মোস্তফা অভি
একটি বেড়াল ও রহস্যময় নারীর নীরব সমঝোতা
একদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে বিঘাই গ্রামের মানুষ জানতে পারে, গ্রামের বেড়ালগুলো বাড়ির আঙিনায় বুক চিতিয়ে মরে পড়ে আছে। ওগুলোর ফ্যাকাশে চোখ, পাথরের মত নিশ্চল দেহ। মনে হয় বেড়ালগুলো মৃত্যুর আগেই প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মের সাথে মানিয়ে নিয়ে পরাপারে পাড়ি জমিয়েছে।
যখন আমি গ্রামের অন্য বেড়ালগুলোর মৃতুর খবর পাই, আমি আমার পোষা বেড়াল থাম্বাকে খুঁজতে শুরু করলাম। বেড়ালের মহামারির খবর শুনে আমি গতরাতে থাম্বাকে একটা পুরনো খাঁচার ভেতর ভরে রেখেছিলাম। রাতে খাওয়ার জন্য দিয়েছিলাম আধাসেদ্ধ কয়েকটা মাছের টুকরা। অন্য যে কোনো দিনের তুলনায় ওর শরীরটা ছিল খারাপ। তাই সন্ধ্যার পর থেকেই থাম্বা মিউ মিউ করতে শুরু করেছিল। আমি থাম্বাকে খাঁচার ভেতর রাখার পর ওর মিউ মিউ আরো বেড়ে গেলো। যখন মধ্যরাত, আমি ওর কাতরস্বরে মিউ মিউ ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ওর খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলাম, যে মাছগুলো ওকে খাবার জন্য দেওয়া হয়েছিল, ওগুলো খাঁচার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চারপাশে পিঁপড়ে আর ছোট পোকামাকড়ের দীর্ঘ সারি। খাঁচার দরজাটা অনায়াসভাবে খোলা, তবে থাম্বার কোনো অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পেলাম না।
সকাল থেকে থাম্বাকে আমি পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করলাম। বাড়ির চারপাশ, পাইত্রার বন, রাস্তার ধারের কচুবন- যেখানে যেখানে থাকার সম্ভাবনা, সবখানে। দুপুরের দিকে আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পথে ফিরতে শুরু করলাম, তখন এক মধ্যবয়সী লোক থাম্বার কথা শুনে আমাকে বলল,
তুমি তোমার বেড়ালটা মানেরুদ্দিনের বাড়িতে খোঁজ করে দেখতে পারো।
মানেরুদ্দিনের বাড়ি, আমি কপাল কুঁচকে তাকে প্রশ্ন করলাম।
লোকটা নির্বিকারভারে উত্তর দিল, সেই বাড়িতে এক অল্পবয়সী বিধবা মহিলা থাকে, যার কাছে প্রতিদিন পুরো গ্রামের বেড়ালগুলো জড়ো হয়। আমি ঠিক জানিনা, বেড়ালগুলো কোন অজানা আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেয়েলোকটার কাছে চলে আসে আর সেখান থেকে বিকালের দিকে কেনই বা নিজ মনিবের বাড়িতে ফিরে যায়। গ্রামের অনেকের কাছে সেই বিধবা মোয়েলোকটা আশ্চর্য এক রহস্য বটে। এমনকি অনেকে তাকে বেড়ালের আধ্যাত্মিক মা বলেও অবহিত করে থাকে।
দুপুরের দিকে যখন আমি মানেরুদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, আমার মনে হল, বাড়িটা যেন সময়ের বাইরে এক স্থবির স্মৃতিস্তম্ভ। যেখানে নীরবতা এতটাই গাঢ় যে, বাতাসও ধুলো উড়িয়ে নিঃশব্দে চলে যায়। উঠোনজুড়ে শুকনো পাতার স্তূপ, যেন বহুদিন ধরে সেখানে কোনো পায়ের চিহ্ন পড়েনি। মেয়েলোকটার ঘরের জানালার আধখোলা পাল্লাগুলো বাতাসে হালকা করে কেঁপে ওঠে অথচ সেগুলো কখনোই আর পুরোপুরি বন্ধ হয়না। ছাদের টিনে বসে থাকা কাকগুলো অলস, স্থির। যেন তাদেরও অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বাড়িটার পাশেই এক পুরনো বদ্ধ খাল, সেখান থেকে অদৃশ্যে শোনা যায় গভীর নিঃসঙ্গতার শব্দ। একটা থমকে থাকা শূন্যতার ব্যথা, যা নিস্তব্ধতার ভারে বহু বছর ধরে ঢেকে আছে।
যে বিধবা মেয়েলোকটা সেখানে একা বসবাস করে, সাধারণত গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে পায়না। আর যারা দেখে, তারা বলে, মেয়েলোকটার একটাই কাজ, সে হারিয়ে যাওয়া বেড়ালদের খবর রাখে। কেউ কেউ বলে, রাতের গভীরে মেয়েলোকটাকে খালের ধারে বসে থাকতে দেখা যায়। খালের স্থির জলে চাঁদের ম্রিয়মাণ আলোয় তার ছায়া টলমল করে। বাতাসে মাঝে মাঝে তার ঘরের জানালার কপাট এমনভাবে কেঁপে ওঠে, যেন কোনো পুরনো আত্মা বহুদিন ধরে কোনো কথা মানুষের কাছে বলতে চাইছে। তবে আত্মার প্রাণহীন অস্তিত্বের কারণে কথাগুলো বেরিয়ে আসতে পারছে না। বাড়ির উঠোনে দুটো রাতা মোরগ ধীর গতিতে হাঁটছে, যেন তাদের ঠোঁটের নিচে জমে থাকা রক্তের দাগের মত লাল দাগ লুকোতে চায়। মেহগিনি গাছের ছায়ায় একটা বকরি বাঁধা, সেটা তার গলায় পরানো দড়ির সাথে মুখ ঘষছে। আর মাঝে মাঝে এমন এক অদ্ভুত শব্দ করছে, যেন সেটা তার বন্দিত্বের দীর্ঘশ্বাস।
আমি যখন বাড়ির পেছন দিকটায় গেলাম, দেখলাম, বিশালদেহী এক মেয়েলোক বসে আছে সেখানে। শরীরে কাপড় চোপড়ের বালাই নেই। তার বেঢপ স্তনদুটো প্রায় অনাবৃত হয়ে দুপুরের ঝা ঝা আলোয় চকচক করছে। আর তার শরীর থেকে একধরনের গাঢ় উষ্ণতা বেরিয়ে আসছে আমার চোখের দিকে। যা বাতাসে মিশে গিয়ে চারপাশের পাতায় এক অজানা কাঁপুনি ধরাচ্ছে। মেয়েলোকটা আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলল, įতুমি কি তোমার হারিয়ে যাওয়া বেড়াল খুঁজতে এসেছ?”
আমি তার দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
মেয়েলোকটা ঝিমিয়ে পড়া একজন মানুষের ভঙ্গিতে বলল, হয়তো তোমার বেড়ালটা এখানে এসেছে তবে নিশ্চয়ই ও কোনো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। তুমি কি তোমার বেড়ালের জন্য অপেক্ষা করতে চাও ?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়েলোকটাকে জিগ্যেস করলাম, এই যে আপনার এতগুলো বেড়াল, এরা আসলে কোথা থেকে আপনার কাছে আসে?
ঠোঁট বাঁকা করে হাসল মেয়েলোকটা, তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত টান- ওরা নিজে থেকেই আসে। কিছু কিছু চলে যায়, আবার কিছু বেড়াল চিরদিনের জন্য এখানেই থেকে যায়।
আমি মেয়েলোকটার অদ্ভুত আর রহস্যময় কথার মর্মার্থ কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলাম না। আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, থাম্বা কি এখানে ফিরে আসবে?
-যদি ওর ইচ্ছে হয়, তাহলে আসবে। আর যদি ওর ইচ্ছে না হয়, এমন কোথাও চলে যাবে, যেখানে গেলে ওকে আর তুমি কখনোই খুঁজে আনতে পারবে না।
আমি হতাশ হয়ে মেয়েলোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
থাম্বার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো। মেয়েলোকটা আমাকে বলল, নিরামিষ বসে না থেকে আমি যেনো দুপুরের খাবারটা তার সাথে খাই। যদিও তার বাড়িতে খাবার খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, তবুও নতুন কোনো অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশে আমি তার সাথে খেতে বসলাম। কারণ আমি এটা চাই, মেয়েলোকটার সুমতির কারণে জীবিত থাম্বাকে নিয়ে যেনো সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারি। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মেয়েলোকটা আমার চোখ বরারবর তার চোখদুটো স্থির রেখে বলল, įএখন চাইলে তুমি একটু ঘুমিয়ে নিতে পারো। আমি তোমার বেড়ালের জন্য অপেক্ষা করছি।”
প্রথমে আমি খানিক্ষণ ইতস্তত করলাম। কেননা, আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, এই অচেনা বাড়িতে, এই অদ্ভুত নারীর বিছানায় ঘুমিয়ে পড়া আমার জন্য সমীচীন কি না! ক্লান্ত শরীর আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। মেয়েলোকটা তার কাঁচা মেঝের দিকে দেখিয়ে বলল, একটাই বিছানা। তুমি চাইলে এখানেই ঘুমিয়ে পড়তে পারো।
আমি তাকে আর কিছু বললাম না। শুয়ে পড়ার খানিক পরেই চোখের দুটো পাতা এক হয়ে গেলো। আর আমি কিছু সময়ের ভেতরেই সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম।
বিকালের দিকে কোনো এক নরম স্পর্শে আমার চেতনা ফিরে এল। আমি চোখ খুলে দেখি, মেয়েলোকটা আমার পাশেই বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। তার প্রায় অনাবৃত বুকের কাছাকাছি চুপটি করে বসে আছে আমার বেড়াল থাম্বা।
আমি থাম্বার দিকে তাকিয়ে চোখদুটো খানিক্ষণ পিটপিট করলাম।
আমি মনে মনে ভাবলাম, থাম্বা কি সত্যিই এখানে! নাকি আমি এখনো ঘুমের ঘোরের ভেতর আটকে ভুলভাল কিছু দেখছি। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। মেয়েলোকটা হঠাৎ আমার কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, তোমার বেড়াল ফিরে এসেছে সত্য তবে ও এখন আর আগের মত নেই। তোমার সামনে পুরোপুরি বদলে যাওয়া এক থাম্বাকে তুমি দেখছ।
আমি বেঢপ মেয়েলোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর প্রায় অস্ফুট শব্দে তাকে বললাম, মানে?
মেয়েলোকটা তার চোখদুটো বন্ধ অবস্থাই উত্তর দিল, তোমার বেড়াল এখন আমাদেরই একজন।
থাম্বা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখের ভেতরে সেই পুরনো অনুসন্ধিৎসা। মেয়েলোকটা আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে জীর্ণ বিছানা থেকে উঠে বসলাম কিন্তু আমার শরীরে যেন আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। চোখ তুলে দেখি, জানালার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকালের আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গুঞ্জনে মিশে আছে তান্ত্রিকের মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। জলে ডুবিয়ে রাখা কাঠের গন্ধের মত একটা পরিচিত গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অথচ সেই ভেজা কাঠের উৎস আমি কোথাও খুঁজে পেলাম না। চারপাশের দৃশ্য দেখে মনে হল, পুরো ঘরটাই যেন এক রহস্যময় ঘোরের মধ্যে চিরদিনের জন্য ডুবে গেছে।
আমি থাম্বাকে কোলে তুলে নিলাম। বেড়ালটা কোনো প্রতিবাদ করল না। শুধু ওর রহস্যময় চোখদুটো দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই চোখের গভীরে কি এক শীতল দৃষ্টি, বহুদিনের চেনা বেড়ালটাকে আমার কাছে অচেনা মনে হতে লাগল। যখন আমি দরজা খুলে বাইরের দিকে পা রাখলাম, চারদিক নিস্তব্ধতা দেখে আমার মনে হল, অদৃশ্য কেউ একজন আমাকে অনুসরণ করছে। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েলোকটা এখনো একইভাবে ঘুমিয়ে আছে। তার শরীর থেকে এক অদ্ভুত রহস্যময় শীতলতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে মিশে আছে চাপা ফিসফিস শব্দ, মনে হল, দূর থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে।
সেই রাতে বাড়ি ফিরে আমার মনে হল, এটা কি সত্যিই আমার বেড়াল থাম্বা! অথচ সেই প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই আমি খুঁজে পেলাম না। যখন আমি মাঝরাতে জেগে থাম্বার থাকার জায়গার দিকে মুখ ফেরাই, তখন জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসে ওর অচেনা চোখের দৃষ্টি। আমি ঘুমের ভেতর অনুভব করি, থাম্বা ওর শীতল, নরম থাবা আমার গালে বুলিয়ে যাচ্ছে। খখনো মনে হয় সেটা থাম্বার কোনো স্পর্শ নয় বরং এক জ্যান্ত, উষ্ণ, পেলব কোনো স্পর্শ। যা হিমে-ঢাকা অথচ মাংসল, যেন কোনো অচেনা অস্তিত্বের স্নেহ-মাখানো হাত আমার চোখ-মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, সেটা সেই বেঢপ মেয়েলোকটারই স্পর্শ। তার শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া এক আশ্চর্য উষ্ণতা আমার গালের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটা চাপা শিরশিরানি আমার স্নায়ুর ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে থাকে। আমি অনুভব করি, বেঢপ মেয়েলোকটার স্তনের গাঢ় পেলবতা আমার চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে আর আমি কোনো ধূসর স্বপ্নের গভীরে ডুবে যাচ্ছি। যেখানে মেয়েলোকটা আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস, তার শরীরের ভার, সবকিছু আমাকে কোনো গভীর রহস্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
*************************