উৎপল মান
দরজা
যখন আগুনে-সাপের মতো বিদ্যুৎ তরঙ্গগুলো আকাশের গায়ে চিড়িক চিড়িক করে লাফিয়ে উঠছিল, ঝোড়ো বাতাসে টালমাটাল হয়ে উঠছিল গাছপালা, মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচুতে, রাস্তা প্রায় খাঁ খাঁ- তখন সুকুমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল।
লোডশেডিং বলে বেল বাজেনি নিশ্চয়। দরজা অল্প ফাঁক করে মানু প্রায় আঁতকে উঠল- ‘কী ব্যাপার সুকুমারদা, তুমি!’
একরকম দরজা ঠেলে সুকুমার ঢুকে পড়ল ভিতরে। মানুর অনুমতির অপেক্ষা না করেই। সুকুমার কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জানাল, ‘জানি আমার আসাটা আনএক্সপেক্টেড। তবু না এসে পারলাম না।’
‘তাতে কী হয়েছে! এতদিন পর তুমি এলে। দীপক যদি ঘরে থাকত তাতেই বা কী!’
‘জানি আমার ফোন করে আসা উচিত ছিল। কিন্তু দীপক কখন ফিরবে?’
‘ও বাইরে গেছে অফিসের কাজে। আজ ফিরবে না।’
বাইরে আলোর ঝলকানি। জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ছে ঘরে। কেউ আটকাতে পারে ওদের! এই মুহূর্তে মানুকে ওর অন্ধকার আকাশ বলে মনে হল। আর সে নিজে আচমকা বিদ্যুৎ তরঙ্গ। মানু কি আকাশটার মতো ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে? দীপক আজ বাড়িতে ফিরবে না জেনে স্বস্তি বোধ করল সুকুমার। আরাম করে সোফায় বসল। এখানে পৌছাতে কী ঝক্কিটাই না গেল! সকাল থেকে সারা দিনটা কেটেছে যাচ্ছেতাইভাবে। এখন এই ঝোড়ো আবহাওয়ায় সন্ধ্যাটাকে রাত মনে হচ্ছে। রাতটা খুব তাড়াতাড়ি নেমে এসেছে।
ইতিমধ্যে মানু এমার্জেন্সি ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে কিচেনে ঢুকেছে। সুকুমার বাথরুমে গেছে।
দু’জনে যখন জলখাবার নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসল, তখন বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে চারদিক। মানুর ঘোর তখনও ভাঙ্গেনি। হয়তো ভিতরে একটা টেনশন কাজ করছে। সেটা অনুমান করেই সুকুমার জানতে চাইল, ‘ভয় পাচ্ছিস? স্বাভাবিক। কিন্তু আমার না এসে উপায় ছিল না।’
‘যদি দীপক বাড়িতে থাকত কিংবা রাতে ফিরত- এসবই বোধহয় ভাবছ তুমি?’
‘আগেও একবার এসেছি মানু। দূর সম্পর্কের দাদা না কী যেন একটা বলেছিলি না?’
‘তুমি সব ব্যাপারে এত ক্যাজুয়াল থাক কী করে আমি বুঝতে পারি না। আগের মতোই রয়ে গেলে। বদলালে না একটুও।’
সুকুমার চায়ে চুমুক দিল। সেঁকা পাউরুটিতে বাটার মাখানো। কামড় বসাল। বলল, ‘তুই তো জানিস আমি এমনই। জীবনে কিছুই শিখলাম না। পেলামও না।’
‘পাওয়ার কথা আর বোলো না সুকুমারদা। আমার রাগ হয়। তুমি কিছু দিতে শেখনি কোন দিন।’
‘আলোটা নেভাই?’ সুকমার প্রস্তাব দিল।
‘কেন? চারপাশটাতো অন্ধকার। এত অন্ধকার ভালো লাগে তোমার?’
‘তুই আসলে ভয় পাচ্ছিস মানু।’
জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। সঙ্গে এলোপাতাড়ি বাতাস। বৃষ্টিটা জোরে নামল। অনেকদিন পর আজ বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সারাটা দিন অবশ্য মেঘলা ছিল।চ রোদের তাঁত খুব একটা ছিল না। ঘরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বেশ আরামদায়ক শীতলতা ঘরময় গুরুগম্ভীর নাদে। সামনে কোথাও বাজ পড়ল।
সুকুমারের কথাযর কোন জবাব না দিয়ে যে ব্যাপারটা ওকে প্রথম থেকে ধন্দে ফেলেছে, তাই সে জানতে চাইল- ‘ঝড়ো কাকের মতো হঠাৎ চলে এলে। না এসে উপায় ছিল না বললে। কী সেই দরকার? এতদিন পর!’
‘আছে মানু। জানবি। তবে এখন নয়।’ সুকুমার জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বিদ্যুতের চকমকি আলোয় ওর মুখটা পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। কী অসাধারণ রুক্ষতা ওর সারা মুখে। পরনের পাঞ্জাবিটা ফত ফত করছে হাওয়ায়। বৃষ্টি কী অপরূপ মহিমায় ঝরে যাচ্ছে।
মানু সুইচটা অফ করে দিয়ে সুকুমারের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘এই অন্ধকার তুমি চাইছিলে?’
‘তোর সত্যিই ভয় করছে, না মানু?’
‘আজকের রাত্রিটা বড় ভালো। ভয় পেলে এই সুন্দর বোধটা হারিয়ে যাবে যে।’
‘সুন্দর! তুইতো বেশ! একজন আগন্তুক এই ঝড়বৃষ্টির রাতে বিবাহিত একটি যুবতীর ঘরে ঢুকে পড়ল যখন সে একা বাড়িতে- আর এটা তোর কাছে সুন্দর মনে হল!’
‘তুমি আমার বহু দিনের চেনা যে। আগন্তুক হলে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম।’ মানু হাসল। হাসির শব্দটা বৃষ্টি শোষণ করে বাতাসে মিশিয়ে দিল।
সুকুমার ভাবতে লাগল একটা ফেলে আসা পথের কথা। প্রায় শহর হয়ে ওঠে একটা গ্রাম। অল্প সংগ্রাম অল্প আগুন। প্রেম। তারপর লম্বা মাঠের মতো পড়ে থাকা একলা একটা জীবন। মানুর বাড়ির লোক তখন চায়নি সুকুমারের মতন একজন বোহেমিয়ানের সাথে মানুর ঘনিষ্ঠতা বাড়ুক। মানুও কি ওকে স্রেফ একটা বোহেমিয়ান ভাবত? সুকুমার তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে পথ। একটা রাস্তা। গতানুগতিকভাবে বেঁচে থাকতে চায়নি। একটা চাকরি একটা বউ একটা কি দুটো বাচ্চা। একটা হ্যাপি ফ্যামিলি। ব্যাস, জীবন শেষ! ঘেন্না করেছে সে। জাস্ট ঘেন্না করেছে।
পৃথিবীটা বেড়ে উঠছে। রং মাখছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবন। তাল মিলিয়ে চলতে পারলে হাঁটো, না হয় ফোটো। কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে গ্রাম। মানুষজন। চারদিকে শুধু হয়ে ওঠার উৎসব।। পেয়ে ওঠার। নিয়ে যাও নিয়ে যাও। যেভাবে পার নিয়ে যাও। কারও কথা কেউ ভাববে না। ভাবার দরকার নেই। লাইফ ইজ গ্লোরিয়াস। জাস্ট এনজয় ইট। এটাই সাম্প্রতিক যাপনের ভাষা।
এমএ ভর্তি হয়ে জানতে চেয়েছিল মানু, ‘কী করবে এবার বলো? তুমি কি এখনও নির্লিপ্ত থাকবে? মানু যখন ফোন করে এসব জানতে চেয়েছিল, তখন সুকুমার এক আদিবাসী বন্ধুর বাড়িতে। তালডাংরা লাগোয়া জংলি গ্রাম। আমতলা। ইউক্যালিপটাসের বন কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদার তিনখানা লরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনের মাঝে। ওগুলো যাবে রোড চন্দ্রকোনা। সারাদিন গাছকাটার ঠকাঠক শব্দ। একটানা শব্দের ক্লান্তি। সভ্য জগত থেকে অনেক দূরে এসে খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে সুকুমার ভাবছিল এক আদিম কালের কথা। কাঠ কাটার ঠকাঠক শব্দ। ধামসা মাদলের দ্রিম দ্রিম। আগুনে ঝলসানো শিকার। আর আগুনের চারধারে বসে বুভুক্ষু আদিম মানব। সাব-অলটার্নদের অবস্থা এখন সত্যিই কতটা পালটেছে?
মানুর ফোনটা এসেছিল। তখন বন্ধুর বউ রমণী মুর্মু আচারের তেল দিয়ে মুড়ি মাখছিল ওকে দেবে বলে। দুটো ন্যাংটা বাচ্চা খেলছিল উঠোনে। চিল রঙের একখানা মেঘ সারা চরাচরে ব্যপ্ত হয়েছিল। গাছ কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছিল অবিরাম।
‘কী হয়েছে তোমার বলো তো?’ মানু বাহু ধরে টান দিল। সংবিৎ ফিরল সুকুমারের।
অন্ধকার। মানুর দিকে তবু চোখ ফেরাল না। জানলা দিয়ে হাত বাড়াল। বৃষ্টির শীতল স্পর্শ মনকে শান্ত করে। উত্তেজনা প্রশমিত করে। বাইরে অন্ধকারে যতটা চোখ যায়, একবার দৃষ্টি রাখে। বেশি দূর এগোয় না। দৃষ্টি সামনেই আটকে যায়। সীমাবদ্ধতা টের পাই সুকুমার। এই সীমাবদ্ধতাকে সে চড় মেরে শায়েস্তা করতে চেয়েছে। তাই বারবার বেরিয়ে পড়েছে পথের সন্ধানে। শুধু ঘুরে বেড়িয়েছে। একটা মানুষের জীবনে এত অস্থিরতা! কতবার ভেবেছে সে, কীভাবে লোকেরা বুকের উপর হাওয়া খেলিয়ে দিনের পর দিন একই রকম জীবনযাপন করে যাচ্ছে। মানু বলত, তুমি কি জিপসিদের মতো ভ্রাম্যমান সুকুমারদা? যাযাবর?
সুকুমার তখন পাবলো নেরুদার একটি কবিতার কিছু পংক্তি শোনাত- “ইউ স্টার্ট ডাইং স্লোলি/ ইফ ইউ ডু নট ট্রাভেল/ ইফ ইউ ডু নট রিড/ ইফ ইউ ডু নট লিসন টু দ্য সাউন্ডস অফ লাইফ/ ইফ ইউ ডু নট অ্যাপ্রিশিয়েট ইউরসেলফ।”
সুকুমার সোফায় এসে বসল। বলল, ‘আমার তো কখনও কিছু হয়নি মানু। আজও না। আর হলেও গ্রাহ্য করিনি।’
একটা অস্বাভাবিক নীরবতা। রহস্যময় একটি অন্ধকার। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কেবল। ঝমঝম ঝমঝম।
সুকুমার বলল, ‘তোকে খুব বিপদে ফেললাম, বল?’
মানু সে কথার উত্তর না দিয়ে জানাল, ‘তোমাকে কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে সুকুমারদা। তুমি কি গ্রামের বাড়ি থেকে আসছ, না-কি কোথাও গিয়েছিলে আর পথের মাঝে আমার কাছে…’
মানু কথাটা শেষ করতে পারল না। টি-টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা ফোনটা বাজছে। ঘরটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল। দু’জনের ভিতরে যে স্রোতমান অতীত আপনা-আপনি গল্প বলে যাচ্ছিল একে-অপরের সঙ্গে, তাতে ছেদ পড়ল। মানু কলটা রিসিভ করল না।
‘কার কল?’ সুকুমার জানতে চাইল।
‘দীপকের।’ মানুর গলাটা নির্বিকার শোনাল।
‘ধরলি না!’
‘পরে রিং-ব্যাক করে নেব।’
সুকুমার আবার বলল, ‘তোকে সত্যিই খুব বিপদে ফেললাম।’
মানু বলল, ‘বিপদ এখনও হয়নি। তবে সম্ভাবনা আছে। আমি অবশ্য ভয় করি না। তুমিই বরং ভীতু।’
‘কীভাবে?’
মানু হঠাৎ আলোটা জ্বালিয়ে দিল। সুকুমারের চোখে চোখ রাখল। তারপর বলল, ‘তোমার কাছে শোনা একটা কবিতার কিছু লাইন আমার এখনও মনে আছে সুকুমারদা।’
সুকুমার ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকল মানুর দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আর সেই মুহূর্তেই মানু বলতে শুরু করল- “ইউ স্টার্ট ডাইং স্লোলি/ ইফ ইউ অ্যাভয়েড টু ফিল প্যাশন/ অ্যান্ড দেয়ার টারবিউলেন্ট ইমোশনস/ দোস হুইচ মেক ইয়োর আইজ গ্লিসেন/ অ্যান্ড ইয়োর হার্ট বিট ফাস্ট।”
সুকুমার মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল, ‘তোর এখনও মনে আছে মানু!’
‘মনে আছে শুধু! বলো, গাঁথা আছে। বুকে। তুমি কিন্তু এক্ষেত্রে হেরে গেছ। পালিয়ে বেড়িয়েছ শুধু। জীবনটাকে তুমি কীভাবে নিলে সুকুমারদা!”
সুকুমার কোনও প্রত্যুত্তর করল না। জানলার দিকে চোখ রাখল। বলল, ‘আলোটা নিভিয়ে দে।’
‘তুমি মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছ, না সুকুমারদা?’
‘তাহলে কি তোর কাছে আসতাম?’
মানু হঠাৎ সদর দরজা খুলে দিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। ওর চুল পাগলা বাতাসে উঠতে লাগল। শীতল বাতাস ঘরময় আছড়ে পড়তে লাগল। বৃষ্টির শব্দ আরও স্পষ্ট ধ্বনিময় হয়ে বেজে যেতে লাগল। সুকুমার যেন পথ হাতড়ে পথ হাতড়ে মানুর কাছে এসে দাঁড়াল। আর তখনই মানু প্রশ্ন করল, ‘বাণীদির খবর কী সুকুমারদা?’
বাণী নাটক করত। নাটকটা ভালবাসত ও। ওদের নাট্যদলের নাম ছিল ঘূর্ণি। নানা শহরে নাটক করতে যেত। বাণীর ডেডিকেশন ছিল। নিজেকে নিংড়ে দিত। ছোট দল। ছোট বাজেট। কিন্তু অভিনয়টাকে ছোট ভাবত না। কীভাবে যেন নাটক ওকে পেয়ে বসেছিল। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর বাবা-মা দু’জনেই মারা যান। বাণী তখন থেকে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। নাটক ছেড়ে সুকুমারের সঙ্গে নানা কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। শালবনি, বান্দোয়ান, রাইপুর নানা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত ওরা। জঙ্গল লাগোয়া সাঁওতাল পরিবারের সাথে রাত কাটাত। মানুষ কত কষ্টে থাকে, থাকতে পারে- একজন নাট্যকর্মী হয়েও বুঝে ওঠেনি এতদিন। কতবার মনে হয়েছিল ওর, এদের দুর্দশা ও বঞ্চনাকে প্রতিবাদের আকারে নাটকে উপস্থাপিত করবে। কতবার সেসব নিয়ে কথা হয়েছে সুকুমারের সঙ্গে।
তারপর সুকুমারকে পুলিশে ধরল। জেল হল। বছর পাঁচেক পর ফিরে এসে দেখল বাণী উন্মাদ হয়ে গেছে। মাঝের এই কয়েক বছর বাণী নাটকের দলে ফেরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বানীর উপর সন্দেহ তখন সকলের। পুলিশ ওকে জেরা করেছে কয়েকবার। দলের নির্দেশক শান্তিদাও ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল ওকে নিলে দলের ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং আরও কিছুদিন যাক অবস্থার পরিবর্তন হলে দেখা যাবে।
বাড়ি ফিরে বাণী হা-হুতাশ কেঁদেছিল। এই পৃথিবীতে সুকুমারদাই ওর একমাত্র আপন মানুষ ছিল। সে-ও জেলে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। আর ছিল তার দল ঘূর্ণি। দলের উত্থানে তারও ভূমিকা কম ছিল না। সেখানেই ফিরতে চেয়েছিল বাণী। ভেবেছিল শান্তিদা ওকে আশ্রয় দেবে।
গানটা জানত বাণী। সুকন্ঠী ছিল। ওটাকে পুঁজি করে বাঁচতে চেয়েছিল শেষমেশ। ছোটদের গানের স্কুল খুলেছিল নিজের বাড়িতেই। শহর হয়ে ওঠা একটা গ্রামে কত দ্রুত সব বদলে যেতে লাগল। গ্রাম থেকে তিন কিমির মধ্যে ওপেন কাস্ট কোলিয়ারি। বড় চওড়া রাস্তা। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল, ওয়েডিং হল, পোস্টঅফিস ইত্যাদি আগে থেকেই ছিল। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল।
বাচ্চাদের গান শেখানোর পাশাপাশি নতুন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর কাজও জুটেছিল। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আবার অন্যরকম একটা জীবনে। কাজের জীবনে। আর এ সবের মাঝে নীরবে সে অপেক্ষা করত সুকুমারের জন্য। একদিন আসবে। একদিন ফিরে আসবে। অপেক্ষার মধ্যে যেমন একটা অনিশ্চয়তা থাকে, তেমনি মধুরতাও থাকে। গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে একটা স্বপ্ন। সুযোগ পেলেই সেই স্বপ্নময়তা ওকে নিয়ে খেলা করত। খেলাটাকে প্রশ্রয় দিত বাণী।
কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যেই মারণরোগ ধরা পড়ল। চিকিৎসা চলতে থাকলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল বাণী। সুকুমার জেল থেকে বেরিয়ে বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি ও নানা ঘাটের জল খেয়ে যখন গ্রামে ফিরল, দেখল বাণী প্রায় উন্মাদ।
মানু সুকুমারের হাত ধরে একটা মোক্ষম ঝাঁকুনি দিল। বলল, ‘কথার উত্তর দিচ্ছ না যে বড়! বাণীদি গ্রামে আছে তো?’
সুকুমার হুঁ বা না কিছুই বলল না। কিন্তু মাথা নেড়ে কী বোঝাল তা-ও বোধ হয় মানু বুঝতে পারল না।
বিদ্যুৎ চমকাল। মানু সুকুমারের হাত আচমকা ধরল। সুকুমারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকল। ঘরের নির্মিত অন্ধকারে দু’জনেই রপ্ত হয়ে গেছে এখন। যেন আলোর প্রয়োজন ছিল না। এখনও নেই। অন্ধকারে যদি একে-অপরকে ঠিকঠাক কমিউনিকেট করতে পারে, তবেই না গভীরতা। কিন্তু মানুর তবুও মনে হল, সুকুমারদা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। ছোঁয়া গেলেও ধরা যায় না। নিজেকে একটা অস্পষ্ট দূরত্বে রাখতে পছন্দ করে বরাবর। যখন সুকুমারদার জন্য ছটফটানি ছিল, ওকে একা পাওয়ার আকুলতা ছিল, ওর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার দিন হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদেছিল- তখনও এক রহস্যময় নিষ্ক্রিয়তা সে লক্ষ করেছিল সুকুমারদার হাবভাবে। কেন? কেন? কেন?
না আজ অবশ্য তেমন কোনও প্যাশন নেই। থাকা উচিতও নয়। দীপক সান্যাল নামক এক নামী ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী সে। সম্পূর্ণ এক গৃহবধূ। তাছাড়া একদিন বাড়ি থেকে আল্টিমেটাম পাওয়ার পর বুকফাটা যন্ত্রণায় যখন সে সুকুমারদার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল তখনও সুকুমারদা সিরিয়াস হয়নি। কী পরিমাণ রাগ আর অভিমান যে জমা হয়েছিল, তা কেবল ও-ই জানে। সুকুমারদার কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘তোমার কি লক্ষ্যটা বলবে আমায়?’
‘কত দিন এমন বৃষ্টি হয়নি বল!’ সুকুমার সোফায় এসে বসল আবার।
‘কত দিন আগে তুমি যেবার প্রথম এসেছিলে, ছিলে তো মাত্র আধঘন্টা, সেবারও কিন্তু বৃষ্টি হয়েছিল।’ বলতে বলতে মানু ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রান্নাঘরে গেল। ওখান থেকেই একটু উচ্চগ্রামে বলল, ‘মাঝে মাঝে এসো। তুমি এলেই বৃষ্টি হবে।’
মানুর ফোনটা আবার বাজছে। প্রায় একমিনিট টানা বেজে ওটা চুপ করে গেল। মানু ফোন ধরছে না কেন? মানুকে সে-কথা জিগ্যেস করার আগেই ডাইনিংয়ের জানলা দুটো বন্ধ করে আবার ও রান্নাঘরে ফিরে গেল। ঝড়ো বাতাস বইছে বাইরে। বৃষ্টির ছাট ঘরে ঢুকে মেঝের কিছুটা ভিজিয়ে দিয়েছে।
মানু ফিরে এল দশ মিনিটের মধ্যেই। সুকুমারকে বলল, ‘তুমি একটু গড়িয়ে নিতে পার সুকুমারদা। তুমি কি কলকাতা থেকে আসছ? তবে তো অনেক ধকল গেছে।’
সুকুমার বলল, ‘না। তোদের শহরে এসেছিলাম। তবে ঠিক শহরের মধ্যে না, দামোদরের তীরে।’
‘দামোদরের তীর! কেন? এখনও কি ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াও নাকি?’
‘আরে না না। একটা কাজে।’ সুকুমার জানাল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘শোন মানু, রাত্তিরে আমার দুটো রুটি আর ডাল হলেই চলবে। হাবিজাবি কিছু করতে যাবি না।’
‘তোমার কথা শুনছে কে।’ মানু আবদার করে বলল, ‘আমার ঘরে এসেছ, আমি যা খাওয়াবে তাই খাবে। ব্যাস।’
‘বেশি কিছু খাওয়ার মতো শরীর আর মন দুটোই আজ নেই রে। পরে আবার যখন একদিন আসব, কবজি ডুবিয়ে খাব বুঝলি।’ সুকুমার কথাগুলো ভাবলেশহীন বলে গেল।
মানু এবার সুকুমারের পাশে সোফায় এসে বসল। কপালে হাত রেখে দেখল জ্বর এসেছে কিনা। সুকুমারের একটা হাত নিয়ে নিজের মুখমণ্ডলে মেলে মেলে ধরল। মৃদু উষ্ণতা সুকুমারের শরীরে চারিয়ে দিতে চাইল। গভীর নিঃশ্বাস নিতে নিতে জানতে চাইল, ‘আমাকে বলবে না কী হয়েছে তোমার?
সুকুমার মানুর স্পর্শটুকু ফিরিয়ে দিতে পারে না। আবার সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতেও পারে না। শুধু অস্ফুটে বলল, ‘আমার কিছুই হয়নি। আর তুই তো এতটা দুর্বল ছিলি না। তবে কেন…’
ঝটিতে সরে এল এল মানু সোফার অন্য প্রান্তে। উঠে দাঁড়াল। একটা অপমানবোধ ওর কানের দুপাশে গরম হওয়ার মতো ঘুরপাক খেতে খেতে ওর কান দুটোকে যেন উত্তপ্ত করে তুলছে। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় একটা জানলা খুলে দিয়ে জানলার গায়ে যেন নিজেকে লেপটে রাখল লতার মতো। উথালপাথাল হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট ওর চোখমুখকানগলা ভেজাতে লাগল।সংবিৎ ফিরল একটা শব্দে। দেখল সুকুমারদা সোফায় নেই। মেজানাইন ফ্লোরে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে।
মানু আলোটা সামনে এনে ধরল। ‘ওপর কেন যাচ্ছিলে? ভীতুরাম। নাকি স্টার্ন মরালিস্ট?’ বলতে বলতে পাতলা হাসল।
পরিবেশটা হালকা হতেই সুকুমার জানাল, ‘ধুর, আমি সিগারেট ধরাব বলে যাচ্ছিলাম।’
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাতও বেড়েছে। মানুর কত কী জানার ছিল সুকুমারদার করেছে। খাওয়া-দাওয়ার পর এখন ও ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। হঠাৎ এখানে আসার কারণটা তো সুকুমারদা জানাল না! নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মানু নিজেও। কিন্তু আচমকা ঘুম ভেঙে গেল ওর। মনের ভেতর প্রবল একটা ইচ্ছে জেগে উঠল। ওর এই নিঃসন্তান জীবনে এখনও তো কিছু পাওয়ার থাকতে পারে সুকুমারদার কাছে। কিন্তু ও শরীরে বল পাচ্ছে না কেন? বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পা টলমল করে উঠল। তবুও বুকের মধ্যে একটা সাহস অর্জন করে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে সুকুমারের ঘরের দিকে। দরজা ঠেসানো। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। বিছানার পাশে বসে সুকুমারকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াল মানু। কিন্তু সুকুমারদা কোথায়? ‘সুকুমারদা’ বলে ডেকে ফেলল চকিতে। আলোটা তড়িঘড়ি খুঁজে নিয়ে জ্বালাল। বাথরুমে দেখল। নেই। কোথায় গেল সুকুমারদা! এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। শেষে শোয়ার ঘরের টেবিলে নজর পড়ল। একটা কাগজ অ্যাশট্রে দিয়ে চেপে রাখা। এমারজেন্সির প্রায় নিভে আসা আলোয় চকিতে পড়ে ফেলল।
প্রিয় মানু,
জানতে চাইছিলি, তাই বলছি। বাণী আর নেই। আজই ওকে দাহ করে ফিরছিলাম। মনে হল, তোর সাথে দেখা করে যাই। অবশ্য বাণীর মৃত্যুর খবর শোনানোর জন্য নয়। নিজের জন্য। স্রেফ নিজের জন্য। তোকে একবার দেখার জন্য। হয়তো বেঁচে থাকব। কিন্তু চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি চলে যেতে পারে। তুই তো জানিস, আমার বাঁ চোখটা দুর্বল। কম দেখি। এখন আমার ডান চোখের রেটিনাটাও গেছে। ডাক্তারের মতে এটাও নিস্ক্রিয় হতে খুব বেশিদিন লাগবে না। হয়তো তোকে এসব না জানালেই হত। কিন্তু কাকেই বা বলি। আর এভাবে লুকিয়ে পালিয়ে এলাম কেন? এখনও কি বুঝলি না? অনেক দুঃখ দিলাম । মাপ করে দিস।
চিঠিটা পড়ার পর বুকে দমক দিয়ে কান্না পেতে লাগল মানুর। কিন্তু ব্যাপারটা সামলে উঠতে না উঠতেই হঠাৎ দরজার বেল বাজল। কারেন্ট কখন এল ও বুঝতেই পারেনি! মানু ছুটে গিয়ে দরজা খুলতে গেল। সুকুমারদা ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই।
দরজা তো ঠেসানো ছিল। খুলে দেখল দীপক দাঁড়িয়ে। দরজা এমনই হয়, মানু ভাবল, কাউকে ঢোকায় কাউকে বের হতে দেয়।
**************************