বিচিত্রা সেন
অন্তরে তার ডাক পাঠাবো
১**নিপুর কথা
রাকিবের কাছ থেকে খবরটা শুনে চমকে উঠলাম। রাকিব অবশ্য খবরটা দেওয়ার সময় ইতস্তত করছিল। সে বুঝতে পারছিল না খবরটা আমাকে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। এই দ্বিধার নেপথ্যে দুটো কারণ থাকতে পারে। ১. লাবণীকে আমি মনে রেখেছি কিনা ২. লাবণীর এমন অবস্থা আমি মেনে নিতে পারবো কিনা। আসলে রাকিব তো জানে না,আমার মনে আমি কী রেখেছি। সেদিন ওর সাথেই দেখা হলো প্রায় পাঁচ বছর পর। গণি বেকারির মোড়ে ওকে যখন দেখলাম আমিই ওকে ডাক দিয়েছিলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমি ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
-নিপু ভাই,তুমি দেশে আসলে কবে?
আমি হেসে বললাম,
-একমাস তো হয়ে গেলো।
এ কথা সে কথার পর ও একটু আমতা আমতা করে বললো,
-নিপু ভাই,লাবণী আপুর খবর জানো?
নামটা শোনার সাথে সাথে বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠলো। যেন অনেক উপর থেকে আমি খাদে পড়ে যাচ্ছি। নিজের অজান্তেই হয়তো বা মুখে তার ছাপ পড়েছিল। রাকিব আবারও ইতস্তত করে বললো,
-তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা,বুঝতে পারছি না।
আমি যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম,
-না না বলো। লাবণীর কী হয়েছে?
ও বললো,
-লাবণী আপু তো আইসিইউতে। খুব খারাপ অবস্থা নাকি।
ওই যে মনে হয়েছিল আমি উপর থেকে পড়ে যাচ্ছি,এবার মনে হলো আমি পাহাড়ের চূড়া থেকে গভীর খাদে পড়েই গেলাম। উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চাইলাম,
-কোন হাসপাতালে? কী হয়েছিল ওর?
রাকিব শান্ত স্বরে বললো,
-হার্টে নাকি মারাত্মক প্রবলেম। এর আগেও অ্যাটাক হয়েছে দুবার। পার্কভিউতে আছে।
কোনোরকমে ওর সাথে কথা শেষ করে বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে একা বসে আছি। প্রথমে ভেবেছিলাম পার্কভিউতে গিয়ে লাবণীকে একবার দেখে আসবো। পরে ভাবলাম ওখানে নিশ্চয় ওর মা বোনরা থাকবে। আমাকে ওরা কিছুতেই লাবণীর কাছে যেতে দেবে না৷ তাছাড়া ওর হাজবেন্ড থাকলেও জটিলতা বাড়বে। সেই থেকে খুব কষ্ট পাচ্ছি। বুকটা মনে হচ্ছে ব্যথা আর নিতে পারছে না। মনে পড়ছে এক এক করে সব স্মৃতি। লাবণী… আমার লাবণী… গত পাঁচটি বছর এ নামটি আমাকে ঘুমের মধ্যেও অঝোরে কাঁদিয়েছে। বাঁচা আর মরার মাঝামাঝি দুলেছি শুধু এ নামটির কারণে। কতবার মরতে চেয়েও বেঁচে গেছি শুধু ওকে আরেকবার দেখবো বলে। আবার বার বার দেশে ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারিনি শুধু ওকে দেখবো না বলে। আমার সেই লাবণী আজ আইসিইউতে পড়ে আছে? দুলছে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে? হায়,লাবণী!
লাবনীকে আমি প্রথম দেখেছিলাম কলেজে। আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল সে। মেয়েদের দিকে তাকানোর মতো সময় আমার ছিল না। ফুটবল আর গান ছিল আমার নেশা। আমরা থাকতাম শহরতলীতে। ওখানকার সবচেয়ে বড় কলেজটাতেই পড়তাম আমরা। নিয়মিত শহরে যেতাম। প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলতাম। আর কলেজের প্রতিটি প্রোগ্রামে গাইতাম। রাজনীতির পোকাও ঢুকেছিল মাথায়। একসাথে এতকিছু করতে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। কিন্তু মেয়েরা যে আমাকে খুব পছন্দ করতো সেটা বুঝতে পারতাম। আমাকে ক্যাম্পাসে পেলেই ওরা নিপু ভাই নিপু ভাই বলে ঘিরে ধরতো। আমি কথা বলতাম ঠিকই,কিন্তু কাউকে মনের দরজা খুলে দিইনি। হঠাৎ করেই একদিন লাবণীকে দেখলাম। কয়েকজন বান্ধবীর সাথে হেঁটে যাচ্ছে। শান্ত,স্নিগ্ধ, মিষ্টি একটা মুখ আমাকে কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন করে দিলো। আমি পলকহীনভাবে ওকে দেখছিলাম,আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার তাকানোটা এমনই ছিল বন্ধুদের চোখে ধরা পড়ে গেলাম ঠিকই। রাজু কানের কাছে মুখ এনে বললো,
-মেয়েটা ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। নাম লাবণী। খুব ভালো মেয়ে।
এত সুন্দর নাম! এ মেয়ের নাম তো এমনই হওয়ার কথা। যে চারপাশে লাবণ্য ছড়িয়ে যায়,তার নাম তো লাবণীই হবে। বন্ধুদের বললাম,
-বিয়ে করলে ওকেই করবো। ওর দিকে কেউ চোখ দিবি না। ও শুধু আমার।
বন্ধুদের তো বললাম এ কথা,কিন্তু আমি তো মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। বিয়েশাদী তো বহুত দূর। তাছাড়া আমি মেতে থাকি ফুটবল,গান আর রাজনীতি নিয়ে। ও কি আমাকে মেনে নেবে? তাছাড়া শুধু প্রেম করলে তো হবে না,বিয়ের জন্য যোগ্যও তো হতে হবে৷ ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলাম। কেমন করে যে কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না,তবে লাবণীকে আমার চাই-ই চাই। এ মুহূর্তে যদি প্রপোজ করে প্রত্যাখ্যাত হই,সে ভয়ে ওকে সরাসরি প্রপোজ করার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম। ভাবলাম,ওকে আমি অন্তর দিয়েই ডাকবো। যদি আমার ভালোবাসা সত্যি হয়,তবে ওর অন্তরে আমার ডাক পৌঁছাবেই। আমি ওকে অনুসরণ করতে লাগলাম। তবে ওর সামনে যেতাম না। হয়তো ও বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, আমি ইচ্ছে করেই ওদের পাশ দিয়ে একবার হেঁটে যেতাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম ও লাজুক চোখে আমাকে এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। আমার মন বলতো ওর চোখ আমাতে সমর্পিত,তবু কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। একদিন দেখলাম ও একা সদ্য প্রকাশিত দেয়ালিকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, আজকে অন্তত সরাসরি ওর সাথে কথা বলি। এগিয়ে গেলাম। ও আমাকে দেখে চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি দেয়ালিকায় চোখ রাখলাম। দেখলাম,ঠিক মধ্যখানে ওর লেখা কবিতা জ্বলজ্বল করছে। পড়ে মুগ্ধ হলাম,বললাম,
-বাহ্! কবিতাটা তো চমৎকার।
ওর মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। এত সুন্দর লাগছিল ওকে, কিন্তু আর কিছুই বলতে পারলাম না। মনে হলো এখনো সে সময় আসেনি। আরও সময় দিতে হবে লাবণীকে। আমার ডাক ওর অন্তরে পৌঁছালে ওই বলবে আমাকে। আমি ততদিন অপেক্ষা করি। আমি সরে আসলাম ওখান থেকে। কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বন্ধুদের আড্ডায় কামাল বললো,
-কী রে! তোর অবস্থা তো কিছু বুঝতে পারছি না। লাবণীকে বউ বানাবি ঠিক করে রেখেছিস,অথচ ওকে কিছু জানতে দিচ্ছিস না। এটা আবার কেমন ধরনের ভালোবাসা?
রাজু বললো,
-ও জীবনেও এ সাহস করতে পারবে না। যা করার আমাদেরই করতে হবে।
আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম,
-না না তোরা কিছু করিস না। যা করার আমিই করবো।
ওরা কিছু করতো না ঠিকই, তবে একটা কাজ করতো। এতে অবশ্য আমার লাভই হয়েছিল। ওরা চলার পথে লাবণীকে শুনিয়ে বলতো,
-এই খবরদার,ওর দিকে কেউ তাকাবি না। ও আমাদের নিপুর চয়েস।
এটা আমি পরে শুনেছিলাম লাবণীর কাছ থেকে।
বলবো বলবো করে আমি কিছুতেই বলতে পারছিলাম না আমার ভালোবাসার কথা। শুধু অপেক্ষা করছিলাম কবে ওর অন্তরে আমার ডাক পৌঁছায় তার জন্য। কীভাবে এ ডাক পৌঁছাবে আমি জানি না,তবে আমার মন বলছিল লাবণী ঠিকই বুঝবে। অবশেষে সেই দিনটি এলো।
শহরে পরপর কয়েকটা ম্যাচ খেলে বাড়ি এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কলেজে যাওয়ার উপায় নেই। এতদিন যে লাবণীকে দূর থেকে দেখতাম, তাতে আমার অন্তর কতটা শান্তি পেতো তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম। ওকে না দেখে বেঁচে থাকা আমার দায় হলো। জ্বরের ঘোরে বিরহকাতর মনের কথাগুলো লিখে রাখছিলাম ডায়েরিতে। কথাগুলো যেহেতু কখনো বলতে পারিনি,তাই ডায়েরির পাতায় মূর্ত হয়ে উঠছিল। প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এখনো শরীর খুব দুর্বল। হঠাৎ এক বিকেলে লাবণীর বান্ধবী জবা এসে হাজির। আমি তো ওকে দেখে হতবাক। ও
বললো,
-নিপু ভাই,কেমন আছেন? আপনার জন্য যে কেউ এতটা উতলা হতে পারে তা তো আমাদের জানা ছিল না। পাগল বানিয়ে ফেললো একেবারে ।
আমি হেসে বললাম,
-আমার তো জ্বর। তো আমার জন্য কে এমন উতলা হলো?
জবা বললো,
-কে আবার! আপনার প্রণয়িনী।
বুকের ভেতর আবার তোলপাড় শব্দ। মনে হচ্ছে সাঁওতাল পল্লীতে বিরামহীন মাদল বাজছে। আমার প্রণয়িনী! আহা,কী মধুর শব্দ। সত্যি তো, আমার লাবণী আমার প্রণয়িনীই তো। যদিও মুখ ফুটে এখনো কেউ কাউকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটি বলিনি। তবুও আমাদের মধ্যে যে যুগ যুগান্তরের প্রণয়। ও আমার জন্য বান্ধবীদের পাগল বানিয়ে ফেলছে? আমি সত্যি শুনছি তো? বললাম,
-কার কথা বলছো?
জবা ভ্রু নাচিয়ে, চোখ পাকিয়ে বললো,
-ইশ,ঢং! কে আবার? আপনার লাবণী। কলেজের সবাই জানে,আর উনি জানেন না!
আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম৷ যাক,তাহলে আমার অন্তরের ডাক লাবণীর অন্তর শুনতে পেয়েছে। ‘ভালোবাসি’ শব্দটি না বলেও ওকে ভালোবাসার কথা জানাতে পেরেছি। এবার তাহলে মুখে জানাবার সময় হয়েছে। জবাকে বললাম,
-তোমার বান্ধবীকে বলো, জ্বর ভালো হলে আমি আবার কলেজে আসবো।
একবার ভাবলাম ডায়েরিটা জবাকে দিয়ে লাবণীর কাছে পাঠিয়ে দিই। আবার ভাবলাম,না এটা ঠিক হবে না। জবা ঠিকই সবাইকে এটা দেখাবে৷ জনে জনে পড়বে এ ডায়েরি। আমাদের দুজনার বলতে আলাদা কিছু থাকবে না। সে চিন্তা বাদ দিলাম,তবে ডায়েরিটা আমি ঠিকই পাঠিয়েছিলাম লাবণীর কাছে।জবাকে দিয়ে নয়, আমার ছোটভাইকে দিয়ে। ও ছিল খুব বিশ্বস্ত, আর লাবণীর প্রতি আমার আগ্রহের কথা সে কলেজেই জেনেছিল। এখনো মাঝে মাঝে ভাবি,কী অদ্ভুত, তাই না? আমরা দুজন কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলার আগে পুরো কলেজ জেনে গিয়েছিল আমরা দুজন দুজনার। ডায়েরি পড়েই লাবণী প্রথম আমার সব অনুভূতি জানতে পেরেছিল। এখন মনে হয় লাবণী যদি সেদিন জবাকে আমাদের বাড়িতে না পাঠাতো আমি হয়তো কখনো তাকে আমার মনের কথাগুলো এমন উজাড় করে বলতে পারতাম না। জ্বরটাকে সেসময় আমার কাছে বিধাতার আশীর্বাদই মনে হয়েছিল।
২** লাবণীর কথা
সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম,হঠাৎ দীপু এসে সামনে হাজির। ছেলেটাকে চিনি,নিপুর ভাই। আমাদের ব্যাচের,তবে কখনো কথা হয়নি৷ আজ সামনে এসে সালাম দিয়ে বললো,
-এটা একটা ভীতু ছেলে আপনাকে দিয়েছে। ছেলেটা খুব জ্বরে ভুগছে। দোয়া করবেন। ভীতু ছেলেটা আমার ভাই। ভাইয়া বলেছে,ডায়েরিটা পড়ে আপনার অনুভূতি জানাতে।
আমি ভয়ে ভয়ে চারপাশে চোখ বুলালাম। না,কারো চোখ এদিকে নেই। আমি দ্রুত ডায়েরিটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। বুকটা এত কাঁপছিল দীপুকে কিছু বলতে পারিনি। শুধু মনে হলো,এ কেমন ছেলে রে বাবা! প্রেমপত্রের বদলে পুরো একটা ডায়েরি দিয়ে দিলো? বাড়িতে এসে ডায়েরিটা আলমারিতে জামাকাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখলাম। মায়ের চোখে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার তিন বছরের বড় বোন নিজের পছন্দে বিয়ে করাতে মা খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমার বেলায় মা আর কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাই সবসময় চোখে চোখে রাখেন। ভাইয়াও সবসময় অতন্দ্র প্রহরী। তাই নিপুকে আমার যত ভালোই লাগুক এ মুহূর্তে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। রাতে সবাই খেয়ে যখন শুয়ে পড়লো আমি আস্তে আস্তে উঠে আলমারি থেকে ডায়েরিটা বের করলাম। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা “ভালোবাসি”। এরপর পাতায় পাতায় শুধু আমার নাম,আর আমাকে ঘিরে নিপুর স্বপ্নের বিবরণ। আমাকে কখন কোথায় দেখেছে,আমাকে নিয়ে কখন কী করবে তার আবেগময় বর্ণনা। এক জায়গায় লেখা-
“জবার কাছে যখন শুনলাম,তুমি আমাকে নিয়ে ভাবছো,আমি হয়ে গেলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষদের একজন।”
আরেক পাতায় লেখা…
সবাই বলেছে তোমাকে সরাসরি প্রপোজ করতে, আমি ভেবেছি-
“… পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাবো, আনবো ডেকে…
ডাকবো না, ডাকবো না।অমন করে বাইরে থেকে ডাকবো না……”
তারপর আরো ২/৩ পৃষ্ঠা পরে লেখা
” এ্যাই মেয়ে! তুমি এতো গম্ভীর ক্যানো? গাছ পাথর একটা!! আমার ভয় লাগে তোমাকে!! সত্যি বলছি,ভয়ে কোনদিন সরাসরি বলতে পারিনি- ” ভালোবাসি”…
একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় লেখা –
We Must Love
One Another
Or Die…
শেষের এই প্রমিজটাতে এসে আমার কেন যেন খুব কান্না পেলো। অনেকক্ষণ বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। এত ভালোবাসে আমাকে ও? অথচ কখনো মুখ ফুটে একটি কথাও বলেনি। কেন বলেনি সেটারও ব্যাখ্যা আছে ডায়েরিতে। সে আমাকে বিয়ের মাধ্যমে একেবারে পেতে চায়। তার আগে সে আমার কাছে আসতে চায় না। তবে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। আর তার মাধ্যম হবে চিঠি। এত ভালো লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল এমন ছেলের জন্য আমি ডুবে মরতেও রাজি। খুব নিঃশব্দে ডায়েরিটি আবার আলমারিতে রেখে চিঠি লিখতে বসলাম। ভয় লাগছিল এই ভেবে যে যদি আমার ঘরে আলো দেখে মা আবার দেখতে আসে। ভাগ্য আমার সহায় হলো,কেউ এলো না। মনের সব আকুতি ঢেলে দিলাম চিঠিতে। আমার মনে যে এত কথা জমানো ছিল তা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। চিঠি শেষ করে দেখলাম সাত পৃষ্ঠা মাত্র! পরদিন এই চিঠি দীপুর হাতে দিয়ে বললাম,
–কেউ যেন জানতে না পারে।
সত্যি কেউ জানতে পারেনি। কয়মাস পরে নিপু এইচএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। এখন আর আগের মতো ওকে দেখতে পাই না,তাতে কী? আমাদের কথা তো হয় নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে। মাঝে মাঝে ও আমাদের কলেজে আসে। রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলতে আসা,কিন্তু ঠিকই কোনো এক ছুতোয় আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। একবার কলেজের ফাংশানে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে গাইলো “কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে”। খুব ইচ্ছে করতো তার পিঠে হেলান দিয়ে বসে গল্প করি,কিন্তু সাহস হতো না। সেও কখনো চায়নি তার সাথে আমি কোথাও যাই। একবার চিঠিতে লিখেছিলাম,”তোমার ইচ্ছে করে না আমাকে নিয়ে ঘুরতে?” জবাবে সে লিখেছিল,”না,এখন সেসব আমি করবো না। বিয়ের আগে আমি তোমাকে কখনো স্পর্শ করবো না। আমি চাই তোমাকে বউ হিসেবে পেতে। বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে আমি এত ঘুরবো যে, তুমি হাঁপিয়ে উঠবে। আমরা কিন্তু এ শহরতলীতেই থাকবো৷ শহরে যাবো বেড়াতে,কিন্তু একেবারে থাকবো না। যখন জোছনায় আমাদের বাড়ি ভেসে যাবে,তখন আমরা দুজন উঠোনে নেমে জোছনায় গোসল করবো।”
এভাবে আমরা দুজন দুজনকে দুজনের স্বপ্নের কথা জানাতাম৷ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমরা স্বামী-স্ত্রী। শুধু ও মাস্টার্স করলেই সামাজিকভাবে আমাদের বিয়েটা হবে। একসময় আমিও এইচএসসি পাশ করে সরকারি মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। হায়! এরপরই শুরু হলো উৎপাত। ঘটকের আনাগোনা বেড়ে গেলো বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনরাও মাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। সবার এক কথা এই বয়সে বিয়ে না দিলে ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না। একে তো বাবা নেই,তার ওপর বয়স হয়ে গেলে মেয়েদের আর লাবণ্য থাকে না। চতুর্মুখী চাপে আমি দিশাহারা হয়ে পড়লাম। চিঠিতে ওকে সব জানালাম। পরের সপ্তাহে ও এক কাণ্ড করে বসলো। বড় বোনকে নিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতে। ভয়ে আমি সামনে গেলাম না। ওর বড়বোন মায়ের কাছে হাতজোড় করে ভাইয়ের জন্য একবছর সময় চাইলো। মা চুপ থাকলেন। ওরা চলে গেলে মা আর ভাইয়া আমার রুমে আসলেন। মা বললেন,
-যে স্বপ্ন তুমি দেখছো,তা কোনোদিন পূরণ হবে না৷ আমি ওই ছেলেকে কখনো জামাতা হিসেবে মেনে নেবো না৷ কাল থেকে তোমার কলেজে যাওয়া বন্ধ।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া বললো,
-আম্মার মতই আমার মত।
আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবলাম,ওর সাথে পালিয়ে যাই। কিন্তু ওকে তো সে কথা জানাতে হবে৷ কীভাবে জানাবো সেটা? আমি তো নজরবন্দি। ঘর থেকে বেরুতে না পারলে চিঠি পোস্ট করবো কীভাবে? কয়েকটা দিন কীভাবে গেলো আমি নিজেই জানি না। আমি খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কোনো লাভ হলো না। মা আমাকে একবারও খেতে ডাকলেন না। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নিজেই আবার খাওয়া শুরু করলাম। ওর কোনো চিঠি পাচ্ছি না। নিশ্চয় মা কিংবা ভাইয়া ডাকপিওনকে আমাদের বাড়ি আসতে নিষেধ করেছে। একবার যদি ওদের বাড়ি যেতে পারতাম। কিন্তু মা আমাকে ঘর থেকে বেরুতেই দিচ্ছেন না। ওকে ছাড়া তো আমার বাঁচা সম্ভব নয়। ইচ্ছে করছে মরে যেতে,কিন্তু আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার নেই। সারাদিন শুধু কাঁদতাম,আর আল্লাহর কাছে বিচার দিতাম। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি,শুধু দুজন দুজনকে ভালোবেসেছি। তাহলে কেন আমাদেরকে এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে? এর মধ্যে আমার কোনো বান্ধবীও এলো না। বুঝলাম,মা কাউকে আমার সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। এমন দমবন্ধ মুহূর্তে মৃত্যুকে যেন অনুভব করছিলাম। দিনের পর দিন যেতে যেতে কখন একমাস পার হয়ে গেলো জানি না। তখন আর আমি সময়ের হিসাব করি না। ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে দিন রাত্রি সব সমান হয়ে গেছে আমার কাছে। কারো সাথে কথা বলি না। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ওর চিঠিগুলো পড়ি। ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে রাখি। কানের কাছে শুধু বাজতে থাকে -We Must Love One Another
Or Die….। হঠাৎ একদিন আমার দরজায় করাঘাত,মা ডাকছেন। এমন কণ্ঠ কবে শুনেছিলাম আমার মনে নেই। খুব আদর করে মা আমাকে ডাকছেন,
–লাবু… লাবু… দরজা খোল,দেখ,কে এসেছে?
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। কে এসেছে? মা আমাকে এমন নরম কণ্ঠে ডাকছেন কেন? ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। জবাকে দেখে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সত্যি ও এসেছে? নাকি আমার ভুল হচ্ছে? জবা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
-কী অবস্থা হয়েছে তোর?
আমাকে জড়িয়ে ধরে ও খাটে বসালো। মা সরে গেলেন। আমি জবার কোলে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছিলাম। ও আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
-তোর জন্য এমন জিনিস এনেছি,তুই এখন কান্না ভুলে হাহা করে হাসবি।
আমি মাথা তুলে ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। ও চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-নিপু ভাই চিঠি পাঠিয়েছে। পড়ে দেখ।
বলে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিলো। কিন্তু এ কী! এটা তো বিদেশি খাম। নিপু কোথায় আছে? আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম,
-বিদেশি খাম কেন? নিপু কোথায়? জবা ফিসফিস করে বললো,
-উনি তো কাতার চলে গেছেন? তুই কিছু জানিস না?
আমি হতবাক হয়ে জবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এসব কী বলছে ও? নিপু আমাকে ফেলে বিদেশ যাবে কেন? আমি এখন কী করবো? নিপুকে ছাড়া আমি লড়াইটা করবো কীভাবে? মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। আমি জবার কোলেই ঢলে পড়লাম। যখন চোখ মেললাম,দেখলাম জবা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। ওর চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। আস্তে আস্তে আমি উঠে বসলাম। চিঠিটা বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখলাম৷ রাতে পড়বো ঠাণ্ডা মাথায়। চা নাস্তা খেয়ে জবা বিদায় নিলো। মায়ের ব্যবহার পাল্টে গেছে৷ খুব মায়া দিয়ে কথা বলছেন। বুঝলাম,তিনিও জেনে গেছেন নিপু দেশে নেই। আমার মাথাটা কেমন শূন্য হয়ে গেছে। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো চলছি। মাথার ভেতর শুধু দুটো শব্দই ঘুরছে… নিপু নেই… নিপু নেই…। চিঠিটা না পড়া পর্যন্ত বুঝতে পারছি না নিপু এভাবে পালালো কেন? আমি এখন কার কাছে যাবো? কে আমার নিপুকে আমার কাছে এনে দেবে? ভালো করে হাঁটতেও পারছি না। নিপু… তুমি আমাকে রেখে এভাবে পালালে কেন? পালাবেই যদি,তাহলে আমাকে এত স্বপ্ন দেখিয়েছিলে কেন?
বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। একটু যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতাাম। বুকে এত ব্যথা কেন? দম নিতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমি কি মারা যাচ্ছি? লাবু… লাবু… খেতে আয়… মা ডাকছেন। কতদিন পর মা আমাকে তাঁদের সাথে খেতে ডাকলেন। এতদিন আমি নিজেরটা নিজের মতো করে খেয়ে নিতাম। আজ বুকভাঙা কষ্ট নিয়ে মা, ভাইয়ার সাথে খেলাম। খাওয়ার পর নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। তারপর বিছানার নিচ থেকে চিঠিটা বের করে খুললাম। আহ! জ্বালা… ঝাপসা চোখে একটা অক্ষরও তো দেখতে পাচ্ছি না। এত জল চোখে লুকানো ছিল? ওড়না দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে পড়তে লাগলাম। নিপু লিখেছে,
আমার ময়না,বুলবুলি,লাবণী,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমাকে না জানিয়ে কাতার আসার জন্য। আমি জানি,তুমি জানলে কখনো আমাকে এতদূরে আসতে দিতে না। কী করবো বলো জানপাখি? তোমাকে আমার চাই-ই চাই। তোমাকে পেতে হলে তো নিজেকে যোগ্য করতে হবে। তাই মাত্র এক বছরের জন্য এ দেশে আসা। তোমার মায়ের কাছ থেকে আমি এক বছর সময় চেয়ে নিয়েছি। এই এক বছর এ দেশে থেকে আমি টাকা জমাবো। তারপর দেশে ফিরে তোমাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিয়ে করবো। তবে,তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার বর অশিক্ষিত থাকবে না। আমি একবছর গ্যাপ দিয়ে আবার অনার্স ফাইনাল দেবো। মাস্টার্সও করবো। তুমি শুধু একটি বছর আমার জন্য অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি। এক বছর চোখের পলকে চলে যাবে। তারপর আমরা দুজন শুধু দুজনার। মনে আছে তো আমার প্রমিজের কথা? We Must Love One Another Or Die….।
আরও অনেক অনেক কথা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তো আমি জেনে গেছি… নিপু নেই… নিপুকে আমি কোত্থাও পাবো না। চিঠিটা শেষ করে আমি অঝোরে কাঁদলাম। কারণ আমি জানি আমার কাছে এক বছর মানে এক যুগ। আমি জানি মা ভাইয়ের সাথে আমি যুদ্ধ করতে পারবো না। ও থাকলে হয়তো পারতাম,কিন্তু এখন আমার সে শক্তি নেই। আমি নিপুকে হারালাম,চিরজীবনের জন্যই হারালাম৷ ও কেন এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিল? একবারও আমার সাথে আলাপ করলো না? আমি তো পেট্রো ডলার চাই না। আমি চাই নিপুকে। ও কেন এমন বৈরী সময়ে আমাকে একা রেখে চলে গেলো? কাঁদতে কাঁদতে আমি বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়লাম৷
এর পরের ইতিহাস আমার নিঃশেষ হওয়ার ইতিহাস। নিপু বিদেশ যাওয়ার দুইমাসের মধ্যে আমার বিয়ে হলো। ভাইয়ার বন্ধুর বড় ভাইয়ের সাথে। আমার কোনো আপত্তিই কেউ গ্রাহ্য করেনি। আমিও সংসার থেকে নিজেকে তুলে নিয়েছিলাম। না,সংসার ছেড়ে কোথাও পালাইনি। শুধু মনটাকে আলগা করে নিয়েছিলাম। আমার স্বামীরও আমাকে নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। সে ব্যবসা আর টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। শুধু জৈবিক তাড়নায় যতটুকু দরকার ততটুকু হলেই চলতো। আমার শুধু কানে বাজতো-We Must Love One Another Or Die….। রাতে ঘুমাতাম না। ঠিকমতো খেতাম না। শরীরকে যত কষ্ট দেওয়া যায় ততটা দিতাম। মন তো কবেই মরে গিয়েছিল। আমাকে নজরে রাখার মতো সংসারে কেউ ছিল না। তিল তিল করে নিজেকে কষ্ট দিয়েছি। শরীর আজ তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। জানি না নিপু এখন কোথায় আছে,কেমন আছে? একবার, শুধু একবার যদি ওকে দেখতে পেতাম। এখন আমি আইসিইউতে। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছি। জানি না ফিরবো কিনা। না ফিরলে কোনো দুঃখ নেই। আমি তো জানি আমি আমার প্রমিজ থেকে সরিনি। জীবনে ওর হতে পারিনি। তাই মরণের কাছে আত্মসমর্পণ।
***********************