You are currently viewing অংশীদার || মৌরী তানিয়া

অংশীদার || মৌরী তানিয়া

অংশীদার
মৌরী তানিয়া

লিপির সাজানো গোছানো,ঝলমলে,রঙ্গিন ও আলোকোজ্জ্বল ড্রয়িং রুমে ছুটি গ্রুপের সবাই বিষন্ন মুখে বসে আছে।তাদের আজকের থমথমে আর হতাশ মুখগুলো এই ড্রয়িং রুমের সঙ্গে একেবারে বেমানান লাগছে। ছুটি গ্রুপের এ বারের ট্যুর নিয়ে আলোচনা চলছে।ইরা পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকায় ওর সঙ্গে ডিটেইলস আলোচনা করার সুযোগ হয়নি। তাই ও ফেরার পর আজ সবাই আবার বসেছে।গ্রামের বাড়িতে গেলে ওখানকার সবাইকে নিয়ে ইরা এত ব্যস্ত থাকে ফোন ধরেই না।অজস্রবার ফোন দেয়ার পর ধরলেও তাড়াহুড়ো করে দু একটা কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় সে। সবাই আলোচনা করে ট্যুরের জন্য যে তারিখটা ঠিক করেছে সেই তারিখে ইরা যেতে পারবে কিনা ফোনে তা জেনে নিয়ে সবাই ডেট ফিক্সড করেছে। সমুদ্রের কথা শুনলে ইরা সবসময় খুশি হয়ে ওঠে।সবাই যেহেতু এই ট্যুরে কক্সবাজার যেতে চায় তাই ওর সঙ্গে আর ট্যুরের স্পট নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ।ডেট ফিক্সড হওয়ার পর হোটেলও বুকিং দেয়া হয়েছে। যেকোন ট্যুরে যাওয়ার মূল সমস্যা সবার টাইম একসঙ্গে মেলানো। টাইম মিললে জায়গা সিলেক্টে কখনও কেউ বাধ সাধেনা।সংখ্যাগুরুরা যেখানে যেতে চায় সংখ্যালঘুরা সেটাই মেনে নেয়।কিন্তু ইরা যে কক্সবাজারের ট্যুরে বাধ সাধবে এটা কেউ কম্পিনকালেও ভাবেনি!সে কিছুতেই কক্সবাজার যেতে চায় না।তার কথা,দেশের ভেতরে যেকোন জায়গায় যেতে রাজি,শুধু কক্সবাজার নয়।কিন্তু হোটেল বুকিং দেয়া হয়ে গিয়েছে!ইরাকে ছাড়া কেউ ট্যুরে যেতে চায় না।শুধু ইরা নয়,ছুটি গ্রুপ যেখানেই যাক নয়জন সদস্যের একজনকেও ছেড়ে যেতে চায় না।অসুস্থতা,অফিস ছুটি না পাওয়া বা অন্য কোন গুরুতর সমস্যার কারণে কেউ যেতে না পারলে বেশিরভাগ সময় পুরো ট্যুরটা ক্যান্সেল করা হয়। ইরার সে ধরনের কোন সমস্যা নেই। এমন কি সমুদ্র যে তাকে টানে না, তাও নয়। পতেঙ্গা বা কটকাতে গিয়ে তাকে সমুদ্র থেকে টেনে তোলায় দায় হয়ে পড়েছিল,গোঁ ধরেছিল,সারারাত সী বিচে থাকবে সে।ঢেউয়ের সঙ্গে খেলবে।সেই ইরা এখন বলছে, কক্সবাজার যাবে না! ইনানী বীচের কাছে সবাই থাকবে শুনে গোঁয়াড়ের মতো বলে উঠে, প্রশ্নই আসে না!

আলোচনার মাঝখানে একটা ফোন আসায় ইরা কথা বলতে বলতে পাশের ঘরের দিকে হাঁটা দিল।

বিবেচক ও সহনশীল রাকা সবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, ছেলে তন্ময়কে ছাড়া থাকতে পারবে না বলে কি ইরা এমন গোঁ ধরেছে? আমরা সবাই হাসাহাসি করি বলে হয়তো কথাটা বলতে পারছে না।

শান্তশিষ্ট রোজ বলে, ছেলের বিষয়ে ইরা কখনও কোন কনসিডার করে না। ছেলেকে ছেড়ে থাকতে না পারলে ও সরাসরি বলত। দেশের বাইরের ট্যুরের কথা উঠলে ও তো শুরুতেই সরাসরিই বলে দেয়, যাব না, কারণ ছেলেকে ছাড়া এতদিন থাকতে পারব না। সবাই তো আমরা কত হাসাহাসিই করি কিন্তু ও কি পাত্তা দেয় কখনও।

দু একদিনের বেশি ছেলেকে ছাড়া ইরা থাকতে পারে না বলে ছুটি গ্রুপের সবাই খুব হাসাহাসি করে।হাসাহাসি করারই তো কথা! ইরার ছেলে তন্ময় এবার মেডিকেল পাশ করল।এখনও সে ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারে না। তন্ময় সিলেটে সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলো কিন্তু ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারবে না বলে তাকে গাদা গাদা টাকা খরচ করে নিজের কাছে রেখে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াচ্ছে।‌

গুরুগম্ভীর ও দাপুটে ঝর্ণা ইরার বয়সে বড়, সে তো রীতিমত ঝাড়ি মারে,ছেলেকে কি বিয়ে দিবা না? এমন ছেলে ন্যাওটা মা থাকলে বউ পালাবে, সে খেয়াল আছে তোমার?

সবাই বলে এখনও সময় আছে,ছেলের বিয়ের আগে ছেলেকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস করো।

ছুটি গ্রুপের সেদিন এক আড্ডায় জেসমিন হাসতে হাসতে সবার দিকে( ইরা ছিল না সেই আড্ডাতে)তাকিয়ে বলে, এক দু দিন পর পর নাকি ইরা মাঝরাতে নিজের বালিশ কাঁথা বগলদাবা করে ছেলের বিছানায় যেয়ে ঘুমায়!

লিপি অট্টহাসিতে ফেটে পরে, এটা কোন কথা! আমাদের কি আর ছেলে পুলে নাই!

জেসমিন বলে,তোমার তো ছেলেও আছে, পুলেও আছে, মানে তোমার তো দুইটা, ইরার যদি দুইটা বাচ্চা থাকত তাহলে এমন অস্বাভাবিক আচরন করত না।একটা বলেই এমন করে।তোমরা তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়েছ, মানে বিয়ের পরপরই ছেলে পুলে পেয়ে গেছ। কিন্তু ইরার ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি।একটা ছেলেও আবার বহু প্রতীক্ষার পর,মানে বিয়ের বহুতবছর পর হয়েছে,তাই ছেলেকে নিয়ে এমন মরিয়া সে!

যাইহোক ইরার ট্যুরে না যেতে চাওয়ার কারণ ছেলে নয়,এটা সবাই নিশ্চিত। দুইরাতের ট্যুরে সে ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারে। এর আগে বহু ট্যুরে সে অতি উৎসাহে ছেলেকে ছাড়া গিয়েছে।সবার অফিস ছুটি নিতে হয় বলে সাধারনত ট্যুরগুলো দু রাতেরই হয়। দেশের বাইরের ট্যুরগুলোতে মিনিমাম পাঁচ ছয় রাত থাকতে হয়। ইরা ছেলেকে ছাড়া এতদিন থাকতে পারে না, আবার অন্যদের এতদিন ছুটি নেয়া সমস্যা বলে দেশের বাইরে দু-তিনটা ট্যুরের বেশি দেয়া হয়নি। সবাইকে নিয়েই ট্যুর গুলো করতে চায় বলে দেশের ভেতরেই যায় ওরা।

পাশের ঘরে ইরা ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। ঝর্না থমথমে আর চাপা গলায় ,পাগলের পাগলামো কে বাড়তে দেয়া যাবে না, বুঝলা, ওকে যে করেই হোক রাজি করাতেই হবে।

রোজ দম ফুরানো গলায়,আমাদের কতদিনের ইচ্ছে কক্সবাজারে ট্যুর দিব!

সবার সময় একসঙ্গে মেলানো খুবই টাফ, চঞ্চল আর উচ্চ কন্ঠের লিপি পাশের ঘরের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে নিজের কন্ঠনালীটাকে যেন গায়ের জোরে চেপে ধরে ফিসফিস করে,এর সময় মিলে, তো, ও অসুস্থ হয়। এ সুস্থ হয়, তো, ও অফিস ছুটি পায় না। সবার সময় একসঙ্গে করতে করতেই চার-পাঁচ মাস চলে গেল। কত কষ্টে সবার সময় একসঙ্গে করে যখন সব ঠিকঠাক, তখন পাগল আবার গোঁ ধরেছে, সে কক্সবাজার যাবে না। গুরুতর কোন কারণ থাকলে মানতাম। কোন কারণ নাই শুধু তার কক্সবাজার যেতে মন চাইছে না,তাই এমন গোঁয়ার্তুমি করছে। এটা কোন কথা! মনের উপর সে নাকি জোর খাটাতে পারে না।কি উচ্চবর্গীয় মন রে! আমাদের মনের উপর জোর দিতে দিতে মনটা তো এক্কেবারে চিড়েচ্যাপ্টা!

যথারীতি রাকার কথায় বিবেচনাবোধ ফুটে ওঠে,ওর মনেহয় আসলেই পার্সোনাল কোন সমস্যা আছে।সেকারণেই মনেহয় এমন করছে। যা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না।

খুব মিশুক ও সাইকোলজিতে পড়াশোনা করা বুলার কথায় সাইকোলজির জ্ঞান ফুটে ওঠে, এত বছর ধরে ওকে চিনি। ও সব কিছুই তো আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে।ওর চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়,ও খুব সরল মনের। ওর সঙ্গে এক দু মিনিট কথা বললে যে কেউ বুঝতে পারে,ও কোন কথা চেপে রাখতে পারে না।মনের সব কথা অকপটে বলে ফেলে।ওর তেমন কোন সমস্যা নেই। সমস্যা থাকলে অবশ্যই বলত।এটা ওর পাগলামো ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুঃখ বিলাসী আর ফোন পাগল কান্তা দুঃখী দুঃখী মুখে, ফোন চাপতে চাপতে বলে উঠল, আমাদের তাহলে কক্সবাজারের ট্যুর ক্যান্সেল করতে হবে!

ফোনে কথা শেষ করে ইরা পাশের ঘর থেকে এসে আবার যোগ দিল আলোচনায়।

জেসমিন মোমের মতো মাখো মাখো গলায়, ইরা পাগলামো করো না প্লিজ। তুমি তো জান দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস অপেক্ষা করে সবার টাইম মেলাতে পারলাম অবশেষে। শুধু তোমার একার কারণে ট্যুরটা ক্যান্সেল হলে সবাই খুব কষ্ট পাব আমরা।হোটেল বুকিং করা হয়েছে।কক্সবাজার ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ হাতে একদম সময় নেই। এই অল্প সময়ে ট্যুরের নতুন জায়গা সিলেক্ট করে সবকিছু অ্যারেঞ্জ করা খুব টাফ, সেকারণে ট্যুরটা ক্যান্সেল করা ছাড়া উপায় থাকবে না। সবাই কতদিন ধরে কত আশা করে আছি কক্সবাজারের এই ট্যুরের জন্য!সবদিক দিয়ে দক্ষ জেসমিন সুন্দরভাবে তার দক্ষতা কাজে লাগালো।

যত পাগলাটেই হোক, ইরার মনটা খুব নরম। জেসমিন সেটা বুঝেই, শেষ অস্ত্রটা নিক্ষেপ করেছে আর সেটাতে কাজও হলো। ইরা রাজি হলো। সবাই হুল্লোড় করে উঠল।

কিন্তু সবার মনে একটা প্রশ্ন রিনঝিন করে বেজেই চলেছে, সমুদ্র দেখলে যে ইরা খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে, সে কেন কক্সবাজার যেতে চাইল না!

যাইহোক ছুটি গ্রুপের পঞ্চাশ উর্ধ্ব নয়জন সদস্য দুদিন পরেই আগস্টের ১০ তারিখ খুব ভোরে হৈ হৈ করতে করতে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হলো। আপনারা হয়তো এতক্ষণে ভেবে অবাক হচ্ছেন পঞ্চাশ উর্ধ্ব বুড়িরা আবার হৈ হৈ করতে পারে? হ্যাঁ,পারে, খুব পারে। বয়সে বুড়ো হলেও মনে তারা তরুণী, একেবারেই তরুণী!

সংসার থেকে,অফিস থেকে এক কথায় সব রকম দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে সবাই হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে বলেই কান্তা এই নয়জনকে নিয়ে মেসেঞ্জারে ছুটি গ্রুপ নামে এই গ্রুপ খোলে।ব্যস্ততার কারণে সবসময় দেখা সাক্ষাত না করতে পারলেও প্রতিদিন মেসেঞ্জারে এই গ্রুপের সবাই মনের সবকিছু শেয়ার করে।সবার মনের মিল খুব দৃঢ় বলেই সবাই একসাথে ঘুরতে যায়,আড্ডাবাজি করে, সুখে দুঃখে সবাই সবার পাশে থাকে।

প্লেন ছাড়ার বেশ আগেই পৌঁছে গেল তারা। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর থেকে সবাই আড্ডাবাজি আর ফটোসেশন নিয়ে মহা ব্যস্ত কিন্তু ইরা এসবের সাতেপাঁচে নেই। একদম গম্ভীর মুখে চুপচাপ সামনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । তাকিয়ে আছে কিন্তু চোখজোড়াতে যেন কোন দৃষ্টি নেই, যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। চোখের পাতার নীচে দুটি মার্বেল যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে। লিপি, ঝর্নার দিকে তাকিয়ে কিনকিনে গলায়, আমার এখন মনেহচ্ছে ইরার কক্সবাজারে আসতে না চাওয়ার পেছনে গোপন কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। দেখ ওর দিকে তাকিয়ে, ও কেমন প্রাণহীন আর নিস্তেজ হয়ে বসে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে! সব ট্যুরে ও সবাইকে প্রাণবন্ত করে রাখে। কিন্তু এখন ও নিজেই কেমন প্রাণহীন, জড়বস্তু হয়ে বসে আছে! আর কি এত গভীর হয়ে ভাবছে!

ঝর্না বলে,আরে দূর! কি যে বলো তুমি! এতদিনেও ওকে চিনলা না তুমি! গোপন কোন রহস্যের ভার ও মনে চেপে রাখতে পারবে। নরমাল ব্যক্তিগত কথাবর্তা যেটা সবাই মনে চেপে রাখে,সেইসব কথাবার্তার চাপই ও সহ্য করতে পারে না! হর হর করে সব বলে দেয়। রহস্য তো দূর কি বাত! পাগলামো বুঝছ, জাষ্ট পাগলামো! মাঝে মাঝে ওকে পাগলামোতে পায় তখন সে অন্য গ্রহে চলে যায়। ছেলেবেলায়, আমাদের পাড়ায় খায়রুল পাগলা নামে এক ঘোরতর পাগল ছিল।সারাদিন ছোটাছুটি, চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো পাড়া এক্কেবারে মাথায় তুলে রাখত। হঠাৎ দেখতাম এক- দুদিন একটানা খড়ের গাদার মধ্যে চুপচাপ ঠাঁই বসে থাকত সে। নট নড়ন-চড়ন!

ঝর্না এবার লিপির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, ওকে ওর মতো থাকতে দাও। কিছুক্ষণ পর আপনা থেকেই আবার হা হা হি হি শুরু করবে। পাগলে কিনা করে! বুঝছ।

ইরা যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ও আসলে দেখতে পাচ্ছে রাতুলকে। রাতুল ওর পাশে বসে আছে। কতকাল আগের কথা! অফিসের ট্যুরে সেবার ইরা রাতুলের সঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছিল। একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে দুজন। অফিসের ডরমেটরিতে ওরা ছিলো। ডরমেটরির ছাদে ওরা পাশাপাশি বসে ছিলো। আকাশের চাঁদটাকে সেই রাতে যেন বেশি বড় মনে হচ্ছিল ওর। ওরা দুজন যেন সরাসরি চাঁদের নীচে বসে আছে। রাতুল ইরার হাতে হাত রাখে। ইরা রাতুলের কাঁধে মাথা রাখে। ইরার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

তুমি কেন সবসময় এমন কষ্ট পাও বলো তো? রাতুল ইরার চোখের অশ্রু মুছে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলে, আমি তো আছি তোমার হয়ে। সারাজীবন তোমার হয়েই থাকতে চাই ইরা। হাসবেন্ড হিসেবে ফাহিম তো খুবই ভালো। ফাহিমও তোমাকে খুব ভালোবাসে ইরা।

হাসবেন্ড আর প্রেমিকের ভালোবাসা দিয়ে কি আমার বুকের হাহাকার দূর হবে রাতুল? আমার এই হাহাকারটা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভালোবাসা দিয়েও মিটবে না। শতকোটি মানুষের ভালোবাসা দিয়ে আমি কি মা ডাক শুনতে পাব বলো! ইরা হু হু করে কেঁদে ওঠে।

ভালো ডাক্তার দেখাও, একদিন ঠিক ঠিক মা ডাক শুনতে পাবে তুমি। রাতুল ইরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সান্ত্বনা দেয়।

চেষ্টার তো কোন ত্রুটি করছি না রাতুল। দেশ, বিদেশের কত বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি! তারাবিহীন দূরের নিঃসঙ্গ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আশাহত গলায় বলে ইরা।

ডুবে যাওয়ার মুহুর্তে মানুষ এক টুকরো খড়কুটোকে যেমন আঁকড়ে ধরে তেমনিভাবে রাতুলকে বুকে আঁকড়ে ধরে ইরা বলে উঠে,সবকিছুর বিনিময়ে আমি মা ডাক শুনতে চাই,রাতুল। বলো, আমার এই শখ কি কোনদিন পূরণ হবে না?

হবে,অবশ্যই হবে। ধৈর্য হারিও না প্লিজ। ডাক্তাররা তো চেষ্টা করছেন। রাতুল ইরার মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে বলে। রাতুল বোবা চোখে চুপচাপ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি কিভাবে তোমার এই কষ্ট দূর করব,বলো ? আমার তো সেই সাধ্য নেই ইরা। আমি শুধু আমার বুকের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিতে পারি তোমায়। আমি জানি, তোমাকে সবটুকু পাওয়া হবে না আমার কোনদিন। যেভাবে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি থাকব সারাজীবন।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি,খুব।আমি ফাহিমের সঙ্গে এতবড় বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারব না কখনও।ফাহিম যে আমার বন্ধু,খুব ভালো বন্ধু ইরা। তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কটার জন্যই সারাক্ষণ দহন যন্ত্রনায় জ্বলছি।আমি আসতে চাইনি তোমার সঙ্গে একা অফিসের এই ট্যুরে।এমনিতেই আমরা একটা রিলেশনে জড়িয়ে গেছি ।এমন একটা রিলেশনে থেকে দুজন একসঙ্গে এই ট্যুরে আসার সাহস হয়নি আমার। যদিও নিজের উপর আস্থা আছে তবুও কেন জানি ভয় হচ্ছিল। কিন্তু তুমিই বসকে বুঝিয়েছ,এই প্রজেক্টে যেহেতু দুজন একসঙ্গে কাজ করছি তাই সার্ভেতে আমি থাকলে সুবিধা হবে। আমি অন্য একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে এই ট্যুরে আসাটা এড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে নিয়ে এলে। আমি বুঝি তোমার কষ্ট। আমার কাছে তুমি তোমার কষ্টগুলো যতটা উজার করতে পার ততটা তো আর কারও কাছে পার না।
ঝর্না এয়ারপোর্টের ছবি থাকবে না, তাই কি হয়? ইরা হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় ঝর্নার দিকে।

থাকবে না কে বলল? হাজারখানেক হয়ে গেছে। তুমি তো আসমানে ছিলা, তাই ডাকতে পারি নাই। ঝর্না বলে।

ইরা প্রায় বত্রিশটা দাঁত বের করে ইউএস বাঙলার কাউন্টারের সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়ায়। ইরার পাশে হৈ হৈ করে আবার সবাই দাঁড়িয়ে যায়।একেকজন আবার একেক ভাবে পোজ দেয়,সঙ্গে ইরা,যেন তারা এতক্ষণ একটাও ছবি তোলে নি!ঝর্না এবার বিরক্ত হয়ে বলে,ছবি তুলতে তুলতে আমার হাত ব্যাথা হয়ে গেল, তোমাদের ঠ্যাং আর ঠোঁট ব্যাথা হয় না ক্যান?

ঝর্না আমার এই সানগ্লাস পরে কোন ছবি তোলা হয় নি এখানে,একটা প্লিজ। বুলা পোজ দিয়ে দাঁড়ায়।

এটাই কিন্তু শেষ, আর না। একটু পরেই প্লেনে উঠতে হবে। বুড়ি মহিলাদের এত ঢং আসে কোত্থেকে বুঝিনা! ফোনের ক্যামেরায় একটার পর একটা ক্লিক শেষে ঝর্না গজ গজ করতে করতে হ্যান্ড ব্যাগগুলো গোছাতে শুরু করে।

রোজ ঠোঁটে তাড়াহুড়ো করে লিপস্টিক ঘঁষে ঝর্নার দিকে আগায়,লিপস্টিক ঘোঁষার ব্যস্ততার কারণে ঝর্নার মেজাজটা খেয়াল করে নি।জেসমিন ইশারায় বুঝিয়ে দেয়। বেচারা রোজের মুখের কালো ছায়া দেখে জেসমিনের মায়া হয় খুব,সে তার ফোন দিয়ে ছবি তুলে দেয় রোজকে। রোজের মুখের কালো ছায়া দূর হয় কিন্তু হালকা কুয়াশা দূর হয় না। ঝর্না ছাড়া এই কুয়াশা কেউ দূর করতে পারবে না। সবার ফোনের ক্যামেরা থাকলেও ঝর্নার ফোনের ক্যামেরা সবচেয়ে ভালো আর ঝর্ণার ছবি তোলার সেন্সও খুব ভালো। তাছাড়া নয়জন সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র ঝর্নার নিজের ছবি তোলার নেশাটা একটু কম বলে অন্যদের ছবি তুলে দেয় সে। অন্যদের ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য নিজেও তোলে।

প্লেনে উঠে যার যার সিটে সবাই বসল। এরপর সুরাইয়ার খেয়াল হলো তার পায়ে যে পায়েল পরা আছে সেটা এতক্ষণ তার মনে ছিলো না। ইশ! এতক্ষণ যে শ’য়ে, শ’য়ে ছবি তুললাম একটাতেও তার পায়ের এত্ত সুন্দর পায়েলটা ওঠে নাই! সুরাইয়া যেন দপ করে নিভে গেল!এত শখ করে পায়েলটা পরলাম,আর সেটার কথায় বেমালুম ভুলে গেলাম! হাসির দিক দিয়ে অন্যরা কেউ কাউকে হারাতে না পারলেও সুরাইয়া সবাইকে হারিয়ে দেয় অনায়াসে।সেই হাসির রাজা সুরাইয়ার মুখটা ভার! পাশে বসা রোজ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,ঘটনা কি? সুরাইয়া বলল তার দুঃখের কাহিনী। ঝর্নার মেজাজ ততক্ষণে ঠান্ডা হয়েছে। সুরাইয়ার রিনঝিন হাসির শব্দ ঢেউ তুলছে না জন্য সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে মনো সংযোগ করেছে।পেছনের সিটে বসে সুরাইয়ার দুঃখের কাহিনী শুনে ঝর্না অনেক কসরত করে প্লেনের মধ্যেই বিভিন্ন এঙ্গেলে পায়েলসহ সুরাইয়ার ছবি তুলে দিল। এই সুযোগে অন্যরাও চান্স নিল।

পৌঁছে হোটেলে ব্যাগ বোচকা রেখে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সমুদ্রে ছুটে যায় তারা।সমুদ্র হোটেলের খুব কাছে,কয়েকগজ দূরেই।সমুদ্রের রাশি রাশি ঢেউয়ের তালে তালে ঝাঁপা ঝাঁপি,নাচা নাচি আর ছবি তোলা তুলি শেষে ওরা আবার হোটেল রুমে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে প্রবাল বীচের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।চাঁদের গাড়িতে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাওয়াই চুল দোলাতে দোলাতে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে চলল। দূর থেকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না এরা সবাই ৫০ উর্দ্ধ নারী। প্রবাল বীচটার এখানে সেখানে অজস্র ছোট বড় প্রবাল ছড়ানো ছিটানো আছে। উপরের আকাশটা যেন নীল রং মেখেছে।নীল আকাশে গোল বড় চাঁদটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। আকাশ থেকে নীল রংটা যেন বীচের পানিতে এসে মিশেছে। পুরো বীচটা নীলাভ আলোয় মাখামাখি। বীচের নীল পানিতে পা চুবিয়ে ইরা বড় একটা প্রবালের উপর চুপ করে বসে দূরে আকাশ আর সাগরের ঢলাঢলি দেখছে। অন্যরা সবাই ফটোসেশনে ব্যস্ত।

সেবার রাতুলের সঙ্গে চারদিনের অফিসের নেত্রকোনার ট্যুর শেষে চার মাস পর আবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা দেয় ইরা আর রাতুল। এবার অফিসের ট্যুরে নয়। ব্যক্তিগত ট্যুরে যায় ইরা আর রাতুল। ইরা তার ব্যাংকার স্বামী ফাহিমকে বলেছে অফিসের ট্যুরে যাচ্ছে সে। অফিসের ট্যুরে প্রায়ই ইরাকে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। তাই ফাহিমের মনে কোন সন্দেহ জাগে নি। তাছাড়া ইরার উপর একশত ভাগ বিশ্বাস আছে ফাহিমের।

কক্সবাজারের ইনানী বীচে ইরা রাতুলের হাত ধরে সমুদ্রের ঢেউ চিরে চিরে গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতের গোল বড় চাঁদটা রেশমের মতো সাদা চাদরে ওদেরকে মুড়িয়ে রেখেছে, জড়িয়ে রেখেছে। বড় বড় ঢেউ গুলো ওদের গোড়ালি ছাড়িয়ে হাঁটুতে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্র ধীরে ধীরে উত্তাল হচ্ছে।ইনানী বীচটা খুব নিরিবিলি। দিনের বেলায় মানুষের আনাগোনা কম। রাতে একদম জনশূন্য। ওরা দুজন ইনানী বীচের কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে।

কিছুদূর আসার পর উত্তাল সমুদ্রের ফুঁসে ওঠা একেকটা ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে রাতুল শিওরে ওঠে,ভয়ার্ত গলায় বলে,চলো,তীরে ফিরে যাই।

ইরা রাতুলের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে, আরে দূর, এত ভয় পাও কেন? আমি তো আছি। পদ্মার পাড়ে বেড়ে ওঠা মেয়ে আমি। তোমার মতো ঢাকার হোস্টেলে বেড়ে উঠি নি। এই ছোট ছোট ঢেউ আমায় কিচ্ছু করতে পারবে না। বর্ষায় উন্মত্ত পদ্মায় সাঁতার কেটে বড় হয়েছি আমি।

সমুদ্র রাতুলকে টানে। খুব টানে। মাঝে মাঝেই সে সমুদ্রে ছুটে আসে। তীরে সমুদ্রের পানিতে পা রেখে চুপটি করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। দূর থেকে আসা বড় বড় ঢেউ গুলো মিলিয়ে যেতে যেতে ওকে জড়িয়ে ধরে। সমুদ্রের এত গভীরে আসে নি কখনও। এত বড় বড় ঢেউ এর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। রাতুল সত্যিই ভয় পাচ্ছে।ও সাঁতার জানে না। পদ্মা কি ও তো ছোট পুকুরেও নামেনি কখনও। তবে ইরা আছে ভেবে সাহস সঞ্চয় করছে।

ওরা দুজন হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা রাতুলের কাঁধে মাথা রেখে বড় চাঁদটার দিকে তাকায়। মায়াবী চাঁদটা যেন হাসছে ওদের দিকে তাকিয়ে। ইরা সমুদ্রের দিকে তাকায়। দূর থেকে ভীষণ মুর্তি ধারন করে চোখ রাঙিয়ে, গর্জন করতে করতে ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ছে ওদের বুকে। রাতুল কে শক্ত হাতে ধরে আছে ইরা। রাতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, কি ভয় করছে?

নাহ, একদম না। ভয় কেটে গেছে এখন। তুমি তো আছ।,রাতুল মুগ্ধ হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকায়।

ঝুপ করে একটা শব্দ,সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায়।

ইরা কিছুক্ষণ একা নিঃসীম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র ততক্ষণে আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে। গোল বড় চাঁদটাকে সঙ্গী করে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তীরে উঠে দাঁড়ায় ইরা।

আচ্ছা ইরার হলোটা কি? কান্তা রোজকে উদ্দেশ্য করে ফোন স্ক্রল করতে করতে বলে, এর আগের কোন ট্যুরে ওকে তো কখনও এমন মনমরা হয়ে থাকতে দেখিনি!

রোজের মুখ চোখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে,আসলেই, প্রতিটা ট্যুরে কি প্রাণোচ্ছ্বল থাকে সে, এবার কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে!

সবাই ইরার কাছে যায়।

তোমাকে এমন জোর করে আনা উচিৎ হয়নি আমাদের, তাই না ইরা? রাকা বলে।

ইরা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে, কি আবোল তাবোল বলছ তোমরা! আমি আসতে না চাইলে কেউ কি আমাকে জোর করে,ভুলায়ে ভালায়ে আনতে পারত? দূরে হাত উঁচিয়ে বলে,এমন নীল আকাশ আর সাগরের জড়াজড়ি,মাখামাখি আর চুমাচুমি দেখলে,মনটা উদাস না হয়ে কি পারে!

সবাই চাঁদের গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় চুল দোলাতে দোলাতে গলা ছেড়ে গান ধরে।গাড়ি হোটেলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।

হোটেলে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে সবাই ঝর্না, লিপি আর রোজের রুমে হাজির হলো। এই বড় রুমে তিনজন একসঙ্গে আছে। বাকিরা দুজন করে এক রুমে আছে। যাইহোক সঙ্গে নিয়ে আসা স্পিকারে গান ছাড়া হলো। গান শুরু হলে ইরা কখনও স্থির থাকতে পারে না। নাচানাচি শুরু করল। এরপর জেসমিন, লিপি, বুলা, শুরু করল নাচ। সবাই পা আর কোমড়ের ব্যাথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তুমুল নাচানাচি করছে।

নাচতে নাচতে বুলা বলল, এই রাতুল কিন্তু আমাদেরকে আর এই হোটেলে নেক্সট টাইট আসতে দেবে না। গানের ভলিউম কমাও।

ইরা চমকে তাকায়, রাতুল কে?

কেন তুমি এখনও জানো না? বুলা ব্যাথা কোমড়টা বাঁকিয়ে নাচতে নাচতেই বলল, এই হোটেলের মালিক রাতুল। আমার হাসবেন্ড এর বন্ধুর ভাই। ওর কারণেই আমরা এখানে উঠেছি। বেশ বড় এমাউন্টের কনসেশনও দিয়েছে রাতুল। তা না হলে আমরা কি ফাইভ স্টার এই হোটেলে উঠতে পারতাম।
শোন, চাকুরী আমি বেশিদিন করব না ইরা।চাকুরী করতে আমার ভালো লাগে না। ব্যবসায়ীর ছেলে তো।দাদাও কিন্তু বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা আমার রক্তে রক্তে। ইনানী বীচের ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে যেতে যেতে রাতুল সেদিন বলেছিল। আমি কক্সবাজার এ একটা হোটেল দিব। এক্কেবারে ফাইভ স্টার হোটেল, বুঝছ।

তোমার দেশের বাড়ি তো রাজশাহী,ওদিকে না দিয়ে,কক্সবাজার কেন? ইরা প্রশ্ন করে।

তুমি তো জান,সমুদ্র আমায় টানে সবসময়। আমার বুকের মধ্যে সবসময় সমুদ্রের গান বেজে চলে। সবসময় মনে হয় সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে সারাক্ষণ চুপচাপ সমুদ্রের সেই গান শুনি। কক্সবাজারে হোটেল দিলে রথ দেখাও হবে, কলা বেচাও হবে।

আমার আবার দেশের বাড়ি! রাতুল এর ঠোঁটে শ্লেষ মাখানো হাসি ফুটে ওঠে। ডিভোর্সী মা বাবার ছেলে আমি!সেই ছেলেবেলাতেই মা বাবার ডিভোর্স হয়েছে। মা বিদেশে আর একজনের সঙ্গে সংসার করছে। বাবা বিয়ে করেনি। তবে আমাকে সঙ্গেও রাখেনি কখনও। ছয়মাস বিদেশে, ছয়মাস দেশে থাকে। ছেলেবেলা থেকে বোর্ডিং স্কুলে পড়েছি। কী অদ্ভুত জীবন আমার!উদাসী আকাশের দিকে তাকায় রাতুল।

হ্যাঁ,রাতুল চাইলে ফাইভ স্টার হোটেল দিতে পারবে। ওর ব্যবসায়ী বাবা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন ।ছেলেবেলাতেই বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছেন,সঙ্গে রাখেন নি রাতুলকে।রাখবেন কিভাবে,মাসের অর্ধেক সময়ই ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে থাকেন,তখন ওকে দেখবে কে? ছুটিছাটায় দেশে থাকলে রাতুল বাবার সঙ্গে থাকে। রাতুলের বাবা বিয়ে করেন নি। বাবা মার প্রতি খুব অভিমান রাতুলের। বাবার সব সম্পদের মালিক তো রাতুলই। ফাইভ স্টার হোটেল দিতে তার খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। একরকম শখের বসেই এই চাকুরীতে ঢুকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছে,একটা ভালো চাকুরিতে না ঢুকলে কি মুখ রক্ষা হয়! চাকুরীটা হয়তো এতদিন ছেড়েই দিত কিন্তু ইরার সঙ্গে সম্পর্কটাই ওকে চাকুরিতে আটকে রেখেছে।

বিয়ের বয়স পার হলেও বিয়ে করেনি রাতুল। বাবা মার ডিভোর্সের কারণে সে পণ করেছে বিয়ে করবে না কোনদিন। বিয়ে করলে ওর সংসারটাও যদি না টেকে।যে মানসিক যন্ত্রণা হায়েনার মতো সেই ছেলেবেলা থেকে এখন অব্দি ওকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে, ও চায় না সেই হায়েনা তার সন্তানকে আক্রমণ করুক।নাহ,কোনদিন সে তা হতে দেবে না।কোনদিন না।

রাতুল সমুদ্রের লোনা পানি আঁজলা ভরে তুলে উপরে ছুঁড়ে আবারও ইরার হাতটা শক্ত করে ধরে,আমি কক্সবাজারে হোটেল দিলে তুমি কিন্তু মাঝে মাঝেই আসবা ।তোমাকে বেশিদিন না দেখলে আমি থাকতে পারব না কিন্তু।কথাটা মনে থাকবে তো!

কি হলো ইরা রাতুলের কথা শুনে তোমার নাচ বন্ধ হলো কেন? আর কি এমন গভীর হয়ে ভাবছ? রাতুলকে চেন নাকি তুমি? বুলা নাচ না থামিয়ে ব্যাথা কোমড়টা ডলতে ডলতে বলে ওঠে।

আরে দূর!রাতুলকে আবার আমি চিনব কেমনে? আবার নাচতে শুরু করল ইরা।

পায়ের প্রচন্ড ব্যথায় উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে না পারায় ঝর্না বসে বসেই দু হাত উপরে উঠিয়ে নাচাচ্ছে,বিপুল বেগে শরীর দোলাচ্ছে!সুরাইয়া তার কোমড় ব্যাথা নিয়ে কিছুক্ষণ নাচের নামে লাফালাফি করে কাবু হয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। অন্যরা কিছুক্ষণ তুমুল নাচানাচি শেষে ক্ষ্যান্ত দিল। গান চলতে থাকল। খাওয়া দাওয়া চলছে আর আড্ডা চলছে সমানে। সারাদিনের ছুটাছুটির পর সবার একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছে । প্রতিবারের মতো এবারও ইরা শুরু করে তার মোক্ষম চাল। প্রতিবার ট্যুরে রাতের ঘুম দূর করার ওষুধ ইরার কাছ থেকেই আসে। ওষুধের নাম হলো প্রেম। এই শব্দটা মুখ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার ঘুম হাওয়া। ঘুম দূর করার এই ওষুধটা ইরাই আবিস্কার করেছে।

কুড়মুড় করে চিপস চিবাতে চিবাতে ইরা বলে,৫০ পরবর্তী এই আধ বুইড়া জীবনে এসে কার কার প্রেম এখনও জেগে আছে, বলো তো?

ঘুমে ঢুলে ঢুলে ইরার চেয়ে বয়সে বেশ বড় সুরাইয়া বলে, ৫০ এর পর কি আর স্বামীর প্রতি প্রেম থাকে রে পাগলী! থাকে না। যা থাকে তা হলো মায়া। আহা! কি যে মায়া!

ইরা সবার দিকে তাকিয়ে দেখে,সবাই ঘুমে ঢুলছে। রাকা তো ঘুমে প্রায় বিভোর। নাহ,ডোজটা ঠিকমতো হলো না, ঘুম তো ছুটছে না কারও! শুধু প্রেম নামের এই ওষুধের ডোজে আর কারও ঘুম ছুটবে না। প্রতিবার ট্যুরে এক ডোজ ব্যবহার করতে করতে রেজিস্ট্যান্স হয়ে গিয়েছে। কাজ করছে না।এবার ডোজ বাড়াতে হবে।বেড়াতে এসে সারারাত আড্ডা না দিলে বেড়ানোটা কি একশ ভাগ ফুলফিল হয়!

সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে ইরা বলল, আমি কি বদ্ধ পাগল হইছি নাকি, যে স্বামীর প্রতি প্রেমের কথা বলব! আরে বাবা অন্য পুরুষকে দেখলে আমাদের মতো বুড়িদের মধ্যে এখনও কার কার প্রেম জাগে? পরকিয়া টরকিয়া করতে মন চায় নাকি কারও?

সবাই লাফিয়ে উঠল।

আমার পরকিয়া করতে মনচায়, খুব চায়। ইরা সবার দিকে তেরসা চোখে তাকিয়ে স্পিকারের ভলিউমটা একটু কমিয়ে দেয়।

সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, কি সর্বনাশ!

বুলা বলে উঠল, এই বুইড়া বয়সে এসে পরকিয়ার পাগলামোতে ধরছে বলেই কি তুমি এবার এমন অদ্ভুত আচরন করছ?

হ্যাঁ,পরকিয়াই বলতে পারো তোমরা,তবে গতানুগতিক নয়,একটু অন্যরকম পরকিয়া। বুলার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ইরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,যে পুরুষ ফিজিক্যাল রিলেশন করতে চাইবে না,সেরকম একজনের সঙ্গে পরকিয়া করতে চাই আমি। শুধু দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটব আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব দুজনার দিকে।

ঝর্না,লিপি আর বুলা সমস্বরে বলে উঠল,এমন পুরুষ দুনিয়ায় নাই।

রোজ বলে,হাত ধরা পুরুষ তুমি কোথাও খুঁজে পাবা না। তোমাকে সবই—।রোজের কথা শেষ হলো না,মাঝরাতে হাসির রোল পড়ল।

কান্তা যথারীতি ফোন চাপতে চাপতে, বুইড়া হইতে তোমাদের আর কত দেরী পাঞ্জেরী!কি আশ্চর্য!

সুরাইয়া ফুলে ঢোল হওয়া হাঁটুতে গরম কফির কাপটা ঠেঁসে ধরে,বুইড়া হইতেই হবে এমন কোন আইন আছে নাকি কোথাও!

কিছুক্ষণ আগে ঘুমে বিভোর রাকা বড় বড় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলে, বিয়ের পর থেকেই আমার কখনও অন্য পুরুষকে দেখলে প্রেমের অনুভূতি হয় নি। কিন্তু হওয়া উচিত। হইলে মন ভালো থাকে। আমার খুব আফসোস,আমার ক্যান এই অনুভূতি নাই!

স্কুল জীবনে আমার প্রেমে যে ছেলেটা হাবুডুবু খেত কিন্তু আমি প্রেম করিনি, লাজুক মুখে জেসমিন বলে চলে, এই বৃদ্ধ বয়সে সে আমাকে ফেসবুকে খুঁজে পেয়ে ফোন দেয়। ও ফোন দিলে আমার খুব ভালো লাগে। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি। সুবিধা হলো, সে বউ, ছেলে, মেয়ে, নাতি পুঁতি নিয়ে বিদেশে থাকে। ইরার দিকে তাকিয়ে জেসমিন মুচকি হেসে, আমার হাত ধরারও রিস্ক নাই। ও যখন ফোন দেয় আমার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। এটাকে প্রেম বলো আর পরকিয়াই বলো, বলতে পার। তবে আমার যে স্বামীর প্রতি আকর্ষণ বা ভালোবাসা কমেছে এমন কিন্তু নয়। সবকিছু আগের মতো চলছে শুধু সে ফোন করলে আমার ভালো লাগে। এই ভালো লাগা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব কেন বলো? বঞ্চিত করার কোন মানেই নেই। তাই আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি।

রাকা ছাড়া সবাই বলে ওঠে,ইশ,আমাদের প্রেমিকেরা যদি আমাদেরকে এমন করে খুঁজে বের করত !

মায়ের মারধর খেয়ে কত কষ্ট করে পাঁচ,পাঁচটা প্রেম করলাম।লিপির গলায় আপসোস, শালারা এত নিষ্ঠুর!এতটা বছর ধরে কেউ একটু খুঁজলও না।ফেসবুকের এই দুনিয়ায় খুঁজলে তো পেতই আমাকে।

রোজ বলে,ওরা খোঁজেনি তো কি হয়েছে,তুমি খুঁজে নিয়ে জেসমিনের মতো চালিয়ে যাও।

ধ্যাত,নিজের একটা ভাব আছে না!আমার হাতে পায়ে ধরে যারা একসময় প্রেম করেছে,তাদের সঙ্গে আমি নিজে খুঁজে কথা বলব! তা কি হয়! নাহ,তা হয় না। লিপি হাই তুলতে তুলতে,কব্বরে তো এখনও যাই নি।সময় তো আছে,অপেক্ষা করি, জেসমিনের মতো কপাল খুলতেও পারে‌।

সবাই হাই তুলতে তুলতে হেসে ওঠে। ফজরের আজানের শব্দে সবাই চমকে ওঠে যার যার রুমে চলে যায়।

ইরার ঘুম আসছে না কিছুতেই। পাশে তাকিয়ে দেখে রাকা ঘুমে বিভোর। ইরা ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সেবার ইরা কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার সপ্তাহ দুয়েক পর ছুটির দিনের এক সকালে ফাহিম বলে,কিছুদিন ধরে তোমাকে খুব খুশি খুশি দেখছি, কেন ?

ইরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসে।

ফাহিম বলে,পিরিয়ড কমাস ধরে বন্ধ তাই খুশি!এত খুশি হয়ো না প্লিজ। প্রতিবারের মতো এবারও কষ্ট পাবে। বিয়ের প্রায় ১৫ বছর ধরে কতবার যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে!তবুও কেন তুমি এমন আশা করে থাক,বলো তো? কত দম্পতিদেরই তো বাচ্চা নেই।ওরা তা মেনে নিয়েই সুন্দরভাবে জীবন কাটাচ্ছে।কষ্ট হয়তো হয় ওদের কিন্তু সেই কষ্টকে জয় করেই ওরা ভালো থাকে,হাসিখুশি থাকে।আমাদের জীবনও কেটে যাবে।তুমি কেন মেনে নিতে পারো না ইরা!সারাক্ষণ তুমি কি যে বিষন্ন থাকো!তোমার সারা মুখে যেন কষ্ট লেপ্টে থাকে!মেনে নাও। এত কষ্ট পেয়ো না প্লিজ।ফাহিম ইরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,আমি তো আছি।

এর মাসখানেক পর ইরা ফাহিমকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়।ডাক্তার জানায়, ইরা প্রেগন্যান্ট। রাতুলের সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার আগে ইরা একা একা ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সেটা সে ফাহিমকে জানায় নি। আর এক , দুমাস যাক,ডেঞ্জার পিরিয়ডটা পার হোক,তারপর সে জানাবে ফাহিমকে।

যাইহোক ডাক্তারের কাছ থেকে বাসায় ফিরে ফাহিম ইরাকে বুকে জড়িয়ে ছিলো সারারাত।পরদিন থেকে অফিসের ব্যস্ততা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলে ফাহিম।সে যেন কিছুদিন ধরে অফিসের মাঝেই ডুবে থাকতে চাইতো।এখন অফিস ছাড়া বাকি সময়টুকু সারাক্ষণ ইরার যত্ন আত্মিতেই কাটিয়ে দেয় ফাহিম।

কমাস পর ইরার ফুটফুটে একটা ছেলে জন্ম নেয়। ফাহিম আর ইরা মিলে নাম রাখে তন্ময়। তন্ময় জন্মানোর পর ফাহিমের তন্ময়তা যেন কাটতেই চায় না!সারাক্ষণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে থাকে।খাওয়া, ঘুম ভুলে তন্ময়কে তন্ময় হয়ে দেখে ফাহিম। ইরা জোর করে ফাহিমকে অফিসে পাঠায়। ফাহিমকে জোর করে অফিসে পাঠায় ঠিকই কিন্তু ছেলেকে কাজের বুয়ার কাছে রেখে নিজে অফিসে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না।নানা,নানী,দাদা,দাদী বা কোন আপনজন কেউ এসে যে তন্ময়ের কাছে থাকবে সেটাও সম্ভব নয়।চাকুরী করলে ছেলেকে কাজের বুয়ার কাছে রেখে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।আর তাতে ফাহিম ও ইরার মন কিছুতেই সায় দেয় না।তাই চাকুরীটা শেষপর্যন্ত ছেড়ে দেয় ইরা।

ইন্টারকমের শব্দে চমকে ফোনটা ধরে সে। রাকা আড়মোড়া দিয়ে তাকায়।ওপাশ থেকে রোজ জানায়,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাস্তা করতে চলো। সকালের নাস্তা সেরে ওরা হিমছড়ি,লাবণী বীচ,কলাতলী বীচে সারাদিন কাটিয়ে রাতে ফিরে এলো।রাতে আড্ডা শেষে ঘুমাতে গেল।আজ ওরা বেশি রাত পর্যন্ত আড্ডা দিল না কারণ ফেরার জন্য খুব ভোরে এয়ারপোর্ট যেতে হবে।

ইরা ছাদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। পাশে ঘুমন্ত রাকা চি চি শব্দে নাক ডাকছে। ইরা ঘড়ির দিকে তাকায়,রাত দুইটা। নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে।কয়েকগজ দূরেই সমুদ্রের দিকে একা হাঁটতে শুরু করে। নিঃসীম সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ায় ইরা। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ওর পায়ে। চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। আকাশের বড় চাঁদটা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।নিঝুম,নিরব রাতে সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে ইরা কান পেতে সমুদ্রের কথা শুনছে। সমুদ্র যেন একমনে তার না বলা সব কথা বলে চলেছে অবিরত। কখনও তার কন্ঠ উঁচুতে উঠছে,কখনও নীচু স্বরে কথা বলছে। বিশাল সমুদ্রের কাছে কখনোও কখনোও নিজেকে ওর অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছে।আবার কখনও মনে হচ্ছে ও যেন কোন মানুষ নয় যেন একটা বিন্দু হয়ে সমুদ্রের বুকে ভাসছে। মনে হচ্ছে সমুদ্র ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।পুরো পৃথিবীটা যেন আস্ত একটা সমুদ্র। সে যেন বাতাস হয়ে সমুদ্রকে জড়িয়ে আছে।

রাতুল এসে ইরার কাঁধে হাত রাখে। ইরার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়।

তন্ময়ের পিতৃত্বের অংশীদার হয়ে এই পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকুক আমি চাইনি রাতুল! রাতুলের কাঁধে মাথা রেখে ইরা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের ফুঁসে ওঠা ঢেউয়ের দিকে। তরঙ্গায়িত ফেনিল ঢেউ রাশির মধ্যে তার অতি চেনা,অতি আপন মুখাবয়বটি ডুবছে আর ভাসছে,ভাসছে আর ডুবছে।একসময় সেই চিরচেনা মুখটি দুধ সাদা ফেনায়িত ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়!
***********************************

Leave a Reply