মনির জামান-এর জোড়া গল্প
লাল কাঁকড়ার দল
সরলতার কাছে ষড়যন্ত্র টেকে না—এই কথাটা তখন বুঝলাম, যখন আমারে আর ক্যাপ-বাবুরে সেঁজুতির সামনে থেকে পুলিশে ধইরা নিয়া গেলো!
আমরা বসে ছিলাম শিশু একাডেমির সামনের ফুটপাতের হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে। দোকানটা বাবু দিছিলো, কারণ সে নারিকেলের ছোবা দিয়ে বক বানাতে পারতো। আমি ছিলাম ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা; সেঁজুতির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে দোকানটায় আসতাম।
সেঁজুতি ক্যাপ-বাবুর বন্ধু। আরে না, পার্কে সবাই সবার বন্ধু, আবার কেউ কারো না।
সেঁজুতি আসতো গুপিবাগ থেকে, যেতো জাহাঙ্গির নগর ভার্সিটিতে। আসা যাওয়ার পথের মাঝে পার্ক; যেমন বহতা জীবনের মধ্যে প্রেম—সেঁজুতি পার্কের প্রেমে পড়ে যায়। যায় কারণ, সে প্রেম করতে চাইতো ন্যাটা-বাবুর সঙ্গে; কিন্তু ন্যাটা-বাবু ভালোবাসতো মেয়ে-বাবুকে! ফলে সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতে এসে পার্কে লুটিয়ে পড়তো; আর আমাকে দেখতে পেয়ে বলতো—এই খোকন দা, একটা স্টিক খাওয়াতে পারবা?
আমি বলতাম—আমার কাছে তো নাই; চল, ক্যাপ-বাবুর দোকানে যাই। বাবুর কাছে স্টক থাকে।
আমরা টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া থেকে ৭ টাকার ডিম-পোলাউ কিনে নিয়ে বাবুর দোকানে চলে যেতাম। সেঁজুতিকে দেখে বলে উঠতো—এই, আইছে; ব্যবসা লাঠে উঠবো।
সেঁজুতি বলতো—হইছে; ধরো, লাঞ্চ করো; তারপর চলো, বাগানে গিয়ে তামুক খেয়ে আসি।
সেঁজুতি পরির মতো মেয়ে। এমন মধুমেখে কথা বললে কার না মন গলে যায়! বাবু বলে—তুই না ন্যাটা-বাবুকে ভালোপাস? আমার কাছে কি!
সেঁজুতি বলে—আমার এখন ন্যাটাকে দরকার নাই; ক্যাপ-বাবু হলেই চলবে।
কয়েকটা মাটির হাতি-ঘোড়া বেচে ক্যাপটাকে উল্টো করে বাবু বলে—চল যাই। পিচ্চিকে বলে—দোকান থেইকা এক চুলও লড়বি না; টের পাইলে ঠ্যাং লুলা কইরা দিমু…।
আমরা পার্কে এসে অর্জুণ গাছের তলে বসি। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেলে পয়সাওয়ালা বন্ধুগুলো জুটে যায়। সবাই আলাদা আলাদা ভাবে সেঁজুতিকে পছন্দ করে। কারণ, মেয়েটা পরির মতো। কেউ এসে আমাদের সঙ্গে বসে। যারা কল্কি পছন্দ করে, তাদের ভিতর থেকে উৎসাহী একজন ডাক দেয়—এই সেঁজুতি, এখানে আসো; টান দিয়ে যাও।
সেঁজুতি কখনো যায়, কখনো যায় না। গাঁজা টেনে মেয়েটা ন্যাটা-বাবুর দুঃখে কাতর হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে বলে—বাসায় যাই খোকন দা। ও আমাকে ভালোবাসে না…।
ক্যাপ-বাবু যখন বলে—তুই তো টালটক্কর; রিক্সা পর্যন্ত যেতে পারবি? তখন পুলিশ বন্ধুটা আগ বাড়িয়ে বলে ওঠে—চলো সেঁজুতি, আমার মটর সাইকেলে করে দিয়ে আসি।
ব্যাপারখানা ভিতরে ভিতরে অনেকটা বোম্বাই সিনেমার ‘ এক ফুল, হাজার মালি’র মতো। সেঁজুতি কখনো বলে—ভালো আমাকে যে কেউ বাসতে পারে; কিন্তু ন্যাটা-বাবু যে একদম পাত্তাই দেয় না, এইটা শিওর!
কে এই ন্যাটা-বাবু, অনেকেই জানে না। মেয়েটার এই দুঃখকে বন্ধুরা ন্যাকামীই মনে করে। তবুও পরির মতো মেয়ে বলে কথা—মনে মনে ভালোবেসে প্রশ্রয় দিতে কার্পন্য করে না কেউ।
কেউ কেউ আমাকে বলে বসে—তোমার সঙ্গে ওর এতো পিরিত কিসের?
আমি উত্তর দিই না। বুঝতে পারি, এসব পুরুষালি হিংসুটেপনা। কিন্তু তখনো বুঝিনি, এই হিংসামী চক্রান্ত হয়ে আমাদেরকে বিপদে ফেলে দিতে পারে।
সেঁজুতি প্রতিদিনের মতো আমাকে খুঁজে নিয়ে বাবুর দোকানে আসে। গিয়ে দেখি, ফুটপাতের দোকানগুলোর সামনে জটলা। বাবু বলে—দেখ তো, পুলিশ এসে আমাদেরকে তুলে দিচ্ছে। গরিব লোকগুলো কোথায় যাবে বল! চল, সবাইকে জড় করে প্রতিবাদ করি।
পুলিশ দোকানের উপর লাঠিচার্জ করলে সবাই হৈচৈ করে ওঠে—এই যে, আপনারা জিনিসপত্র ভাংতেছেন কেন! একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বাবুর ক্যাপটা মাথা থেকে খুলে নিলে ওর টাক বেরিয়ে পড়ে; আর বাবু ক্ষেপে গিয়ে পুলিশটাকে ঘুষি মেরে দেয়। শুরু হয় মারপিট। লোকগুলো স্লোগান ধরে—গরিবের পেটে লাথি মারা চলবে না, বন্ধ করো…।
তখন পার্কে আড্ডামারা পুলিশ বন্ধুটা মটর সাইকেল নিয়ে এসে বলে—ওদেরকে থানায় নিয়ে চলেন।
পুলিশ শুধু আমাকে আর বাবুকে গাড়িতে তুলে নেয়। সেঁজুতি দিশেহারা হয়ে মটর সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ বন্ধুটা ভোঁ করে পালিয়ে যায়।
আমি বুঝতে পারি, পুরোটাই সাজানো নাটক। বাবু বলে—ঘাবড়াইস না। দেখি না কি করে।
ক্যাপ ছাড়া বাবুক দেখে আমার হাসি পেলে বলি—মাফলারটা মাথায় বাইন্ধা ল।
থানার দারোগা মাফলারটাও খুলে নেয়। তারপর বলে—ক্যাপ বাবু! খুব মস্তানি!
আমি বলি—ভাই, এসপি বাবুকে একটু খবর দেন।
দারোগা সাহেব ক্ষেপে যায়—ভাই কি! স্যার বল; শালা শিক্ষিত নেশাখোর!
একরাত থানার লকাপে আটক থেকে পরদিন সন্ধ্যায় কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসি। পুরো কাজটার জন্য সেঁজুতি ছুটোছুটি করে। যে উকিল জামিন নেয়, সে-ও পার্কে আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারে। পার্কে এসে দেখি, সেঁজুতির সঙ্গে পুলিশ, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাকটর বন্ধুগুলো খুব খাতির দিচ্ছে, আর বলতেছে, আমাদের দুজনের খুব সাহস বেড়ে গেছে। সায়েস্তা হওয়া দরকার ছিলো…।
সেঁজুতি বাবুকে কোর্ট-কাচারি থেকে নতুন একটা ক্যাপ কিনে দেয়। ক্যাপটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বলে—চলতো সেঁজুতি, এইসব ফাউলদের সঙ্গে থাকা যাবে না।
সকালবেলা আমি, বাবু আর সেঁজুতি বাসে চড়ে মাওয়া ফেরিঘাটে গিয়ে পদ্মার বালুচরে খুব ছুটোছুটি করি। সেঁজুতি আমাদেরকে ইলিশ দিয়ে গরম ভাত খাওয়ায়। সুনশান বালুচরে দাঁড়িয়ে সেঁজুতি বলে—খুব প্রস্রাব চাপছে; তলপেট ফাইটা যাইতেছে।
বাবু বলে—আমরা উল্টা হয়া খাড়ায়া আছি। তুই এইখানেই ছাইড়া দে।
সেঁজুতি ছ্যড় ছ্যড় শব্দ তুলে অনেক্ষণ ধরে মোতে। মুতের শব্দে আমাদের নুনু তিড়িং করে দাঁড়িয়ে যায়।গলা শুকিয়ে আসে।পদ্মার চরে তখন মৃদু বাতাস বহে। নিরবতা ভেঙ্গে সেঁজুতি বলে—ঐদিকে ঘুইরা আছস ক্যান! এদিকে আয়; দেখ, দেখ…।
আমি আর বাবু কাছে এসে দেখি, সেঁজুতি যেখানে প্রস্রাব করেছে, বালু ভেদ করে শত শত লাল কাঁকড়া সেদিকে এগিয়ে আসতেছে!
সেঁজুতি হাসতে হাসতে বলে—চল, চল; এখানে আর থাকা যাবে না; ষড়যন্ত্র শুরু হয়া গেছে! ফেরিঘাটে গিয়া বাসে উঠি।
বাস না পেয়ে আমরা একটা ট্রাকে চড়ে ঢাকায় ফিরি। তখনো কাঁকড়াগুলো প্রস্রাবে ভেজা বালুটুকু ঘিরে সুং নাড়ে, আর পার্কে চক্রান্তকারী বন্ধুরা কল্কিতে টান দিয়ে হেসে উঠে বলে—সেঁজুর লগে পিরিত! দিছি ঐ দুইটারে ফাঁসাইয়া; এখন কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে থাকুক…।
পিরিতি কারে কয়
পুটি আর চান্দু; আর একটা কালো কুকুর, যার পিঠের খানিকটা সাদা—একরাতে আমি আবিষ্কার করি; যখন শহরের কোলাহল থেমে যাচ্ছিলো; জেগে উঠতেছিলো আরেক শহর; যা মধ্যবিত্তের একদম অচেনা।
আমি তখন বদ্ধ বহেমিয়ান। মনে হতো পৃথিবীর পুরোটাই আমার বাসস্থান। শ্রেনী-চৈতন্য ভুলে গিয়ে শুয়ে থাকতাম পথের পাশে। চেনা-জানারা বলতো—আহা, শিক্ষিত পোলাডা ক্যামনে এমন পাগল হয়া গেলো…!
পাগল ব্যাপারটা আপেক্ষিক। পরিচিতরা এড়িয়ে যাচ্ছিলো; আর অচেনারা হয়ে উঠেছিলো আপন। অনেকটা গরিব আত্মিয়দের মধ্যবিত্তরা যেমন এড়িয়ে চলে, আমিও তেমনি চেনা শহরে অচেনা মানুষ হয়ে থাকি।
একরাতে বৃষ্টি হবে হবে সময়ে, আমি নির্জন যাত্রি-ছাউনিতে বসে থাকতে থাকতে কাঁৎ হয়ে শুয়ে পড়ি। আর কালো কুকুরটা লাফ মেরে আমার পায়ের কাছে উঠে এসে পাছার উপর বসে সামনের পাদুটোয় ভর করে এদিক ওদিক তাকায়। আমি কিছু মনে করি না; ও-ও যেনো আমাকে অনেকদিন ধরে চেনে।
তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়। এমন তুমুল বৃষ্টি—ধাবমান গাড়ির আলোটিকুই শুধু চোখে পড়ে। আমি উঠে বসি; আর, কুকুরটা লাফ মেরে রাস্তায় নামে গিয়ে আবার যখন ফিরে আসে, তখন ওর সঙ্গে যে দুটি ছেলে-মেয়ে আসে, ওরাই চান্দু আর পুট।
বেশ ভিজে গেছিলো। বেঞ্চে বসে মেয়েটা ফস করে বিড়ি ধরায়।
আমি সিগারেট বের করে বলি—আগুনটা দে।
বিড়ির আগুনে সিগারেট ধরিয়ে আমি বৃষ্টির তান্ডব দেখি। ওরা খুব কাছাকাছি মুখোমুখি বসে চোখে চোখে তাকাতাকি করে মিটমিট করে হাসে। ছেলেটা বলে—কি?
মেয়েটাও বলে—কি!
ওরা ‘কি’, ‘কি’ কাটাকাটি করে; আর কুকুরটা ওদের পায়ের কাছে বসে কান নাড়ায়। মেয়েটা কুকুরটার পিঠের উপর পা তুলে দিয়ে আদর করে। কুকুরটা বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেনো চলে যায়।
ওদের ‘কি’ ‘কি’ খেলা আর কুকুরটার দুরন্তপনা নিমিশে আমার বিষাদ কাটিয়ে দিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় তোলে—কি? কি? প্রশ্নই যেনো উত্তর।
বৃষ্টি থেমে গিয়ে ভোররাতের আকাশে চাঁদ দেখা দেয়। আমি ঝিরিঝি বৃষ্টির নিচে রাস্তায় নেমে এসে গান ধরি—বৃষ্টি ভেজা রাত/ সোডিয়াম আলো। একটা কালো কুকুর/ আর একখানা বেঞ্চ, নড়বড়ে/ এমন রাতে বলো কে থাকে ঘরে…।
জাহিদের গান; টিএসসির বারান্দায় বসে গলা ফাটিয়ে গাইতাম। খান আতার ছেলে আগুন অনুমতি না নিয়ে টিভিতে গেয়েছিলো বলে খুব আন্দোলন করেছিলাম। আর এখন, গানটা আপন আনন্দে মাঝ-রাস্তায় নেচে নেচে গাই। দুইজন টহল পুলিশ যেতে যেতে বলে—শহরটা পাগলে ভইরা গেছে।
এরপর দিনমান যতই বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা নিয়ে ঘুরি, রাত বেড়ে যখন পোয়াতি হয়, মাথাটা দুই হাঁটুতে নেমে আসে, তখন অবচেতনে দেখি—পুটির পিছে প্রবল ঊচ্ছলতায় চান্দু ছুটতেছে! আর রাতের বাতাসে পুষ্পরেনু ছড়িয়ে দিয়ে পুটি খিলখিল করে হাসতেছে।
ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কালো কুকুরটা আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। তখন পুটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—দেখেন তো ভাই, চান্দুটা আমারে রাইতভর ক্যামন বিরক্ত করে! পুটি আমার পিছে লুকায়। চান্দু ডানে-বায়ে ঊঁকি দিয়ে বলে—কি? কি!
মেয়েটা একটু দম নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে। কুকুরটা ওর আগে আগে ছোটে; চান্দু ওদের পিছে পিছে। বাতাসে আনন্দের রেনু ছড়িয়ে ওরা কোথায় যে চলে যায়, আর দেখিনা। মনে মনে হাসতে হাসতে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
এ জীবন হিসাব-নিকাশের না; এ যেনো শিমুল তুলোর উড়াউরি।
একরাতে পার্কে আড্ডা দিচ্ছিলাম; কালো কুকুরটা এসে লেজ নাড়ে। আমি হাত নাচিয়ে বলি—কি?
কুকুরটা ছুটে দূরে চলে যায়। তাকিয়ে দেখি, পুটি আমাকে ইশারায় ডাকতেছে। আমি গেলে চান্দু বলে—ভাই, মাজার থেইকা শিন্নি আনছি। পুটি কইলো আপনারে লইয়া খাইবো।
খেতে খেতে পুটির বাড়ন্ত পেট দেখে বলি—কি?
চান্দু বলে—পুটি পোয়াতি। মানিক মামা কইছে, পোলা হইবো।
পুটি জানতে চায়—ভাই, পোলা ভালো, না মাইয়া ভালো?
যেটা হয়, সেটাই ভালো।
ঠিক কইছেন। চান্দু খালি পোলা পোলা করে।
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে চান্দুকে শাসায়।
চান্দু লাথি মারলে কুকুরটা দূরে গিয়ে বসে কুঁইকুঁই করে। চান্দু বলে—পুটি পোয়াতি হওয়ার পর থেইকা কুত্তাডা আমারে সহ্য করতে পারেনা। এই কুত্তা গেলি, না পুলিশ ডাকমু!
আরেক বৃষ্টিভেজা রাতে বুশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম; কুকুরটা এসে দাঁড়ায়। আমি গেয়ে উঠি—একটি কালো কুকুর/ একখানা বেঞ্চ, নড়বড়ে…। কুকুরটা লেজ নাড়ে। আমি বলি—অরা কই?
কুকুরটা আমার প্যান্ট কামড়ে ধরে টানে। আমি বলি—চল, যাই।
আমরা যেমন ভাবি, সবার জীবন কী তেমন? যৌবন এলে আমরা সঙ্গি চাই; সন্তান এলে সংসার; বার্ধক্যে গোরেস্তান খুঁজি। পুটিকে জানার আগে ভাবতে পারিনি—জীবন নিজেই এইসব বৃত্তের বাইরে গিয়ে আরো মুক্ততা খুঁজে নিতে জানে!
বহুদিন ধরে ভেবে আসছিলাম, জ্ঞানেই মুক্তি; জেনে-শুনে, যুক্তি-বুদ্ধিতে চলতে হয়। এখন দেখতেছি, জীবন চলে জীবনের নিয়মে। কালো কুকুরটা, যার পিঠের খানিকটা সাদা—কাউকে যাত্রি ছাউনির কাছে ঘেষতে দেয় না। চান্দুর দিকেও ঘেঁউ ঘেঁউ করে তেড়ে যায়।
চান্দু দেখতে চায়, শিশুটি কেমন করে মাতৃস্তন চষে চুষে অস্তিত্বের জানান দিতেছে; কী আবেগে চাঁদের আলো শরীরে মাখছে মা ও শিশু। পুটি যে তা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না, কালো কুকুরটাই তা জানতে পায়। কুকুরটার অস্থিরতা দেখে পুটি বলে—এহানে বইয়া আছো ক্যান! যাও, খাওনের জোগাড় করো গিয়া।
আমি উঠে দাঁড়াই।কোলাহল থেমে গিয়ে শহরের গায়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে। চান্দুর হাতেকিছু টাকা দিয়ে বলি—যা, ভাতওয়ালিগো কাছ থিকা খাওন লইয়া আয়।
যেতে যেতে চান্দু কুকুরটার উপর রাগ দেখায়—খাড়া, আইতাছি; আমারে ঘেউয়াস! তোর ঠ্যাং আমি ভাইঙ্গা দিতাছি; সবাই তোরে কইবো, লুলা কুত্তা।
কুকুরটা বসে থেকেই ঘেঁউ ঘেঁউ করে জবাব দেয়—বাচ্চা চুরি করবি! যা যা, আমি থাকতে পারবি না।
রাস্তার মাঝখানে গিয়ে বলে উঠি—সাব্বাস। তারপর নেচে নেচে গেয়ে উঠি—আমি মানুষ, আমার কেনো পাখির মতো মন/ তাইরে নাইরে গেলো আমার সারাটি জীবন…।
ছাউনির নিচে যে বুড়িটা বিড়ি খাচ্ছিলো, গানের মধ্যেই বলতে থাকে—বুঝছো নি বেডা, মাইয়াডা ভালো না; মাইনষের চাইতে কুত্তারে বেশি ভালো পায়।
আমি জানতে চাই—তুমি কারে ভালো পাও, মা জননী?
বুড়ি হাসে—মওলারে; মওলা পাগলারে। হি হি হি…।
শহর কারো নয়; তবু শহরেই থাকতে হয়। এই যে দালান-কোঠা—সব ছেড়ে ধনীরা নতুন শহরে চলে যেতে থাকে। আর এই শূন্যতার দখল নেওয়ার জন্য নতুন মধ্যবিত্তরা আন্দোলন গড়ে তোলে। যৌক্তিক ব্যস্ততায় পুটির কথা ভুলে যাই। চান্দুকে দেখি, আন্দোলনকারীদের কাছে গাঁজা বেচতেছে—আগের মতো ভোলাভালা না, চৌকশ লুম্পেনের ভঙ্গিতে। আমাকে দেখে সালাম দেয়। পুটির কথা জানতে চাইলে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলে—কই থাকে কে জানে।
একলগে থাকস না?
আমার টাইম নাই, ভাই।
সময় এমন, আন্দোলনও শেষ হয়। আশাবাদী জনতা ব্যানার গুটিয়ে ঘরে ফেরে। পথের পাশে থেকে যাই আমি আর আশাহীন একফালি চাঁদ। সারারাত জেগে জেগে যখন পাঁপড়িতে পাথর গড়ায়, তখন মনে হয়, কেউ যেনো আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। চোখ মেলে দেখি—কালো কুকুরটা আর শিশু কোলে পুটি। আমার সাড়া পেয়ে মিষ্টি হেসে বলে—ভাই!
আমি উঠে বসি। শিশুটিকে কোলে নিই। মেয়েটা বলে—মাজার থেইকা শিন্নি আনছি; খাইবেন আমাগো লগে?
রাত আসে রাত যায়। ভোরের আলো ফুটলে দেখি, কুকুরটা শিশুটির সাথে শুয়ে আছে। দুজনেই আলুথালু; হয়তো স্বপ্ন দেখতেছে। একটা ছেলে এসে বলে—এই পুটি ওঠ; চল যাই।
পুটি ছেলেটার সাথে হাঁটা দেয়। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে—অর নামও চান্দু।
দূরন্ত ছেলেটা গলা উঁচু করে বলে—ভাই, আমিও পুটিরে ভালো পাই।
সোনালী সকালে ওরা পার্কে ঢুকে ফুল কুড়াবে। আমি কি করে ওদের বাঁধা দিই!
********************