You are currently viewing কুর্দি কবি আব্দুল্লা পেশোয়া : কবিতা ও কথোপকথন || ঋতো আহমেদ

কুর্দি কবি আব্দুল্লা পেশোয়া : কবিতা ও কথোপকথন || ঋতো আহমেদ

কুর্দি কবি আব্দুল্লা পেশোয়া : কবিতা ও কথোপকথন || ঋতো আহমেদ

বিশিষ্ট কুর্দি কবি ও লেখক আবদুল্লা পেশোয়া-কে বহুল জনপ্রিয় জীবিত কুর্দি কবি হিসাবে গণ্য করা হয়। জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালে ইরাকী কুর্দিস্তানের আর্বিলে। সেখানে টিচার্স ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউশনে লেখাপড়া করেন। তিনি ১৯৭০ সালে বাগদাদে কুর্দিজ রাইটার্স ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় সংযুক্ত ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যান। এবং ১৯৭৯ সালে এমএ আর ১৯৮৪ সালে দর্শনশাস্ত্রে পিএইচডি করে পরবর্তী ৫ বছর লিভিয়ার ত্রিপলিতে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৯৫ পর্য‌ন্ত ফিনল্যান্ডে বসবাস করেছেন। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে আর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৬৭ সালে। তারপর তাঁর আরও সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো ’বড়উ জর্দাপার (গোধূলির দিকে যাত্রা)’ আর ’হেসপিম হিউরু রেকিফিম চিয়া (মেঘ আমার ঘোড়া, পর্বত আমার রেকাব)’। এছাড়া তিনি কুর্দিতে ওয়াল্ট হুইটম্যান আর আলেকজান্ডার পুশকিন অনুবাদ করেছেন।

কবিতা

১.
যদি চাও
তোমার বাচ্চাদের বালিশগুলো
প্রস্ফুটিত হোক পিঙ্কের মতো,
যদি চাও বরফ-সাদা সিল্কি
স্বপ্নের দোলনায় বেষ্টিত হোক ওরা,
যদি তুমি চাও ওদের ডায়াপার হোক
রংধনুর মতো রঙীন আর
মসীহার হৃদয় দিয়ে
খেলুক পুতুল ওরা,
যদি চাও
ইক্ষুর ফলনে ভরে উঠুক তোমার আখক্ষেত,
যদি চাও তোমার আনন্দের উচ্ছ্বাস থেকে
সূর্য‌ তার তৃষ্ণা মেটাক,
যদি চাও ওই ঘন মেঘেরা তোমার মাঠগুলোয়
সবুজের বার্তা পাঠাক আর
মেলে ধরুক বসন্তের ঢুলুঢুলু চোখের ওই পাপড়িগুলো,
তাহলে মুক্ত করো—
মুক্ত করো
আমার জবানে বাসা বাঁধে
যেই পাখি।

০৪.০৬.১৯৭২
কুর্দিস্তান

২.
তোমার সাথে পরিচয়ের আগে,
আমি ছিলাম আত্মকেন্দ্রীক, এক শিশু।
চওড়া আকাশটাকে
ভাবতাম একটা তাঁবু
আমার জন্যই টাঙানো রয়েছে, আর
অন্য কেউ নয় কেবল আমার দ্বারাই অধ্যুষিত
এই পৃথিবীটা একটি প্লাবন-পরবর্তী দ্বীপ মাত্র।

কিন্তু হঠাৎ করেই তোমার ভালোবাসা এসে পৌঁছুল আমার কাছে
আর ধ্বংস করে দিল আমার এই দুর্গ, দুর্গের দেয়ালগুলো,
বদলে দিল সব রঙ,
বাতিল ঘোষণা করলো সমস্ত আইন।
আমার নির্জনতার জন্য
বিশাল পৃথিবীটাকে একটি খাঁচায় পরিণত করে দিলো সে।
শিখিয়ে দিলো
অর্ধেক বালিশে কী করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

০১.১২.১৯৭৩
ভরোনেজ

৩.
তোমার কাছে
আমার কবিতা
রাস্তার পাশে পাথরের মতোই তুচ্ছ
তোমার কাছে
আমার শব্দগুলো
কোনো নভোচারী নয়, বরং পৃথিবীরই সামান্য শিশু।
প্রাণ আমার, কী আর করবো বলো?
এক মুহুর্তের জন্য ঝকঝকে ছবি
কিংবা চিকণ বুদ্ধিও মরে যায়
উদ্যান আর বাগানের কালো রাত্রিদের
জোনাকীর মতো—
আমি কেবল সেগুলোই ধরতে পারি
ক্লান্ত হয়ে পড়ে যায় যেগুলো
শরতের পাতার মতো।

১৪.০৭.১৯৯৩
মস্কো

৪.
যখন আমি নিরব থাকি
তখন কিছু বোলো না আমায়

ফল না-পাকা পর্যন্ত
জিভের ডগা আমার কাঁপিও না

কেননা আমিই একমাত্র নিরব নই

পাথরগুলোর দিকে
তাকাও
যদিও বুক উঁচিয়ে আছে বজ্রের দিকে
তবুও নিরব ওরা

ঘাসের দিকে
তাকাও
আলোর দিকে ফলক প্রসারিত করেও
নিরব ওরা

যখন আমি নিরব থাকি
ভেবো না যে অনর্থক বা অলস আমি
বিশ্বাস করো
মাথার খুলিটা আমার আস্ত একটা মৌচাক হয়ে যায় সে সময়, খুবই অস্থির থাকে

আমার স্বদেশ সম্পর্কে অনেক বলেছি তোমাকে
তোমার হৃদয় উদ্বেল হয়ে আছে ভালোবাসায়
তুমি কি চাও এর গ্রাম আর শহরগুলো তোমার চোখ দুটো ধাঁদিয়ে দিক?
তুমি কি এর ক্ষতটুকুও স্পর্শ করতে চাও?
তাহলে
যখন নিরব থাকি আমি
তখন জিন পরাও আমার নিরবতায়
পা রাখো ওই রেকাবে আর ঘাই মারো তুমি
তবেই দেখতে পাবে আমার পুরো স্বদেশ।

০৫.০৮.১৯৮০
মস্কো

৫.
ঝড়ের মতো প্রবাস যখন ভেঙে যায়
আমার স্তব্ধতার খোলা সমতলে,
দুঃখ যখন তার ডানা ছড়িয়ে দেয়
ঝুলন্ত কাকের মতো
আমার দ্বারে,
তখন আমার দুঃখের
হিমায়িত ডানার চড়ুইটাকে তুলে নিই আমার হাতে, আর
যেতেই থাকি, যেতেই থাকি
যতক্ষণ-না কোনো শিশু খুঁজে পাই
আর তার চোখের আলোয়
চড়ুইটাকে আবারো উড়তে শেখাই—
এখনও, প্রিয়তমা,
কতবার যে দেখেছি
শিশুরা এই শহরে শোক প্রকাশ করছে
যেন ছোট্ট হাসের মতো
আবারও তারা স্নান করতে আসে
তোমার চোখের হ্রদে।

৬.
যখন ভালিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করে,
“প্রথম কবে এই পৃথিবীতে পা রেখেছ তুমি?”,
আমি হেসে ফেলি, ঠিক যেমন রেউচিনির অঙ্কুর
তার শির নিক্ষেপ করে আমার মুখের ভেতর তুষারে।
আমার হাসি
পৃথিবীর তাবৎ-হাসি-একাট্টা-করা এক শিশু।
হ্যাঁ, ভালিয়া,
আমি নিয়ান্ডারথাল ছিলাম
যখন আমি এই পৃথিবীতে প্রথম পা রাখি।
আমার নিজের চোখ দিয়ে
নবীদের যুগ দেখেছি আমি,
ইতিহাসের লজ্জাজনক উত্তরণ
নীচের দিকে আমার কপালের কুঁচকানো দাগে চিহ্নিত রয়েছে।
আর এখনও পর্য‌ন্ত…
সময়ের পচনশীল চেতনার এইসব
জোচ্চোর প্রতিষ্ঠানগুলো
জীবনের বইতে
আমার নামই লেখেনি।

১৯.১০.১৯৭৪
মস্কো

৭.
তোমার জন্য
একান্তে আমার একটি রাত আর একটি দিন প্রস্তাব করছি
আমি ঠিক করেছি
আমার বিচরণশীল মানসিকতায় ফিরে আসবো আবার
স্তম্ভিত করে দেব ঢেউগুলিকে
তোমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভরে ফেলবো আমার ঘর
জানালা দরজা সব বন্ধ করে সমস্ত ফাঁক বুঁজে দেব
যেন বাতাস বাইরে থাকে।

প্রিয়তমা আমার
শুধু একবার
চেষ্টা করো:
একটি দিন আর একটি রাত আমাকে উৎসর্গ করো
ভেঙে ফেলো সব ঐতিহ্যের বাঁধ
ভেস্তে দাও সমস্ত নিয়ম
তোমাকে যে ঘিরে ধরে তার থেকেও পালিয়ে যাও:
বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন
চাঁদ কিংবা নক্ষত্র
নীল আকাশ আর মেঘ
আর এই ভারী দুনিয়া—
পালিয়ে যাও
একদম তাকিও না ঘড়ির দিকে
বাদ দাও প্রাত্যহিকতা—
উল্টে যাবে না এই পুরোনো পৃথিবী
শুধু একবার,
একটি রাত আর একটি মাত্র দিনের জন্য,
সেই নারী হয়ে ওঠো আমার!
আমিও তোমার হবো এক রাত এক দিন
একান্ত আমার হবে তুমিও, একটি রাত আর একটি দিন।

হেলসিন্কি
১৮.০৫.২০০০

সাক্ষাৎকার

২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯

জিয়াদ রাশাদ: মনে করুন যদি আমার জায়গায় আপনি হতেন তবে কোন প্রশ্নটি দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করতেন আপনি?

আব্দুল্লা পেশোয়া: আমার একটি কবিতা “কাজেওয়াইয়া”-তে বলেছি, “বহু প্রশ্ন পেরিয়ে এসছি আমি, তবুও/ অনেক পেরুনো বাকী…” প্রতিদিন, প্রচুর প্রশ্ন আসে মনে, এমনকি তার পেছনে, মনের দরজায় আরো এক গাদা প্রশ্ন অপেক্ষায় থাকে। যা-ই বলি-না-কেন, যা-ই-করি-না-কেন আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, “আমি কি সঠিকভাবে করেছি? আমি কি সত্য বলেছি? আমি কি সঠিকভাবে করি?” মনের ভেতর এতো এতো প্রশ্ন নিয়ে কীভাবে বলি কোন প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করবো আমি?

জিয়াদ রাশাদ: দু’বছর আগে, যখন রাজনীতিবিদরা কুর্দি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, আপনি তখন বলেছিলেন বুদ্ধিজীবীদেরও (যারা হঠাৎ করেই ঐক্য উদ্যাপন শুরু করলেন) তাদের কাজের মাধ্যমে কলমের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কেন আপনি এই অবস্থান নিয়েছিলেন?

আব্দুল্লা পেশোয়া: ২০০২ সালে আমি একবার একটি কবিতা পাঠ করেছিলাম। সেখানে বলা ছিল, “সাহসিকতা বিষয়ে কোনো কবিতা পাঠ করতে পারি না আমি যদি আমি নিজে কাপুরুষ হই, উদারতা বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারি না আমি যদি কৃপণ আর ক্ষুদ্র মনের হই। আসলে ঐক্য নিয়ে তামাশা দেখে আমার হাসি পায় যখন লেখকরা নিজেরাই পক্ষপাতদুষ্ট।” আমি এখনও মনে করি যদি বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিবিদ এবং যারা রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা করেন তাদের পর্যবেক্ষণ না করেন, তবে অর্থ আর ক্ষমতার লড়াইকে কখনো এই জাতির শিরায় প্রবাহিত হওয়া থেকে রোধ করা যাবে না। আমরা কেবল বুদ্ধিজীবীদের তাদের আচরণের মাধ্যমে আরও বড় দার্শনিক অর্থে মূল্যায়ন করতে পারি। এমনকি যদি কেউ অনেক অনেক বই পড়েন, বা অনেকগুলি কবিতা এবং উপন্যাস লেখেনও, তার পদক্ষেপগুলি যদি চিন্তাশীল না হয় তিনি বুদ্ধিজীবী নন।

কর্তৃত্বের পক্ষে যারা নিজেদেরকে মুখপাত্র হিসেবে তৈরি করেছেন, তারা কি চুরির জন্য দোষী নন? সেই একই লোকেরা যারা বিভিন্ন দলের পক্ষে আওয়াজ তুলেছিল যেহেতু গৃহযুদ্ধে কুর্দিরা কুর্দিদের হত্যা করেছিল, যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষমতা যাদের ছিল তাদের চেয়ে কি তারা কম অপরাধী বলা যায়?

জিয়াদ রাশাদ: সাহিত্যিক জীবনে আপনার কোনো অনুশোচনাবোধ আছে?

আব্দুল্লা পেশোয়া: সৌভাগ্যক্রমে, আমি এখনও অনুশোচনা করার মতো কিছু লিখিনি। তেমন কিছু লিখার আগে, প্রথমে সামনাসামনি হই। নিজস্ব বিচার বিবেচনায় যাচাই করি। সচেতনতা ঘিরে ধরে আমাকে। প্রথম যৌবনে পদে পদে আমার ছিল উন্মুক্ত চিন্তা ভাবনা আর রাজনৈতিক বক্তব্য। আমি যা-ই লিখেছি তাতে এগুলোই প্রতিফলিত হয়েছে। হ্যাঁ, নারী বিষয়ে তীব্র কিছু কবিতাও লিখেছি যেগুলোর হয়তো এতোটা রূঢ় হওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু সেগুলো কিছু নির্দিষ্ট উপলক্ষ আর কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে নিয়ে লিখেছি। ওই কবিতাগুলি সাধারণভাবে নারী জাতিকে প্রতিফলিত করে না। যখন কুর্দিস্তানে থাকতাম, যদিও আমার অস্তিতে সব সময় প্রেমই বইতো, তবুও তখন নারী বিষয়ে তেমন কিছুই জানতাম না। নারীদের জানার সুযোগ পেয়েছিলাম যখন বিদেশে ছিলাম। শিখেছিলাম নারী হতে পরেন বন্ধু, স্ত্রী, বোন, অথবা প্রেমিকা। আমি বিদেশে চলে আসার পর থেকে রাগ বা জ্বালা প্রকাশের জন্য কোনও কবিতা লিখেছি বলে আমার মনে হয় না।

জিয়াদ রাশাদ: কুর্দি বা অন্য কোন লেখক আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন?

আব্দুল্লা পেশোয়া: আমি প্রতিটি ভাল কবিতা থেকে আনন্দ এবং অনুভুতি গ্রহন করি। সুতরাং, কবিতাটি হার্ডি বা গোরান, হুইটম্যান বা পুশকিনের অন্তর্ভুক্ত কিনা তা বিবেচ্য নয় আমার কাছে। কেননা, আনন্দ দেয় এমন কিছু তার নিজস্ব প্রভাবকেই ভুলে যায়।

জিয়াদ রাশাদ: কুর্দিস্তানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার অভিমত কী: সেখানে স্বাধীনতা বলতে কতোটুকু আছে? আপনি কি মনে করেন না যে এই কবিতা লেখার বিষয়ে আপনাকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে? অন্য কেউ হলে, এতোদিনে থামিয়ে দেয়া হতো?

আব্দুল্লা পেশোয়া: আমরা এমন একটি অঞ্চলে থাকি যেখানে কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে কিছু নেই। এখনও আমাদের মধ্যে গণতন্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন আর চর্চার এবং নাগরিক সরকার গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকারই দল আর দলই সরকার এখানে। স্থানীয় সরকার কাঠামো একটি লাল দাগের বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ। কোনো সমালোচনার আওয়াজই তাকে ভাঙতে পারে না। কুর্দি মিডিয়া হাস্যকরভাবে দল-সংশ্লিষ্ট। এই রাজ্যে মজুরি, খাদ্য, জল, বায়ু, বিদ্যুৎ, একাডেমিক ডিগ্রি, পেশা, কেরিয়ার: সবই কর্তৃপক্ষের আওতাধীন। ঘুষের সাথে জড়িত সব কিছু। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান সবকিছুর মান হ্রাস করেছে। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের আত্মীয়রা জাতির কাছ থেকে যা পারে তা-ই লুটে নেয়। বৌদ্ধিকতা এবং শিক্ষা, অন্য কোনও সময়েও, কখনও এত দরিদ্র হয়নি। অপেশাদাররা পরিকল্পিতভাবে, নিরলসভাবে এর ঐক্য নষ্ট করার জন্য কুর্দি ভাষা দখল করেছে। যদি কেউ দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, তাকে কর্মসংস্থানের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। কুর্দিস্তানে, কেউ কাজ করে না। যদি কোনো ক্যাডার কিংবা দলের সদস্যরা দুর্নীতি এবং কিছুটা স্বাক্ষরতা থেকে উদ্ভূত ক্ষমতা অর্জন করে তবে হঠাৎ করেই তারা বিশেষজ্ঞ ভাষাবিদ, সাংবাদিক, কবি, সুরকার, উপদেষ্টা, অ্যাথলেট, এমপি, ব্যাংকের প্রধান কিংবা চিকিৎসক বনে যান!

হ্যাঁ, অনেক বার আমাকে বলা হয়েছে, “আপনি যা বলতে চান তাই বলুন এবং আপনি যা বলবেন তা সাদরে গৃহীত হবে।” এটা যেমন সত্য, তেমনি মিথ্যেও। হ্যাঁ, যদি কেউ তার আপন ইচ্ছের মূল্য দেয়, যেমনটা আমি দিয়ে এসেছি সারা জীবন, তবে সে আমার মতোই নিজের কথা বলতে পারে এবং নিজের মতো করতে পারে। কোনও কর্তৃপক্ষই আমি যা করেছি তা করার ক্ষমতা আমাকে দেয় নি। বস্তুগত এবং আর্থিক ক্ষমতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে আমি নৈতিক শক্তি অর্জন করেছি। আমার সহকর্মীদের সমর্থন ব্যতীত, আমি মনে করি না যে আমি এটি করতে পারতাম।

আমি যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমার চল্লিশ বছরের লেখালেখি এবং বিচার/বিবেচনাকে দেখতে পাই: যা আমার সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এটি আমার জন্য একটি ছোট নাম এবং মানুষের সাথে একটি দুর্দান্ত বিশ্বাস তৈরি করেছে। এখনও, আমার হৃদয়ের ভেতর নিজেরই হাত স্পর্শ করে বলছি, সেই সম্পদটুকু হারাতে ভয় হয় আমার।

জিয়াদ রাশাদ: যে কবিতাগুলি দূর্বোদ্ধ বা কেবল এক অভিজাত শ্রেণির পাঠকেরা বুঝতে পারেন, সেগুলো সম্পর্কে কী অভিমত আপনার?

আব্দুল্লা পেশোয়া: আমি জানি না এটি সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যজনক বিষয় কিনা যে আমার কাছে এমন কোনো কবিতাই নেই! এটা একটা ঘাটতি হতে পারে। কোনও ধরনের কবিতারই বিরুদ্ধে নই আমি। আমি সব সময় বর্ণময়তার ধারনার সাথে সম্পর্কযুক্ত; কুর্দি কবিতা বর্ণময়তায় সমৃদ্ধ।

জিয়াদ রাশাদ: শেখ সায়ীদ পীরানের বিচারকালে তার এক বিচারক বলেছিলেন, কুর্দি বিদ্রোহের জন্য শেখই কেবল দায়বদ্ধ ছিলেন না। আহমেদ জানির মেম ইউ জিন আরেকটি কারণ ছিলেন। যদ্দূর মনে পড়ে, মায়াকভস্কিই তাঁর শত্রুদের বলেছিলেন: আমি আমার কবিতা দিয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দেব। আপনি কি মনে করেন যে কবিতার এই ভূমিকাটি থাকতে পারে, এটি শত্রু এবং উগ্রপন্থীদের মোকাবিলা করতে পারে? কবিতা আজকাল কী ধরনের বার্তা বহন করে বলে মনে হয় আপনার?

আব্দুল্লা পেশোয়া: আমাদের কুর্দিস্তানে, কবিতায় সবসময় একটি নৈতিক শক্তি ছিল যা কেউ কখনও সরিয়ে দিতে পারেনি। সত্য-যে, প্রতিটি যুগেই কিছু দুর্বল কবিতা ছিল, তবে সত্যের কবিতা সর্বদা অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি আরও বলতে চাই আমাদের গণতন্ত্রকরণের প্রক্রিয়াতে কবিতার ভূমিকা কমানো হয়েছে এখানে।

জিয়াদ রাশাদ: আপনি সাধারণত কখন লিখেন? আপনি কি অনুপ্রেরণা এবং উদ্ঘাটনে বিশ্বাস করেন?

আব্দুল্লা পেশোয়া: কবিতা লেখার জন্য আমার কোনো নির্দিষ্ট সময় আর জায়গা লাগে না। তবে, রাতের শেষভাগেই বেশিরভাগ কবিতা লিখেছি আমি। রাত্রি আমার কবিতার মা আর অনিদ্রা হলো সেবিকা। তবে শুধুমাত্র অনুপ্রেরণাই যথেষ্ট নয়: কবিতা লেখার জন্য প্রতিটি শব্দ, ছন্দ, কমা এবং বিন্দুতে সঠিক কৌশল এবং নৈপুণ্যের প্রয়োজন।

জিয়াদ রাশাদ: আপনার দৃষ্টিতে, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এবং কর্তৃপক্ষ আর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সম্পর্ক কী হওয়া উচিত?

আব্দুল্লা পেশোয়া: কুর্দিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক দলই সর্বগ্রাসী; এগুলি কমিউনিস্ট দলগুলির অনুসারে তৈরি করা হয়েছে। বাগদাদ, উত্তর কোরিয়া, কিউবা এবং দামেস্কে বিদ্যমান দলগুলির থেকে এগুলি তেমন আলাদা নয়। আমি যে বিষয়ে কথা বলছি তা হলো আইনের শাসন এবং এটির আমাদের সিস্টেমের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের সামনে এখনও এমন কোনো দল নেই যেটি ইউরোপের সেই দলগুলোকে অনুসরন করে তৈরি যারা দলের সদস্য আর সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখতে পারে।

সোভিয়েত আমলে এমন অনেক কবি ও লেখক ছিলেন যাদের লেখাগুলো প্রকাশ আর বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল দুর্নীতিবাজ দলীয় সদস্যদের দ্বারা জনগণের কাছ থেকে চুরি করা অর্থ নিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বিলীন হলো, এই লেখকরাও তখন বিস্মৃত হয়ে গেলেন। আর ম্যান্ডেলস্টাম, গোমিলভ এবং প্যাস্তরনাক হয়ে উঠলেন অবিস্মরণীয়। পার্টির সমস্ত লেখক এবং বুদ্ধিজীবী অজ্ঞাত পরিচয়েই মারা গিয়েছিলেন। শিক্ষা নেয়ার জন্য ভাল উদাহরণ হলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীণ লেখকগণ।

জিয়াদ রাশাদ: স্মৃতিকথা লিখেছেন আপনার, নাকি তার কোনো ইচ্ছা নেই?

আব্দুল্লা পেশোয়া: স্মৃতিকথা লিখতে এক ধরনের স্থায়িত্ব লাগে। ১৯৯৭ পর্য‌ন্ত আমি ছিলাম শরণার্থী। এখনও আমার সংরক্ষণাগার এবং আমার গ্রন্থাগারটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, প্রতিটি বই রয়েছে পৃথিবীর আলাদা আলাদা কোণায়।

**********************************

ঋতো আহমেদ। কবি, গদ্যকার, অনুবাদক। প্রকাশিত মৌলিক কবিতাবই – ‘ভাঙনের মুখ’, ‘জলের পাতাল’। অনুবাদ কবিতাবই – ‘ওয়াকিং টু মারথাস ভিনিয়ার্ড’, ‘আদিরসাত্মক সংস্কৃত কবিতা’ ও ‘পাউল সেলানের নির্বাচিত কবিতা‘। গদ্যবই – ‘কবিতায় অভিনিবেশ’ ও ‘কবিতার দৃশ্যমান, কবিতার দৃশ্যাতীত’।
**********************************

Leave a Reply