নাহার মনিকা
হাওয়াবন্দী
এ শহরের অন্যসব মানুষের জন্য কেমন কে জানে, কিন্তু বেলালের জন্য আজকের সকাল অভূতপূর্ব!
প্রায় সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে সে। সকালে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুমের মধ্যে মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেলে চমৎকৃত হয়ে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ায়।
কাগজ সরু করে ছিঁড়ে মধ্যমা আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষে পাকিয়ে আরো সরু করে নাকের ডান ফুটোয় আলতো করে ঢুকিয়ে চোখ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত মনঃসংযোগ করতে হয়। নাকের ভেতরের মৃদু উৎপাত ফুসফুসে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে অপ্রচলিত বাতাস বের করে দিতে চাইলে তারপর চলে আসে কাংখিত হাঁচি। পরপর সাত আটবার হাঁচি দিয়ে চোখে পানি চলে আসে। এটাই বেলাল চায়। নাকের পানি, চোখের পানি এক হয়ে কণ্ঠস্বর বুজে এলে গলায় হাত বুলিয়ে মোবাইল টেনে নেয় সে।
এখন অফিসে ম্যানেজার তাহেরা আকন্দকে ফোন দেয়া যায়। সকালের চা খাওয়া হয়নি এখনো। কিন্তু ফোনটা করে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অন্য কিছু শুরু করা চলে না।
ছুটা বুয়া বসার ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। একটু পরেই চলে যাবে। কিন্তু তাহেরা আপাকে ফোন দিতে দেরী করা ঠিক হবে না। তার সঙ্গে কথা বলার সময় কোন বিঘ্ন ঘটতে দেয়া যাবে না। ফোন নিয়ে শোবার ঘরের কোনার দিকে চলে যায় বেলাল।
-‘বেলাল, তোমার অবস্থা তো বড়ই খারাপ। জ্বরজারি বাঁধাইছো নাকি?
-‘মনে হয় ফ্লু আপা। কালকে যে গাজীপুর গেলাম। আসার সময় জ্যামে আটকায় গেলাম, তখন থেকে। ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাইতেছে আপা…’ বেলালের গলা পুরাই বসে যাওয়া, সর্দিতে কাশিতে বেহাল দশা। কাশির দমকে কথা শেষ করতে পারে না।
-‘আচ্ছা, ঠিকাছে, ঠিক আছে, তুমি কথা না বলে রেষ্ট করো, ওষুধ খাও, প্রচুর সি ভিটামিন খাও। টেইক কেয়ার অব ইয়োরসেলফ। সাবধানে থাকো। একদম সুস্থ্য হয়ে তাড়াতাড়ি জয়েন করবা’, -বিরক্তি আর স্নেহের মিশেলে কথা বলেন তাহেরা আপা।
যাক, তাহেরা আকন্দের কঠিন হৃদয় গলানো গেছে।
ইয়েসসসস! পাকানো মুঠি ঝাঁকি দিয়ে বাঁ পা উঁচু করে ছোট একটা লাফ দেয় বেলাল।
বুয়াকে কি একটু চা বানিয়ে দিতে বলবে? নাকি তাকে এক্ষুনি চলে যেতে বলবে। তারপর বাসাটা তার একার! এখন সে যখন তখন পায়ের ওপর পা তুলে বসে সময় কাটাতে পারে। সময় আজকে তার কাছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়ার জিনিস।
এমন একটা দিন কাটানোর কথা সে গত তিন বৎসর ধরে কল্পনা করে এসেছে।
কিন্তু তাদের অফিসে মালিক ইউনুস সাহেবের পরে ষ্টাফ বলতে ম্যানেজার তাহেরা আপা, তিনজন সেলসে, লিমন ভাই একাউটেন্ট। আই টি’র কাউকে লাগলে দিনচুক্তি ডেকে আনা হয়। এদের সবার মধ্যে গালভারী অফিস ম্যানেজার নামের পোষ্ট নিয়ে বেলাল থাকে সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। যেমন তাহেরা আপা সবসময় বলে- ‘বেলাল তুমি এবার একটু চন্ডীপাঠ করো এখন, এই নাও ইংরেজী ইমেইলগুলির উত্তর পাঠাও!’
এমন না যে উনি ইংরেজী পারেন না। দশ বছর ধরে এই অফিসে চাকরী করেন। গৎবাঁধা চিঠিপত্রের জবাব দিতে দিব্যি পারেন। কিন্তু ঐ যে বেলালকে দেখলে সবার কড়ে আঙ্গুলের নখ বেড়ে যায়।
তো সকালবেলা চন্ডীপাঠ শেষ হলে বিকেলের দিকে ইউনুস স্যার ফোন করবেন-‘বেলাল তোমাকে এক্ষুনি একবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে’।
হয় অফিসের এয়ার-শিপমেন্ট কাষ্টমস ক্লিয়ার করে ছাড়িয়ে আনো, না হলে বড় গাড়ি ভাড়া করে ইউনুস সাহেবের কোন আত্মীয়কে রিসিভ করে আনো। মাঝে মাঝে তার ছেলেকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতেও বেলালকে যেতে হয়! ড্রাইভারকে নাকি একা বিশ্বাস করা যায় না।
– ‘অসম্ভব স্যার, বললেই হলো না কি? আমি অফিস ছুটির পর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন বাসায় যাবো, জম্পেশ শাওয়ার নিয়ে গরম চা আর জিলাপী খাবো’,- বেলালের ভেতর থেকে আশিভাগ বেলাল এইসব বলার জন্য মুখিয়ে থাকে, কিন্তু বাকী বিশভাগের “বস ইজ ওলওয়েজ রাইট’- আপ্তবাক্য মনে পড়ে আর জোকের মুখে নুন পড়ার মত গুটিয়ে আসে নিজের সমস্তটা।
কাজেই শুক্রবারও তার ডাক পড়লে সে লুঙ্গি বদলে দেয়ালের হুকে ঝুলিয়ে রাখা প্যান্ট পরে তড়াক করে রাস্তায় নেমে ‘এই রিক্সা, এই সিএন জি?’ করে গন্তব্যে ছোটে।
বেরিয়ে পড়লে বরং একধরনের ভালোই লাগে, বাসার ভেতরের তান্ডব তো এড়ানো গেল! তা না হলে ছুটির দিনের সকালগুলোতে ঘুমানোর সুযোগ পায় কোথায় সে? লিমন ভাইয়ের ছয় বছরের গুটলু ছেলে আদনান ডাইনিং স্পেসে ক্রিকেট খেললে তার এক কামড়ার দেবালয় কি এড়ায়? ঘন ঘন বল এসে বেলালের দরজায় বাড়ি খায়, পিচ্চিটা নিজেকে ‘মুস্তাফিজ, মুস্তাফিজ’ দাবি করে খুশিতে চিৎকার করে। বিরক্ত বেলাল তখন হাসিমুখে দরজা খুললে আদনান সুড়ুৎ করে বল পাঠিয়ে দেয় একদম তার খাটের নিচে। তখন বলের সঙ্গে, ব্যাটের সঙ্গে, স্বঘোষিত মুস্তাফিজের সঙ্গে বেলালের খেলা শুরু করতেই হয়।
লিমন ভাইয়ের স্ত্রী ম্যাক্সিতে আটামাখা হাত মুছে খেলা দেখতে আসে তার দরজায়।
মুখ টিপে হাসে, বলে-‘বেলাল ভাইকে দেখেও যদি লিমন কিছু শেখে! ছুটির দিনে কোথায় ছেলের সঙ্গে একটু খেলবে তা না পড়ে পড়ে ঘুমায়। নবাব সাহেবকে জাগানো নিষেধ!’
গতকাল আদনানকে নিয়ে তার বাবা মা তিনদিনের সফরে গ্রামের বাড়ি গেছে।
ইয়েসসস! আজকে বেলালের দিন! আজকে সে নিজেই ক্রিকেট খেলতে পারে।
ব্যাট কোথায় রাখে গুটলু? তার খেলার সরঞ্জাম? সাবলেট এ একঘর নিয়ে থাকলেও এক অফিসে চাকরীর সুবাদে এরা বেলালকে অগাধ বিশ্বাস করে। কোথাও গেলে ঘর তালা টালা দিয়ে আটাকায় না।
বেলাল পায়ে পায়ে তিনটা ঘরে ঘুর ঘুর করে। ঐ তো দরজার পাশে ক্রিকেট ব্যাট দাঁড়িয়ে আছে।
-‘আয় ব্যাটা ব্যাট, আয়, এইবার আমার সঙ্গে খেল!’
ব্যাটটাকে দু’হাতে বাগিয়ে বল মারার ভঙ্গি করে বেলাল। বল ছুটে এসে তার ব্যাটের আগায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। বেলাল সর্বশক্তিতে ব্যাট দিয়ে বাড়ি দেয়। ছক্কা!! বল ডায়নিং স্পেস পার হয়ে বারান্দায়, সেখানের খোপ খোপ গ্রিলের ব্যারিকেড ভেদ করে পাশের বাড়ির ছাদ, তাদের ছাদবাগানের বিশাল সূর্যমুখী ফুলগুলোকে গুড়িয়ে দিয়ে আরেকটু ওপরে ঝুঁকে থাকা ধুলিময় আমের বউল ঝরিয়ে আকাশে উঠে মিলিয়ে গেল বল! আরে, আরে বল কোথায় গেল!
যাক, বেলাল ঐ বলের পেছনে দৌড় দেবে না আজকে। তার এই সাতাশ বছরের জীবনে একহারা গড়নের শ্যামলা ভাসা ভাসা চোখের কোকড়া চুলের সাদামাটা পোষাক-আশাকের বেলাল সাতদিনের মধ্যে ছয়দিনই পায়ের নিচে স্প্রিং লাগিয়ে শহরের এমাথা থেকে ওমাথায় ছোটে। সবখানে গিয়ে ‘আমি বেলাল, আমার নাম বেলাল’ করে। কিন্তু কেউ কি তাকে চেনে?
আজকে এই শহরের কাছে বেলাল আর নিজের নাম বলবে না বলে ঠিক করে ফেলে। সে বেলাল, মহিউদ্দীন, কিংবা নির্মল হলে এর কিছু কি আসবে যাবে? যতই সে এর গায়ে গা লাগিয়ে মগ্ন থাকতে চেয়েছে, ততই এই শহর, মফস্বল থেকে আসা বেলালকে ধাক্কা ঠিক দেয় নাই, তবে বিশাল তন্দুরের গনগনে আগুনের মধ্যে তেতে ওঠা নানরুটি যেমন তাপে আলগা হতে থাকে তেমন সেও আলগা হয়ে গেছে। ছুটতে ছুটতে টের পেয়েছে সে কেউ না। কিছু না। খাদ্যবস্তু না, কোন স্বাদ না, কোমল না।
বেলাল নিজের নতুন নাম দিতে পারে ‘শ্রান্ত’।
না, শরীর না। ইউনুস স্যার বা তাহেরা আপা বললে এখনই সে লাগামহীন ঘোড়ার মত খুর টগবগিয়ে দৌড় দিতে পারবে আবার। কিন্তু তার এই শরীরের সঙ্গে মনের যোগাযোগ নাই। মন ক্লান্ত হলেও শরীর দৌড়ায়। ইচ্ছে করে না অথচ তার পা দৌড়ে চলে। সে যেন ডোপ নেয়া অলিম্পিক দৌড়বিদ। কোন মাদকের ক্রিয়ায় নিজের ক্ষমতার চেয়ে বেশী ফল বয়ে আনছে।
আরো আছে, এই শহরে বেলালের মত আরো অনেক আছে যাদের কোথাও কেউ নেই। ধাক্কা বা হোঁচট খেয়ে পরে গেলে ফোন টিপে ডাকার মত কেউ, যে এককথায় সাঁই সাঁই গাড়ি উড়িয়ে নিজে চলে আসবে, অথবা মোবাইল টিপে এমন সব জায়গায় ফোন করবে যে সবখানে খবর হয়ে যাবে। যেমন ইউনুস স্যারের আছে। তাহেরা আপাদেরও আছে সম্ভবত। কিন্তু বেলালের? কেউ নেই। এই রাস্তার প্রতি কদমে যারা চলাচল করে, তাদের সবার আছে, সবাই কথায় কথায় বলে ওঠে-“আমারে চিনস?”
বেলালের যে নেই একথা সে গতকালের আগে পর্যন্ত বুঝে উঠতেও পারেনি।
গতকাল রোদ উঠেছিল বেশ দেরী করে। ঢাকা শহরে রোদ না উঠলে শহরটা আর চেনা যায় না। পুরো শহরের অলিগলি শিরা উপশিরায় কেমন বিমান ধ্বংসের গতি নিয়ে কিছু একটা নেমে যেতে থাকে। ঐ যে বলে না? চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ যখন পৃথিবীর কক্ষপথে মাপে খাপে পড়ে যায়, পৃথিবীতে ঘোর আঁধার নামে, সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে শুভ, অশুভ কতকিছু নেমে আসে। তেমন কিছু।
বেলালের জন্য বোধহয় গতকাল শুভ কিছু নেমে এসেছিল।
ধূসর ম্যাড়ম্যাড়ে তাবুর মত কুয়াশা তার মাথার ওপর এসে নামলো। তখন হাত খানেক দূরের কিছুও পরিস্কার দেখা যায় না। বেলালও দেখতে পায়নি, কিন্তু অনুভব করলো। মাথার ওপরে ভারী অথচ পলকা কিছু একটা। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে কপালের ওপরে দেখতে চাইলে চলন্ত বাসের চলটা ওঠা ছাদ নজরে আসে শুধু।
বাসে সিট পায় না বেলাল। রড ধরে দাঁড়িয়ে দোলে। সত্যি বলতে তেমন কষ্ট হয় না। রোদ উঠে বাইরের কুয়াশা ফালি ফালি করে কেটে দিচ্ছে। বাসের ভেতর বাতাস ঢুকে আটকে পড়ছে। বেলাল একমুঠ বাতাস খপ করে ধরে ফেলে। হাতের মুঠোয় আটকা পড়ে হাওয়াটুকু খচমচ করে। সে আরেকটু শক্ত করে বাতাস দিয়ে মুঠি বানায়। তারপর পকেটে ভরে রাখে। প্রতিদিন যাওয়া আসার পথে চেনা, আধচেনা, অচেনা মানুষ কি বলছে কিছুই কানে ঢোকে না। বাতাসের সঙ্গে ফিস ফিস কথা বলে বেলাল। হঠাৎ করে টুকরো বাতাস ছড়িয়ে বিরাট হয়ে যায়। যেন এক ঐন্দ্রজালিক নাগরদোলা, বাতাসের ঢেউ ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠছে। বেলালের তলপেটের কাছে কেউ বুঝি কস্তরী মৃগনাভি ঢুকিয়ে দিয়েছে। অল্প সুখের ব্যথা বোধ হচ্ছে। চারপাশে একটা বিশাল রজনীগন্ধা ফুলের বাগান। হঠাৎ সে যেন এক দোকান সুগন্ধি সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে।
বাস থেকে নেমে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে হাত তুলে রিক্সা ডাকে সে। ঘাড় কাৎ করে হাঁটতে গিয়ে টের পায় মুখটা হাসি হাসি হয়ে আছে তার। এখন যদি কেউ বেলালকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে যে কেন হাসছে, সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। ঝটপট হাসি ভাবটা মুছে ফেলে। আশপাশে চেনা জানা কেউ নেই।
রাস্তা যেখানে আরো বড় রাস্তার কাছে এসেছে, সেখানে এসে পা শ্লথ হয়ে যায় বেলালের, সে পেছন ফিরে দেখে।
দেখে লম্বা গলির শেষ মাথায় তার জন্য এক বাটি সময় বসে আছে। শুধু তার জন্য। বাঁ হাতের উল্টোপিঠে একটু সময়ের স্পর্শ, ঘন মেঘের মত গভীর করে চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে কথা বলা ধূপের মেদুর গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে সেই আঘ্রাণে ডুবে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে বেলালের মনে হলো, মাথার ওপরে তাবুর মত অনুভব আসলে এই সময়টা, যা কিনা
শুধু তার জন্য বসে আছে। অথচ আজপর্যন্ত সে নিজেকেই তৈরী করে উঠতে পারেনি।
চা খাওয়ার পর চনমনে লাগে বেলালের। কি করা যায়, কি করা যায়? আজকে সে কারো সঙ্গে কথা
বলবে না। কোথাও যাবে না। বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে চাদরের নিচে ঢুকে পা উঁচু করে মাথা ঢেকে
একা একা হুটোপুটি করে। তার গলায় সুর আসে না, তবু কিছুক্ষণ গান গাওয়া যায়। দু তিন লাইনের
বেশী, পুরো গান কোনটা পারে বেলাল? কেন যেন চল চল চল রণ সঙ্গীত মনে আসছে। বেলাল
মেঝেতে পা ঠুকে কিছুক্ষণ চল চল গায়।
আচ্ছা, গতসন্ধ্যায় যে অপূর্ব বাতাস মুঠোবন্দী করে পকেটে পুরেছিল, কোথায় সে বাতাসটুকু? এ
বাসায় সে বাতাস আনা যায় না? চট করে প্যাণ্টের পকেট হাতড়ায় বেলাল। খালি। পকেটের সূতি
কাপড় উলটে বের করলে শুকনো রজনীগন্ধার একটা আবছা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে।
নাহ, সেই হাওয়াটুকু চাই। কিভাবে, কোথায় পাবে? অস্থির লাগে বেলালের। সবগুলো ঘরে এবং
বারান্দায় দ্রুত পায়ে পায়চারী করে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে ধরবে কি ধরবে না করতে করতে যন্ত্রচালিতের মত বেলালের হাত এগিয়ে
গিয়ে ফোনটা ধরে ফেলে। একটা স্বাভাবিক ‘হ্যালো’ বলে নিজেই ধরা পড়ার ভয়ে চমকে যায়।
-‘হ্যা, বেলাল তোমার না কি অসুখ? ইউনুস স্যারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। – ‘না না বেলাল তোমার অসুখ হলে চলবে?’
ইউনুস স্যার কি ধরতে পারলেন বেলালের কণ্ঠস্বরের মুহূর্তে বদল? অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ। তা না হলে ব্যবসা টিকে আজকাল? বেলালের এবার হতবুদ্ধি লাগে। সে কি ধরা পড়ে গেল?
স্যারের উপদেশ, কি কি খাবে, কিভাবে বিশ্রাম নিয়ে দ্রুত সুস্থ্য হওয়া সম্ভব সেসবের কিছুই আর মাথায় ঢোকে না। মাথার কোকড়া চুলের কতটা একটানে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এত বেখেয়াল কিভাবে হলো সে?
ফোন রেখে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে ধপাস করে বসে পড়ে বেলাল। নিজের বলা ‘হ্যালো’ মাথার ভেতর বারবার রিওয়াইন্ড ফরোয়ার্ড করে বুঝতে চায় সে যখন ইউনুস স্যারকে হ্যালো বললো প্রথম, তা কতটা স্বাভাবিক শুনিয়েছে? স্যার কি সন্দেহ করলেন?
সে নিজে কি কি বলেছে স্যারকে? সে কি বলেছে যে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হতে আরো তিনদিন। অন্তত লিমন ভাইদের ফিরে আসার আগে নয়!
বারান্দার গ্রীলে কাঁচের বোতলে মানিপ্ল্যান্টের সবুজ পাতা দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে বেলালের মনে হয়- বাতাসে সুঘ্রাণ টুঘ্রাণ এসব মিথ্যে কথা। তার বাতাসে বালি কিচ কিচ করে। আর তার জন্য কোন সময়ের বাটিও বসে নেই।
পরক্ষণেই আবার মনে হয়- ইউনুস স্যারের অত সময় কোথায় বেলালের কণ্ঠস্বর কতটা অসুস্থ্য শোনাচ্ছে যাচাই করার? তিনদিনের দিন অফিসে হাজির না হলে বরখাস্ত করতে হাত কাঁপবে না। নেহাত বেলালের মত করৎকর্মা সর্বকাজে হ্যা বলা একজনের প্রতি ভদ্রতা দেখিয়ে ফোন করেছে।
হুহ! উঠে দাঁড়ায় বেলাল। ফ্রিজের দরজা খোলে। আবার ফোনের দিকে চোখ পড়ে।আবার ফ্রিজের দরজা।
বারান্দার গ্রীলে মানি প্ল্যান্ট। আবার ফোনের স্ক্রীণ, যেন এক্ষুণি আরেকবার বেজে উঠবে। ফোনটার কাছ থেকে কেন যেন দূরে যেতে পারছে না বেলাল।
***********************