জাকিয়া শিমু
একটি শ্রাবণসন্ধ্যা উপাখ্যান
মোটের ওপর সাহেদা একবার নয় পরপর তিনবার পেট খসাইছে’! এমন দুরাচারীনারী সংসারে থাকলে সে সংসারে গজব পড়বে! মজিদ মিয়াঁ বুঝদার মানুষ জেনেবোঝে সে এমনতর গুনাহর কাজ করতে পারে না! এরপর শ্বাসরোগী মজিদ গলার কাছে আটকে থাকা দমটা সজোরে টেনে কোনমতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে এবং তর্জনী যথাসম্ভব উঁচিয়ে সালিশে সাফ জানিয়ে দেয় সাহেদার সাথে সংসারটা সে করবে না! শুধু অভিযোগে নিবৃত্ত হয় না সে! স্বপক্ষে নালিশ যুতসইমতো প্রমান করতে সাহেদার নিজহাতে লেখা চিঠি সালিশের মাতাব্বরদের দেখায়! এরপর সে আসলেই অতিরিক্ত পেরেশান হয়ে ওঠে! ঘন ঘন দম টানে এবং নিজেকে সামলে নিতে লুঙ্গির কোঁচরের ঢিলেঢালা-খুঁট দুহাতে শক্তআঁটে বাঁধতে বাঁধতে উঠোনের একপাশে যেয়ে দাঁড়ায়। তারপরও বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাসফাঁস করে। ন্যুজে যাওয়া বুকটা সোজা করতে উঠোনঘেঁষা রোয়াকের বাঁশেরথামে ঠেস দিয়ে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে বারকয়েক লম্বা করে দম টানে। তার শ্বাসের ব্যামোটা বড্ড বেশি ত্যক্ত করছে আজকাল!
ঘটনা সত্য! অভিযোগে একদণ্ড মিথ্যা নেই। সাহেদা স্বামী মজিদের কাছে কোনকিছুই গোপন করে নাই। সেসময়ের কথা, সাহেদা সবেমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশে গেছে। এখনকার মতো দেশে গণহারে ফোনের চল ছিল না। গাঁয়ের বটতলার বাজারে ফোনের একটা মাত্র দোকান ছিল। সে সেখানে ফোন করে মাসে একআধবার পরিবারের সাথে কথা বলত। তখন স্বামী মজিদ মিয়াঁর সাথে আলাপের পুরোটাই জুরে থাকতো তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ। এবং প্রায় প্রতিসপ্তাহে স্বামীর কাছে পত্র লিখত সাহেদা ওই একই বিষয়ে! পারতপক্ষে মজিদ মিয়াঁ পত্র কিংবা ফোনালাপে স্ত্রীর মিনতি কোনরকম আমলে তো নেয় নাই উপরোন্ত সাহেদা দেশে ফিরে আসলে কঠিন শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে!
মজিদ মিয়াঁ নিদেনপক্ষে স্ত্রীকে ধৈর্য বৃদ্ধির দাওয়াই দিয়েছে! তার বিবেচনায়, মেয়েছেলে বিদেশ যায় বাসাবাড়িতে কাজ করতে। মনিবের হুকুমকাজ তা যেকাজ হোক ঘরেরকাজের মধ্যে পড়ে! মনিবের সাথে দৈহিক মিলনে সাহেদার মনোকষ্টের কারণ মজিদের কাছে পরিষ্কার হয় না! পবিত্র-দেশের লোক, তাদের সাথে কাজ করতে দ্বিধা থাকাও পাপ! এসব উপদেশ দিয়ে স্ত্রীকে পত্র লিখত সে! সাহেদা মনের দুঃখে কিংবা জেদের বশে স্বামীর উপদেশবাণীসমেত পত্র পড়া শেষে ছিঁড়ে কুটিকুটি করেছে! নিদেনপক্ষে ধূর্ত মজিদের মতো কোন প্রমাণাদি রাখেনি সে! তখনকার সময়টা এমন ভয়ঙ্কর ছিল যে আত্নহত্যা ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না তার কাছে কিন্তু চোখেরকোণে বাচ্চাগুলোর মুখ ভেসে ওঠতে, মুখ বুজে স্বামীর আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হয় সে!
এসব ঘটনা সাহেদার মনের ভেতরে চেপে-রাখা গোপন কষ্টের গল্প! সেসব গল্প এজনমে কারো কাছে প্রকাশ দূরে থাক নিজেও দ্বিতীয়বার মনে করতে চায় না! সে জেনে এসেছে- কিছু কিছু গোপন-সত্য বুকের অচেতন স্থানে কবর দিয়ে রাখতে হয়! তাতে নিজের না হলেও সংসার নামক সংগঠন মজবুত হয়! কিন্তু সালিশে শত শত লোকের সামনে মজিদ মিয়াঁ সেসব চিঠির গোপন কথা এবং তালাক শব্দটি মুখে আনতে সে গভীর কষ্টে কেঁপে ওঠে! সালিশের লোকজন মজিদের বিরুদ্ধে সাহেদার কোন নালিশ অভিযোগ শুনতে চাইলে সে তার প্রতি স্বামীর এমনতর আক্ষেপে এতটাই বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে মরামানুষের মতো নির্জীব দৃষ্টি ফেলে শুধু তাকিয়ে থাকে! তার মুখের ভাষা স্থবির হয়ে যায়!
সাহেদার তখন বেণীদুলানো বয়স, বড়জোর তের-চৌদ্দ হবে। ঢোলকলমির সতেজ-নিটোল ডাঁটার মতোন একখানা লকলকে বেঁয়ে-ওঠা শরীর। মাথার পরে ঈষৎ বাদামী একগাছি চুল ঘাড়-পিঠ ছাড়িয়ে কোমরের কাছে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে থাকে। গাঁয়েররঙ একটু ময়লা হলেও চোখ-নাক হিন্দুদেবীদের মতো খাড়া খাড়া। বিকেলে কলসিকাঁখে দুবেণী দুলিয়ে নদীরপারে হেলেদুলে যখন হেঁটে যায় অনেকে পিছু ফিরে তাকায়। এমন বয়সকালের একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে,সাহেদার তখন সেই সময়।
মজিদ মিয়াঁ একই গাঁয়ে বাস করে। কাজকামহীন মানুষটা সারাদিন টুঁটুঁ করে ঘুরে বেড়ায়। তার নজর পড়ে সাহেদার দিকে এরপর অকর্মা মজিদ ওর পিছু পিছু ঘুর ঘুর করে! একদিন,দুইদিন এবং একসময় সাহেদার চোখে সে ধরা পড়ে যায়! প্রথম প্রথম সে এড়িয়ে গেলেও উঠতি-বয়েসের একটা অবিবেচনাপ্রসূত ভালোলাগা আছে, সেই ধকলে কিনা সাহেদা ম্যাটা ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের রোগাইতা মজিদ মিয়াঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে!
এরপরের সময়গুলোতে ঘটে যায় সেসময়ের প্রেক্ষিতে যেরূপ কাণ্ড ঘটার কথা সেসব ঘটনা। একনজর দেখতে সারাদিন অপেক্ষা,অসময়ে সাহেদার বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করা, ধূসরনীল খাতার পাতা ভর্তি ভুলভাল কাটাছেঁড়া অলীকস্বপ্নের মিথ্যে-ভালোবাসার গল্প বোনা আরও কতো কী! গাঁয়েরলোকের চোখ এড়ায় না। কথা ওঠে! এবং একদিন আশ্বিনমাসের ভোরসকালে সাহেদা এবং মজিদ মিয়াঁকে খোঁজে পাওয়া যায় না! প্রায় ছ’মাস পরে তারা গাঁয়ে ফিরে আসে এবং সংসার শুরু করে। বিয়ের বছর না ঘুরতে তাদের ঘরে প্রথম সন্তান আসে। এরপরের বছর আরেক সন্তান। মজিদ কামকাজ বলতে তেমন কিছুই করে না। বাবারকালানের এককানি জমির উপর ভর করে বাঁচে তার পুরো চারজনের পরিবার। সে মদ তাড়িতে আসক্ত সে খবর নতুন নয় তবে এই সময়ে এসে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। প্রায় দিন মদ্যপ হয়ে বাড়ি এসে চেঁচামেচি করে এবং অকারণে সাহেদার গায়ে হাত তুলে!
সেসময়ে গ্রামদেশে মধ্যপ্রাচ্যে কাজে যাওয়ার এক হিড়িক ওঠে! আসলে হিড়িক বলাটা সমীচীন নয়, কারন ওসব দেশগুলোতে সাধারন সময়ের চেয়ে বিশেষ কারনে সেসময়ে একটু বেশি সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। মজিদের বন্ধুবান্ধব অনেকেই এই সুযোগে বিদেশ যেতে দৌড়ঝপা শুরু করে। কিন্তু মজিদ এব্যাপারে মোটেও আগ্রহ দেখায় না। সাহেদা তাকে সংসারের অভাবের তরাসে বিদেশের ব্যাপার তুলতে মজিদ তেড়ে ওঠে অনেকটা খোঁচা-খাওয়া গোক্ষর সাপের মতো! মজিদ আগাগোড়া অলসমানুষ, গা খাটাতে নারাজ। সংসারে অভাব বাড়ে, এবং এর মাত্রা অধিকতর তীব্র হতে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করার মতো বেহাল দশায় চলে আসলে মজিদ ঘুরে দাঁড়ায়। অবশ্য সে নিজে নয় উল্টো সাহেদাকে বিদেশ পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে!
সাহেদার অল্পবয়সী দু’সন্তান। মজিদ মদ্যপ। মদ্যপের চিন্তাধারা শিশুবোধক হয়। ওর ওপর দু’সন্তানের দেখভাল’র দায়িত্ব দেওয়া অবিবেচক কাজ! নিদেনপক্ষে তার নিজের শরীরেরও বেহাল অবস্থা! অল্পবয়সে বিয়ে! অভাবের সংসার তার উপর একবছরের ব্যবধানে দু’সন্তানের জন্ম! এছাড়ও, ভালো ঘরের মেয়েলোক বিদেশে কাজ করতে যায় না’ এমন কথা গাঁয়েরলোকের মুখে মুখে ফেরে। যদিও এসব ফেলনা কথা নয়! তাদের গাঁয়ের এক মেয়ে সেদিন দেশে ফিরেছে গর্ভবতী হয়ে! চোখের সামনে এসব দেখে কিন্তু মেয়েমানুষের বিদেশ যাওয়া কমে না বরং তাদের বিভিন্নভাবে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয়। সাহেদার ভয় হয়! সে না খেয়ে মরে গেলেও এমন কাজ করতে পারবে না।
কিন্তু সাহেদা শেষমেশ মধ্যপ্রাচ্যে যেতে বাধ্য হয়! সংসারে অভাব চরমে ওঠে! চোখের সামনে অভুক্ত সন্তানদের শরীর ক্ষয়ে-যাওয়া, মায়ের চোখ সহ্য করতে পারে না! ওদিকে উক্তমতো খাবার না পেলে মজিদ সাহেদাকে সকাল-বিকাল পেটায়, তালাকের হুমকি দেয়!
সাহেদা মধ্যপ্রাচ্যে যে বাড়িতে কাজ করতে আসে তা আসলে বাড়ি নয়, তার কাছে মনে হয় এ- এক বেশ্যালয়! মনিবের তিন সেয়ানা ছেলে,মনিব এবং তার স্ত্রী এই নিয়ে এই যমঘর। মনিবের স্ত্রী বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকে। এই পরিবারের দেখাশুনা এবং ঘরের যাবতীয় কাজ পুরোটা করতে হয় সাহেদাকে। দিন-রাত কঠিন খাটতে হয়। রাতে নির্ভারে একরাতও সে ঘুমাতে পারে না! একটু পর পর তার দরোজায় টোকা পড়ে। সে ভয়ে চিৎকার করে। কেউ এগিয়ে আসে না। হাত পায়ে পড়ে মাফ চেয়েও কাজ হয় না। প্রথম অবস্থায় অবশ্য মনিব তার ঘরে আসত না। কিন্তু একটা সময় পর সেও তাকে ছাড় দেয় না! বাবা আর ছেলেদের শরীরের চাহিদা মেটাতে সাহেদা অতি মাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। মনিবের স্ত্রীকে জানাতে সে উল্টো মারধর করে! অচিন দেশ। কোন পরিচিত নিকটজন নেই! পালাবার কোন পথ নেই! একসময় অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে সাহেদা আটকা পড়ে যায়!
সাহেদা সমস্ত ঘটনা মজিদকে জানায়। তাকে ফিরিয়ে আনতে কতো যে মিনতি করে কিন্তু কোনকিছুতেই মজিদের মন ঘুরে না। মজিদ তাকে মানিয়ে নিতে হুকুম করে। একমাত্র জমি বন্ধক দেওয়া আছে। ঘরে অভাব। বাচ্চাদের সুখের ভবিষ্যৎ দেখিয়ে সাহেদাকে ওসব মেনে চলতে বলা হয়। কিন্তু সাহেদা মজিদের কথা মানতে পারে না। বাপের বাড়ির অংশ বিক্রি করে তার জমি ছাড়িয়ে দিবে বলে দিব্যি কেটে প্রতিজ্ঞা করে। এরপর অবশ্য মজিদ সাহেদাকে কঠিনভাবে শাসিয়ে জানিয়ে দেয় দেশে ফেরত এলে তাকে তালাক দিয়ে সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে!
মজিদের কথা শোনে সাহেদা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বাচ্চাগুলোর জন্যে তার মন সারাক্ষণ ছটফট করে। প্রতিদিন রাতে চারজন মানুষের অত্যাচার সইতে না পেরে প্রায়ই সে আত্নহননের পরিকল্পনা করে! কিন্তু অবুঝ সন্তান দুটোর চেহারা তাকে মরার মতো করে হলেও বেঁচে থাকতে প্রেরণা যোগায়। একসময় সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। হসপিটালে নিয়ে পেটের সন্তান খালাস করে আনা হয়! অত্যাচারের মাত্রা কমে না! একটা শরীর কতটুকু কুলাতে পারে! আবার সে গর্ভবতী হয়। এবং আবার! এরপর অবশ্য তাকে পাকাপোক্তভাবে সন্তান পেটে আসার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়!
মজিদের হাতে প্রতিমাসে অবাধে টাকা আসে। সাহেদা মাসের বেতন পুরোটা স্বামীর নামে পাঠিয়ে দেয়। মজিদের সংসারে আর অভাব নেই। বাজারের বড় মাছটি এখন তার বাড়িতে আসে! বন্ধকজমিটা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দু’চালা ঘুণে খাওয়া টিন-কাঠের ঘরটা এখন চৌচালা পাকাঘর হয় হয়ে উঠেছে! এলাকায় বিজলি বাতি নেই তারপরও অনেকে ব্যাটারি দিয়ে টেলিভিশন চালায়। মজিদের সাতজন্মের স্বপ্ন একখানা টেলিভিশনের তাও পূরণ হয়েছে। নিয়মিত সে তাসের আড্ডায় যায়। শুঁড়িপাড়ায় যাতায়াতও আগের মতো দেদারসে চলে! রাতে, নিষিদ্ধপাড়ায় যাতায়াত তাও থেমে নেই! পুরোপাঁচটা পূর্ণতার পরও মজিদের কিসের যেন তৃষ্ণা হয়! শরীরমনে সারাক্ষণ নাই নাই বোধ হয়! ঘরটা কেমন যেন অসামঞ্জস্য লাগে তবে সে শূন্যতা সাহেদার অনুপ্সহিতি’ নয়, তা সে অবশ্য স্পষ্ট টের পায়! এবং এই অচিন আক্ষেপ মেটাতে সে অল্প বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনে!
সাহেদা মজিদের বিয়ের খবর বিয়ের ছয় মাসের মাথায় পায়! সে ঘরে সন্তান আসে তার কাছে খবর যায়। স্বামীর বিয়ে কিংবা সন্তান এসব কোন বিষয়ে সাহেদার কোন অভিযোগ থাকে না! নিজের কোন সাধ আহ্লাদ নেই। ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন নেই! মনটা মরে গেছে। সাপের মতো নিজের খোলসটা বদলে ফেলেছে সে। যেন খোলসের ভিতরের মানুষটা সে নিজে নয়। নিজের মনকে কবর দেওয়া হয়ে গেছে স্বামীর প্রথম চিঠির পাওয়ার পরপরই। এখন সবকিছু তার কাছে আটপৌরে লাগে। স্বামীর বিষয়েও তার কোন আগ্রহ নেই। স্বামী সংসার বিষয়গুলো তাকে আর তাড়িত করে না। ভবিষ্যৎ কিংবা স্বপ্ন এসব অবান্তর লাগে। শুধু ছেলে দুটোর জন্য তার এই বেঁচে থাকা।
আট বছর পরে সাহেদা দেশে ফিরে আসে। দেশে পা রাখতে মনটা অতিরিক্ত অস্থির হয়ে ওঠে! এবং সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে নিজদেশ এবং দেশে রেখে যাওয়া দু’সন্তানের জন্যে এতদিনের উতলাভাবটা দেশে ফেরা মাত্র কোথায় যেন হারিয়ে গেল! মনে হয় যেন সে ভিনদেশে ভুল করে চলে এসেছে! এই দেশ কিংবা মানুষগুলো তার কাছের কেউ নয়! একবার কেউ বাড়ি ছাড়া হলে নির্জীব ঘরদোরও তাকে আর আপন করে নিতে পারে না! তার অস্তিত্ব গত আট বছরের অনুপস্থিতিতে সবাই ভুলে গেছে! নিজের করা হাড়িকুড়িকেও তার বড়ো অচনা লাগে। নিজের পেটের ছেলেরা দূর থেকে মাকে তাকিয়ে দেখে, মায়ের কাছে ঘেঁষতে হয়তো তারা শরমিন্দা হয়!
সাহেদা একবারে দেশে ফিরে এসেছে। ওদেশে সে আর ফিরবে না। এমন কথা শোনার পর থেকে মজিদ সাহেদার ধারের কাছেও ভিড়ছে না। যেটুকু সময় বাড়ি থাকে মুখটা আঁধার করে উঠোনের দক্ষিণকোণের আমগাছতলায় জলচৌকী পেতে বসে থাকে। তবে সাহেদার সতিন রেশমা বড় মিশুকপ্রকৃতির মেয়ে। মেয়েটি সেই শুরু থেকে তাকে বু বু করে আপন করে নিয়েছে। মেয়েটির ব্যবহার মিষ্ট চোখেমুখে মায়া খেলে যায়। সাহেদা তাকে ছোট বোনের মতো স্নেহে রেখেছে। গরীবের মেয়ে। ভাতকাপড়ের আশায় এমন শ্বাসেররোগী বাবার বয়সী লোককে বিয়ে করেছে। তার দোষ দিয়ে কী লাভ। বরং দোষ যা তা তার নিজের কপালের! সংসারটাকে বাঁচাতে গিয়ে সে সংসারের মানুষগুলোোকে হারিয়ে ফেলেছে! মানুষের মন, বড়ো শক্ত বিষয়! একবার সেখান থেকে উঠে গেলে পুনরায় সেস্থান ফেরত পাওয়া দুষ্কর! সে নিস্ফল চেষ্টা অবশ্য সাহেদা করে না। তাতে মঙ্গল তো নেই- ই উপরন্ত দুঃখের বোঝা শতগুণে বাড়বে!
মজিদ সাহেদার পাঠানো টাকা দেদারসে উড়িয়ে প্রায় শেষ করে ফেলেছে! এক বিঘা জমি সাহেদার জোরাজোরিতে কিনলে, গোপনে নিজ নামে দলিল করেছে! স্ত্রী একবারে দেশে চলে আসায় এখন রোজগারেরপথ একরকম প্রায় বন্ধ। সাহেদা বেশ কিছু টাকা গোপনে জমিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল। এবং দেশে ফিরে স্বামী সংসারের বেহাল দশায় একান্ত নিজের এবং সন্তানদের কথা মাথায় এনে বেশকিছু জমি নিজের নামে ক্রয় করে। মজিদের বারণ সত্বেও জীবনের প্রথম সে স্বামীর অবাধ্য হয়ে নিজের নামে সম্পদ করে। এমন ঘটনায় মজিদ ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মতো মেজাজী হয়ে ওঠে!। তার নামে এক বিঘা জমি আর এই বাড়িটা ছাড়া কিছু নেই। সম্পদ বেহাত এবং ভবিষ্যৎ দুর্ভাবনায় সে এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে রাতদিন এর একটি বিহিতের চিন্তা মাথায় বয়ে অস্থির হয়ে ঘুরে ফেরে! একসময় অবশ্য তার মাথায় আদিকালের সেই বুদ্ধি এসে চেপে বসে! অর্থাৎ সাহেদাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে সকল ঝুঁটঝামেলার যেমন আসান মিলবে বিষয়সম্পত্তিও নিজনামে চলে আসবে!
কিন্তু মজিদের একার পক্ষে কাজটা বেশ ভারী ঠেকছে! সে অনেক ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এবিষয়ে পরামর্শ করে। এটা ঠিক সে কাউকে বিশ্বাস করে না এমন কী নিজের উপরও তার বিশ্বাস নেই! সে চতুর প্রকৃতির লোক। পারতপক্ষে সে রেশমাকে আড়ালে রেখে একা কাজটি করতে চেয়েছে। একে তো মেয়েমানুষ তারওপর ওর মনটা আষাঢ়ে বৃষ্টিস্নাত বিকেলের মতো নরম সহজ সরল মমতায় পূর্ণ। নির্বোধ মেয়েমানুষ না হলে সতিনকে কেউ আপন বোনের স্থানে তুলে রাখে! কিন্তু ঘরের মানুষকে সরাতে ঘরের একান্ত বিশ্বাসী কেউ না হলে এমনতর কাজ একা সম্ভব নয়। ধরা পড়ার ভয় থেকে যায়। সে রেশমাকে অবশেষে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে রেশমা খুব সহজে রাজী হয়ে যায়! উপরন্ত কী কৌশলে সাহেদাকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে তেমন একটি নিছিদ্র পথও সে বাতলে দেয়! মজিদ তার এই অল্পবয়সী বউটির বুদ্ধিতে যারপরনাই বিস্মিত হয়!
সাহেদার চায়ের নেশা আছে। এমন সৌখিন স্বভাব অবশ্য তার আগে ছিল না! মরুদেশে গিয়ে তার এই আসক্তিতে ধরেছে। তবে তার নেশা সকলের মতো সকাল বিকাল কিংবা যখনতখন ধরে না, অদ্ভুত সময়কালে তার চায়ের নেশা পায়! যেমন দিনের বেলায় চারদিক কালো হয়ে আকাশে মেঘ জমলে কিংবা ভরসন্ধ্যায় হাওয়ায় দোলে দুনিয়া দুলে উঠতে সে যখন উঠোনে শীতলপাটি পেতে আয়োজন করে বসে চাঁদের স্বরূপ দেখবে বলে তখন তার তুমুল চায়ের তৃষ্ণা পায়! রেশমা তার সাহেদা বু’র আহ্লাদ আবদার বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকে। সে আকাশের কথা মতো আর কিছু না হোক অন্তত বুবুর চায়ের যোগারজন্ত প্রস্তুত রাখে। বুবু’র জন্যে আলাদা চায়ের মগ যত্ন করে তুলে রাখে। বুবু যখন সন্ধ্যাবেলায় বাইরবাড়িতে বসে কাঁসার থালার মতো চাঁদটার দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে কিংবা ভরদুপুরে আকাশ কালো করে মেঘের পাহাড় তাদের বাড়ির নামার খোলা মাঠের উপর আকাশটাতে ভিড় করে, বুবু ঘর হতে আলগা পায়ে মাঠে যেয়ে দাঁড়ায়! রেশমা তখন হাতের কাজ দূরে ঠেলে চুলায় চায়ের পাতিল বসিয়ে দেয়। বুবু’র মগটা বর্ষাকালের নদীটার মতো কানায় কানায় ভরে যতটুকু বাকি থাকে নিজের কাপে ঢালে। রেশমার চায়ের নেশা নেই। বুবু’র তাড়ায় নিজের সাথে জোরজবরদশ্তি করে দু’ এক চুমুক দিলেও পেট গুলিয়ে তা বেরিয়ে আসতে চায়। বুবু’ কালো তিতা চায়ের লিকারে জগতের কোন শান্তি খোঁজে পায় কে জানে অন্তত রেশমার কাছে সে হিসেব মিলে না!
মজিদ পাকা লোক! বাড়ি হতে বিশ মাইল দূরের শহর থেকে বিষ সংগ্রহ করে! স্থানীয় হাটবাজারে বিষের আকাল নেই কিন্তু সে তার কাজের কোনরকম প্রমান রাখবে না! শহুরে বিষের শিশিতে নাম লেখা থাকে। মজিদ পেপসি বোতলে বিষ ঢেলে বিষের খালিবোতল পাশের বাড়ির মজা পুকুরে রাতেদুপুরে ফেলে দিয়ে আসে। এবং রেশমাকে গোপনস্থানে পেপসি বোতল লুকিয়ে রাখতে বলে। প্রকৃতিতে বর্ষাকাল চলছে। আষাঢ় মাইসা চান্দের আলো মনের ভেতর জ্বালা ধরায়’ রেশমার বুবু’র কথা। বুবু চান্দের আলো দেখতে বাইরবাড়ির উঠোনে প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে। রেশমা চা নিয়ে বুবুর কাছ ঘেঁষে বসে এবং দু’জনে গল্প করে। কী মনে করে কে জানে আজকাল মজিদ মিয়াঁকেও তাদের সাথে দেখা যায়। কদিন ধরে মজিদ সন্ধ্যার আঁধার না জমতে বাড়ি ফিরে আসে। এমনিতে তার অভ্যাস বেশি রাতে বাড়ি ফেরা কিন্তু রেশমা খেয়াল করে দেখেছে বিষের শিশিটা ঘরে আসা মাত্র মজিদকে যেন বৈরাগ্যতে ধরেছে। চুপচাপ বসে থাকে আগের মতো অকারনে চেঁচামেচি করে না। বুবু’র ছায়া মাড়াত না অথচ এখন বুবু’র পাশ ছাড়ে না! রেশমা তাই এককাপ চায়ের পানি বেশি চড়িয়ে দেয় যাতে মজিদ তাদের সাথে বসতে পারে। মজিদ চায়ের কাপে মুখ রেখে গোপনে সাহেদার দিকে তাকিয়ে থাকে! মজিদ দুটানায় ভোগে! সাহেদার জন্যে মনের ভেতর মোচরে ওঠে। আগেরদিনের কথা মনে পড়ে। তখন রেশমার কোন অস্তিত্ব ছিল না সেই সময়ের কথা। এমন ভরা জোসনায় দু’জনে চাটাই পেতে ঠিক একই স্থানে বসে বসে কতো রাত পার করেছে। কতো কথা কতো গল্পে সময় গিয়েছে কেটে! সাহেদার জোসনা দেখার বাতিক তখনো ছিল! এর পর পর মজিদ অন্য মানুষ হয়ে যায়! চতুষ্পদী জন্তুর মতো লোভী হয়ে ওঠে সে! সাহেদাকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ দেখে না!
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা রাত। দু’দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে। সাঁজেরবেলায় বৃষ্টির আধিক্য আজ একটু কমলেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তার বিরাম নেই! সন্ধ্যা নামতে আকাশে ভারি ওজনের মেঘের আনাগোনা বেড়ে যায়। তবে চাঁদের খেলা থেমে থাকে না। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পরিপুষ্ট চাঁদ এই আসে এই যায়! সারাদিনের বৃষ্টিতে উঠোন চুপচুপা ভিজে বলে বুবু আজ খোলা দুয়ারে শীতলপাতি পেতে বসেছে। বুবু’র পাশে মজিদ বসে গল্প করছে। সাহেদা মজিদের সাথে পারতপক্ষে কথা বলে না অথবা একদম যা না বললেই নয় সেরূপ আলাপ করে। কথা যা বলার মজিদ একাই বলে যায়, সাহেদা আগবাড়িয়ে তার সাথে আলাপ পারে না। মজিদ আজ সারাদিনে একবারও বাড়ির বাইরে যায়নি। রেশমার সাথে দফায় দফায় গোপন পরামর্শ করেছে। আজ সন্ধ্যায় চায়ের কাপে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হবে সাহেদাকে! আজকের মতো মোক্ষম দিন হবার নয়। এমন অঝোর বৃষ্টির দিনে দুনিয়ার কোথায় কী ঘটে গেল নিদেনপক্ষে গাঁয়ের কেউ ঠিকঠাক খোঁজ নেবার অবকাশ পাবে না!
সন্ধ্যা নামতে রেশমা চুলায় চায়ের পানি বসায়। উনুনে জাল জ্বলে উঠতে উত্তরদিকের আকাশে ঘন ঘন বিজলিবাতি ঝলেসে ওঠে। ক্রমে ভারি মেঘে ঢেকে যায় রাতের আকাশ। চায়ের পানিতে বলক উঠে। উঠোনের পূবকোণার পাকঘর থেকে দুয়ারে বসা বুবুর মুখটি থেকে থেকে বিজলিবাতির আলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বুবু উদাস চোখে মেঘেঢাকা চাঁদের খোঁজে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে! রেশমা মোহগ্রস্ত হয়ে একমনে বুবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন মায়াময় মুখ সে আগে কখনো দেখেনি! সাক্ষাৎ দেবীর মতো লাগছে! মজিদ মেঘের গর্জনকে পেছনে ঠেলে উচ্চস্বরে চায়ের তাড়া দেয়! রেশমা গোপনে কায়দা করে মজিদের কাপে বিষ মিশিয়ে চায়ের কাপ তার দিকে এগিয়ে দেয়। এসময় আকাশ ভেঙ্গে ডলক নামে। শ্বাসরোগী মজিদ, বিষমরণের যন্ত্রণায় ছটফট করে! শ্রাবণ-ঢলকের সাথে উথালপাথাল বাজের তাণ্ডবে দুনিয়া কেঁপে ওঠে। এবং মজিদের নিস্পন্দদেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে!
**************************