You are currently viewing পচাপাতার গলিপথে || খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন

পচাপাতার গলিপথে || খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন

পচাপাতার গলিপথে
খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন

[এক]
কাঁচাপাকা ঢেউ তোলা আউশের একটানা লম্বা চর পেরিয়ে সোজা উত্তর দিকে গেলে, চোখে পড়ে ঘন কালো সবুজের সীমানা ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বাকাশে মাথে তুলে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি দু’টো তাল গাছ। গাছ দুটোকে হাতের ডানে ফেলে আরও উত্তর দিকে ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেছে, একটা সর্পিলাকার চিকন গলিপথ। এ গলিপথটাতে সূর্যের আলো পড়ে কিনা সন্দেহ। উপরে সবুজ পাতার চাপা ছাউনি সযত্নে আগলে রেখেছে পথটাকে। পা রাখলেই পচাপাতার ম্যাজম্যাজে মাদকীয় গন্ধ নাকে এসে হোঁচট খায়। দিনের পর দিন ঝরা পাতার আস্তরণ প’ড়ে প’ড়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে গলিপথটা।

আন্তনির উঠানটা, সেই আগের মতন আর নেই। বেধড়ক বেড়ে ওঠা জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সমস্ত ভিটে বাড়িটা। নানা প্রকার জংলী গাছগাছালিতে পূর্ণ হয়ে গেছে উঠানটা। শুধু উত্তর ভিটেয় ভাঙ্গা দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। দেখলেই মনে হয় যেন, আদিকালের কোন এক ইতিহাসের করুণ কাহিনী বয়ান করতে পথে এসে দাঁড়িয়েছে এই ভিটেটা। এখানে প্রতিদিনের শেষে কালিসন্ধ্যায়, খ্য্যাঁকশিয়ালের সংসদ বসে। আন্তনির পরিত্যক্ত ভিটেবাড়িটা, ‘হুক্কাহুয়া’ কলধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

আন্তনি অনেক আগেই পাগল হয়ে গেছে। পাড়ার ময়মুরুব্বিরা কেহ জানেন না, আন্তনি নামের পাগলা মানুষটা এখন কোথায়। বেঁচে আছে, নাকি সে ম’রে গেছে। সে প্রায় এক যুগ আগের কথা। তরতাজা শিশুবাচ্চাটাকে বুকে জাপটে ধ’রে কোথায় সে বেরিয়ে গেছে! কেহ বলতেও পারেন না। তাঁদের সকলেরও মনে সেই একই জিজ্ঞাসা। অবশ্য যামিনী বুড়ি থাকলে, লোকটার খোঁজখবর জানা সম্ভব হতো। আন্তনির পাগল হওয়ার ছ’মাস পরেই যামিনী মারা যায় ভীষণ দুঃখ নিয়ে। এ কথা থাক।

তো আন্তনির ভাঙাচোরা মনটা গুছিয়ে এনেছিল কান্তা। এই কান্তা আন্তনির বিবাহিতা স্ত্রী। সে বেমক্কা উল্টো এক ইতিহাস! ধর্মছাড়া, কর্মছাড়া, দিশেহারা আন্তনি বাপ মরার পরপরই এতিম হয়ে পড়েছিল। আন্তনির ঘরে কান্তা এসে, নিপুণ কারিগরের মতন গ’ড়ে তোলে আন্তনিকে। তার নরম তুলতুলে আঙুলের ছোঁয়ায়, আন্তনির কঠিন মনটা একেবারেই গলিয়ে ফেলে।

কান্তা, আন্তনির বউ হয়ে আসার পরপরই; নেশাগ্রস্ত লোকটা দিব্যি ঘর বাঁধল। নিজের প্রাপ্য সম্পত্তি রক্ষায় হল তৎপর। কান্তার আদর পেয়ে, অন্যকেও আদর করতে শিখল। বুকে জ’মে থাকা চাপচাপ দুঃখব্যথা ভুলে, নিজের ঘরের মানুষটিকে নিয়ে সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠল। বনের সুডৌল লতার মতো একে অন্যকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে, স্বপ্ন দেখল অনেক।

ওদের দেখে পাড়াগাঁয়ের, ভিন গাঁয়ের লোকদের চোখ জুড়াতো। তারিফ করতো অনেকেই। পরম সুখে তাকিয়ে দেখে পরখ করতো তারা, লম্বা সময় নিয়ে। আন্তনির সুন্দর সুঠাম তনুর পাশে, কান্তাকে মানতোও অদ্ভূত! ওদের সংসার সুখের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো তারা।

খেতে যাওয়ার সময় ভালো ক’রে একটা নাদুস নুদুস পান পেঁচিয়ে, স্বামীর মুখে পুড়ে দিতো কান্তা । আন্তনি ঠোঁট টিপে হাসতো। কখনও রঙিন খুনসুটিতে মত্ত হয়ে উঠতো। ঘুটঘুটে গলিপথটাতে পা রেখে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতো আন্তনি, কান্তা তার ঘরের বেড়া ধ’রে দাঁড়িয়ে চিকনপথের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে লম্বাদৃষ্টি নিয়ে। দুপুরবেলা কাজের ছেলে বিরুকে দিয়ে, খেতে খাবার পাঠিয়ে দিতো কান্তা । মাঝে মধ্যে আন্তনি নিজেই এসে খেয়ে যেতো। হয়তোবা খাওয়ার ছল ক’রে, কান্তাকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসতো। অথচ ওদের মাঝেই একটা কালো দেয়াল এসে, বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। আন্তনি, কান্তা দু’জন দু’দিকে ছিটকে পড়লো। এবং একটা সাজানো বাগান আগাছা জঙ্গলে ছেয়ে গেল!

[দুই]
পচাপাতার গলিপথটা দিয়ে প্রতি মৌসুমে, আন্তনির উঠানে সোনার ফসল উঠে আসে। পথটা বাড়ির উঠানের কাছে গিয়ে থেমে গেছে। এখানটা বেশ ফাঁকা। নিজের চোখে কেউ না দেখলে বিশ্বাসই করবে না, এমন ঘন জঙ্গলে আন্তনি নামে কোন যুবক ঘর বেঁধেছে তার সুন্দরী বউ কান্তা কে নিয়ে। ঘরে স্তূপীকৃত সোনালী ফসলের মাঝে ওরা ডুবে থাকে। কিছু স্বপ্ন দেখে এবং একটা সংসার গ’ড়ে তোলার খেলায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

পৈত্রিক সম্পত্তিতেই আন্তনির বাস। তার বাপ যে জমি আর গাছগাছালি রেখে গেছে, তা’তে ক’রে স্বচ্ছন্দে দিন কেটে যায়। মুনি-কামলা রাখতেই হয়। হালের দু’টো বলদ আর দুধেল একটা গাভী ও বাছুর রাখার জন্য পশ্চিম পাড়ার টেকবাড়ির কান্দ্রার ছেলে বিরুকে রেখেছে। তাছাড়া কান্তার দিনও প’ড়ে এসেছে। ওকে সাহায্য করার জন্য দক্ষিণ পাড়ার বিধবা যামিনী বুড়ীকে রেখেছে। তাকে আন্তনি ও কান্তা দু’জন ‘দিদিমা’ সম্বোধন করে। আন্তনি কতক্ষণই বা বাড়ি থাকে? গাঁয়ের বিয়ে-শাদী, আচার-বিচার, হাট-বাজার এবং খেত-খোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। উঠানের পূর্ব পাশের আঙিনায়, এক খণ্ড টানা জমি। লাউ-শিম-বরবটির মাচা উঠেছে সেখানে। পশ্চিম দিকেও এক টুকরো তাজাবাগান। দেশী ফুলের দুষ্প্রাপ্য সমাহার সেখানে!

দক্ষিণ দিকে খোলা বাতাসে চওড়া কলাপাতাদের সবুজ মাতামাতি। প্রায় প্রতিটি কলাগাছের যৌবনময় শরীরে ঝুলছে, ইতস্ততঃ ছোটবড় কলার ছড়ি। কান্তার হাতের স্পর্শে আন্তনির বাড়িতে যেন, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নেমে এসেছে! আন্তনি এখন বুক ফুলিয়ে পথ চলে। গাঁও-গেরামের খোঁজ-খবর রাখে আর মাতবর-প্রধানদের সাথে যোগাযোগ রাখে। নিয়মিতই গলিপথটাতে পা রেখে, টানা শব্দ ক’রে শ্বাস নেয়। প্রশান্তির প্রশ্বাস ছাড়ে।

কান্তাকে নিয়ে আন্তনির বিক্ষিপ্ত যত ভাবনা। এমন সুন্দরীবউ নিয়ে, এই জঙ্গলবাড়িতে থাকতেও কেমন ভয়ভয় লাগে! সেই একটা রাতের কথা মনে হ’লে শরীরের লোমগুলো এখনও খাঁড়া হয়ে ওঠে! কান্তা ঘুমুচ্ছিলো পাশেই। লণ্ঠনের মৃদু আলোয় কান্তার ঝাড়া ঝাড়া নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করছিল আন্তনি। এমন সময় ধুমধাম শব্দে বাইরের খোলা অন্ধকার থেকে, গোটা চার ঢেলা এসে পড়ল ঘরের চালে। ঘুমের ঘোরে আঁতকে উঠেছিল কান্তা । আন্তনিও চমকে উঠেছিল। ভোর রাতে সে স্বপ্ন দেখলো, এক বুড়ো দরবেশ ওর কাছে একজোড়া নারকেল চাইছে। না দিলে গেরস্থের ক্ষতি হবে! আন্তনি ভয়ে ভয়ে রাজী হয়েছিল। পরের দিন যামিনী বুড়িকে স্বপ্নটা খুলে বলে সে। যামিনী কপালে চোখ তুলে বলেছিলো, ‘স্বপনে নারকেল চাওয়া ভালা নারে দাদা! মানুষ মরে!’ সেই থেকে কান্তাকে নিয়ে যত ভাবনা আন্তনির। সে মন শক্ত করে। ভাবে, ‘সেই দিন এখন আর নাই! তাই আজকাল, জিন-পরী, ভূত-প্রেত ওসব কিছুই নাই! তাই বুড়ো দরবেশ দেখার কোন অর্থই নাই।’

কয়েকদিন থেকেই নড়তে চড়তে কষ্ট হচ্ছে কান্তার। কাজ-কর্ম তেমন কিছুই করতে পারে না। বাড়ির দাওয়ায় ব’সে ছোট ছোট রঙ্গিন কাঁথা বানায়। কাছে দাঁড়িয়ে আন্তনি তার কান্তাবউকে দেখে আর মিটিমটি হাসে।

সকাল থেকেই ভীষণ ছটফট করছে কান্তা। ঘরের কোণে হাত-পা ছড়িয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে প্রবল। সেদ্ধ চালের চারটে দানা পেটে ফেলে হাটে চ’লে যায় আন্তনি। বিকেলে বিষণ্ণ নগ্নপায় পচাপাতার গলিপথ পেরিয়ে, উঠানে পা রাখার আগেই দেখে বাড়িভরা লোকজন! ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না তার কাছে। চাঙারিটা কাঁত ক’রে কুয়োতলায় রেখেই, ঘরের দোরে পা রাখে সে।
-আন্তুরে! তোর আন্ধার ঘরে বাত্তি জ্বইলা, আবার নিব্বা গেলোরে!
আন্তনির বুকের ভেতরটা, দারুণ ভাবে মোচড় দিয়ে ওঠে।
-ব্যাপারটা কী?
যামিনী দিদিমা চোখে মুখে নিরালা আতংক টেনে বলে, ‘বউডার অবস্থা বেশি ভালা নারে! খিঁচতে আছে! তুই যদু কবিরাজের বাড়ি যা। ঘরে আহিস না অহন! যা!’

এই সময় আন্তনির, দু’হাতে বুড়ি যামিনীর গলাটা সজোরে টিপে ধরতে ইচ্ছা হলো! বলতে গেলে সারাটা দিনই ব্যস্ত! অনাহারী! আর শেষ বেলায় এখন বলে, ‘বাত্তি নিব্বা গেছে!’ কিন্তু তার আদরের কান্তা বউ? সে এখন কেমন আছে?

ফিরে পচাপাতার উপর, ধূলিময় নগ্ন পা রাখে আন্তনি। পাশ থেকেই একটা হুতুমপেঁচা, সুর ক’রে মুখ ভেংচে উঠলো। অশ্লীল একটা গালি বেরিয়ে আসে, আন্তনির মুখ থেকে।

একমুখ খোঁচাদাঁড়ি নিয়ে যদু কবিরাজের ঘরের দোরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত, হতাশাগ্রস্ত লোকটা। সে উঁকি মেরে দেখে; যদু দু’হাঁটুর চিপায় মাথা রেখে পরম নিভৃতে, হাতের তালুতে গাঁজাপাতা টিপছে। শব্দ ক’রে, গলাখাঁকারি দেয় আন্তনি।
-পুঁটীর মা, দেহো তো আবার কোন চোরে…।
-চোর না! তোমার বাবা!
-ও আন্তু, তুই! আয় আয়। ব’।
ন্যুব্জ দেহ নিয়ে ঘুরে বসে যদু। বয়েস নব্বইয়ের কোঠায়। দীর্ঘপ্রশ্বাস ছেড়ে ছেঁড়ামাদুরের উপর কাঁত হয়ে ব’সে পড়ে।
-বউডা খিঁচতাছে! যামিনী-দিদিমায় কইছে কিছু দিতে।
– খিঁচতাছে? ও বুঝছি। বাপ হইবার লাগছো, আন্তু বেডা তুমি! তয় …
– হইবার লাগছি না, কাকা! হইয়া মইরা গেছে! মরা ছাও! আমার কপালডাই মন্দ!
– কী কইলি তুই, আন্তু বেডা!
-হ কাকা! মরা ছাও! পোলা! জানো কাকা, কত আশা করিছিলাম, ফুটফুইটা একটা বেডা অইবো! আমারে ‘বাবা’ ডাকবো! তা আর অইলো না! হাতের পিঠে চোখের পানি মোছে ব্যর্থ আন্তনি।

‘তুই বস ব’লে’ হাতের জিনিসটুকু একটা ছোট্টপিঁড়িতে রেখে, ঝাপ ঠেলে উঠানের দিকে শীর্ণ লম্বা ঠ্যাং বাড়ায় যদু। পিঠের ‘মেরুদন্ড’ নামক ফ্রেমটা বেঁকে গেছে। বাংলাপাঁচ আকৃতিতে কুঁজো হয়ে হাঁটে। আন্তনি তাকিয়ে থাকে মূর্তিটার দিকে, যেন দেখেনি আগে কখনও। সবুজ ধানখেত পেরিয়ে, পাশের ছোট জঙ্গলটাতে কাৎ হয়ে ঢুকে পড়ে যদু ।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে, দু’ টুকরো তাজা শিকড় আন্তনির হাতে তুলে দেয়, এলাকার সব মানুষের ভরসা এই যদু কবিরাজ।
-তয়, ভূতে পাইছে তোর বউরে! বড় শক্ত ভূত! সহজে ছাড়বো না, হ্যাঁ। খুব শক্তভূত! বড় পাজী!
-কী কইলা? ভূতে পাইছে! মানে জীনপরী!
আন্তনির হাতের আঙ্গুলগুলো, অদ্ভূত বাঁকা হয়ে আসতে চাইছে ভয়ে। কপালে দু’চোখ তুলে হাঁ ক’রে, তাকিয়ে থাকে সে।
-হ। জীনপরী না। অন্য কিছু। সাবধানে থাকিস।

শুষ্ক লতা-পাতার পুরিয়া আন্তনির হাতে দিয়ে বলে, ‘এই একটা বউডার হাতে, আর একটা কোমরে বাইন্ধা দিস। যা …।’

বাড়ির ফিরতি পথ টানে বিষণ্ণ আন্তনি। যদু কাকার কথাগুলো বারবার কানে এসে ধাক্কা মারছে। ‘ভূতে পাইছে তোর বউরে! সহজে ছাড়বো না, মনে হয়! খুব শক্তভূত! বড়ই পাজী! … সাবধানে থাকিস, তুই!’ বাতাস বইছে প্রবল বেগে। সে দেখতে পায়, মোড়ের গাবগাছটা এখনই, বড় বেসামাল হয়ে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে! আচমকা কোত্থেকে কী এক দমকা বাতাস এসে, দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইছে এত বড় গাছটাকে! আন্তনি অবাক দৃষ্টি নিয়ে, তাকিয়ে থাকে তার ঠাকুরদার আমলের পুরনো গাবগাছটার দিকে। ঘনপাতার আড়ালে, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। অপলক তার চাহনি। তারপর, এক দুই ক’রে গলিটাতে পা রাখে। বজ্ বজ্ ক’রে পা দুটো তার, সেঁধিয়ে যায় পচাপাতার ভিতর। বদ হুতোমপ্যাঁচা একটা, কর্কশ ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে পিছনে! গলাটা শুকিয়ে যায় তার। বার বার ঢোক গিলে। হতবুদ্ধি হয়ে, ‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ ব’লে, জিহ্বা নাড়ে আন্তনি। গলা দিয়ে তার, স্বর আর বেরোয় না! তারপর আচম্বিতে পড়ি কি মরি, সামনের দিকে দেয় লম্বা দৌড়! মনে হচ্ছে যেন, পিছন দিক থেকে সবকিছু ভেঙেচুরে, তার দিকেই এগিয়ে আসছে!

ইদানীং, বাইরের অনেক কাজ কমিয়ে দিয়েছে আন্তনি। পাড়ায় যাওয়াটাও তেমন হয় না। কান্তা ও অনেকটা চুপ হয়ে গেছে! এই সময় সে, কান্তা কে ঘরের বের হতেও দেয় না। সময়-অসময় গির্জার কবরস্থানে ছুটে যায়। সেখানে নতুন ছোট্ট কবরটার কাছে দাঁড়িয়ে, ছল ছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ব্যর্থপিতা! লম্বা নিঃশ্বাস নেই বুক ভরে। আবার তা ছেড়ে দিয়ে, বুকটা খালি করে। গামছার খুঁটে চোখের পানি মোছে। বাচ্চাটা তার, অদ্ভূত গাঢ়নীল হয়ে গিয়েছিল! দেখে মনে হয়েছে, যেন কালসাপে ঠুকেছে! আচ্ছা, এত সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটা, এমন নীল হলো কেন? তবে কি, তার দেখা সেই স্বপ্নটাই ঠিক? সন্দেহের নাগরদোলায় ঘুরপাক খায় আন্তনি।

হঠাৎ কী এক খেয়ালি পাগলাঘোড়ার পিঠে, চেপে বসে আন্তনি সে। বিরুকে, মধুকে ও হাসমতকে নিয়ে মোড়ের গাবগাছটা, কেটে ফেলে এক দিনেই! প্রথমে যামিনী দেখে, হা-হা-হা ক’রে তেড়ে এল! ‘খামাক্কা কেউ গাছ কাডে নাহি?’ তো, সেকেলে বুড়িটার কথা কানে তোলেনি আন্তনি। স্ত্রী কান্তা ও দু’হাত নেড়ে মানা করেছে। ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি সে।

ওই রাতে কান্তার সাথে শোয় আন্তনি। মাঝরাতের দিকে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সে, এক অপরিচিত কন্ঠ তাকে বলছে, ‘তুই আমার গাছ কাটলি? আমিও তোর গাছ কাটুম …!’

সকালবেলা দখিনা দমকা কী একটা বাতাস এসে, বাড়ির আঙিনায় বাগানের সবগুলো কলাগাছ ভেঙ্গে দিয়ে গেল! ‘কী এক আচানক কারবার!’ হতাশাগ্রস্ত আন্তনি দাওয়ায় ব’সে ভাবে।
-খিদা নাই তোমার?
কান্তা ভাত বেড়ে খাওয়ার তাগাদা দেয়। আন্তনি সাড়া দেয় না। কান্তা পায় পায় বেরিয়ে এসে বলে, ‘কিছু খাইবা লইবা না? ভাত দিছি তো।
-তুই খাইয়া ঘরে যা! আমারে জ্বালাইস্ না!
-বারবার মানা করেছি, দেখ তুমি গাছটা কাইটো না বেহুদা!
-মাগি! তোর কথা আর হুনতে চাই না! আমার সামনে থন তুই যা! যা কইতাছি!
কথা না বাড়িয়ে, অগত্যা ঘরে চ’লে যায় কান্তা । ভিতর থেকে ভেসে আসে তার বিষন্নবিলাপ, ‘কতা কইলে হুনবা না। কোন ক্ষতি অইলে আমার যত দুষ!’ তারপর তার স্বগতঃকান্নার শব্দাবলী, বাতাসে ঢেউ তোলে। বিরক্ত আন্তনি উঠে পা বাড়ায়।

[তিন]
পচাপাতার গলিটাতে এসে দাঁড়ায় সে। এখানে পা রাখলেই, এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর আচ্ছন্নতা চেপে ধরে তাকে। তারপরও নিঃশব্দ দুপুরের প্রচ্ছন্ন নির্জনতা, ওর কাছে এখন অনেক ভালো লাগছে। এক পা দু’পা ক’রে যদু কবিরাজের ঘরের সামনে আসে দাঁড়ায়, মৃত নবজাতকের বাপ। চোখের দৃষ্টি ঘুরে ঘুরে, ধূমায়িত রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে বারববার। কপালে তার, বিন্দুবিন্দু ঘাম জ’মে ওঠে। ভগ্নদূতের ন্যায় দাঁড়িয়ে এখন অন্য এক আন্তনি।
-যদু কাকা! ও যদু কাকা!
-হেয় তো পশ্চিমপাড়া গেছে।
ঝাড়া ঝাড়া নারীকণ্ঠ! সচকিত হয়ে ওঠে আন্তনি। চোখের তারায় তারায়, অদম্য আদিম ইচ্ছারা দাপাদাপি করে। বুকের উপর থেকে ভারী পাথরটা ধীরে ধীরে নেমে যায়। অপস্রৃয়মাণ অন্ধকারটা, ফের মগজের খুপরিতে জমাট বাঁধে। কিলবিল ক’রে সেটা এখন, আন্তনির মনের মধ্যে ভালোবাসার রঙ ছড়ায়।

যদু কবিরাজের পুত্রবধূ এই পুঁটির মা। এক সন্তানের জননী, তিরিশোর্ধ এই নারীর দেহে যেন পূর্ণ যৌবনের মাদকীয় ছাঁট! তার স্বামী নিকু, আলসারের ‘বারোমাইস্যা’ রোগী! জুটমিলে ওভারটাইম ডিউটি করে নিত্য। সেই বিহানে বেরোয়। দেহ-মনে অক্ষম হয়ে, ফেরে সেই রাত এগারোটার পর!

অন্য ধরনের এক প্রাপ্তির নেশায় চঞ্চল হয়ে ওঠে আন্তনি। এ সময় মনে হল তার, এখানেই সে পাবে অনেক তৃপ্তি। অনেক শান্তি! কাঠের পিঁড়িটা টেনে, নিজেই উদ্যোগী হয়ে উঠানের এক কোণে ব’সে পড়ে সে। লম্বা ভারী গরম শ্বাস ছাড়ে সে। এখন স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে, বুকের ধুকধুকানিটা বেড়েই যাচ্ছে তার।

বিবেকটাও মাথার মগজে, আঘাত হানে বারবার। কান্তা ! পুঁটির মা! একজন অসহায় আন্তনি। না। না। নিকু যদি শোনে! তবে কল্লা কেটে ফেলবে! আরে দূর! এইতো লম্বা সুযোগ! বিপর্যস্ত রক্ত মাংসে উল্টাপাল্টা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, আস্ত পুরুষটার দেহে। এ সময় সে, নিজেকে দীর্ঘ দিনের ‘অভুক্ত’ বলেই মনে করে। চোখে, নাকে, ঠোঁটে, জিহ্বায়, বুকের ভিতর, পেটে এমনকি তারও নীচে এবং চার হাত-পায়ে খিদার জ্বালা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! শরীরের সর্বত্রই, দুর্দমনীয় কামনার আগুন! শরীরে অন্যরকম ঝাঁকুনি টের পায় আন্তনি। নিঃশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে তার। নিজেকে দীর্ঘদিনের, এক ‘অভুক্ত বাঘ’ বলেই মনে হল! সামনে যা পাবে, সবই থাবা মেরে গিলে খাবে!

ঠিক এ সময়, অন্য এক চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় পুঁটির মা! চমকে ওঠে আন্তনি! তার একেবারে কাছেই, একটা টসটসে ডালিমের চেহারার মেয়েমানুষ! ‘কী সোন্দর লাগচে গো!’ সে কে? এ কী পুঁটির মা? নাকি অন্য কেহ? অলক্ষেই যেন বুকের কাপড়টা, খ’সে পড়েছে তার! ‘হ! এ তো দেকচি মরার পুঁটির মাই তো! খাইচে আমারে!’ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি সতেজ দেখাচ্ছে, আলসার রোগীর বউটারে! দেহে তার, ভরা বর্ষার বেমক্কা ঢেউ আছড়ে পড়ছে যেন! চোখের কোণে উপচেপড়া অসামাজিক প্রশ্রয়, পাগল ক’রে তোলে বিপর্যস্ত আন্তনিকে। বিবেক-টিবেক বলতে এখন আর কিছু নেই ওর মধ্যে! নিজেই এ সময় টের পায়, আপাদমস্তক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে সে। তাই এই নিকষ ঘন অন্ধকারের গুপ্ত নির্যাস প্রাণ ভরে উপভোগ করার, আহা এই তো সময়! এই তো অপূর্ব সুযোগ!

টলতে টলতে, পচাপাতার স্যাঁতস্যাঁতে দীঘলে নেমে আসে আন্তনি। সহসা দারুণ এক হোঁচট খেয়ে, হুড়মুড় ক’রে যদু কবিরাজের সামনে এসে পড়ে সে।
-হেহ্ কাকা! তোমার কাছেই গেছিলাম!
-আমি জানি! বুইঝা গেছি সব! বলদ, তুই গাছটা কাটলি ক্যান?
-আমি ভাবছিলাম কাকা, গাছটা কাটলেই বুঝি সব শ্যাষ হইয়া যাবে গ্যা!
-তোরে দেইখা, আমার তো আর ভালা লাগতছে না! তুই তো আরেক আন্ধারের ভিতরে, ঢুইকা গেছস গা! তোর আর, রক্ষা নাইরে আন্তুইনা! তুই উত্তর দে, তোর জন্যি, আমি আর কী করতে পারি? বলদ!
ধূতির খুঁট থেকে একটা তামাটে তাবিজ বের ক’রে যদু কাকা। আন্তনির হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘আইচ্ছা ধর। এইডা তোর বউর কোমরে বাইন্ধা দিস। যা বেক্কল!’

পর পর দু’টো মৌসুম, মার খায় আন্তনি। পাঁচ-ছ্য় খণ্ড ধানিজমি খরায় জ্ব’লে যায়। কী এক অজানা রোগে, পাঁচদিনের মধ্যে হালের বলদ দু’টো ছটফট ক’রে ম’রে গেল! ম্যালেরিয়া জ্বরের ঘোরে নিজে, বিছানায় প’ড়ে থাকে একটানা পনেরো দিনের মত! এই সুযোগে, যামিনীর গলার তেজটা ঠান্ডার চোটে আরও চরমে ওঠে। অনবরত বকবক করতেই থাকে বুড়িটা! ওর জ্বালায় রাতে ঘুমাতে, বড়ই অসুবিধা হয় আন্তনির। আবার, কাশতে কাশতে, পাঁচপরাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড় হয়ে যায় তার! কিছু বলাও যায় না। বললে কর্মসারা! পরের দিনই পোটলাপুটলি বগলতলে ফেলে ‘যাইরে আন্তু! যাইরে বউ!’ ব’লে সোজা পচাপাতার গলিটাতে পা বাড়াবে! তখন শত ডাকাডাকি, হাজার দেনদরবার, বোতল বোতল তেল মাখামাখি ক’রেও ফিরিয়ে আনা যাবে না তাকে। তখন ভুতের উৎপাত নির্ঘাত বেড়েই যাবে! বজ্জাতের হাঁড়ি! ওই নচ্ছার যামিনীকে হাড়েহাড়ে চেনে আন্তনি। তবে হ্যাঁ। বুড়িটা কাছে থাকা মানে, একটা গাছের ছায়ার নীচে থাকা। মানতেই হবে, বুড়িটা আসোলেই অনেক কিছু জানে!

বেচারি যামিনীর একটা ছেলেই ছিলো। বয়েস তেরোতে একদিন তালগাছে বাঁশ লাগাতে গিয়ে, ফসকে নিচে প’ড়ে হাত-পা ভেঙ্গে দম আটকে শেষে মারাই গেল সাধন ছেলেটা! আর তখন থেকেই, খিটখিটে মেজাজী হয়ে যায় বিধবা যামিনী। বেচারা! স্বামী-ছেলে হারা এই বুড়িটার জন্য মায়াও লাগে আন্তনির। নিজের ছেলের মতো স্নেহ করে ওকে। আসলে, যামিনী দিদিমা, সেও তো একজন মানুষ! তারও ভালোবাসার একটা মন আছে। তারও ভালোবাসা পেতে মন চায়। আবার, অন্যকে দিতেও মন চায়। আর কান্তার প্রতিও বুড়ির দুর্বলতা রয়েছে প্রচুর। মানতেই হবে।

যামিনীর উপর নীচের দু’পাটির চারটে কলেরদাঁত ছাড়া, মুখে আর কোন দাঁতই নেই। পান খায় দেদার। মাথায় একঝাঁকড়া সাদা চুল। তার পরনেও থাকে, পাড় ছাড়া সাদা শাড়ি। উঁকুনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে, দু’হাতে চুল খাবলায়। কখনও কান্তার সামনে যেয়ে, মাথাটা মেলে ধরে। ব’সে ব’সে বুড়ি দিদিমামার মাথায় বিলি দেয় কান্তা । আন্তনির বাড়ির ঘরদুয়ারের, সমস্ত কাজই এখন যামিনী করে।

কান্তা তার মা-বাবার একমাত্র ও আদরের মেয়ে ছিল। তাঁদের বড় আশা ছিল, মেয়েকে ভালো ঘরের পাত্রের হাতে সঁপে দিয়ে শান্তিতে মরবেন। কিন্তু স্বপ্ন তাঁদের অপূর্ণই রয়ে গেছে! কান্তার চৌদ্দ বছর বয়সে কলেরায়, তিন দিনের ব্যবধানে তাঁরা দু’জনই মারা যান। একমাত্র কাকার পৃষ্ঠপোষকতায় মা-বাবাহারা গাঁয়ের এক উদ্ভ্রান্ত যুবক, আন্তনির সাথে কান্তার বিয়ে হয়। এই আন্তনিকে ঘিরে সে, স্বপ্নের ঘর বেঁধেছে। একটা ছোট্ট সুখী সংসারের প্রতিচ্ছবি দেখেছে। মনেপ্রাণে সেই সংসারটাকে গোছাতে চেষ্টাও করেছে। কোমরে আঁচল বেঁধে জমিতে নেমেছে। কিন্তু কী হ’তে যে কী হয়ে গেল! এমন ক’রেই বুঝি ঈশ্বর তাঁর ভাঙাগড়া খেলার ঘুঁটি চালেন?

এ সময় যদুর বাড়িতে আন্তনির আনাগোনা, বেশ জ’মে ওঠে। পুঁটির মাকে ঘিরে অন্য এক স্বপ্নে, বিভোর হয়ে থাকে আন্তনি। কামনার আর তৃপ্তির অথই গভীরে ডুব দেয় সে। এখানে নেই দায়িত্বের কোন বোঝা। জীবনটাকে খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। পুঁটির মা’র কাছে, আলাদা একটা সুখ আছে! তা টের পায় আন্তনি। কান্তা আন্তনির জীবনে এসেছে ঠিকই। কিন্তু চেতনার যমুনার পাড়ে নিয়ে, কান্তা কেবল আন্তনিকে দাঁড় করিয়েই রেখেছে। যমুনার জলে সাঁতার কেটে তাকে, নদী পার করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি সে রক্ষা করতে পারেনি।

কান্তার আওতা থেকে, আন্তনি এখন মুক্তি চায়। দূরে দূরে রাখতেই চায় সে নিজেকে। চাওয়া-পাওয়ার চরম ব্যর্থতার মাঝে, খেই হারিয়ে ফেলে। এমনি ক’রে তাকে অপদস্ত হতে হবে, তা সে ভাবেনি কোনদিন। অনাগত সন্তানের মাঝে পিতৃত্বের সার্থকতা খুঁজতে গিয়ে শুধু পরাজয় বরণই করেনি, চরম ব্যর্থতার গ্লানিতে দগ্ধ হয়ে অপমানিতও হয়েছে। তাছাড়া অন্য দশজনের মত, নিজেও নতুন কিছু পাওয়ার জন্য আশায় বুক বেঁধেছে। নতুনের আস্বাদে পুরাতন যে এমন ক’রে অবহেলিত হয়ে পড়ে, তা জানতো না আন্তনি। কান্তা এখন শুধু একটা যন্ত্রণাই নয়, অবাঞ্চিত এক ভারী বোঝাও বটে!

একটু সুযোগ পেলেই মনটাকে হালকা করার জন্য, পচাপাতার ঘিঞ্জি গলিপথ পেরিয়ে দুর্নিবার এক মায়াবী আকর্ষণের তাড়নায়, যদু কবিরাজের পুত্রবধূর কাছে ছুটে যায় আন্তনি। সাংসারিক চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে, এতটুকু বিচলিত হয় না সে। কান্তা কে উপেক্ষা ক’রে, তার দেহমনের চাহিদাকে পদদলিত ক’রে ঘন অন্ধকারে নেমে পড়ে আন্তনি।

আন্তনির আচরণ, কান্তা কেও ভাবিয়ে তোলে। সময়ে অসময়ে বাড়ির কাজকর্ম ফেলে, কোথায় কোন ঠিকানায় উধাও হয়ে যায় মানুষটা! কখনও ফিরে গভীর রাত্তিরে। আবার কখনও ঘরেই আসে না! কোথায় যায়? কোথায় খায়? এমনই অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে অন্তর্জ্বালায়, দিনরাত জ্ব’লে মরে কান্তা ।

ইদানীং শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না তার। ভেতরে ভেতরে জ্বর বয়। মাথে ঘোরে। চোখে অন্ধকার দেখে। এবং আরও অনেক উপসর্গ, যা সে গোপন ক’রে রাখে। সে জানে, স্বামীর কাজে অন্তরায় হ’লে কোন লাভ হবে না। যামিনীর কাছেও খুলে বলে না। হয়তো বা কখনও কখনও ধরা প’ড়ে যায়। যামিনীও হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। কিন্তু মুখ ফুটে সব বলতে পারে না কান্তা ।

নিজের প্রয়োজনে কান্তার কাছে আসে আন্তনি। উল্টো বউটার প্রয়োজন, কখনও বুঝতে চেষ্টা করেনি। আজকাল স্বামীর মুখ থেকে, উৎকট একটা গন্ধ বেরোয়। গন্ধটা সহ্য করতে পারে না কান্তা । নাকের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে গেলেই, পেটের নাড়িভুঁড়ি সবই ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সারাটা রাত অসহ্য পরিবেশে, স্বামীর পাশে গুম হয়ে প’ড়ে থাকতে হয় তাকে। ভোর হওয়ার সাথে সাথে, আবছা উঠানের খোলা পরিসরে, আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায় প্রায়ই। টেনে টেনে বুক ভ’রে মুক্ত ঠাণ্ডা বাতাস নেয়।

কথাটা যামিনী দিদিমার কাছে বলবে কিনা, তাই ভাবছে কান্তা এখন। না বললেও একদিন তো সবাই জানবে। জেনে যাবে আগে যেমনটি হয়েছিল ঠিক তেমনই ক’রে। কিন্তু তবুও মনটাকে প্রসন্ন রাখতে পারে না সে। তাছাড়া এবারও যদি তেমন মৃত সন্তান …! ভাবতে পারে না কান্তা আর। না! না! ঈশ্বর এমন নির্দয় হবেন না কখনও! আর যদি আগের মতন হয়, তবে তার আগেই মরণকে আঁকড়ে ধরতে চায় সে। ব্যাপারটা আন্তনি কীভাবে নেবে তাই ভাবে কান্তা । নাকি চরম বিতৃষ্ণায় প্রত্যাখান করবে!

যামিনী আগেই জেনে ফেলেছে বিষয়টা। তবুও হয়তো, কান্তার মুখে শোনার অপেক্ষায় ছিল ক’টা দিন। শেষমেশ নিজেই উপযাচক হয়ে, জিজ্ঞেস করলো কান্তা কে, তার অনুমান ঠিক কিনা। ভয়, লজ্জা ও নতুন কিছু স্বপ্নের সংমিশ্রিত হাসি টেনে, কথাটা স্বীকার করে কান্তা । যামিনীর ফোকলা মুখে, পান-সুপাোরি হাসি খেলে যায়। একবার তার ইচ্ছা হলো, দৌড়ে গিয়ে আন্তুকে খুশীর খবরটা জানিয়ে দেবে! জিলেপি-রসগোল্লার দাবিটাও সাথে ক’রে বসবে! কিন্তু কান্তার গাল বেয়ে পানি গড়াতে দেখে, থেমে যায় যামিনী!

আউশ কাটার মহাধুম প’ড়ে যায় গাঁয়ে। সোনালিধানের অবারিত উল্লাস নিয়ে, খেতের মানুষগুলো ব্যস্ত সারাদিন। সাজসাজ রব প’ড়ে যায় সর্বত্র। সূর্য ওঠার আগেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। এদিকে দাওয়ায় একা ব’সে থাকে, নির্জীব আন্তনি। আজ নেই তার কোন চঞ্চলতা। নেই নতুন ধানের গন্ধে মুগ্ধ হওয়ার সেই উদ্যমতা।

এ সময়, কান্তা ও ব’সে থাকে না। ঘরদোর পরিচ্ছন্ন সাজে ভ’রে তোলার কাজে, ব্যস্ত হয়ে ওঠে। যামিনীর বাধা উপেক্ষা ক’রে, উঠানে নেমে আসে সে। যদিও অন্যান্য বারের মতো ধান ফলেনি এবার। তবুও যা হয়েছে তা’তে তার আনন্দটা আগেই মতনই অটুট রয়েছে। কান্তার চঞ্চল পায়ের দিকে তাকিয়ে, কর্মোদ্দমহীন মাতাল আন্তনি অন্য এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।

আড়চোখে স্বামীকে দেখে কান্তা । কেমন নির্জীব হয়ে গেছে মানুষটা! অদ্ভূত একধরণের পরিবর্তন এসেছে, তার মাঝে! এমন তো আগে কখনও হয়নি! ঠিক এরকম সে ছিল না কোনদিন! কাজের ধান্ধায় সারাটা দিন ব্যস্ত থাকতো। বিশ্রামের এতোটুকু সময় পেতো না। অথচ কী এক বিশ্রী চেহারা নিয়ে পুরুষটা, কাজের কথা ভুলে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে! এমনটি হল কেন? এর জন্য কি এই মানুষটা নিজেই দায়ী? নাকি এক জনমদুঃখী কান্তা ?

কাস্তে নিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য, স্বামীকে তাগাদা দেয় কান্তা । বিরুকে সেই কাকডাকা ভোরে, পাঠিয়ে দিয়েছে। তার সাথে চার জন কামলা। অথচ, এই কাজের সময়, স্বামী তার বিগত সারাটা দিন, সারাটা রাত বাইরে কাটিয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি এল ঢুলে ঢুলে!
-এক দিন এক রাইত পরে বাড়ি আইছো তুমি! কার ঘরের ভাতার হইয়া, এই সময় ছিলা? তোমার কি ঘর-সংসার, খেত-খোলা কিছুই নাই? কি কথা কও না কেন? তুমি কি …’
কান্তার মুখে উচ্চারিত হয়, দুর্বিনীত শব্দাবলী। ইচ্ছা করেই স্বামীকে বাড়িয়ে, কথা শোনায় সে। কঠিন ভাষায় অতিষ্ঠ ক’রে তোলে আন্তনিকে।

আন্তনি আর ব’সে থাকতে পারে না। জ্বলজ্বলে চোখে দেখা হাতের কাছে প’ড়ে থাকা, আমের লম্বা চ্যালাটা হাতে তুলে নেয় অনায়াসে। এগিয়ে যায় কান্তার দিকে। রোষানলের প্রচন্ড জ্বালার মুখে, ক্ষিপ্রগতিতে তা বসিয়ে দেয় কান্তার কোমর বরাবর। কান্তার কন্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে, একটা তীব্র আর্তনাদ। উঠানের এক পাশে রাখা, নতুন ধানের স্তূপের কাছেই ঢ’লে পড়ে, যন্ত্রণাকাতর গৃহবধূ। হায় হায় ক’রে ছুটে আসে বেহুঁশ যামিনী।
-আন্তু! তুই এ কী করলি হারামজাদা! বউডার পেডে বাচ্চা, আন্তুনি!

যামিনীর আর্তনাদ শুনে, চমকে ওঠে আন্তনি! কান্তা কে ধরতে গিয়েও পারেনি সে। কী এক ঘৃণা নিয়ে, একপা দু’পা ক’রে পচাপাতার গলিপথটাতে এসে দাঁড়ায়। অনুশোচনা না অতৃপ্ত আক্রোশের দ্বন্দ্বে বুকের ভেতরটা জ্ব’লে যাচ্ছে, তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না এখন। বেদনায় বিকৃত কান্তার মুখখানা, চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার চিৎকারটা কানে এসে, ধাক্কা মারছে বারবার।

প্রসববেদনায় ছটফট করছে কান্তা । গত রাত থেকেই চিনচিন ক’রে ব্যথাটা বাড়তে থাকে। তীব্র যন্ত্রণায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে সে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে যামিনী। ভোরে দাই চান্দার মাকে আনার জন্য, বিরুকে পাঠিয়েছিল। একটু আগেই, চান্দার মা এসেছে। ঘর-বাইরের সমস্ত কাজ নিয়ে, যামিনী পুরাদস্তুর ব্যস্ত। বেআক্কেল পুরুষটা, গেল রাতে বেরিয়েছে অথচ রাত গড়িয়ে আরেকটা দিন এসে গেছে, তার ঘরে ফেরার নামগন্ধটি নেই!

টলতে টলতে উঠানে, পা রাখে মাতাল লোকটা। গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে, ‘অক্ অক্ থো’ শব্দে বমি করে। পচাগুঁড়ের উৎকট গন্ধে, ভ’রে ওঠে সারাটা বাড়ি। চিলতে উঠানের ঈশানকোণে, ডালিমগাছটার নিচে দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে ব’সে পড়ে আন্তনি। ঝুলে পড়া কপালে একজোড়া চোখ তুলে, যামিনী বেরিয়ে আসে।
-আরে আন্তু! সারাডা রাইত পার কইরা, অহন একটা শাড়ি কাপড় লইয়া তুই বাড়ি আইছস্! তোর মাথায় চিন্তা নাই?

যামিনীর গলায় শ্লেষ্মামাখা শব্দ ধারালো হয়ে ওঠে, ‘তোর কি আক্কেল আছে? তোরে কইলাম, পোষমাস। বাচ্চা অইবো বউডার! গরমকাপড় আনিস কিছু। আর তুই আনছো্স, একখান নীলাম্বরী পাবনাই শাড়ি! হায় ঈশ্বর!’

শাড়িটা বগলতলে চেপে লুঙ্গি ঠিক করতে, উঠে দাঁড়ায় আন্তনি মাতাল লোকটা। যামিনীর চোখে, ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে এই মানুষটা! পচন ধরেছে তার পুরো অস্তিত্বে।
-ক্যান? গরম কাপড় ক্যান?
-গরম কাপড় আনবি ক্যান, জানোস না? আরে চাঁন কপাইল্যা! তোর ফুটফুইটা সোন্দর; একটা পোলা অইছে! এহন থাইকা তুই পোলার বাপরে, আন্তু! বড়ই চানকপাইল্যা তুই! ঈশ্বর তোরে দয়া করেছে!
বাঁশ ছন আর পাতায় ঘেরা কুটীর থেকে, সূতিকাগন্ধের সাথে ভেসে আসে নবজাতকের গলাফাটা কান্নার শব্দ। সচকিত হয়ে ওঠে মাতাল আন্তনি।
-ও পোলা আমার না! ওইডা ভূতের পোলা!
-আন্তুনি! কস কী তুই, হারামজাদা …!
হা হা ক’রে ছুটে আসে যামিনী, আন্তনির কাছে।
-আন্তু ভাই! ও কতা কয় না লক্ষ্মী সোনা! তোর পোলা জ্যাতা আছে! দে ভাই সোনা। শাড়িডা আমার কাছে দে!
এগিয়ে গিয়ে, আন্তুর পিঠে হাত বুলায় যামিনী।
-না! এই শাড়ি আমি, এই বড়দিনে পুঁটির মায়রে দিমু!
-পুঁটির মায়রে!
দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে যামিনী আশ্চর্য হয়ে। রাগে ক্ষোভে অতিষ্ঠ হয়ে, নিজের চুল টানতে থাকে সে।
-ও বুচ্ছি! ওই পুঁটির মায়ের লগে তুমি পিড়িত করবার চাও! তারে তুমি …!

চোখ দু’টি জ্ব’লে ওঠে আন্তনির। দু’হাত বাড়িয়ে সজোরে ধাক্কা মারে সে। নিজেকে সামলাতে না পেরে উল্টে প’ড়ে যায় যামিনী। ‘বেজন্মা কুত্তা …!’ মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তার, আদিকালের অশ্রাব্য খিস্তি। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়া ঠেলে ঘরে ঢোকে উন্মাদ আন্তনি। চিৎ হয়ে, অর্ধচেতন শরীরে দুর্বল শ্বাস টানছে কান্তা । কাছেই দাই চান্দার মা, সদ্যোজাত শিশুটিকে কোলে নিয়ে, নাড়াচাড়া করছে। কাছেই শায়িতা কান্তার দিকে এগিয়ে যায়, বেহুঁশ আন্তনি।
-ক’ হারামজাদী! আমার ঘরে ভূতের বাচ্চা আইছে ক্যান? বাইরা! বাইরাইয়া যা আমার ঘর থন! এক্ষণই যাবি!
তার ডান পা তুলে, প্রবল গতিতে ছুঁড়ে মারে সে কান্তার দিকে। ক্ষীণ একটা শব্দ ক’রে, ন’ড়ে উঠলো কান্তার দুর্বল দেহটা। সাথে সাথে নবজাতক, চিৎকার ক’রে ওঠে আরও জোরে।

চারপাশে কেমন অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধ ব্যস্ততা! মাথা নিচু ক’রে উঠানে নেমে আসে, নির্বাক আন্তনি। প্রবল ক্লান্তির ছায়া তার সারা দেহে। সে বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করে, গ্রামবাসীরা ছুটাছুটি করছে! তারা ব্যস্ত হয়ে, কান্তার ঘরে ঢুকছে কেবল!

ঘরের পিছনে জ্বলজ্বলে রক্তজবা গাছের কাছে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আন্তনি। হঠাৎ খালি খাটিয়া সহ শববাহকদের আগমন দেখে, মদের নেশা ছুটে যায় তার। নিজের ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখে সে, লোকেরা ধরাধরি ক’রে কিছু একটা উঠানে বের করছে। কাছে এগিয়ে মাথা কাঁত ক’রে একটু লক্ষ্য ক’রে দেখলো, তার সুন্দরী কান্তা বউয়ের নাক মুখ দিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে!

গলাফাটা চিৎকারে, হাঁটু ভেঙ্গে ব’সে পড়ে আন্তনি। ভীড় ঠেলে, কান্তার কাছে যায় সে। তার বৌয়ের শক্ত-ঠাণ্ডা চিবুক ধ’রে, ঝাঁকুনি মারে প্রবল। সে দেখতে পায়, গল্ গল্ রক্ত বেরিয়ে আসছে কেবল! সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘একি খাঁটি রক্ত? নাকি অন্য কিছু?’ নিজের হাতের দিকে আন্তনি তাকিয়ে দেখে, অদ্ভূত লাল হয়ে উঠেছে তার হাত দু’টো! শুধুই রক্ত! অদ্ভূত লাল!

দাই চান্দার মাকে দেখে, ছুটে যায় আন্তনি তার কাছে। তার মনে হচ্ছে, নবজাত বাচ্চাটা, পিট্ পিট্ ক’রে তাকাচ্ছে তার বাবার দিকে। উদ্ভ্রান্ত আন্তনি, আবার দৌড়ে আসে লাশটার কাছে। এবার কাঁদলো না সে। নিঃশব্দে ব’সে পড়ে, প্রাণহীন কান্তার কাছে। ডান হাতটা বুলিয়ে, রক্তের রঙটা মুছে দিতে চেষ্টা চালায়। আন্তনির চোখে জল নেই। নেই কোন প্রতিক্রিয়া।

[চার]
শোকাতুরা যামিনী, কান্তার শোকে মূহ্যমান। ওর স্মৃতি বারবার আঘাত হানে, বৃদ্ধার মনের গভীরে। তাই বাচ্চাটাকে, সর্বদা নিজের বুকে বুকেই রাখে। আন্তনিকে এখন গ্রামবাসীরা, তার নাম ধ’রে ডাকে না। বরাবর ‘আন্তুপাগলা’ ব’লেই ডাকে। আন্তনি পাগলই হয়ে গেছে! গায়ে ঢোলা ময়লা পাঞ্জাবি। পরনে ছিন্ন লুঙ্গি। মাথায় উশকোখুশকো চুল। মুখ ভর্তি কালো বেসামাল দাড়ি। যখন ইচ্ছা, তখন গির্জার কবরস্থানে সে ঢুকে পড়ে। কান্তার কবরের উপর, গড়াগড়ি খায়। মাটি খোঁড়ে। কখনও হাসে। আবার কখনও কাঁদে।

চাঁদিফাটা রোদে ঘামে জবজবে হয়ে, এ সময় নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে বাড়ির আঙিনায়। পরনে পুরনো খয়েরি লুঙ্গি ছাড়া তার গায়ে আর কিছু নেই। ধূসর উঠান পেরিয়ে, পা রাখে ছনের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দেয়া ঘরের পইঠায়। চৌকির উপর তেলচিটে কাঁথায় ঘুমাচ্ছে, তার আদরের পুত্রসন্তান। হাত বাড়িয়ে, বাচ্চাটাকে আদর করতে আসে আন্তনি। চুলদাড়িতে ঢাকা আধাপাগল মানুষটিকে দেখে আঁতকে ওঠে যামিনী। হা হা ক’রে ছুটে আসে সে। ব্যাকুল পায়ে, আন্তনির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। শিশুটিকে স্পর্শ করতে দেয় না। ‘দূর হ’ হারামজাদা’ বলে খেঁকিয়ে ওঠে সে। দুহাত বাড়িয়ে, গায়ের বল এক করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় আন্তনিকে। মুখ ভর্তি ‘ছেবলী’ নিয়ে, মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় আন্তুপাগলা। তার বিকৃত হাসির আওয়াজ; শুনতে পায় যামিনী। আবার আন্তনির কণ্ঠে কিছু দুর্বোধ্য প্রলাপ শূনতে পায় সে। পচাপাতার গলিপথে পা রাখার আগে চিৎকার করে আন্তনি বলে, ‘এইডা আমার পোলা! আমি ওর বাপ!’ যামিনী গলা উঁচিয়ে বলে, ‘দূর হ’ শয়তান!’

পড়ন্ত বেলায় কূয়াতলা থেকে স্নান সেরে ঝাঁপ ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢোকে যামিনী। দেখে বাচ্চাটা নেই! কোথাও নেই! স্নানে যাওয়ার আগে, ঘরের চৌকিতে বাচ্চাটিকে রেখে গিয়েছিল সে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে সে, বাচাটা নেই! হালকা আলোর পরিসরে এদিক ওদিক তাকিয়ে ডেকে, না। কোথাও নেই! নিজেকে প্রশ্ন করে সে, ‘ঘুমের বাচ্চাটা ঘর থেকে, দিব্যি উধাও হয়ে গেল?’ বেহুঁশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে যামিনী। দুহাত মাথায় তুলে, ‘তুই এইডা কী করলিরে আন্তু! এইডা কী করলি …!’ গলাফাটা চিৎকারে পাড়া মাথায় তোলে।
-হায়! হায়! এইডা কী হইলো, ভগবান! রক্ষা কর তুমি!
যামিনীর আর্তচিৎকারে, ব্যস্ত হয়ে প্রতিবেশী সবাই ছুটে এল । কিন্তু আন্তু পাগলা এল না।

সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এই জনপদের অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথে, কালের বৃক্ষ থেকে পাতারা ঝরছে তো ঝরছেই। এবং এই ঝরাপাতারা জ’মে জ’মে, পচে যাচ্ছে কালের সাক্ষ্য দেয়ার প্রস্তুতি পর্বে। তারপর জীবাশ্ম হয়ে সৃষ্টির সাক্ষী রূপে, নিজেদের তুলে দিচ্ছে স্রষ্টার করতলে। তাই আন্তনির বাড়ির সামনের পচাপাতাসমৃদ্ধ দীর্ঘ গলিপথটা, তার বিবর্ণ ভূতুড়ে অবয়ব নিয়ে, ক্রমশঃ ফেঁপে উঠতেই থাকে!
****************************

Leave a Reply