানি তোরা দুজনে দুজনকে পছন্দ করিস। কিন্তু সেটা তো একটা জায়গায় আনতে হবে। তার জন্য সময় দে!
– তোদের মতো ঐ সময় ধরে দুজনে মিলে বেরোনো সম্ভব না!
বাস্তবিক, হঠাৎ কোনোভাবে দেখা হয়ে গেল তো গেল, নয়তো আলাদা করে সময় দেবার মতো সময় ওর ছিল না। ভালবেসেছে, ব্যস! ওর এখন মাথায় ঘুরছে যে করে হোক পাশ করে একটা চাকরী! আগে দাঁড়াই ঠিক করে, তারপর দেখা যাবে।
তখন বিকেল হয়ে গেছে, সূর্য্য ডোবার পালা। অফিস ফেরৎ ঐ জঙ্গলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বাড়িতে মায়ের সাথে কথা বলছিল। প্রথম মাইনেটা পাবার পর অনলাইনেই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা পেয়েছে কি না, সবাই কেমন আছে, ইত্যাদি। বাড়িতে যেতে গেলে অনেকটা খরচ, তার চেয়ে টাকাটা অনলাইনে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল। এইসব সাধারণ কথাবার্তা। অনেকদিন বন্ধুদের সাথেও কথা হয়না। ইচ্ছা হয় অনুর কথা জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু সেটাও বাধো বাধো ঠেকে। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক ছিল। জঙ্গল মতো জায়গাটার উল্টোদিকে, যেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাঁচিলটা শেষ হয়েছে, সেটা ছাড়িয়ে একটা বড় পুকুর মতন আছে। সাধারণতঃ ওটা থেকে পাশের জমিতে জল দেওয়া হয়। অনেকে স্নান ও সারে।
একটু ঝুজ্কি ঝুজ্কি অন্ধকার, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এর মধ্যে হঠাৎ কিছু আওয়াজ আর নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে হেমন্ত পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল মালতী গলা জলে। আরো কেউ ছিল কিনা আন্দাজ পেল না।
– কি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছো! ঘর যাওনা।
হেমন্ত অস্বস্তিটা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরমুখো হল।
– তুমি কি তালকানা নাকি! একটা মেয়ে গলা জলে ডুবে আছে, আর তুমি ওখান থেকে যাবার নাম করছো না।
মনটা খিঁচড়ে গেল।
রাতে মালতী পিছনের রাস্তা দিয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকে রুটি করল, চলে গেল। বুঝল তালকানা বলায় রাগ হয়েছে। ও সাধারনতঃ হেমন্তের শোবার ঘরে ঢুকত না।
– তুমি কি তালকানা নাকি, এতভাবে ইশারা-ইঙ্গিত দিচ্ছে, তুমি একটু অনুর হাতটা চাইতে পারছো না!
তরুও বলেছিল।
না, সে চাইতে পারেনি। তার সামনের কঠিন বাস্তব তাকে দমিয়ে দিচ্ছিল।
তারপর তো ওরা সবাই কলেজ পাশ করে বেরিয়ে গেল। হেমন্ত আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে যেন ঢুকে গেল। শুধু মাথায় চাকরীর পরীক্ষা, তার প্রস্তুতি।
চাকরীর খবরটা পাওয়ার পর ও যেন নিজেকে মুক্ত করতে পারল। সমস্ত ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব দূর করে যাবে এবার অনুর কাছে। বহুদিন কোনো খবর নেয়নি, কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানা নেই। নিজেকে একেবারে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। একটা কেমন প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল ভালবাসার উপর, যেন সেটা একবার হয়ে গেলে হয়ে গেল।
তরুর কাছে খবর পেল অনুর। অনুরা এপাড়ায় আর থাকে না। ওরা দুজনেই এখন এম,এ করছে। সেটুকুও হেমন্ত খবর রাখেনি। তরুর সঙ্গে কথা হল, ওরা কফি হাউসে মীট করবে। ওখানেই দেখা হবে। তরু আর কিছুই বলল না, একটু নির্লিপ্তই থাকল যেন।
কফি হাউসের নীচে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তনুর দেখা পেল। হেমন্তর চোখ আরো কাউকে খুঁজছিল। তরু সেটা বুঝেও বুঝল না। একসঙ্গে উপরে গেল। দূরে একটা টেবিলে অনু বসে আছে, পাশে কোনো বন্ধু। তার হাতে হাত রেখে নিবিষ্ট মনে গল্প করছে। হেমন্ত থমকে গেল, তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। তরু দু’একবার ডাকল, ওর কানে আর কিছু ঢুকল না। অনুকে ফেলে এল, ভালবাসাটা রয়ে গেল, হয়তো সারাজীবনের জন্যই।
অন্যমনস্ক হয়ে এসব ভাবছিল। মালতী যাবার আগে বলে গেল রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে, এতেই ওর হুঁশ ফিরল।
এরপর বছর খানেক কেটে গেছে। হেমন্ত ওখানেই একটি মেয়েকে পড়ায়। সেটি নিকটবর্তী শহরের একটা ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। সাধারণতঃ এই গ্ৰামের মেয়েরা কাছেই একটা বাংলা স্কুলে পড়ে, কিন্তু এ আবার আলাদা। বাপে কোথায় বা বড় চাকরী করে, বদলীর চাকরী, পরিবার গ্ৰামে থাকে। মেয়েকে ইংরেজী মিডিয়ামে ভর্তি করে দিয়েছে।
ক্লাস টেনের একটা সেমিস্টার খারাপ হওয়ায় বাপে এসে খুঁজছিল বাড়িতে পড়ানোর কাউকে। কেউ বোধহয় হেমন্তের খোঁজ দিয়েছিল। যদিও হেমন্ত ইংরেজী মিডিয়ামের নয়, তবু তাকেই ঠিক করা হল। বছর খানেক তাকেই পড়াচ্ছে।
মালতীর চেয়ে সুমনা দু’এক বছরের ছোটোই হবে, কিন্তু গ্ৰামে এই বয়সে বন্ধু হতে বাধা থাকে না। ফলে হেমন্তের ঘর- গেরস্থালি তার ছাত্রী বা তার মায়ের কাছে লুকোনো থাকে না। আর মালতী বলে, সাবধানে থাকতে।
– আমাকে তো বাঁচিয়ে চল, বেশ কর। কিন্তু ওখানে বাঁচতে পারো কিনা দেখি।
মালতী তো জানে না, ও ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে সেই কবে! মাঝেমধ্যে মনে হয় জিজ্ঞেস করে তরুকে, অনু বিয়ে করেছে কিনা, কাকে বিয়ে করেছে! কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।
– কি রে মালতী, তোর মামা যে দুদিন ধরে আসছে না, অফিসেও যাচ্ছে না!
– কে জানে কি হয়েছে! স্নান-খাওয়াও করছে না ঠিকমতো।
– চল তো দেখি কি ব্যাপার!
তিনজনে দল বেঁধে ছুটল হেমন্তের বাড়ি।
সামনের ঘর খোলাই ছিল। হেমন্ত বসে আছে উদভ্রান্তের মতো।
এর আগে এরা কেউ কোনোদিন এর ঘরে ঢোকেনি, মালতীও এই শোবার ঘরে ঢোকেনি।
ঘরটা অগোছালো হয়ে পড়ে আছে, হেমন্ত স্নান খাওয়াও বোধহয় করেনি মনে হচ্ছে।
খাটে মোবাইলটা স্ক্রীন খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে একটা বিয়ের কার্ড, সঙ্গে একটা ছোট্ট লেখা। তরু বলে কেউ পাঠিয়েছে।
– অনুর বিয়ে, পারলে এসো।
সুমনা আর মালতী ঘরটা একটু গুছিয়ে দিল। সুমনার মা হেমন্তের পাশে বসে আশ্বাস দেবার মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
সুমনা এসে হেমন্তর কনুই ধরে টেনে বলল,
– চল, আমার পরীক্ষা।
হেমন্ত আনমনে তাকাল সুমনার দিকে, তারপর উঠে দাঁড়ালো। দুজনে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোল, সুমনা যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা অসহায় মানুষকে।
মালতী আর সুমনার মা পিছন থেকে দেখল শুধু দুজনে চুপচাপ চলে যাচ্ছে। সুমনার মা শুধু বুঝতে পারল তার মেয়ে বড় হয়ে গেছে।
***********************
