মারিও ভার্গাস য়োসা এবং তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য – ওরহান পামুক
অনুবাদ: খালেদ হামিদী
তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য বলে কি কিছু আছে? অশ্লীলতা বা সংকীর্ণতার শিকার না হয়ে এটা কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যে, সেসব দেশের সাহিত্যের মৌলিক গুণাবলী যা গঠন করে তা-ই আমাদের কথিত তৃতীয় বিশ্ব? সবচেয়ে সূক্ষ্ম উচ্চারণে, দৃষ্টান্তস্বরূপ, এডওয়ার্ড সাঈদ বলেন, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের ধারণাটি সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও প্রান্তিকতার পরিসর এবং অ- পশ্চিমা পরিচয় ও জাতীয়তাবাদের সাথে তাদের সম্পর্কটা তুলে ধরে। কিন্ত যখন ফ্রেডারিক জেমসনের মতো কেউ দাবি করেন যে, “তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য জাতীয় রূপক হিসেবে কাজ করে”, তখন তিনি কেবল প্রান্তিক বিষয়ে সাহিত্যের সম্পদ এবং জটিলতার প্রতি বিনম্র নির্লিপ্ততা প্রকাশ করেন। বোর্হেস আর্জেন্টিনায় ১৯৩০-এর দশকে তাঁর ছোট গল্প ও প্রবন্ধগুলি লেখেন। আর্জেন্টিনা ক্লাসিক অর্থে তৃতীয় বিশ্বের দেশ। কিন্তু বিস্বসাহিত্যের একেবারে কেন্দ্রে বোর্হেসের স্থান অবিসংবাদিত।
তবুও এটা স্পষ্ট যে বর্ণনা বা আখ্যানধর্মী উপন্যাসই তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের একটা নির্দিষ্ট ধরন। এই সাহিত্যের মৌলিকত্বে, পৃথিবীর সাহিত্যিক কেন্দ্র থেকে তিনি যে ঢের দূরে বসে লিখছেন এই সত্য জানার চেয়ে, লেখকের ভৌগলিক অবস্থানের অবদান কম। এবং, এই দূরত্ব তিনি নিজের ভেতরে অনুভব করেন। যদি তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যকে আলাদা করে এমন কিছু থাকে, তবে তা সেই দেশগুলোর দারিদ্র্য, সহিংসতা, রাজনীতি বা সামাজিক অস্থিরতা নয় যেখান থেকে এটি প্রকাশিত হয়। বরং তা লেখকের সচেতনতা বা এই মর্মে সজাগ থাকা যে তাঁর কাজ কোনো না কোনোভাবে সেসব কেন্দ্র থেকে দূরে যেখানে তার শিল্পের ইতিহাস ও উপন্যাসের শিল্প বর্ণনা করা হয়েছে। এবং, তিনি তাঁর কাজে এই দূরত্বটা প্রতিফলিত করেন। এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তৃতীয় বিশ্বের লেখকের বিশ্বের সাহিত্যকেন্দ্র থেকে নির্বাসিত হওয়ার অনুভূতি। তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখক তাঁর স্বদেশ ছাড়তে পছন্দ করতে পারেন অথবা ভার্গাস য়োসার মতো ইয়োরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর যে কোনও একটিতে পুনর্বাসিত হতে পারেন। কিন্তু তাঁর স্বকীয় অনুভূতি নাও বদলাতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের লেখকের ওই “নির্বাসন” বেশিরভাগই চেতনাগত অবস্থা হিসেবে ভৌগলিক ব্যাপার নয়। বরং, এটা চিরস্থায়ীরূপে বিদেশী হওয়ার দরুন বহিস্কৃতের অনুভূতিরই নামান্তর।
একই সময়ে আগুন্তুক হয়ে থাকার অনুভূতি তাঁকে তাঁর মৌলিকত্ব বিষয়ক উদ্বেগ থেকে মুক্ত রাখে। নিজস্ব কণ্ঠস্বর খোঁজার জন্যে তাঁকে তাঁর পিতা কিংবা অগ্রদূতদের সাথে আবেশী প্রতিযোগিতায় নামার প্রয়োজন পড়ে না। কেননা তিনি নতুন ভূখণ্ড অন্বেষণ করেন। এমন সব বিষয় স্পর্শ করেন যেগুলো তাঁর সংস্কৃতিতে কখনও আলোচিত হয়নি। এবং, এগুলো প্রায়শই স্বতন্ত্র ও নতুনভাবে উদ্ভূত সম্পর্কগুলোকে সামনে নিয়ে আসে যেগুলো তাঁর দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। এভাবে এগুলো তাঁর লেখাকে নিজস্ব ধরনের মৌলিকতা ও সত্যতা দেয়।
সীমন দ্য বোভোয়ারের লেস বেলেস ইমেজেস-এর প্রাণবন্ত পর্যালোচনায় ভার্গাস য়োসা অমন বৃত্তির নির্ধারক নীতি কী হতে পারে মর্মে পরামর্শ দেন। তিনি বোভোয়ারের প্রশংসা করেন শুধুমাত্র একটি উজ্জ্বল উপন্যাস লেখার জন্যে নয়, বরং তখনকার কেতাদুরস্ত (১৯৬০-এর দশক) নুভিয়াম রোমানের উদ্দেশ্য প্রত্যাখ্যানের জন্যে। ভার্গাস য়োসার মতে, বোভোয়ারের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব হলো অ্যালেট রব-গ্রিলেট, ন্যাথালি সাররাউট, মিশেল বুটর এবং স্যামুয়েল বেকেটের মতো লেখকদের ঔপন্যাসিক রূপ ও লেখার কৌশল গ্রহণ করেও তাঁদের সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া।
ভার্গাস য়োসা সার্ত্রের ওপর লেখা তাঁর অন্য আরেক প্রবন্ধে অপর লেখকদের কৌশল ও আঙ্গিকের ‘ব্যবহার’ সম্পর্কিত নিজের ধারণা বিস্তৃত করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে ভার্গাস য়োসা অভিযোগ করেন যে সার্ত্রের উপন্যাসগুলো বুদ্ধিদীপ্তি ও রহস্যবর্জিত, স্পষ্টভাবে লেখা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত (অথবা বিভ্রান্তিকর)। এবং তাঁর শিল্প পুরোনো ও গতানুগতিক। য়োসা হতাশা প্রকাশ করেন যে তাঁর নিজের মার্কসবাদী দিনগুলোতে, এমনকি এর আগের অবস্থায়ও, তিনি সার্ত্রের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। লে মন্ডে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পড়ে জাঁ পল সার্ত্রের প্রতি তাঁর মোহভঙ্গের কথা ভার্গাস তারিখসহ উল্লেখ করেন। সেই কুখ্যাত প্রবন্ধে (যা তুর্কিয়েতেও ঢেউ তোলে) সার্ত্র বায়াফ্রার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ক্ষুধায় মৃত্যুমুখি এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর পাশে সাহিত্য রেখে ঘোষণা দেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত অনেক দুর্ভোগ চলছে ততক্ষণ পর্যন্ত গরিব দেশগুলোর জন্যে সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্টতা একটা “বিলাসিতা”। এমনকি তিনি এমনও পরামর্শ দেন- তৃতীয় বিশ্বের লেখকেরা কখনোই পরিষ্কার বিবেক নিয়ে সাহিত্যের তথাকথিত বিলাসিতা উপভোগ করতে পারবেন না। এবং, এই উপসংহারে উপনীত হন যে সাহিত্য ধনী দেশগুলোর ব্যবসা। ভার্গাস য়োসা স্বীকার করেন যে সার্ত্রের চিন্তাভাবনার নির্দিষ্ট দিক, তাঁর যত্নশীল যুক্তি এবং জেদ যে সাহিত্য একটি ‘খেলা’ হওয়ার জন্যে সর্বদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা “সেবাযোগ্য” প্রমাণিত হয়েছে। এটা আসলে সার্ত্রকেই ধন্যবাদ জ্ঞাপন যে ভার্গাস য়োসা সাহিত্য এবং রাজনীতির গোলকধাঁধাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর পথ খুঁজে পান। শেষ পর্যন্ত তাই সার্ত্র হয়ে ওঠেন তাঁর উপকারী পথপ্রদর্শক।
কেন্দ্র থেকে একজন লেখকের দূরত্ব বিষয়ে চিরসচেতন হতে, অনুপ্রেরণার পদ্ধতিগুলো এবং অন্য লেখকদের আবিষ্কারসমূহ উপকারে আসতে পারে এমন উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে একজনকে অবশ্যই জীবন্ত নির্দোষিতার অধিকারী হতে হবে (এবং ভার্গাস য়োসার মতে সার্ত্রের মধ্যে কিছুই নিষ্পাপ নয়)। ভার্গাস য়োসার প্রাণময় নিষ্পাপতা কেবল তাঁর উপন্যাস নয়, সমালোচনা, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য রচনাতেও প্রতিফলিত।
যখন তিনি কি-না নিজ পুত্রের রাস্টাফারীয়দের সাথে জড়িত থাকা বিষয়ে লেখেন অথবা নিকারাগুয়ার মার্কসবাদী স্যান্ডিনিস্টাদের একটি রাজনৈতিক মূকনাট্য উপস্থাপন করেন কিংবা বিশ্বকাপ ১৯৯২-এর বর্ণনা দেন, তখন নিবিষ্ট হতে ব্যর্থ হন না। নিজেকে কখনও লেখার বিষয় থেকে আলাদা করেন না। য়োসা কামুকে বিশেষভাবে ভালো জানেন যাঁকে তিনি, একজন যুবক হিসেবে, এক অপ্রীতিকর পদ্ধতিতে পড়ার কথা স্মরণ করেন। সে-সময়ে তাঁর ওপর সার্ত্রের দুর্দান্ত প্রভাব ছিলো। অনেক বছর পরে, লিমায় সন্ত্রাসী হামলা থেকে বেঁচে গিয়ে, তিনি দ্য রেবেল পড়েন। ইতিহাস ও সন্ত্রাস বিষয়ে কামুর দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়ে য়োসা নিশ্চিত হন যে সার্ত্রের চেয়ে কামুই তাঁর বেশি পছন্দের। তবুও তিনি বিষয়ের মর্মে পৌঁছানোর জন্যে সার্ত্রের প্রবন্ধগুলোর প্রশংসা করেন। একই কথা ভার্গাস য়োসার প্রবন্ধ সম্পর্কেও বলা যেতে পারে।
ভার্গাস য়োসার জন্যে সার্ত্র এক বিরক্তিকর চরিত্র, সম্ভবত এমনকি পিতার মতো ব্যক্তিও। জন দোস প্যাসোস সার্ত্রকে এতোটা প্রভাবিত করেন যে ভার্গাস য়োসার জন্যেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। য়োসা সহজ আবেগ-প্রবণতা প্রত্যাখ্যান এবং নতুন বর্ণনামূলক আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষার জন্যে প্যাসোসের প্রশংসা করেন। এবং, য়োসা নিজের উপন্যাসগুলোকে সাজানোর জন্যে কোলাজ, জাক্সটাপোজিশন (সন্নিধি/সংযোজন), মন্তাজ, কাট-অ্যান্ড-পেস্ট এবং অনুরূপ বর্ণনামূলক কৌশল গ্রহণ করেন।
অন্য একটি রচনায় তিনি ডরিস লেসিঙের প্রশংসা করেন এমন একজন লেখক হওয়ার জন্যে যিনি সার্ত্রীয় অনুভববিশ্বে “লিপ্ত” ছিলেন। তাঁর জন্যে ‘লিপ্ত উপন্যাস’ এর সময়ের ঝগড়া, কিংবদন্তি এবং সহিংসতায় নিমজ্জিত। মারিও ভার্গাস য়োসার প্রথম দিকের বামপন্থী কথাসাহিত্য এই ধারার একটি ভালো উদাহরণ। কিন্তু উল্লেখিত প্রাথমিক উপন্যাসগুলোতে আমরা একজন কল্পনা ও আমোদপূর্ণ বামপন্থীকে দেখতে পাই। জয়েস, হেমিংওয়ে ও ব্যাটাইলেসহ যে-সকল লেখকের ওপর ভার্গাস ইয়োসা প্রবন্ধ লেখেন তাঁদের মধ্যে যাঁর কাছে তিনি সবচেয়ে বেশি ঋণী তিনি হলেন ফকনার। স্যাংচুয়ারিতে ভার্গাস য়োসা পরস্পর বিপরীত দৃশ্যের যোজনা এবং সময়ের উল্লম্ফনের প্রশংসা করেন, যেগুলো তাঁর নিজের উপন্যাসগুলোতেও আরও বড়ো প্রমাণরূপে হাজির। তিনি ডেথ ইন দ্য অ্যান্ডেস-এ কণ্ঠস্বর, গল্প এবং সংলাপের নির্মম আড়াআড়ি কাটছাঁট (ক্রসকাটিংয়ের) করবার কৌশলের নিপুণ ব্যবহার সম্পন্ন করেন।
দূরবর্তী এন্ডেসের (আন্দিজের) পরিত্যাক্ত, বিচ্ছিন্ন, ছোট শহরগুলো এই উপন্যাসে স্থান লাভ করে। এই উপন্যাস এন্ডেসের খালি উপত্যকায়, খনিজ শয্যা, পাহাড়ি উপত্যকা ও জনমানবহীন যে-কোনও কিছুর মাঠে বিচরণ করে। এবং, হত্যাকাণ্ড হতে পারে এমন গুমের এক ধারাবাহিক তদন্ত অনুসরণ করে চলে। তদন্তকারী কর্পোরাল লিতুমা এবং নাগরিক রক্ষিবাহিনীতে তার বিপরীত নম্বরধারী থমাস কোরেনো, উভয়ে, ভার্গাস য়োসার অন্য উপন্যাসগুলোর পাঠকদের কাছেও পরিচিত হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় দুই ব্যক্তি পাহাড়ে ঘোরাফেরা করে এবং তারা একে অপরকে তাদের অতীত প্রেম সম্পর্কে জানায়। আর, মাওয়িস্ট শাইনিং পাথ গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় সদা সতর্ক থাকে। পথের ধারে তারা যাদের সাথে দেখা করে এবং ওরা যে গল্পগুলো বলে, সেগুলো তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসের সাথে মিশ্রিত হয়। এভাবে সমকালীন পেরুর সমস্ত যন্ত্রণা ও দুর্দশার মধ্যে এক বিশাল মূকনাট্য তৈরি করে।
অবশ্যই তদন্তের অভিমুখ হত্যার সন্দেহভাজন হিসেবে শাইনিং পাথ গেরিলা এবং এক দম্পতির দিকে স্থির হয়। তারা ওই এলাকায় একটা ক্যান্টিন চালায় এবং ইনকান কাস্টমসকে স্মরণ করে অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপে মাতে। শাইনিং পাথের নির্মম স্থানীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড যেভাবে বর্ণিত এবং পুরোনো ইনকান বলিদানের আচার-অনুষ্ঠানের প্রমাণ তৈরি হয়, সেভাবে ক্রমাগত গাঢ় হতে থাকে মেজাজও। আন্দিজের বন্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় অযৌক্তিকতার হাওয়া। মৃত্যু এই বইয়ের সর্বত্র: পেরুর দারিদ্য, গেরিলা যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতা এবং সাধারণ হতাশার মধ্যেও। কিন্তু পাঠক ভাবেন আধুনিকতাবাদী ভার্গাস য়োসা তাঁর স্নায়ু হারিয়ে ফেলেছেন। কেননা মনে হয় যে তিনি নিজেকে প্রায় একজন উত্তরাধুনিক নৃতাত্ত্বিকে পরিণত করেছেন। তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে এসেছেন এর অযৌক্তিকতা, সহিংসতা, অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলো অধ্যয়ন করতে। এই বইটি, গল্পের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিংবদন্তি, পুরোনো ঈশ্বর, পার্বত্য আত্মা, শয়তান, রাক্ষস ও ডাইনিতে পূর্ণ। এক চরিত্র বলে, “কিন্তু আমরা অবশ্যই ভুল করি যখন এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে আমাদের মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।” “তাদের কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।”
আশ্চর্যজনকভাবে উপন্যাসের জমিতে (টেক্সচারে) অযৌক্তিকতার কোনও চিহ্ন নেই। ডেথ ইন দ্য এন্ডেস উপন্যাসের দুটি
পরস্পরবিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে: এক. রহস্যোপন্যাস হয়ে ওঠা যা বুদ্ধি ও যুক্তি প্রদর্শন করে এবং দুই. অযৌক্তিকতার আবহ তৈরি করা যা সহিংসতা ও নিমর্মতার গোপন শিকড়ের ইঙ্গিত দেয়। এই পরস্পরছেদী লক্ষ্যগুলোর দরুন এ-বইয়ে এমন কোনও স্থান নেই যেখানে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আবির্ভূত হতে পারে। চূড়ান্তভাবে কোনও শ্রেণীবিশেষের প্রতিনিধিস্থানীয় উপন্যাস ভার্গাস য়োসার ডেথ ইন দ্য এন্ডেস। বিভ্রান্তির সব মুহূর্ত সত্ত্বেও উপন্যাসের সর্বত্র বিবরণ
নিয়ন্ত্রিত। চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বরও নিয়ন্ত্রিত সাবধানতার সাথে। এখানে উপন্যাসটির শক্তি ও সৌন্দর্য এর গঠনের নিবিড়তায় নিহিত।
যদিও ডেথ ইন দ্য এন্ডেস তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে ক্লান্ত আধুনিকতাবাদী অনুমানকে এক পাশে সরিয়ে রাখে, তবুও এটি এখনও একটি উত্তরাধুনিক উপন্যাস নয়। যেভাবে, ধরুন, পিনচনের মহাকর্ষের রংধনু। আলোচ্যমান উপন্যাসটি “অপর”কে যুক্তিহীন সত্তা হিসেবে দেখে। এটি জাদুবিদ্যা, অদ্ভুত আচার, অসভ্য ভূদৃশ্য এবং বর্বরতাকে সাধারণ সাধনা এবং বিন্যাসের মধ্যে স্থাপন করে। কিন্তু একে অজ্ঞাত সংস্কৃতির অশিষ্ট বিবৃতি হিসেবে খারিজ করলে ভুল হবে। কেননা এটি পেরুর দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে একটি কৌতুকপূর্ণ এবং অধিকাংশে মজাদার বাস্তববাদী পাঠ। সংক্ষেপে, এক বিশ্বস্ত ইতিহাস। একটি ছোট শহরে গেরিলাদের কার্যকলাপের বিবরণ ও তাদের পরবর্তী বিচার এবং একজন সৈনিক ও এক পতিতার মধ্যকার অতিনাটকীয় প্রেমের সম্পর্কের রয়েছে কাহিনিগত বিশ্বাসযোগ্যতা। ডেথ ইন দ্য এন্ডেস -এর পেরু যদি হয় এমন এক স্থান যে-অঞ্চলটিকে “কেউ বুঝতে পারে না”, তাহলে এটি এমন এক দেশও যেখানে প্রত্যেকে খুব বোধগম্যভাবেই স্বল্প মজুরি এবং তা অর্জনের জন্যে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করার বোকামি সম্পর্কে অভিযোগ করে। যদিও তিনি সবসময় পরীক্ষামূলক, তবুও ভার্গাস য়োসা লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বাস্তববাদী লেখকদের একজন।
তাঁর নায়ক কর্পোরাল লিতুমা ছিলেন হু কিলড্ পোলোমিনো মোলেরো?-য় কেন্দ্রীয় মানবমূর্তি। এটাও একটা গোয়েন্দা উপন্যাস। এক গণিকালয় থেকে যে-বইয়ের নাম নেয়া হয়েছে সেই বই দ্য গ্রিন হাউসে লিতুমা দ্বৈত জীবন উপভোগ করে। আন্ট জুলিয়াতে ও স্ক্রিপ্টরাইটারে তার আছে খোদাই-করা মূর্তিযুক্ত মণিবিশেষ। ভার্গাস য়োসা লিতুমার মধ্যে, তার ভূমিলগ্ন বাস্তববাদ, অবিচল কর্তব্যবোধ (যা তাকে চরমপন্থা থেকে নিরাপদ রাখে), তার সৎ বিচক্ষণতা, বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি এবং শ্লেষাত্মক হাস্যরসযোগে, সুপ্রতিষ্ঠিত ও সহানুভূতিশীল একজন সৈনিকের চিত্রায়ণ সম্পন্ন করেন। পেরুর
একটি মিলিটারি লাইসেকে বিদ্যালয়ের পাঠগ্রহণ য়োসাকে সামরিক জীবনের এক অন্তর্দৃষ্টি দান করে যা অনেক সুবিধার জন্যে তিনি ব্যবহার করেন। যেমন দ্য টাইম অফ দ্য হিরো, ক্যাপ্টিন প্যান্তোজা অ্যান্ড দ্য স্পেশাল সার্ভিসে বর্ণিত তরুণ ক্যাডেটদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঝগড়া এবং সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্যমান আমলাতন্ত্র ও যৌনতার ব্যঙ্গের মধ্যে তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। পৌরুষদৃপ্ত ভঙ্গিতে ভঙ্গুরতার বিন্দুগুলো শনাক্ত করা, পতিতাদের প্রেমে আশাহীনভাবে কঠিন থাকা পুরুষদের চিত্রায়ণ অধবা অপরিশীলিত রসিকতার (যা পুরুষের আবেগকে উড়িয়ে দেয়) মধ্যে য়োসা পুরুষ-বন্ধুত্ব বিষয়ে বিশেষভাবে উজ্জ্বল। তাঁর নির্দয় বুদ্ধির ঝলক সবসময় খুব বিনোদনমূলক এবং এটি কখনও উদ্দেশ্যহীন নয়। কেউ যদি তাঁর প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে সব কাজের সাথে পরিচিত হন তাহলে তিনি দেখতে পাবেন যে ভার্গাস য়োসা সবসময় উজ্জ্বল বাস্তববাদীদের পছন্দ করেছেন। এবং, উপহাস করেছেন মধ্যপন্থী থেকে শুরু করে কাল্পনিক আদর্শবাদী ও ধর্মান্ধদের।
ডেথ ইন দ্য এন্ডেসে সৈনিকরাই নায়ক। এতে শাইনিং পাথ গেরিলাদের বোঝার চেষ্টা কম। তারা চিহ্নিত হয়
নিখাদ অযৌক্তিকতা এবং উদ্ভটতার সীমান্তে থাকা মন্দত্বের প্রতিনিধি হিসেবে। এর অনেক কিছুই বয়স বাড়ার সমান্তরালে লেখক যেসব রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সেসবের সাথে জড়িত। একজন তরুণ হিসেবে, আধুনিকতাপন্থী মার্কসবাদী ভার্গাস য়োসাকে কিউবার বিপ্লবে ঢোকানো হয়। কিন্তু পরিপক্কতা অর্জনের পর তিনি উদার হয়ে ওঠেন। এবং, আশির দশকে তিনি তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন যারা গুন্টার গ্রাসের মতো বলেন, “সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে উদাহরণ হিসেবে কিউবাকে ব্যবহার করতে হয়েছিলো।” অর্ধেক মজার ছলে, ভার্গাস য়োসা নিজেকে “মার্গারেট থ্যাচারের প্রশংসা করে এবং ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে ঘৃণা করে পৃথিবীর তেমন দুজন লেখকের একজন” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। সেই সাথে যোগ করেন: “অন্য লেখক যিনি কবি হিসেবে সঠিকতররূপে বর্ণিত, তিনি ফিলিপ লারকিন।”
ডেথ ইন দ্য এন্ডেসে শাইনিং পাথ গেরিলাদের বিবরণ পড়ার পরে, তাঁর তারুণ্যদৃপ্ত প্রবন্ধগুলোর একটিতে একজন মার্কসবাদী গেরিলার প্রতি ভার্গাস য়োসাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে দেখে বেশ অবাক লাগে। (এই গেরিলা তাঁর বন্ধু যাকে “পেরুভিয়ান সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের” সময় হত্যা করা হয়।) কেউ আশ্চর্য হয় ভেবে যে, আমাদের মতো নিজের যৌবন পেরিয়ে-যাওয়া মানুষের পক্ষে কি গেরিলাদের মধ্যে মানবতা দেখতে পাওয়া অসম্ভব? নাকি একটি নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে আসার পরে আমাদের মতো কারও এমন কোনও বন্ধু থাকে না যে বা যারা গেরিলা? ভার্গাস য়োসা এমন একজন চমৎকার লেখক এবং তাঁর মতামত এতোটাই আকর্ষক যে, এখনও তাঁর কণ্ঠে একটি ছোট বালকের আন্তরিকতা বিদ্যমান,- যে-ছেলেকে কেউ সাহায্য করতে পারে না কিন্তু যার জন্যে স্নেহ অনুভব করে। এমনকি যেখানে একজনের রাজনীতি তার থেকে আলাদা সেখানেও।
পেরুর সবচেয়ে উজ্জ্বল লেখকদের অন্যতম সেবাস্তিয়ান সালাজার বন্ডি (যিনি খুব তরুণ বয়সে ভাঙা বা পঙ্গু মানুষ হিসেবে মারা যান) সম্পর্কে লেখা এক প্রাথমিক প্রবন্ধে য়োসা প্রশ্ন করেন, “পেরুতে লেখক হওয়ার অর্থ কী?” এই প্রশ্ন আমাদের সবার জন্যে অবশ্যই দুঃখ বয়ে আনে। তা এ দুই কারণে নয় যে পেরুতে যথার্থ পাঠকের অভাব রয়েছে এবং সেখানে নেই আন্তরিক সাহিত্যিক প্রকাশনার সংস্কৃতি। ভার্গাস য়োসার রাগ অন্যদের সাথে ভাগ করে নেয়া সহজ যখন তিনি দারিদ্র্য, গতানুগতিকতা, অজ্ঞতা ও শত্রুতা বিষয়ে লেখেন। পেরুর লেখকরা এসব সহ্য করতে বাধ্য হন। এমনকি যদি তারা এসব থেকে বেঁচে থাকেন, তাহলে তাঁরা বাস্তব জগতের বাইরে বসবাস করেন বলে ধরে নেয়া হয়। এতে নেতৃস্থানীয় ভার্গাস য়োসা বলেন, “পেরুর সমস্ত লেখকেরা শেষ পর্যন্ত পরাজিত।” যখন কেউ ভার্গাস য়োসার তারুণ্য এবং পেরুর পুঁজিপতিদের (যাদের তিনি বর্ণনা করেন “অন্য সবার চেয়ে বেশি বোকা” বলে) প্রতি তাঁর ঘৃণার বর্ণনা পাঠ করেন, যখন য়োসা বইয়ের প্রতি আগ্রহ এবং বিশ্বসাহিত্যের প্রতি পেরুর অর্ঘ্য তুচ্ছ বলে এর সম্পূর্ণ অভাবের জন্যে আক্ষেপ করেন আর বিদেশি সাহিত্যের জন্যে নিজের দারুণ ক্ষুধার বর্ণনা দেন, তখন, নিঃসন্দেহে কেন্দ্র থেকে দূরত্বের দুঃখ তাঁর কণ্ঠে বেজে ওঠে। এই মানসিক অবস্থা আমাদের মতো লোকেরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে।
(পুনর্মুদ্রিত।
সূত্রঃ ওরহান পামুকের নির্বাচিত গদ্য/অনুবাদ/খালেদ হামিদী; ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দ্বিমত পাবলিশার্স)
************************************

কবি, লেখক ও অনুবাদক
************************************
