You are currently viewing কাজী লাবণ্য: সোনাইকুন্ড থেকে জারিয়া

কাজী লাবণ্য: সোনাইকুন্ড থেকে জারিয়া

কাজী লাবণ্য
সোনাইকুন্ড থেকে জারিয়া

আকাশে প্লেন উড়লে স্কুলের মাঠে সবুজ ঘাসের উপর যখন লিমা, কৃষ্ণা, সাইফ, মালতি, গীতা, রুবি, সবাই মিলে দৌড়াইতাম তখন হাসিবুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করত,
‘এ্যাই! যাস না যাস না, মাথায় কিন্তু ইয়ে পড়বে’।
আমরা সব্বাই হেসে উঠতাম। মালতি বলত,
‘হাসিব, তোর মাথায় গোবর ভরা’। হাসিব ওর নিজের বিশ্বাসের উপর আস্থা রেখে আবার বলত, ‘গু যখন মাথায় পড়বে তখন বুঝবি ঠ্যালা’।
ততক্ষণে প্লেন দৃষ্টির বাইরে আর আমরা মাঠের ওপারে জলপাই গাছের তলে। গাছটায় প্রতিবছর ঝেঁপে জলপাই ধরে। কিন্তু এখন নাই। ওদিকে ক্লাসে অবনী স্যার ঢুকে পড়েছেন। দেরি হলে স্যার হাতের তালুতে বেতের বাড়ি দেন। আজকাল নাকি স্যারেরা আর মারেন না কিন্তু অবনী স্যার বলেন, ‘মাইর না খাইলে কেউ মানুষ হয় না’।

স্যারের কথা শুনে লিমা, কৃষ্ণা, রুবি, আমরা সবাই চোখাচোখি করি, ‘আমরা তো মানুষই, আবার কীভাবে মানুষ হব তা আর ভেবে পাই না’। নিত্যদিন স্যারের ঐ এক কথা। ভেবে না পেয়ে আবার আমরা ১২’র ঘরের নামতা মুখস্ত করি। স্যার বলেছেন, ‘২০ এর ঘর পর্যন্ত নামতা জানা থাকলে জীবনে কোথাও আটকাতে হইব না’।
না আটকানোর জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টায় আছি ওই পর্যন্ত নামতা মুখস্ত করেই ছাড়ব। হাসিবুল ১৪’র ঘর পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলেছে। লিমা বলে, ‘অর সবেতে বেশি বেশি’।

রমজান মাসের জন্য স্কুল বন্ধ দিয়েছে। মনে মনে ঠিক করেছি এই বন্ধে, আমিও ১৩, ১৪ দুই ঘরের নামতা মুখস্ত করে ফেলব।
কিন্তু আমার মুখস্ত করা হইল না রে গীতা। মা আমারে বুবুর বাড়ি পাঠায় দিল, বুবুকে পাহারা দেবার জন্য। দেখ, মাতো সবার মা। সব সন্তানের জন্যই মায়ের ভাবনা। আমি যেতে চাইনি। তবুও যাওয়া লাগলো। কখনও কখনও লাগে রে।

আকাশে যা কিছুই উড়ত, আমরা জানতাম হয় প্লেন ওড়ে নাহয় পাখি। জানিস, আমি না তোদের সব্বাইকে দেখতে পাচ্ছি। ওই যে আমাদের স্কুল। ওইযে লিমাদের বাড়ি। ওই যে আমাদের জলপাই গাছ, গাছটা এখন শূন্য। সামনে আবার জলপাই ধরবে, পোক্ত হবে, একটা পোক্ত জলপাইয়ের জন্য আমরা হন্যে হয়ে গাছতলায় যাব, কেউ কেউ নুন নিয়ে আসবে, নারে আমি আর যাব না, তোরা সবাই যাবি।
ঐ যে, ঐ দেখা যায়, জারিয়া গ্রাম।
শুনেছি আমার প্রতিবন্ধী বাবা, মাকে নিয়ে সোনাইকুন্ডু থেকে এই জারিয়া গ্রামে এসেছিল। যে বছর এসেছিল সেই বছরই আমি নাকি মায়ের পেটে আসি। জন্মের পরে মা আমার নাম রাখে ‘আসিয়া’। দেখ মালতি, জারিয়া আর আসিয়া কী মিল!
সব্বাই বলছে, ‘মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে’।
আমি যে কেমন কষ্ট পেয়েছি তা তোদেরকে বলতে পারব না। তোরাও কেউ বুঝতে পারবি না। ভেতরটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে রে।
গীতা দেখ, আমার মেজো বইন হাবিবা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আহাজারি করে কানতেছে। ওরে জানায় দিস, আমার আর কোনো কষ্ট নাই। কেবল ওই অন্ধকার কবরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে না। বইনকে বলিস ও যেন লেখাপড়াটা ভালোভাবে করে।

আফসোস লাগে বুবুরে তো পাহারা দিতে পারলাম না। ওরা যে পাহাদারকেই পিষে দিল। আসলে শোন, ‘আমি তো গরীব, প্রতিবন্ধী বাবার মেয়ে, আমার উপর যা খুশি করা যায়। আমার মুখ দিয়ে বা আমার পেশাবের রাস্তা দিয়ে মোটা, লোমশ, হাত ঢুকিয়ে আমার কলিজাটা চরচর করে টেনে বাইরে আনা যায়। ইচ্ছেমত যা তা করা যায়। করতে গিয়ে দুবার ভাবতে হয় না। কারণ ওই একটাই আমরা গরীব, বড্ড বেশি গরীব। একেবারে হাভাতে।
আমি যদি আমাদের রুবিদের মত বড়লোকের মেয়ে হতাম, যদি আমি সুস্থ সবল বাবার মেয়ে হতাম, ওরা আমার গায়ে হাত দেবার আগে একবার ভাবত, একটিবার থমকাত। কিন্তু আমি যে নই। এইযে নই তাতে,
আমার ভূমিকা কি?
আমার অপরাধটা কোথায়?
জীবনে না আটকানোর জন্য আমি তো কুড়ি’র ঘরের নামতা মুখস্ত করতে চাইছিলাম। কিন্তু মুখস্ত করার সুযোগ পাইলাম নারে, এজন্যই বুঝি আটকে গেলাম। এটাই বুঝি আমার অপরাধ।
লিমা, আমার মাকে কষ্ট পেতে মানা করিস। মাকে বলিস, নোমানি ময়দানে এতবড় জানাজা কি আগে কোনোদিন হইছিল? হয় নাই। কেবল মাকে আমার একটা অনুরোধ পৌঁছে দিস, মেয়েদের নিয়া মা যেন বাড়িতেই থাকে। কাউকে বিয়ে দেবার দরকার নাই, বিয়ে দিলে পাহারা দেওয়া লাগে।

কৃষ্ণা! তুই না বলতি, তোর খুব প্লেনে চড়তে ইচ্ছে করে। বলতি, ‘আচ্ছা কারা ঐ প্লেনে চড়ে রে? কত টাকা লাগে ওখানে চড়তে?’। আর আমার সব সময় ইচ্ছে করত পাখি হয়ে উড়তে। অবনী স্যারের বেতের বাড়ি খেয়ে আমার তো আর মানুষ হওয়া হইলো না, তবে পাখি হয়েছি।
আজ কিন্তু আমি সত্যিই উড়ছি রে। পাখি হয়ে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছি তোদের ছেড়ে। স্কুল ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, বাড়িটা ছেড়ে, মা আর আমার প্রতিবন্ধী বাবাকে ছেড়ে।
***************************

Leave a Reply