You are currently viewing মেহনাজ মুস্তারিন: মায়ার পাহাড়

মেহনাজ মুস্তারিন: মায়ার পাহাড়

মেহনাজ মুস্তারিন
মায়ার পাহাড়

খুব বেশিদিন আগের কথা না। সেদিন আকাশে সাদা সাদা মেঘ দলবেঁধে খেলছিল, তারই ফাঁক দিয়ে নীলাকাশ কখনো দেখা যায়, কখনো যায় না। বিকেলের দিকে সূর্য যখন খানিকটা পরিশ্রান্ত হয়ে শক্তি হারিয়ে নূয়ে পড়েছে, আর গাছের পাতাগুলো দিনভর রোদ খেয়ে উদর ভরে ফেলার কারণে তখন একটু বেশিই সবুজ ছিল । আলোছায়া মেঘ কিংবা গাছের পাতার রঙ বদলানো কেন জানি আমার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে না। সেদিনও তাই হলো। এসব দেখতে দেখতে সেই পড়ন্ত বিকেলে খুব ইচ্ছে করছিল তোমার হাতটা ধরে নিরিবিলি কোন পথে হাঁটতে।
তুমি বললে, “কোথায় যাবে বলো?”
বললাম, আচ্ছা খুব সকালে বা দুপুর গড়িয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি। পায়ে হাঁটা পথ ধরে সেই যে মায়ার পাহাড়। চলো আজ ওখানে যাব।
তুমি রাজি হয়ে গেলে।
গল্পে গল্পে শুনেছি মায়ার পাহাড়ের কথা। দু’একবার যাবো বলে ঠিক করেও জানি না কী কারণে আজও যাওয়া হয়নি। খুব তো দূরে নয়, ঘন্টাখানিক লাগবে বোধহয়।
পরদিন সকাল সকালে উঠলাম, দেখলাম তুমিও উঠে গেছ। প্রস্তুতি নিলাম আর দুপুরের পরে পরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম পথে। তুমি যথারীতি ঘাড়ে একটা ব্যাগ নিয়েছো। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস যা হঠাৎ লাগতে পারে, তা গুছিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলেছ। পথে আমার পানি লাগবে সেটা নিতেও ভুল করোনি। রোদে আমার এ্যালার্জি, তাছাড়া রোদ বেড়ে গেলে আমি ক্লান্ত হই, সেটা তুমি জানো, তাই সাথে একটা ছাতা। আর বরবরের মতো কিছু হাল্কা খাবার আর এবয়সে আমার নিত্যসঙ্গী- ঔষধ।
দু’জনে হাঁটছি। চমৎকার ছিমছাম রাস্তা দু’পাশে সারিসারি গাছ। মানুষজন খুব একটা চোখে পড়ছে না। আজ আবহাওয়া ভালো থাকবে বলে মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমি আলতো করে তোমার হাতটা ধরলাম। তুমি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে পুণরায় রাস্তার দিকে মনোযোগ দিলে। ততক্ষণে পুরোনো দিনের গল্প তোমার মগজের দখল নিয়েছে। হাঁটছি আর সেই সাথে বাড়ছে তোমার সযত্নে লালন করা পুরনো দিনের গল্প। কীভাবে আতা গাছে ওঠে আতা পাড়তে , গ্রীষ্মের সময় আম গাছে ওঠে ঝাল লবন দিয়ে কীভাবে মজা করে আম খেতে, কখনো আবার পাখিদের বাসা খুঁজে বের করে বাচ্চা পাখিগুলোকে আদর করতে! এসব গল্প আমার বহুবার শোনা। তারপরও যতবার শুনি, মনে হয় এবারই প্রথমবারের মতো শুনছি। আমার মনকে প্রতিবারই মুগ্ধ করে। আমি নিমগ্ন হয়ে তোমার গল্প শুনছি আর ফিরে যাচ্ছি আমার ছোট বেলায়। কখন যেন একটু -একটু করে সব মনের পর্দায় ভেসে আসতে শুরু করে। কীভাবে শিমুল ফুল পাড়তে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই ঘটনাটা মনে পড়ল সবার আগে! আমাদের বাড়িতে তিনটা আতা গাছ ছিল। সেই গাছ নিয়ে কত গল্প! একবার কলার কাঁদির পুরোটাই এক সাথে হলুদ রঙ ধারণ করেছিল। হলুদ মানে পেকে যাওয়া, পেকে টসটস হয়ে পাখির খাবার হয়ে অপেক্ষা করা। কলার সেই রঙবদল বাসায় কেউ টের পায়নি। আমার নজরে পড়তেই মনটা চনমন করে উঠলো। কীযে ভালোলাগা! আনন্দের ঠেলায় সেদিন কয়টা কলা খেয়েছিলাম, মনে নেই। কিন্তু, আজ আমি তোমার গল্পে বিভোর। তুমি এত গুছিয়ে বলছো, মনে হচ্ছিল যেন ফিরে গেছ সেই দিনগুলোতে! মনে মনে প্রতীজ্ঞা করলাম, আজ আমি কেবল তোমার গল্পই শুনবো। নিজের ভাবনাগুলো দূরে রেখে তাই এগুতে থাকলাম মায়ার পাহাড়ের পথে।
পড়ন্ত দিনের সুর্য উঁকি দিচ্ছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে। কী অসম্ভব মায়াবী সকাল! দারুণ লাগছে! ইচ্ছে করছে ছোট্ট বেলায় যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতাম সেভাবে হাঁটি। কিন্তু তোমার গল্পে ছেদ পড়ে যাবে, সেই ভাবনায় নিরবে তোমার হাসিখুশি মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করছিলাম তোমার ছোটবেলা। তোমার দুষ্টমির গল্পগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এই মানুষটা কীভাবে এত দুষ্টু ছিল! ততক্ষণে মায়ার পাহাড়ে যাবার পথ আমরা অনেকটা পেরিয়ে এসেছি । তুমি গল্পের রেশ থামিয়ে বললে, “এই অনেক দূরে এসে গেছি অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মায়ার পাহাড়ে পোঁছে যাব। পাহাড়ের গায়ে উঠতে তোমার কষ্ট হবে। সূর্যের আলো একটু একটু করে মেলে ধরেছে ততক্ষণে। আসো একটু জিরিয়ে নি আর কিছু মিছু খেয়ে নিই। “
দু’জন পথের ধারে বসে পড়লাম। এখানে মানুষজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছে, কেউ হয়তো আমাদের মতই পাগল, হয়তো মায়ার পাহাড় দেখবে আজ ওরাও । যাক ওদের দিক থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে খাবারের দিকে নজর পড়তেই আমি অবাক ! আরে! কখন তুমি স্যান্ডউইচ বানিয়েছ?আর কাবাব? মুখে না বললে কী হবে, আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তোমার নজর এড়ায় না। দেখি, তুমি মিটিমিটি হাসছো।তোমার মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করার ফাঁকে জানতে চাইলাম, রাতে যখন ঘুমিয়ে গেলাম তখন বানিয়ে রেখেছো তাই না? আচ্ছা, এতকিছু কীভাবে পারো বলতো?
আমার চোখ তখন তোমার চোখে জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে। তুমি আলতো করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, “তোমার ভালবাসার শক্তি,বুঝেছ! আমাকে এতটা প্রাণবন্ত রাখো বলেই না আমি এতকিছু করতে পারি। তুমি বোঝ না?”
আমি বিস্বয়ে চেয়ে থাকি তোমার দিকে ; উত্তর যখন ঠোঁটের কাছে ঠিক তখন আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একটা হলুদ নীল বর্ণের পাখি ডানা ঝাপ্টিয়ে উড়ে গেল। পাখিটার দিকে আঙুল তুলে জানতে চাইলাম, চেন? তারপর তোমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে যেন নিজের সাথেই কথা বলছি, এভাবে সম্পুরক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, পাখিটার নাম কী?
“তুমি বললে, জান্টু! “
দু’জনে এক সাথে হেসে দিলাম। আমাদের নজর গেল আকাশের দিকে, দেখলাম, সারিসারি সাদা বক উড়ে চলেছে! তাদের চলার গতিপথে কী দারুণ ছন্দ। তুমি বললে,এখানে এখন এমন অনেক পাখি দেখতে পাওয়া যাবে। যত পাহাড়ের কাছাকাছি যাব, দেখব প্রকৃতি কীরকম মায়ার আবেশে আমাদের জড়িয়ে নেবে। তুমি মুগ্ধ হয়ে তাদের এসব কারবার দেখতেই থাকবে। নিবিড়ভাবে ওদের সান্নিধ্য পাবার জন্য আমার তর সইছিল না। রাস্তার দু’পাশে হলুদ, সাদা, জংলী ফুলগুলো যেন আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছিল, তাই পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিল আমাদের দু’জনকে।ওদের দিকে চেয়ে কেন এত মায়া লাগছিল আমার! কেন ওদের ফেলে যেতে মন চাইছিল না! হঠাৎ বসে পড়লাম আর ওদের শরীরে বুলিয়ে দিলাম স্নেহের ছোঁয়া। তুমি হাত বাড়িয়ে বললে, চলো এগোই।
ভর দুপুর হলে কি হবে, ঘনবনের কারণে সূর্যেরআলো যেন জোছনার আলোর মতো চুঁইয়ে পড়ছে পাতা আর ডালপালার ফাঁক দিয়ে, তারই কিছু ছোঁয়া আমাদের মুখের উপর আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই আদর মাখতে মাখতে আমরা এগুতে থাকলাম। অল্প দূরে পাহাড়ের উঁচু মাথাটা চোখে পড়লো।আনন্দে তখন আমরা আল্পুত। আমাদের চলার গতি একটু বাড়িয়ে দিলাম। এমন সময় তুমি আমার হাত স্পর্শ করে বললে,” ডানে তাকাও দেখ কী সুন্দর!” আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে দেখি, পাতাবিহীন একটা লিকলিকে গাছে অজস্র বেগুনী ফুল ছেয়ে আছে। বায়না ধরলাম কাছে যাবার ।কাছে যেতেই তুমি দুটো ফুল পাড়লে আর আমি বুঝে ওঠার আগেই পরিয়ে দিলে খোঁপায়। বললাম কী চমৎকার মায়াবী ফুল তাই না?
তুমি বললে, হু , তোমার খোঁপায় ওর সৌন্দর্যটা বহুগুন বেড়ে গেছে।
আমার চোখদুটো তখন বৃষ্টিস্নাত। তুমি দু’হাতে মুঠো করে বৃষ্টির ফোটাগুলো জড়িয়ে নিলে! তারপর আলতো করে নিজের কপোলের সাথে মেশাতে মেশাতে বললে, “এই হলো কী! আজ কী মায়ার পাহাড়ে যাওয়া হবে? “
আমরা আবারও এগুতে থাকলাম। অবশেষে এসে গেলাম প্রত্যাশিত সেই পাহাড়ের কাছে, যাকে দেখার জন্য এতটা পথ হেঁটে এসেছি। দেখি, শীরদাড়া শক্ত করে কী এক অহমিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে । শক্ত পাথরের মত মাটি। ছিটে ফোটা গাছ লেগে আছে তার গায়ে। জঙ্গলি কিছু গাছ লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে। আমি নিরস ভাবে বললাম, এটাই মায়ার পাহাড়!
তারপর তোমার হাত ধরে উঠে গেলাম উপরে। ততক্ষণে সূর্য তার যৌবনের পূর্ণ শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, রূপালী আলো আগুনের মতো ছিটকে পড়েছে গাছের পাতায় পাতায়। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। ঘন বন জঙ্গল আর গাছপালা। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সারি সারি পাখি। ওরা হয়তো আমাদের পাখি ভাবছে, আমাদের দেখে এমন ভাব করছে যেন ওরা মিতালি করতে চাইছে। ঠিক তখন আমার নজর গেল তোমার দিকে, দেখি, তুমি অবাক হয়ে আমার আনন্দগুলোকে আদরের চাদরে মুড়িয়ে নিচ্ছ। তখন পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্যের সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়েছে তোমার সারামুখে । আমি দেখতে পেলাম সেই মুখজুড়ে প্রত্যয়,দৃহতা,আত্নবিশ্বাস,নির্ভরতা, সারল্য, চঞ্চলতা, আর আস্থার বন্ধন, তারা একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে তোমার মায়ায়। আমার দৃষ্টি তখন শুধুই তোমার দিকে। মায়ার পাহাড়ে এসে আমি খুঁজে পেলাম অনেক কিছু। নিরব নিস্তব্ধ সবুজ অরণ্যের মাঝে খুঁজে পেলাম তোমাকে আর আমি আমাকে। খুঁজে পেলাম জীবনের মহিমা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তুমি আমার জীবনে এনে দিয়েছ মায়ার স্নিগ্ধতা। ” কথার পিঠে কোন কথা না বলে তখন তুমি আমার কপোলে এঁকে দিলে মায়ার তীলক। আমরা গুটিগুটি পায়ে ফিরে এলাম মায়ার স্নিগ্ধতা নিয়ে। ফিরে এলাম আমাদের চিরচেনা সেই ঠিকানায় যেখানে শুভ্র সকালগুলো অপেক্ষা করে থাকে বেগুনী রঙ মেখে। মাঝে তমসার অন্ধকার, আমরা জানি এইটুকু সময় আমরা পেরিয়ে যেতে পারবো মায়ার পাহাড়ের স্মৃতিটুকু সম্বল করে।
*****************************

Leave a Reply