খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন
সামনে আবার যুদ্ধ
গ্রামের পাঠ চুকিয়ে এখন শহরে বিপ্লব। আশা ছিল অনেক। এসএসসিতে যখন ভালো রেজাল্ট করা গেল, ঢাকায় এসে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আরও একাগ্রভাবে মনোনিবেশ করা যাবে। সাথে বিস্তর রঙিন
স্বপ্নও ছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের দুঃখ ঘোচাবে সে। কিন্তু আজকে তার জীবনে যে বাস্তবতা, তার সাথে তার সেই আশা ও স্বপ্নের কোন মিলই নেই! সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে বিপ্লবের।
বিপ্লব ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরপরই দেখা দিল, তার থাকার সমস্যা। কিছুদিন এক মামাতো বোনের বাসায় থাকা হল। কিন্তু সেখানে পড়াশুনার পরিবেশ মোটেই ছিল না। তারপর উঠে যাওয়া হল এক মেসে। মুটামুটি পরিবেশে দু’বৎসর পড়াশুনার পর, ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট হল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা। তার জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত রোমাঞ্চকর অধ্যায়। অনেক চেষ্টা তদ্বিরের পরও কোন হলে একটি সিটের ব্যবস্থা সে করতে পারেনি। এদিকে স্বৈরাচার সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ক্লাশ বন্ধ। কয়েকটি টিউশনি ক’রে কোনমতে নিজের খরচটা ম্যানেজ ক’রে নিচ্ছিলো সে। গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও ছোট দু’টো ভাইবোন। তাদের ভরণপোষণ এবং পড়াশুনার খরচ যোগাতেই মাকে হিমশিম খেতে হয়। তাই মাকেও নিয়মিত টাকা দেয় সে।
বিপ্লবের জীবনে তার শিক্ষিকা মায়ের দীক্ষাকে, মূলমন্ত্র ক’রে নিয়েছিলো সে। তাকে একদিন সত্যিকার জ্ঞানী এবং গুণী হতেই হবে। একজন চরিত্রবান মানুষ হওয়া আর জ্ঞানচর্চা করাই হবে, তার জীবনের প্রধান লক্ষ। তবে ইচ্ছা ছিলো ডাক্তারি পড়ার। তা আর হল না। এভাবেই বুঝি মানুষের জীবনের লক্ষ্য, চোখের পলকেই ঘুরে যায়! শেষপর্যন্ত প্রাণ-রসায়ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হল তাকে। মেসে থেকে পড়াশুনা মোটেই ভালো লাগছিল না। স্বৈরাচার সরকারবিরোধী আন্দোলন। চারদিকে হরতাল-মিছিল-সমাবেশ। শহরের আকাশে সংগ্রামী মুষ্ঠিবদ্ধ কণ্ঠে তুমুল প্রতিবাদী কণ্ঠে সমুচ্চারিত শ্লোগান, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক। গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
একদিন ক্লাশের তুখোড় ছাত্রনেতা জীবন, বিপ্লবকে ডেকে নিয়ে গেল তার নিজের রুমে।
-বিপু। ম্যারিট!
-মানে?
বিপ্লব অবাক না হয়ে পারল না।
-ম্যারিট মানে বুঝো না? এখন দেশের কী অবস্থা তা বুঝ?
-তা তো বুঝলাম। আমি নিজের চোখেই তো সমস্ত কিছু দেখছি। কিন্তু …!
-হ্যাঁ, দেখছো। কিন্তু ঠিক উপলব্ধি করছো না। এ মুহূর্তে তোমারও অনেক কিছু করার আছে।
-কিন্তু আমি কীভাবে করবো?
-তোমার যে প্রতিভা আছে, তার কিছু সদ্ব্যবহার করো।
-যেমন?
-যেমন তুমি পড়াশুনায় ভালো। আমি জানি লিখতে, আবৃতি করতে পারো। এবং গান গাইতেও তুমি কম নও।
-তা একটু আধটু জানি বৈকি। এগুলো আমার হবি বলতে পারো।
-শোন বিপু। আমাদের হল থেকে একটা সাংস্কৃতিক দল, গণসঙ্গীত নিয়ে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক-জোটের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছে। তো, আমার ইচ্ছা, তুমিও সক্রিয়ভাবে আমাদের সাথে থাকবে। এক কাজ করো তুমি। তুমি কয়েকটা গণসঙ্গীত ধাঁচের গান লিখো। সেগুলো আমাদের কাজে দেবে।
বিপ্লবের রক্তে চেতনার আগুন জ্বলে ওঠে। জীবন বিপ্লবের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে।
-বিপ্লব। আমি তোমার এই গুণগুলোকে, আমাদের আন্দোলনের জন্যে সদ্ব্যবহার করতে চাই। এক কাজ কর তুমি। অসুবিধা যদি না হয়, তবে তুমি আমার রুমে চ’লে আসো ভাই। এক সাথে কাজ করতে আমাদের, অধিকতর সুবিধা হবে।
আকাশ থেকে যেন পড়ে বিপ্লব। শেষ পর্যন্ত খুব সহজেই, হলে তার সিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। সে জীবনের এক কথাতেই রাজী হয়ে যায়। জীবনও বিপ্লবকে কাছে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে, অনেক খুশী হয়।
হলে উঠে আসে বিপ্লব। জীবনের সাথে তার সময় কেটে যাচ্ছে। নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে সে।
রাজধানী ঢাকার বাতাস, বারুদের গন্ধে মাতম হয়ে আছে। পড়াশুনার কোন পরিবেশই নেই। এদিকে আবার সরকারী জরুরী নির্দেশ জারি হলো, আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে! সামনে পরীক্ষা। ক্লাশ হচ্ছে না নিয়ম মত। তারপর আবার ভার্সিটি বন্ধ ক’রে দেয়া হল। এদিকে আন্দোলনের স্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আন্দোলনরত ছাত্রদের কোন অংশকেই, হল ছাড়তে দেয়া হবে না। তা হলে মাঝপথে আন্দোলনের গতি, অন্যদিকে মোড় নেবে। সরকার মূলতঃ এই উদ্দেশেই হলগুলো বন্ধ ক’রে দিয়েছে।
হলের জীবন এখন অনিয়মিত। বিপ্লবদের রুমে আরও দু’জন ছেলে আছে। ওরাও গ্রামের বাড়িতে চ’লে যাবার জন্যে, উদগ্রীব হয়ে আছে। বিপ্লব জীবনকে, তার নিজের বাড়িতে চ’লে যাবার কথা বলল। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে, হলে অবস্থান নেয়া মোটেই নিরাপদ নয়। পড়াশুনা বা পরীক্ষা কোনটাই হবে না।
জীবন বিপ্লবের কথাটি সহজভাবে নেয়নি।
-বিপু। তুমি নিজের জীবন থেকে, পালিয়ে বেড়াতে চাইছো। তা আর পারবে না বন্ধু। তুমি এখন আমাদের কাতারে, একজন সক্রিয় সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক-কর্মী। তোমার ভিতরে অনেক সুপ্ত প্রতিভা আছে। তুমি সেগুলোর স্ফুরণ ঘটাও। তোমার লেখা গান, পথনাটক অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তুমি এখন শুধু আমাদের দলে নও। পুরো ভার্সিটিতে একটি অতি পরিচিত নাম। এ পরিস্থিতিতে তুমি নিজেকে নিষ্ক্রিয় ক’রে রেখো না। দেখছো তো, শহীদ নূর হোসেন আর জেহাদের রক্ত ছুঁয়ে; দল মত নির্বিশেষে সব ভুলে ছাত্র-সমাজ আজ কেমন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে! সারা দেশময় এখন গণআন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজপথে এখন উত্তাল গণজোয়ার। আর এ মুহূর্তে তুমি চাইছো, গ্রামের বাড়িতে চ’লে যেতে! ছিঃ বিপ্লব! ধিক! ধিক তোমাকে! হবে না! তা আর হবে না! তা তোমাকে করতে দেবো না, বন্ধু!
উঠে গিয়ে নিজের টেবিলের ড্রয়ার খোলে জীবন। কালো কাপড়ে জড়ানো একটা কিছু বের করে। বিপ্লবের হাতে তা তুলে দিয়ে বলে, বিপু! এটাও চলবে, তোমার কলমের পাশাপাশি। হ্যাঁ! ধর এটা! সাবধান কিন্তু। এটার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ আমি তোমাকে দেবো। মনে কর, তুমি এখন একজন রাজনৈতিক-কর্মীও।
-রাজনৈতিক-কর্মী! আমি?
-হ্যাঁ বিপ্লব। তুমি এখন আমাদের দলের। তাই তোমারও দায়িত্ব অনেক। এখন থেকে এটা তোমার।
– কী এটা?
বিপ্লবের সারা শরীর কাঁপতে থাকে, এক অজানা ভয়ে!
-আহ্ বিপু! তুমি এমন করছো কেন? স্বাভাবিক হও। এত ভয় পেলে তো, চলবে না বন্ধু! ভয়ের কী আছে? সাহস সঞ্চয় করো। এখন থেকে কোথায় কখন কী করতে হবে, আমিই সব তোমাকে ব’লে দেবো। আমি জীবন থাকবো, তোমার পাশে পাশে সদা সর্বদা। মূলতঃ এটা তোমার আত্মরক্ষার জন্যেই। এবং আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহারও করবে।
বুঝতে আর দেরী হয় না বিপ্লবের। তার কলমের পাশাপাশি জমকালো এই শক্ত জিনিসটা রাখার, শেষ পরিণতি কী হ’তে পারে! তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজে ঘেরা নিজের গ্রাম। সেই গ্রামে ছায়াঘেরা, কুটীর সদৃশ একটি ছোট ঘর বিপ্লবদের। সেখানে দুটো ভাইবোন নিয়ে, তার বিধবা মায়ের বাস। মা তাকিয়ে আছেন বিপ্লবের পথের দিকে। তাঁর চোখের পানিতে, কালো ফ্রেমের চশমা ঝাপসা হয়ে ওঠে ক্রমশঃ। বার বার আঁচলে চোখ মোছেন মা। বিপ্লবের জন্যে তাঁর যত দুশ্চিন্তা! ঢাকায় আসার সময়, মায়ের সেই চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর শেষ কথাটি তার কানে বাজে, ‘সাবধানে থাকিস বাবা!’
-জীবন! আমি আজ অবস্থার শিকার! কোথায় আমার মা? কোথায় আমার স্বপ্ন? আর কোথায় আমার ভবিষ্যৎ? এভাবে এ দেশে আর কতদিন? আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! আমার মতো অনেক দরিদ্র মায়ের নিরীহ ছেলে, মেয়ে, এক কাতারে আজ আন্দোলন করছে। অথচ তাদেরও সকলের স্বপ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে, সুন্দর জীবন গড়ে তুলবে। একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়বে। দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, সময়ের প্রয়োজনই আমাকে আজ এ পথে টেনে এনেছে। কিন্তু আমি তো, শুধু কলমধারী হতে চেয়েছিলাম। অস্ত্রধারী তো হতে চাইনি আমি! না ভাই! আমি ওটা স্পর্শ করতে পারবো না! তোমাদের পাশে আমি সব সময় আছি এবং থাকবো। অনুরোধ তোমাকে, ওটার দুঃসহনীয় ভার আমার উপর চাপিয়ে দিও না ভাই! আমি তা সহ্য করতে পারবো না!
-বিপু! নূর হোসেনের তাজা রক্ত ছুঁয়ে আমরা শপথ নিয়েছিলাম, এই স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে তবেই আমরা ক্লাশে ফিরে যাবো। তার আগে নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার স্বাদ আমরা পাইনি। মনে কর, নব্বইয়ের গণআন্দোলনই আমাদের জন্য আর একটি মুক্তিযুদ্ধ। আমরা এখন সেই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে! পিছু হটার আর সুযোগ নাই!
-জীবন! অস্ত্র যে ধরে, সে অস্ত্রেই মরে। প্লীজ! এই জমকালো জিনিস তুমি … … জীবন প্লীজ! এটার দরকার নেই আমার!
বিপ্লবের কন্ঠ যেন এবার কেঁপে কেঁপে ওঠে। কিন্তু জীবন বিরক্ত হয়।
-আহ্! তুমি নিছক ভয় পাচ্ছো! তুমি বুঝতে চাইছো না। এখন তুমি একটি পলিটিকাল ফিগার! স্বৈরাচারের পোষা গুন্ডারা, সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখানে এ ভাবে, অবাধে থাকা চলবে না। প্রয়োজন মতো আমরা স্থান পরিবর্তন করবো।
-তার মানে আমাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে?
-কিছুটা তাই।
-না না ভাই! আমি আন্ডার গ্রাউন্ডে যেতে পারবো না।
-আহা! ওটা ঠিক আন্ডারগ্রাউন্ড নয়। সরকারের ভিত ন’ড়ে গেছে। এই ডিসেম্বরের মধ্যেই স্বৈরাচারচক্র হটে যাচ্ছে। আর বেশি দিন নেই। ওরা ঠিকই ফেঁসে গেছে! তারপরই আমাদের সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আমরা একযোগে সকলে, মুক্ত পরিবেশে ক্লাশে যেয়ে আবার বসবো। তখন থাকবে না আর কোন আন্দোলন। থাকবে না শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস। সেশনজট থেকে আমরা সহজেই বেরিয়ে আসবো।
-এত সহজে সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না জীবন। ইতিহাস আমাদের তাই শিক্ষা দেয়।
-না বন্ধু, না। তুমি দেখো, সামনে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!
জীবনের আশ্বাসে বিপ্লব আশার আলো দেখে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে, শরিক ছাত্রদের ও পেশাজীবিদের ঐক্য জোটগুলো, স্বৈরাচারমুক্ত পরিবেশে তাদের ম্যান্ডেট নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। তারপর নিশ্চয় একটি অবাধ নির্বাচন হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটি সরকার, জমে থাকা যত জঞ্জাল সব সরিয়ে দিয়ে সত্যিকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে কোন দুর্নীতি, দুঃশাসন থাকবে না। বাংলার জনগণ, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে আবার।
কিন্তু জীবনের কথামত, সব কিছু ‘ঠিকঠাক’ হয়ে যায়নি। পতনোন্মুখ স্বৈরাচার খুনী শেষ আঘাত হানে, মেধাবী ডাক্তার মিলনের ও শিশু জেহাদের উপর। শোককে শক্তিতে পরিণত ক’রে তাদের রক্তস্নাত রাজপথে, উৎফুল্ল জনতা বিজয় মিছিলে মেতে ওঠে। স্বৈরাচারের পতন ঘটে ঠিকই ডিসেম্বর মাসে।
ইতিহাসের চাকা ঘুরে, অনেক সময় একই অবস্থানে আসে। এ দেশের ইতিহাস বলে, এক একটি যুদ্ধে, এক একটি গণআন্দোলনে মানুষ বিজয়ী হয়। কিন্তু সে বিজ্য় তারা বেশিদিন ধ’রে রাখতে পারে না। সেই বিজয়, সাধারণ মানুষের চাহিদা কখনও পূরণ করতে পারেনি। মূলতঃ সেখানেই দুঃখী এবং সংগ্রামী মানুষের, চাওয়া পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
নব্বইয়ের সেই গণ-আন্দোলনের পর, একটি নির্বাচিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এখন ক্ষমতায়। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি, সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সাংবিধানিক অনুমোদন লাভ করেছে। কিন্তু তবুও এ মুহূর্তে, দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তালা ঝুলছে। সেশন জটের প্যাঁচ খুলছে না। ঐক্যবদ্ধ ছাত্রজোট ভেঙ্গে গেছে। এখন প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় ফিল্মী কায়দায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চলছে। চলছে বন্দুক-যুদ্ধ।
জীবনের দেয়া কালো বস্তুটা নিয়ে, এখন সমস্যায় পড়েছে বিপ্লব। পড়াশুনা করতে হলে, এটা ছুঁড়ে ফেলা এখন অত্যন্ত জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা ছাড়া সে চলবে কী ভাবে? আজ জীবন নেই! দু’টি বিবদমান ছাত্র সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার ছাত্রনেতা জীবন।
স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বচ্ছন্দে সাবলীল জীবন যাপন করার ভাগ্য হয়নি, মায়ের একমাত্র ছেলে জীবনের। সব শেষে সে ফিরে গেছে গাঁয়ে, তার মায়ের কোলে! লাশ হয়ে!
সত্যই জীবনের কথা ঠিক। বিপ্লবের ভিতর অনেক প্রতিভা আছে। সময়ের প্রয়োজনে, সে তার প্রতিভার সদ্ব্যবহার করতে চায়। এখন চারিদিকেই যুদ্ধ। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে রক্ষা করার যুদ্ধ। সর্বোপরি এ দেশে টিকে থাকার যুদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই জানে, বিপ্লব এখন সুবোধ ও ক্লাশের প্রথম সারির ছাত্র নয়। তার হাতে মারমুখী জমকালো বস্তটির, উদ্যত নিশানা। অনেক অপারেশনে, উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে যায় সে। সকলের সামনেই, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় শরীক হয়। ভিতরে তার, এতটুকু স্বস্তি নেই যেন।
কলম চলে না এখন আর বিপ্লবের। কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, তার দরাজ কন্ঠে কবিতার পঙক্তিমালা উচ্চারিত হয় না! সেই গণসঙ্গীতও নেই! কিন্তু তার কাছে, জীবনের সেই জমকালো কঠিন বস্তুটি আছে। এটা থাকবেই। সঙ্গোপনে তার কাছে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে ওটা। সময়ের প্রয়োজনে সে ওটাকে সাথে রাখবেই। এটাই তার শেষ এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কারণ ভবিষ্যতে স্বৈরাচার আবার, মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াবেই। নূর হোসেন, বসুনিয়া, ডাক্তার মিলন, জেহাদ আর জীবনরা তাদের বুকের তাজা তেজী খুন, আবার অকাতরে ঢেলে দেবেই! তাই বিপ্লবেরা বেঁচে থাকবে। এক সময় হয়তো বিপ্লবকেও তাদের মত, জীবন উৎসর্গ করতে হবে। তবে সেই পর্যন্ত, তাকে বেঁচে থাকতে হবেই। কারণ সামনে আবার যুদ্ধ আছে! সেই যুদ্ধে বিপ্লবকে, সামিল হতেই হবে!
***********************