You are currently viewing মলয় রায়চৌধুরীর গালগল্প

মলয় রায়চৌধুরীর গালগল্প

মলয় রায়চৌধুরীর গালগল্প

 

অনেকে মনে করেন, কফি হাউসের আড্ডায় বন্ধুরা বলতো, বেঁচে থেকে আমরা প্রত্যেকেই একটা “আখ্যান” তৈরি করি আর এই আখ্যান হলো ‘আমরা’। একইভাবে খালাসিটোলায় কয়েক গেলাসের পর সেই বন্ধুরাই বলতো, ‘প্রতিস্ব’ বা সেল্ফ হলো আরেকবার লেখা গল্প। এই দুরকমের মতামত মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত, আমরা আত্মজীবনীমূলক আখ্যান হয়ে উঠি, যার সিঁড়ি বেয়ে, বেঁচে থাকার মাধ্যমে, জীবনের আকাশের কথা বলি । সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা সবাই গল্পকার, আর আমরা নিজেরা সেই গল্প যা আমরা বাঁচার মাধ্যমে সময়ের খাতায় লিখে কেটে পড়ি। আমরা নিজেদের নিজেতে খুঁজে পাই ; আমরা আসলে আমাদের উদ্ভাবিত চরিত্র। প্রতিটি জীবন একখানা ভার্চুওসো উপন্যাস। আমরা নিজেদের সব ধরণের আচরণে নিয়োজিত দেখতে পাই আর সর্বদা এটিতে সেরা “চরিত্র” তৈরি করি । একজন লেখকের যেকোনো জনারের রচনা সেই লেখকের জীবন। আমরা আমাদের সমস্ত উপাদানকে বিভিন্ন সন্দর্ভে সমন্বিত করার চেষ্টা করি। আর সেই ন্যারেটিভ আমাদের আত্মজীবনী। সেই আত্মজীবনীতে ছড়িয়ে থাকে কাল্পনিক চরিত্রটি, যা একজনের নিজের। আমার বেলায় মলয় রায়চৌধুরীর। এই বইতে বিভিন্ন জনারের রচনা আছে, তাদের আমি বলছি ‘গালগল্প’। এগুলোকে খোশগল্প, কচাল, বার্তা বিনিময়, একান্ত আলাপ, বলাবলি, পরচর্চা, আলাপচারিতা, বিশ্রম্ভালাপ, কলরব বলা যায়।

কোনো কোনো বিদ্যায়তনিক আলোচক, এমনকি লেখকরাও এই কথাই বলেন। তাঁদের বলা যায় আখ্যানবিদ। আমরা নিজেরাই গল্প করি বা লিখি, আর আমরাই আমাদের গল্প। এই দাবি সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী ঐক্যমত রয়েছে, শুধুমাত্র হিউম্যানিটিজ বিভাগেই নয়, সাইকোথেরাপিতেও। বক্তব্যটা আদর্শগত ভাবে এই ধারণার সাথে যুক্ত যে আত্মকথন ও পরচর্চা একটি ভাল জিনিস, যা মানব জীবনকে পূর্ণ করার জন্য দরকার।

অনেক আলোচক আবার মনে করেন যে এটা মিথ্যা – মিথ্যা যে প্রত্যেকে নিজেরাই গল্প করে, আর মিথ্যা যে এই ব্যাপারটা সবসময় ভাল । তাঁরা বলেন, এগুলো সর্বজনীন মানবিক সত্য নয় – এমনকি যখন আমরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাভাবিক হিসাবে গণনা করা মানুষের প্রতি আমাদের মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখি, তখনও। তাঁরা এও বলেন যে, কিছু মানুষের, এমনকি অনেকের বা বেশিরভাগের ক্ষেত্রেও তা সত্য হলেও, তা সার্বজনীন সত্য নাও হতে পারে। তাঁরা ঠিক কি বলতে চান ? তা কি স্পষ্ট ? তবুও, মেনে নিতে হবে যে মানুষের সমাজে এমন মানুষ থাকবেই যারা মনে করে তাদের জীবন গভীর আখ্যানের বিষয়বস্তু, যেমন আমার নিজের জীবন, যে কারণে আমি ‘ছোটলোকের জীবন’ বইটা লিখেছি । স্বাভাবিকভাবে একজনের জীবন, সময়ের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা বা ধারণা করার জন্য নিষ্পত্তি করা, নিজেকে, বর্ণনামূলক উপায়ে, একটি গল্প হিসেবে, বা সম্ভবত অনেক গল্পের আঙ্গিক হিসাবে, মান্যতা দেয়া হয় ।

কিন্তু সব মানুষই আর সব লেখক বা কবিই প্রাগুক্ত অর্থে নিজেই নিজের আখ্যান নন। তাই একদল বিদ্যায়তনিক আলোচক বলেন যে, ব্যক্তিমানুষ স্বাভাবিকভাবেই – গভীরভাবে – নন-ন্যারেটিভ, কারণ জীবন তো রৈখিক নয়। আমার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’, ছোটোলোকের যুববেলা’ আর ‘ছোটোলোকের জীবন’ সবগুলোই অরৈখিক। তার কারণ ব্যক্তিমানুষ, আমার মতন অতিসাধারণ মানুষও, মৌলিক গঠনের ফলে তার জীবনকে রৈখিকতার পরিসরে ফেলার বর্ণনার বিরোধী। এটা শুধু যে ব্যক্তিমানুষের স্মৃতির পরিত্রাণ, তা কিন্তু নয়, কেননা জীবন ব্যাপারটা , আশাহীনভাবে টুকরো টুকরো এবং বিশৃঙ্খল ঘটনার সমষ্টি নয়, এমনকি যখন আমরা ঘটনাগুলোর অস্থায়ী ক্রম মনে রাখার চেষ্টা করছি তখনও। হাংরি আন্দোলনে আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলুম আর সরকার পঁয়ত্রিশ মাস আমার বিরুদ্ধে মামলা চালিয়েছিল, তার সম্পূর্ণ রৈখিক খতিয়ান আমার কাছে নেই । আমার সেই সময়ের ‘আখ্যান’ সুবিমল বসাকের কাছে আছে কারণ ও প্রতিদিনের ঘটনা ডায়রিতে লিখে রাখতো । আমি যদি ওর ডায়রি এখন পড়ি তাহলে জীবনের সমস্ত ঘটনাকে উদ্বেগে ফেলে দেবে । স্মৃতিতে হুবহু সবকিছু আখ্যান হিসাবে থেকে যাওয়া হবে জীবনের ‘মহা বিপর্যয়’। জীবন কখনোই আমাদের জন্য গল্পের মতো আকার নেয় না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করার প্রবণতা কারোর কারোর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, সকলের নয়। মানুষের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে দু’রকমের প্রত্যয়িত পার্থক্য রয়েছে । একদল মনে করে যে তাদের চিন্তায় ‘লেখকত্বের আবেগ’ আছে, মানে তাদের জীবনটা যৎকিঞ্চিত আখ্যান । আরেকদল মনে করেন যে মানুষের এই ধরনের কোনও আবেগের রৈখিকতা নেই, অর্থাৎ তাদের চিন্তাভাবনাগুলো আপনা থেকেই ঘটে।

একজনের আত্মকথন অনেকাংশে অন্তর্নিহিত এবং অচেতন হতে পারে অর্থাৎ তা পুরোপুরি আখ্যানবস্তু নয়। ব্যক্তিমানুষকে একজন ব্যক্তি হিসাবে সম্পূর্ণরূপে বিকাশের জন্য তার জীবনের একটা পূর্ণ এবং স্পষ্ট বর্ণনার অধিকারী হতে হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ । যদিও সবগুলো এখন আর পাওয়া যায় না। উনিশ শতকের আগে বাংলায় লেখা আত্মজীবনী পাওয়া যায় না। প্রাচীন আর মধ্যযুগের গীতিকবিতায় ভণিতার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তুলে ধরার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে, কাহিনীকাব্যে আত্মপরিচয় অনেকটা বিস্তৃত আকারে লেখা হয়েছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও পদ্মাবতী কাব্যে আলাওল তেমন আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তবে আধুনিক ধারার আত্মজীবনী বলতে যা বোঝায়, এগুলি তার মধ্যে পড়ে না। সাহিত্য হিসেবে আত্মজীবনীর যথার্থ প্রকাশ ঘটে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। অমন আত্মজীবনী প্রথম রচনা করেন দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। সেগুলোকে জীবনের উপন্যাস বলা যাবে না । জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জীবনী থেকে বাদ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর বিভিন্ন রচনায় তা লুকোনো রয়েছে। জীবনানন্দ তাঁর গল্পগুলো সাংকেতিক ইশারায় লিখে গে্ছেন নিজের ডায়েরিতে ; গৌতম মিত্র সেই ঘটনাগুলো ডিকোড করে জীবনানন্দের জীবন সম্পর্কে, যৌনজীবন সম্পর্কে, বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন আমাদের ।

আমেরিকান ঔপন্যাসিক জন আপডাইক মনে করতেন তাঁর জীবনে অবিরাম সংবেদন ঘটে, যেন তিনি সবে জীবন শুরু করেছেন। পর্তুগিজ কবি ফার্নান্দো পেসোয়া বলেছেন, ‘প্রতিটি মুহুর্তে আমার মনে হয় যে আমি যা করেছি তা ঠিক করেছি। একটি নতুন পৃথিবীতে অবিরাম জন্ম হয়েছে আমার।’ কেউ কেউ ওনার কথাটা বুঝতে পারবে। অন্যরা বিভ্রান্ত হবে, এবং সম্ভবত সন্দিহান হবে। আসলে একজন মানুষের একাধিক আইডেনটিটি থাকতে পারে । আমি মনে করি আমার একাধিক আইডেনটিটি আছে যা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদিতে উপস্হাপন করেছি ।

একজন লেখক তার বর্ণনামূলক পরিচয় সম্পর্কে ভাল ধারণা না পাওয়া পর্যন্ত জানতে পারে না সে কে।আমরা প্রত্যেকে কেবল একজনই নই, অনেকগুলো। আমাদের প্রতিস্ব বা সেল্ফ একটা নাটকীয় যন্ত্রপাতির সমাবেশ । আমার হাতে কলম বা কমপিউটারের কি-প্যাড রয়েছে । আমি যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে মালপত্র বের করে আনি। দেখি কেউ ভবিষ্যৎবক্তা, কেউ গুণ্ডামি করছে, কেউ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, কেউ মাঝরাতে গান গাইছে, কারোর রান্নার সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ আসছে, একদল কবি খালাসিটোলায় মাতলামো করছে। ডব্লিউ সামরসেট মম তাঁর ‘এ রাইটারস নোটবুকে’ (১৯৪৯) লিখেছেন যে, ‘আমি স্বীকার করি যে আমি বেশ কয়েকটি ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এবং যে ব্যক্তি এই মুহূর্তে শীর্ষে রয়েছে সে অনিবার্যভাবে অন্যকে স্থান দেবে। কিন্তু আসল কোনটা? তাদের সবগুলো না কোনো একজন ? আক্ষরিক অর্থে একজনের জীবনের গল্পের ক্ষেত্রে দুর্বল স্মৃতি এবং একটি নন-ন্যারেটিভ স্বভাব বাধা নয় – আসলে নিজের জীবন সম্পর্কে কিছু লেখাটাই প্রধান ।

*************************

Leave a Reply