মৌরী তানিয়া
চোখ
১
নিপা খুব সুন্দরী, শিক্ষিত, শান্তশিষ্ট, ধীরস্থির। নিপার স্বামী শিহাব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকুরী করে, দেখতে সুন্দর, স্মার্ট, ভদ্র আর খুব মোলায়েম স্বভাবের। নিপা চাকুরী করে না। খুব সংসারি মেয়ে। ওদের সন্তান নিলয় পূর্ণিমার চাঁদের মতো সংসারটাকে আলোকিত করে রেখেছে। পূর্নিমা রাতে মাখনের মতো নরম আকাশের দিকে তাকালে মনটা যেমন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে, তেমনি নিপার সংসারের দিকে তাকালে সবার মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সবাই বলাবলি করে, নিপা খুব সুখী, খুব ভাগ্যবতী।
কিন্তু সবার ধারনা ভুল, নিপা সুখী হতে পারেনি। সারাক্ষণ ওকে একটা অশান্তি তাড়া করে ফেরে। খুব চাপা স্বভাবের হওয়ায় নিপার দিকে তাকালে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না ওর বুকের ভেতরে একটা ঘুণপোকা সারাক্ষণ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ও মুখে সবসময় একটা শান্তি শান্তি আর সুখী সুখী ভাব ছড়িয়ে রাখে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে নিপা। মেয়েকে সর্বোচ্চ সুখী করতে তাঁদের সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা! বেশ কবছর ধরে অনেক বাছা বাছি, অনেক ভাবাভাবি করে অবশেষে শিহাবের সঙ্গে বিয়ে দেন তাঁরা। সেই নিপাকে কি অসুখী হলে চলে! উঁহু! কোন ভাবেই না। বাবা মার বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। ভাঙ্গা বুকটা নিয়ে না হয় বেঁচে থাকা যায় কিন্তু অপমান নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। কথায় আছে না, অপমানের চেয়ে মৃত্যু ভালো। নিপার বাবা মা এ কথাটিকে বেদবাক্যের মতো মেনে চলেন। নিপা যদি অসুখে থাকে, অশান্তিতে থাকে আর সেকথা যদি ওদের পরিবারের চারপাশের লোকজন জানতে পারে তাহলে ওর মা বাবার অপমানে মাথা হেঁট হয়ে যাবে। আত্মীয় স্বজনরা ঠারাটিপা করবে, সামনে মুখ টিপে হাসবে আর পেছনে পারলে নাচানাচি করবে। অবশ্য একদল আছে যারা সামনে আহাউহু করবে কিন্তু পেছনে ঢোল পিটিয়ে নাচবে। এই যখন অবস্থা তখন নিপাকে কি অসুখী হওয়া চলে? মোটেই না। সুখী সুখী , শান্তি শান্তি ভাব নিয়েই সবসবয় ওকে থাকতে হয়।
ওদের বিয়ের বয়স তিন বছর। নিপার মনেহয়, শিহাবের অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম আছে, কিন্তু বাবা- মার কারণে সে নিপাকে বিয়ে করেছে। শিহাবের বাবা মা নিপাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে এনেছে।
বিয়ের পর পরই নিলয়ের অস্তিত্ব নিজের শরীরে টের পায় নিপা। বছর দেড়েকের মাথায় নিলয় জন্ম নেয় । এর কিছুদিন পর থেকেই নিপা বিষয়টা খেয়াল করেছে। কিছুদিন বিয়ের ঘোরের মধ্যে থাকায় আর নিলয় পেটে আসার পর ওকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর থাকার কারণে আগে বিষয়টা সেভাবে চোখে পড়েনি নিপার।
নিপার এমন সন্দহের কারণ, শিহাব যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ সে ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সে ফোনে কি করে সেটা নিপার সবসময় দেখার সুযোগ হয় না। ফোনটা মুখের কাছে প্রায় সেঁটে রাখে বলে দেখার সুযোগ হয় না। তবে বিভিন্ন কাজে ওর আশপাশ যেয়ে দেখেছে, কখনও ফেসবুক, কখনও মেসেঞ্জার, কখনও অন্য কিসব করে। অবসর সময়ে নিপার সঙ্গে গল্প করে না। শিহাবের অবসর সময়ের সঙ্গী মূলত ফোন।
এ নিয়ে নিপা ঝগড়া করে না, ঝগড়া করা ওর স্বভাবে নেই। অভিমান করেছে। শিহাব খুব শান্ত গলায় বুঝায়, আমি তো সবসময় ফেসবুক , মেসেঞ্জারে থাকি না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাথাটা ক্লিয়ার করার জন্য মাঝে মাঝে ঢুকি। শিহাব বলে চলে, পুরো টিমের লিডার সে। দায়িত্ব অনেক। বাসায় ফেরার পরও অফিসের অনেক কাজ করতে হয় ওকে। অফিসে সারাদিন ল্যাপটপে বসে থাকতে থাকতে কোমড়ে ব্যাথা, সেকারণে বাসায় ফিরে আর ল্যাপটপে বসতে পারে না। কখনও শুয়ে কখনও আধশোয়া হয়ে তাই ফোনেই কাজ করতে হয়।
নিপা মনে মনে ভাবে, কাজের অযুহাত তো দেবেই। কেউ কি আর স্বীকার করবে! কেউ কি বলবে, হ্যাঁ, অফিস শেষে আমি প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম করি!
সারাক্ষণ ফোন নিয়ে থাকায় নিপার মন খারাপ হয়, অভিমান হয় একথা শিহাবকে বুঝিয়েছে। কিন্তু সন্দেহের কথা কখনও শিহাবকে বলেনি। প্রথমেই বলেছি নিপা খুব ধীরস্থির। কোনকিছুতেই সে তাড়াহুড়ো করে না। অস্থিরতা ওর স্বভাবে নেই।
চুপচাপ ফেসবুকে শিহাবের আইডিতে ঢুকে , সবসময় ফলো করে নিপা। সে একটা পোষ্ট দিলে দেখে, ওর পোষ্টে কে কি মন্তব্য করেছে, কে কি রিএ্যাক্ট দিয়েছে। নিপা দেখে শিহাবের সব পোষ্টে তিতলী নামের একটা মেয়ে সবসময় লাভ রিএ্যাক্ট দেয়। শিহাবও তিতলীর পোষ্টে লাভ রিএ্যাক্ট দেয়। নিপা তিতলীর আইডিতে ঢুকে দেখে, তিতলীকে খুব সুন্দরী বললে কম বলা হবে। অপরূপা সুন্দরী, চোখ ফেরানো দায় এমন সুন্দরী তিতলী। শিহাবের অফিসেই চাকুরী করে। অবিবাহিত।
নিপা শান্ত চোখে দেখে, শিহাব যখন মেসেঞ্জারে থাকে তখন তিতলীর ছবিতে সবুজ বাতি জ্বলে, মানে তিতলীও তখন মেসেঞ্জারে থাকে। নিপা বোঝে, তিতলীর সঙ্গেই শিহাবের প্রেমের সম্পর্ক ।
নিপা বোঝে, তবে একশত ভাগ নিশ্চিত হয় না। আর একশত ভাগ নিশ্চিত না হয়ে শিহাবকে কিছু বলবে না বলে সে সিদ্ধান্ত নেয়।
২
বিয়ের পর থেকেই শিহাব নিপার খুব যত্ন নেয়। নিপার বান্ধবী, চাচাত-খালাত-মামাত বোন বা পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির স্বামীরা তাদের বউদের যত যত্ন নেয় তারচেয়ে শিহাব নিপার যত্ন নেয় শতগুণ বেশি। হাজার গুণ বললেও বেশি বলা হবে না। বেশিরভাগ স্বামীরা বউদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীন। বউদের মনের খবর যে নিতে হয়, সেটা স্বামীরা জানেও না।
যেসব খাবার খেলে নিপার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, অসুখ-বিসুখ কম হবে, সেসব খাবার শিহাব বাসায় কিনে আনে সবসময়। তিনবেলা ভাত মাছ ছাড়াও প্রতিদিন একটা কমলা, মাল্টা বা কেনো, একটা আপেল, টক দই, ভিনেগার আরও বিভিন্ন ধরনের খাবার নিপাকে খেতে বলে এবং সেই খাবারগুলো কোনটা কখন শেষ হচ্ছে সে বিষয়টা নিপা খেয়াল না করলেও শিহাব শেষ হওয়ার ঠিক আগেই সেগুলো এনে হাজির করে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে আগে নিপার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, নিপার মনটা ভালো আছে কিনা। যদিও নিপার মনের তল পাওয়া খুবই মুশকিল। ওর মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বাইরে প্রকাশ পায় না। তবে একসঙ্গে কবছর থাকার কারণে মুখের প্রতিটি শাখা প্রশাখা পর্যবেক্ষণ করে শিহাব কখনও কখনও একটু আধটু বুঝতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময়ই বুঝতে পারে না।
অনেক পর্যবেক্ষণ শেষে, যেদিন বুঝতে পারে, নিপার মন খারাপ, সেদিন সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, অসহায় বোধ করে। নিপাকে হাজারও প্রশ্ন করে তার মন খারাপের কারণ বের করার চেষ্টা করে। নিপা যদি কোন কারণ বলে, তা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। নিপার সঙ্গে গল্প করা ছাড়া, অন্য সবকিছু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সে।
নিপার জন্য শিহাবের এতকিছু করার পেছনে নিপার প্রথম যুক্তি হলো, যেহেতু শিহাব প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, সেকারণে ওর ভেতরে এক ধরনের অপরাধ বোধ কাজ করে। সেটা পোষাতে সে এতকিছু করে।
দ্বিতীয়ত, সে ছেলে নিলয়কে খুব ভালোবাসে। নিপাকে সুস্থ না রাখলে, নিলয় সুস্থ থাকবে না। তাছাড়া নিপা তো শিহাবেরও যত্ন আত্ত্বির কোন কমতি করে না। পুরোটা দিন নিপা বাবা আর ছেলের পেছনেই ব্যয় করে। নিপা অসুস্থ হলে শিহাবের শরীরেরও বারোটা বাজবে। বাবা আর ছেলে যেন সুস্থ থাকে সে কারণেই শিহাব নিপার প্রতি এত বেশি যত্নশীল। নিপা ভাবে, শিহব খুব চালাক ও স্বার্থপর।
নিপার যুক্তি, যদি ভালোবাসত, তাহলে শিহাবের ইচ্ছে করত অবসর সময়ে নিপার সঙ্গে গল্প করতে, আড্ডা দিতে, অফিসের যত ব্যস্ততাই থাক না কেন। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে, অবশ্য দুটো একসঙ্গে করার ইচ্ছেটা থাকতে হবে। নিপার সঙ্গ ওকে আনন্দ দেয় না বলেই সে কাজের অজুহাত দেখিয়ে ফোন নিয়ে থাকে। তিতলীর সঙ্গ ওকে আনন্দ দেয়।
নিপা আবার এমনও ভাবে, একসঙ্গে কবছর থাকতে থাকতে কিছুটা ভালোবাসা তো জন্মেছেই নিপার প্রতি। নিপা তো ওর বিয়ে করা বউ, বউ এর প্রতি একটু- আধটু ভালোবাসা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা তিতলীর প্রতি ভালোবাসার তুলনায় কিছুই না। আর সবচেয়ে বড় কথা নিপার প্রতি ভালোবাসা যৎসামান্য থাকলেও প্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই। ওর প্রতি প্রেম থাকলে ওর সঙ্গ শিহাব চাইত। রাতে বিছানার কথাটা অবশ্য আলাদা। সেটা তো একধরনের প্রয়োজনও বটে। এছাড়া কখনো নিপার সঙ্গ শিহাব চায় না। তিতলীর প্রতি প্রেম আছে বলেই তিতলীর সঙ্গ শিহাব চায়, তিতলীর সঙ্গে সময় কাটাতে সে আনন্দ পায়। প্রেম আর ভালোবাসা দুটো আলাদা জিনিস সেটা নিশ্চয় একবাক্যে সবাই স্বীকার করবেন। নিপা বিড়বিড় করে, যাহা প্রেম তাহা ভালোবাসা তবে যাহা ভালোবাসা তাহা প্রেম নহে। নিপা বিকেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে পাশের ছাদে গাছ পালার ভেতরে একটা বাচ্চা শালিকের ছটফটানি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, অফিস থেকে এসেই ফোন হাতে নেয় শিহাব, একদম ঘুমানো পর্যন্ত চলে ওর ফোন যজ্ঞ!
নিপার অবসরের কাজ হলো একবার শিহাবের আইডিতে ঢোকা আর একবার তিতলীর আইডিতে ঢোকা। কে কি পোষ্ট করছে, কার পোষ্টে কে কি রিএ্যাক্ট দিচ্ছে , কে কি কমেন্ট করছে। কে কখন মেসেঞ্জারে ঢুকছে, কে কখন বের হচ্ছে।
এভাবে বছর গড়িয়ে যায়। একই কাজ করতে করতে নিপা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, খুব ধৈর্যশীল হওয়ার পরও নিপা আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে না। যদিও সে এখনও শত ভাগ নিশ্চিত নয়, আর শত ভাগ নিশ্চত না হয়ে শিহাবকে কিছু বলবে না বলে যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা থেকে সে সরে আসে। শিহাবকে সে সব খুলে বলে। শিহাব একটুও রাগ হয় না, সে নিপার কাঁধে হাতটা রেখে খুব আদুরে গলায় নিপাকে বুঝায়, তুমি মিথ্যে সন্দেহ করে কষ্ট পাচ্ছ । তোমার ধারনা পুরোপুরি ভুল নিপা। প্রেম বলো, ভালোবাসা বলো সবকিছুই তোমার সঙ্গে আমার। তুমি ছাড়া আমার মনে অন্য কেউ নেই। নিপার সামনেই তিতলীকে ব্লক করে। শিহাব বুঝতে পারে ফোনে বেশিক্ষণ থাকার কারণে নিপার সন্দেহ হয়। সে খুব সতর্ক হয়। অফিস থেকে ফিরে শিহাব সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিপাকে সময় দেয়ার। ছুটির দিন নিপার সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যায়।
নিপা এখন সত্যিই খুব সুখী। শিহাবের প্রতি ওর সন্দেহটা আর আগের মতো নেই । এতদিন বুকের ভেতরে যে ঘুনপোকাটা ছিল সেটা মরে গিয়েছে। তবে এখন বুকে খুব ছোট একটা আধমরা পিঁপড়া আছে, যেটা কামড়াতে পারে না, তবে একটু নড়াচড়া করে বলে কেমন যেন বুকটা একটু খচ খচ করে। নিপা ভাবে, শিহাব যদি এভাবে চেষ্টা করে তাহলে ধীরে ধীরে বুকের এই আধমরা পিঁপড়াটাও মরে যাবে ইনশাল্লাহ।
আহা! বেচারা কাজে ডুবে থাকার পরও এখন কত চেষ্টা করে সময় বের করে ওকে সঙ্গ দেয়, গল্প করে। শুধু শুধু ওকে ভুল বুঝে এতদিন কষ্ট পেয়েছি। এত বড় পদে থাকলে অফিসের দায়িত্ব তো অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। চাকুরীটাই তো সম্বল ওদের। এটাকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে!
কিছুদিন পর এক বিকালে নিপা শপিং এ বের হয়েছে, কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে। কেনাকাটা শেষে ধানমন্ডি আট নাম্বার ব্রীজটা পার হচ্ছে, চারদিকে আলো আঁধারির মধ্যে হঠাৎ নিপা দেখতে পায়, শিহাব তিতলীর সঙ্গে রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে। নিপা ভালোভাবে চোখটা রগড়ে নিয়ে, বড় বড় চোখ মেলে দেখে, হ্যাঁ, শিহাব আর তিতলী পাশাপাশি বসে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে ওর রিক্সা ক্রস করছে। নিপা শিহাব বলে ডাক দেয় কিন্তু ওদের রিক্সা ততক্ষণে চলে যায় দূরে। নিপার ডাক শিহাবের কানে যায় না। ঘড়ি দেখে নিপা সাড়ে সাতটা বাজে। তারমানে অফিস শেষে শিহাব——-!
নিপা ভাবে, আসলে ফেসবুকে ব্লক করা যে মন থেকে ব্লক করা নয়, এই সহজ বিষয়টা সে বুঝতে পারেনি! এত গাধা সে! নিজের উপর খুব রাগ হয়। ফেসবুকে ব্লক করল, নিপাকে একটু আধটু সময় দিল আর অমনি সে খুশিতে গদ গদ হয়ে ওকে বিশ্বাস করে ফেলল! নিপা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, আমি তো ওকে বিশ্বাস করতেই চাই। আমি যে সংসারটা ভাঙ্গতে চাই না। মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, আমিও একটু বিশ্বাসের গন্ধ পেলে সেটাকে আঁকড়ে ধরেই সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চাই। ওর দুচোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, সেটা আর হলো না। নিলয়ের মুখটা ওর সামনে ভেসে ওঠে।
বাসায় খাওয়ার টেবিলে বসে নিপা বলে, অফিস থেকে কি কোথাও গিয়েছিলে বেড়াতে?
শিহাব খেতে খেতে উত্তর দেয়, না তো, কেন?
নিপা ভাবে, আমি একটা হাদারাম, এই প্রশ্ন করে কি কোন লাভ আছে? ও কি কখনো বলবে, হ্যাঁ, আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কোনদিন ও বলবে না। কেউ কি কখনও বলে? নীলা চুপ করে থাকে। এমনদিনের অপেক্ষায় থাকে যখন আর অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না শিহাবের, আসলে এর আগে বলে কোন লাভ নেই। শুধু ওকে বোকাই বানাবে শিহাব।
নিপা ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে, না এমনি জানতে চাইলাম।
শিহাব বলে, এমনি কি কেউ এমন কথা জানতে চায়? মনে মনে ভাবে, আবার কি আমাকে নিয়ে ওর মনে কোন সন্দেহ দেখা দিয়েছে? শিহাবের বুকটা চাপ ধরে আসে।
শিহাব নিপার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে, তুমি কি কিছু লুকাচ্ছ?
না, আসলে দূর থেকে একটা রিক্সায় তোমার মতো একজনকে দেখলাম তাই।
শিহাবের বুকটা হালকা হলো, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক, তাহলে তেমন কিছু নয়। এমন তো ওর অনেকবার হয়েছে। রাস্তা ঘাটে কতবার মনে হয়েছে নিপা, কিন্তু কাছে যেয়ে দেখে অন্য মেয়ে। শিহাব খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
রিক্সায় শিহাব আর তিতলীকে একসঙ্গে দেখার পর থেকে নিপা সারাক্ষণ মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এক মন বলে,রাত সাড়ে সাতটায় আট নাম্বার ব্রীজটা তো আলো ঝলমলে ছিলো না। আলো আঁধারের মধ্যে ও আসলে ভুল দেখেছে। শিহাব ছিল না। হয়তো শিহাবের মতো অন্য কেউ। এক রকম দেখতে কত মানুষ দুনিয়ায় আছে। আর তিতলী? তিতলী কি অন্য ছেলের সঙ্গে রিক্সায় যেতে পারে না? অবশ্যই পারে। নিপার বুকের উপর থেকে ভারি পাথরটা নেমে যায়।
কিন্তু অন্য মন ঝঙ্কার দেয়, সংসার করতে চাস কর, অন্য মেয়ের সঙ্গে স্বামীর প্রেম মেনে নিয়ে কর। স্বামীকে ধোয়া তুলশী পাতা বানাতে হবে কেন? ঠিক আছে মানলাম শিহাব নয় ওর মতো দেখতে অন্য কেউ, তুই তো চোখ ভালোভাবে রগড়ে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছিলি। ভুল হওয়ার কোন সুযোগই নেই। আচ্ছা তবুও মানলাম দেখতে ভুল হয়েছে। কিন্তু শার্টটা! নীল আর সাদা চেক শার্ট পরেই তো সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিল শিহাব, সঙ্গে ছাই রঙা প্যান্ট ছিল। রিক্সায় তিতলীর পাশে বসা ছেলেটি হবুহু একই শার্ট, প্যান্ট পরা ছিলো। তুই তো সেটাও ভালোভাবে খেয়াল করার পর নিশ্চত হয়েই ডাকটা দিলি!
সংসার করার পক্ষের মনটাকে আঁকড়ে ধরে সে। সেদিনের ঘটনায় একশতভাগ নিশ্চিত কোনভাবেই হওয়া যায় না। আলো আঁধারের মধ্যে এমন ভুল হতেই পারে।
কিছুদিন পর নিপা আর শিহাব একসঙ্গে ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে, ঈদ শেষে শিহাব অফিস খুললে ফিরে আসে। নিপা নিলয়কে নিয়ে রয়ে যায় বাবার বাড়িতে, কিছুদিন পর ফিরবে।
সকাল দশটা, ছুটির দিন। নিপা ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবে, ছুটির দিন একটু দেরীতে উঠলেও এতবেলা পর্যন্ত ঘুমায় না কখনো শিহাব, ভিডিও কল দেয় ওকে। শিহাব ফোনটা ধরে ঘুম জড়ানো গলায় হ্যা–লো– বলার সঙ্গে সঙ্গে নিপা দেখতে পায়, তিতলী আলুথালু বেশে শিহাবের বিছানা থেকে উঠে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। চিৎকার দিতে যেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারটাকে গিলে ফেলে নিপা। কারণ তিতলী ততক্ষণে ক্যামেরার বাইরে চলে গিয়েছে। এখন বলে কোন লাভ নেই। শিহাব কি স্বীকার করবে? কখনও না। কেউ কখনও স্বীকার করে না।
নিপা বুঝতে পারে, বিষয়টা নিয়ে শিহাবের সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ হবে না। জোর করে কাউকে মন থেকে সরানো যায় না। নিপা ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থেকে যায়। শিহাবের সংসারে আর ফিরে যায় না। শিহাব অনেক বুঝায় নিপাকে কিন্তু কোন লাভ হয় না।
আলো আঁধারের মধ্যে নয়, রাস্তায় হাজারো মানুষের ভিড়ে নয়, স্পষ্ট ঝলমলে আলোতে, শিহাবের বাড়িতে, শিহাবের বিছানায় তিতলীকে দেখেছে একদম নিজের চোখে! নিজের চোখে এমন ঘটনা দেখার পর আর কোন মেয়ে সংসার করতে পারে না। শিহব আসলে ছেলের কথা , নিজের কথা, মা বাবার কথা, সমাজের কথা ভেবে নিপার সঙ্গে থাকতে চায়। ওর মন তিতলীর কাছেই পড়ে থাকে। শিহাব অনেক বুঝায় নিপাকে, তুমি যা দেখেছ ভুল দেখেছ।
নিপার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে, নিজের চোখকে অবিশ্বাস করে তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছ শিহাব! দারুন তোমার যুক্তি!
৩
বছর গড়িয়ে যায়। নিপার বড় ভাই বহু বছর ধরে আমেরিকায় থাকে। ওর মা বাবা ওখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছে। নিপা মা বাবার সঙ্গে আমেরিকায় চলে যায় নিলয়কে নিয়ে। ওখানে যেয়ে নিপা আবার পড়াশোনা শুরু করে। পরিবারের সবাই ওর বিয়ের জন্য খুব চেষ্টা করে। কিন্তু নিপা কিছুতেই রাজি হয় না। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসে নিপা। আমেরিকায় ওর মন টেকে না। দেশে ফিরে একটা এনজিওতে চাকুরী নেয়। নিলয় বড় হতে থাকে। পড়াশোনা শেষ করে। মাকে একলা ফেলে বিদেশে যাবে না নিলয়। চাকুরী নেয়ার পর নিপা ছেলের বিয়ে দেয়। নিপা চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে নাতি নাতনীদের সঙ্গে খুনসুটি করে সময় কাটায়।
ছুটির দিন ছেলে, বউমা আর নাতি নাতনিরা জোরাজুরি করে নিপাকে রমনা পার্কে হাঁটতে নিয়ে আসে।
রমনা পার্কের একদম কাছেই ওদের বাসা। ছুটির এক সকালে নিপা নাতনির সঙ্গে রমনা পার্কে কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা গাছের নীচে বসে। শরীরটা ভালো লাগছে না বলে আজ আসতে চায় নি নিপা। নাতনি বলে, রমনায় সবুজের মধ্যে হাঁটলে, ফ্রেশ বাতাসে শ্বাস নিলে, তোমার মন ভালো হবে দাদী। আর মন ভালো হলে শরীর ভালো হবে।
দাদিকে বসিয়ে রেখে নাতনি আরও এক চক্কর দেয়ার জন্য হাঁটা দিয়েছে। নিপা উদাস হয়ে সামনের বড় বকুল গাছটার দিকে তাকায়। গাছটার নীচে ওর চোখ জোড়া থমকে যায়। শিহাব! নিপা ভালোভাবে দেখে। হ্যাঁ শিহাব! নিপা বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর শুনেছে, শিহাব বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ওর সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারেনি নিপা, কোনদিন জানার চেষ্টাও করেনি সে। কি লাভ! যে পুরুষ বউ, বাচ্চা ফেলে অন্য মেয়ের সঙ্গে —! থাক, এসব পুরানো কাসুন্দি আর মনে করতে চায় না সে।
শিহাব কি তাহলে এখন দেশে বেড়াতে এসেছে? তিতলীও কি এসেছে? গাছের ডালে ডালে ছুটোছুটি করা পাখিগুলোর কিচিরমিচির নিপার কানে ভেসে আসে।
নিপা আশপাশ তাকায়, নাহ ওর সঙ্গে কেউ নেই, একলা গাছতলায় বসে আছে শিহাব।
নিপা ভালোভাবে দেখেশুনে ধীরে পায়ে হেঁটে শিহাবের কাছে যায় । এখন হাঁটার সময় রাস্তাঘাট ভালোভাবে দেখেশুনে হাঁটে সে। এই বুড়ো বয়সে পড়ে হাড় ভাঙ্গলে একদম বিছানাগত হতে হবে।
শিহাব আপনমনে সামনে হেঁটে চলা মানুষগুলোকে দেখছে। নিপা শিহাবের পাশে বেঞ্চে বসে। শিহাব ওকে খেয়াল করেনি। ভেবেছে, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত কেউ বেঞ্চে বসেছে। নিপার বসার জায়গা দেয়ার জন্য সামনে লোকজনের চলাচল দেখতে দেখতেই শিহাব বেঞ্চের অপর পাশে একটু সরে বসে।
শিহাব!
শিহাব চমকে ওঠে, নিপা!
নিপা বিস্মিত হয়, মুখ থেকে একটা শব্দ উচ্চারিত হতে না হতেই, ওকে না দেখেই শিহাব চিনতে পারল!
শিহাব ঘাড় ঘুরিয়ে নিপার দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওকে দেখে।
অনেক বুড়িয়ে গিয়েছ!
তুমিও বুড়ো হয়েছ। তারপর বলো, কেমন আছ? নিপা জানতে চায়।
এইতো চলে যাচ্ছে দিন।
তুমি দেশে কবে এসেছ?
বছর চারেক হলো দেশেই থিতু হয়েছি।
তিতলীও কি তোমার সঙ্গে দেশেই থাকে?
শিহাব অবাক হয়, কে?
তোমার তিতলী?
তিতলী কে?
এখনও আমার কাছে মিথ্যা বলতে হবে শিহাব?
শিহাব সত্যিই বুঝতে পারে না নিপা কার কথা বলছে? তিতলী কে? সে নিপার দিকে তাকিয়ে বলে, নিলয়ের কথা ভেবে, আমার কথা ভেবে, তোমাকে তো আমার সঙ্গে এখন রাখার প্রয়োজন নেই আমার, নিপা! এখন তোমাকে মিথ্যা বলব কেন, বলো? শিহাব চোখ থেকে চশমাটা খুলে গায়ের ফতুয়ার কোনা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, সত্যিই তিতলী কে আমি চিনতে পারছি না।
নিপা ভাবে, সত্যিই তো, আমার কাছে এখন মিথ্যে বলার তো প্রয়োজন নেই শিহাবের। নিপা অবাক হয়, তাহলে তিতলীর সঙ্গে ওর কি কোন সম্পর্ক ছিলো না?
ধ্যাত, কি সব ভাবছি! নিজের চোখে যা দেখেছি, তা কি মিথ্যে হবে কখনও?
অনৈতিক কাজের কথা কেউ কি সহজে স্বীকার করতে চায়? তাও আবার আমার কাছে! দেখি না কতক্ষণ স্বীকার না করে থাকতে পারে।
নিপা চোখমুখ শক্ত করে বলে, তোমার কলিগ তিতলী । যাকে তুমি বউ করে ঘরে তুলেছ?
কি সব আজে বাজে বকছ ! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে এবার। জীবনে চলার পথে কত জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আজ এত বছর পর সবার কথা কি মনে আছে? দেখো, কেমন ভুলো আমি, তিতলীর কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছি। এই বুড়ো বয়সে এসে ওর কথাটাও মনে করতে পারতাম না, যদি ওকে নিয়ে মিথ্যে সন্দেহ করে তুমি আমাকে একলা ফেলে চলে যেতে। মনে পড়েছে এখন, বেশ ভালোভাবেই মনে পড়েছে। হাসি ফুটে ওঠে শিহাবের মুখে, আমি বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে তিতলীকে! তিতলী তো ওর ভালোবাসার মানুষকেই বিয়ে করেছে। উচ্ছসিত হয় শিহাব, জানো, ওর কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? আমার ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাসেলকে তো তুমি চেনো, ওর ইমিডিয়েট ছোট ভাই তুহিনের সঙ্গে ওর নাকি দীর্ঘ দিনের প্রেম ছিলো। তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর ওদের বিয়ে হয়। কলিগ হিসেবে তিতলীর আর বন্ধুর ভাই হিসেবে তুহিনের, দুতরফ থেকেই ওদের বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছিলাম।
শিহাব সামনের গাছটার দিকে তাকায়। গাছের অজস্র সাদা ফুলগুলো মাটিতে পড়ে আছে। আকাশের অজস্র তারারা যেন সারারাত জ্বল জ্বল করে জ্বলার পর শ্রান্ত আর ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, তিতলীর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না নিপা। শুনেছি, তুহিন আর রাসেল দু ভাই ধানমন্ডিতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে এখনও নাকি থাকে । চাইলে এই বুড়ো বয়সে ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে পার পুরো সত্যিটা।
শিহাব চশমাটা পরে নিপার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বলে চলে, আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধু তুমিই ছিলে নিপা, এখনও আছ। হাসে একটু, বুড়ো হয়েছি, বেশিদিন তো আর বাঁচব না। যতদিন বাঁচবো তুমিই আমার মন প্রাণ জুড়ে থাকবে।
নিপার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। চারপাশটা হালকা দুলতে থাকে । নিপা চোখ বন্ধ করে, নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ে। কয়েকবার এভাবে শ্বাস নেয় আর ছাড়ে। রমনায় মহিলা অঙ্গনে মাঝে মাঝে সে অনেকের সঙ্গে ব্যায়াম করে এটা শিখেছে, খুব উপকারী।
শিহাব অস্থির হয়, কি হলো নিপা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
নিপার শরীরের দুলুনি থেমে যায়। বেশ ভালো বোধ করে। নিপা শিহাবের দিকে তাকায়, ওর চোখেমুখে হাজারো বিস্ময়, নিজের চোখ জোড়াকেও বিশ্বাস করা যায় না!
আবার চোখ বন্ধ করে নিপা। এবার নিজের চোখজোড়াকে প্রশ্ন করে, কেন তোমরা সেদিন আমার ঘর ভাঙ্গার খেলায় মেতেছিলে?
*************************