You are currently viewing শূন্যপরাণ || লুৎফর রহমান মন্ডল

শূন্যপরাণ || লুৎফর রহমান মন্ডল

শূন্যপরাণ || লুৎফর রহমান মন্ডল

শীতকাল। শীতের চাদর গায়ে ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি ঠান্ডায় কাপছে এখনও। রাতের শীত যেন-তেন হলেও সকালের শীত জড়িয়ে ধরেছে প্রকৃতিকে। এতটুকু বিরাম নেই। সূর্যের মুখটা থালার মত চ্যাপ্টা হয়ে শীতের চাদর থেকে মুখ বের করে হাসছে। এতটুকু পরিমান তেজ নেই। জ্বলজ্বলে ক্রোধান্বিত অবয়ব নেই।
সূর্যের চারদিকে জড়িয়ে থাকা শীতের কাছে মাথা নুয়ে ধরেছে তেজোদীপ্ত সূর্যটা। এতটুকু জড়াজড়ি করছে না। ক্ষীপ্র হয়ে হা-করে গলিয়ে দিচ্ছে না তার সমস্ত সত্বাকে। ভেতরে লুকিয়ে থাকা অগ্নিপিন্ড একেবারে মৃদু,শান্ত, নীরব, মৌন হয়ে ধরা দিয়েছে শীতের প্রকোপের কাছে। শীতের প্রকোপে সূর্যের বলিয়ানকে টেনে ধরলেও মানুষের কাজের গতি এতটুকু কমেনি। বেশ্যাপট্টির আশপাশের জনালয় রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রত্তুষের কাজে।
পট্টি থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে থাকা দোকানিরা দোকানের ঝাপ খুলতে শুরু করেছে। খটাস-মটাস শব্দের প্রতিধ্বনি শীতের গায়ে আছড়ে পড়ে । স্টলের বাসি পরোটা খাওয়ার জন্য কাকের পাল উড়ছে কা-কা করে।
ফেরিপার হওয়া দু’একটা বাস বিরতি দিয়ে থামছে চা-পান খাওয়ার জন্য। দীর্ঘ যাত্রায় বিরতি পেয়ে
যাত্রীরা ছুটছে যে যার কাজে । কেউ বদনা নিয়ে ঝুলে থাকা টয়লেটে ঢুকছে। কেউ দোকানের আড়ালে বসে, দাঁড়িয়ে প্রকৃতির জলডাক সারছে। কেউ হাত মুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে বসে পড়ছে পরোটা-চা খাওয়ার জন্য। সাথে আনা খাবার খাচ্ছে কেউ-কেউ। কেউ বিড়ি ধরিয়ে ফুকাতে ফুকাতে অপরিচিত কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইছে বেশ্যা পট্টিটার কথা। সন্ধান পেয়ে দুর থেকেই আঁকছে কেউ পট্টিকে। এইটা সেই পট্টি যার কথা এতদিন শুনছিলুম। আহ, বাসটা যদি রাত্রি পর্যন্ত থাইকত এক সাটাম মেরে যেতুম। সালা যা আছে কপালে। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না ক্যানে। সবাই কি কামে ব্যস্ত। দূর থেকে উঁকিবুকি করে আগন্তুক চোখ বুলাচ্ছে পট্টিটার দিকে।
কেউ পট্টি মুখ হয়ে শিষ্ণ বের করে ঢুলিয়ে-ঢালিয়ে পানি ছারছে। আর পাখির চোখে লক্ষ্য করছে, কারও লক্ষ্যে পৌঁছাল কি না! বাজারটায় কোলাহল আর তেমনটা নেই। বাসগুলো সব যাত্রীকে পেটে পুরে দৌড় মেরেছে। একেবারে কিছুটা নৈ:শব্দ্য। তবে কাকের কা-কা আর তেল-পরোটার ছ্যাৎ-ছ্যাৎ শব্দ শীতের প্রহরা ভেদ করে চলে যাচ্ছে দূরে। বালিহাঁসের একটা দল এসে পড়েছে খালটাতে। পট্টির পূর্ব পার্শ্বে দক্ষিণে খালটা। খালটাকে আবার ভাগ করে একপাশে বাজারের সাথে লাগোয়া করে পাড় বেঁধে পুকুর করা হয়েছে আর অন্যপাশের শাপলা, শ্যাওলা ভরা খালটি চলে গেছে সাপের মতো লোকালয়ের দিকে। সেই খালের অনতিদূরে দু’পাশ দিয়ে বসতি। মানে মানুষের বসতি। সেখানে গরু ছাগল হাস, মুরগি, কবুতর, বাশঝাড়, কলাগাছ, নিম গাছ, আম গাছ, জামগাছ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে মানুষ থাকে, তাদের ছেলে মেয়ে, নাতি-নাতনি, ছেলের বৌ, মেয়ে জামাই থাকে। তবে সবাইকে দাত খিছিয়ে মানা করে দেয়া । যেন পট্রির কিনারার বাতাসও নাকে না যায় কারও, চোখ হাত তো দূরের কথা। তাই এ ভদ্রলোকালয়ের পাশে বসবাস করা পট্রিটার মানুষগুলোর সম্পর্ক নাই বললেই চলে।


পশ্চিম পাশে বাজারের ধার ঘেঁষে পুরান রেল লাইন। রেলগাড়ি আসে না, তবে লাইন আছে এখনও। স্লিপার নেই, লোহার লাইনও খোয়া গেছে কোথাও-কোথাও। বিছানো পাথর বলতে মাটি ছাড়া কিছু নেই। ঐ লাইন হয়ে ঘাটমুখের যে রাস্তাটা এসেছে তাই ঢুকেছে পট্রিতে। ভদ্রবসতির কেউ একজন বালিহাসেঁর দল থেকে একটা বালিহাঁস ধরে বাড়ির পথে হাটা দেয়- বালিহাঁস, পেলি কনে।
বাজান, খালের ধারের পুকুরটার।
কোনখানের ?
খালের, চর্বি আছে বাজান।
এবার বিজ্ঞ বুড়ো তার বাপের চরিত্রে ফিরে আসে।
চোপ-হাঁস আনার জায়গা পেলি না, খালের! হারামজাদা কোথাকার।
খালের নাতো, পুকুর থাইক্যা আনছি ।
পুকুর, ঐ পট্রির পুকুর!
পট্রির দিকে নাতো এ পাড়ে ছিল, কিনারায়।
ফ্যালাই দিয়া আয়, বাড়িটা নাপাক করলি হারামজাদা। মাগীরা শরীর ধোয় ঐ পুকুরে।
কাপড় কাচে, মাথা ধোয়, আর ওখান থাইক্যা আনছস বালিহাঁস।

পট্রিটা যেন গলার ফাঁস হয়ে বেধেঁছে এলাকার। কিন্তু কারও কিছু করার নেই। তাই নিজে কায়দা করে
গা বাঁচিয়ে চলে একেকজন । কিন্তু দেখা যায় তৃপ্তির বেলায় সবাই এক। রাতের আলোতে পুকুর-খাল দ্বি-মুখী থাকে না। মিশে যায় এক বিছানায় । কিন্তু সমস্যা দিনেই। মুখ দেখলে নাকি একেকজনের পাপ শরীর বেয়ে মাথায় উঠে। কিন্তু অন্ধকার হলেই মেশে এক নদীতে। সাঁতার কেটে দিনের পাপ ভুলে যায় ভদ্রবাসীরা।
শীতের আচরণ কমতে শুরু করেছে। আশপাশ থেকে দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সহজেই। বাজার থেকে উচ্চশব্দের হিন্দি গান ভেসে আসছে হাওয়ার ভেলায়-মে বেবি ডল ফ্রম চায়না। কাটা লাগা-হায় লাগা।
ঢিল খেয়ে বালিহাঁসগুলো ভয়ে উড়াল দিয়ে গেছে আর ফেরেনি। পট্টি বাসিরাও উঠতে শুরু করেছে একে-একে। সূর্যের আলো শীত কাটিয়ে গায়ে এসে পড়ছে। পট্টির পৌঢ়রা উঠে সুবিধা মতো জায়গায় বসে বিড়ি টানছে, যেখানে শরীরে একটু সূর্যের আলো লাগে সেখানে। পৌঢ় বলতে এখানে সবাই বয়স্ক মহিলা। মলিন কাপড়ে একেক জনের চেহারা একেক রকমের । বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে তাদের শরীরের চামড়া। কারও মুখে এতটুকু তৃপ্তির ঝিলিক নেই। শীত থেকে উঁকি মারা সূর্যের মতো পরিছন্নতাও নেই। একেবারে ডাস্টবিনে রাখা ময়লার মতো । পিষে-পিষে থেতলে যাওয়া শরীরে ঝিলিক আসবে কোথা থেকে। পা মেলে বসে একেকজন-একেক জনের শরীর বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, কী ছিলি বইন আর কি হলি !


পূর্বের দিকের খালটার উপরেই টংপাতা। বাশের খুঁটির উপর সুপারি গাছের ফাল্টা দিয়ে টং পাতা। সাথে ছাউনি ঘর, সেখানে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত পাহারাদার থাকে। পট্টিতে ঢোকা প্রতিজনরের কাছ থেকে বিশ টাকা করে নিয়ে টিকেট দেয়া হয়। আর তাদের ঘুম আর বিশ্রাম নেয়ার জন্য টং আর এই ঘুপরি । এগুলো পাহারাদারদের জন্য করা হলেও তাদের কেউই সেখানে থাকেনা নিয়মিত, জিরায় না। এমনকি বসেও না। টংগে থাকতে-থাকতে ক্লান্তি লাগলে কারও ঘরে ঢুকে আরাম করে নেয় কিছুক্ষণ, কারণ সেখানে ঢুকলে বিনোদনের সাথে বিশ্রামও হয়। ফাও কাজ করা বাদ দিয়ে কে খামাখা ঘুপরিতে শুয়ে সময় নষ্ট করবে । সূর্যের আলোর পরশ পেতে খেলাচ্ছলে এক কিশোরী বসার জন্য বানানো বাশের টংয়ে এসে বসেছে। চিকন মাজা টংগে লাগিয়ে দু’পা দুলিয়ে-দুলিয়ে সূর্যের মৌন আলো অনুভব করছিলো সে।
বালিহাঁস উড়ে গেলে একটা দুটো সাদা বলাকা জলকেলিতে ব্যস্ত। শ্যাওলা ভেদ করে নাচিয়ে-নাচিয়ে
ঢুবছিল আর ভাসছিলো বক দুটো । খেলার সমস্ত সুখটাই যেন তৃপ্তিতে অনুভব করছিলো সে। বিন্দুমাত্র হেলা করেও চোখ ফেরায়নি বক দুটো উড়ে যাওয়া পর্যন্ত। কনকনে ঠান্ডার প্রকোপ এখন
তেমনটা নেই। তারপরও যা আছে লেপ কম্বল গায়ে দিয়ে থাকার মতো। কিন্তু কিশোরীর শরীর বলতে গেলে উদোম। কোমর থেকে হাটুর নীচ পর্যন্ত স্কার্ফ । আর আটসাট জামা পড়া, বুকের উপর দিয়ে পাতলা উড়না ফেলানো। লাউয়ের কচি ডাটার মতো লিকলিকে গৌর পা দুটি স্পষ্ট । নাভীর নিচ থেকে পেঠের পুরো অংশ মেদহীনভাবে জড়িয়ে আছে। আর কটিআবৃত আঁটসাট বুকে তাজা মাংসপিন্ড উবু হয়নি ততটা। শরীরের কোমল মসৃন ত্বকাবরণ বলে দিচ্ছে শরীরের ক্ষুধা পেয়ে বসেনি কিশোরীকে। যৌবনের জোয়ার ভাটা না দেখা দিলেও, ভরাট নদীতে জল আছে বিস্তর । কুল-কিনারা ছাপিয়ে প্লাবন সৃষ্টির জল নিয়ে কিশোরীর দেহ প্রস্ফুটিত । জলের খেলা স্থবির হলেও বন্ধ নয় । এ খেলা যে বারিধারার। যখন প্রমত্তা হয়ে উঠবে, তরঙ্গ ঢেউ খেলবে পরশ-পরশে, দোল দেয়া মিহি বাতাসে। তখন উছলে উঠবে কিনারা, দু’কুল ভাসিয়ে বন্যা বয়ে যাবে যৌবনের নদীর পাড়ে। সে কুলে কেউ তরী নিয়ে পাল তুলে দিবে অসঙ্কোচে। লগি দ্রুত চালিয়ে দিতে চাইবে সফেন তরঙ্গ খেলার মুহুর্মহু দোলানীতে। কতটুকু পারবে মাঝি তার পাল সহ নৌকা ওপারে ভেড়াতে।
এ নদী যে কিনারাহীন । এর অতল গহ্ধসঢ়;বর থেকে ফুলে উঠা জোয়ারে সৃষ্ট ঈষৎ তরঙ্গ যে মাঝিকে নিষ্পেষিত করবে মুহুর্তেই। তরী, পাল, লগি সহ ঢুবে যাবে মাঝি মাঝ নদীতে। কিশোরীর পা দোল খায়, স্বচ্ছ ওড়নায় দূর্বল পাহারা ঠেলে অনতিদূরের হাটা পথযাত্রীর চোখ তেড়ে আসে। চোরের মতো চোখ এদিক-ওদিক করে ইশারা দেয়। ঠোঁঠ কামরায়-হাত ঘষে। কেউবা মোতার ভান করে বসে তাকিয়ে থাকে। বেচারার মতো নয়, প্রতিবন্ধির মতো নয়, চাওয়ার মতো করে, কাছে চাওয়ার প্রত্যাশায়। কিশোরীর পা দুলানী পৌঢ় রা পছন্দ করে না, এখানে মেয়ে হলে তার মেয়েলিপনা থাকবে শুধু সন্ধার পর । অন্যসময়ে ওসব ভাব দেখালে তাদের রাগ হয় । ক্ষোভ বাড়ে, বিরক্ত হয়।
ঐ নাচস ক্যান, তেল বাড়ছে, এদিক আয়।
কিশোরী মৌন থাকে।
ওই মাগী শোনস না, কানে কি লেওড়া দিসছ।
কিশোরীর পা দুলতে থাকে।
ওহ ভাব ধরছে, রাত্রির কাম বুঝি কম হয়।
কিশোরী যেন কিছুই শোনে না, দৃষ্টি তার অদূর দিয়ে উড়ে যাওয়া সারস আর পানকৌড়ির দিকে।

একজন রাগে উঠে গিয়ে চুলের মুষ্টি ধরে টেনে আনে । থথমত হয়ে যায় কিশোরীর বাল্য ভাবখানা। ভোর হইছে শরীর না ধূইয়া সূর্যের পানে চাইছস কেন মাগী। ঢং ধরছ, পা দোলাস, সোনার কামড়ানি কমে নাই রাইতে, নাগর যাইব নাকি রাস্তা দিয়া?


ওড়না বুক থেকে পড়ে গেছে কিশোরীর। সূর্যের হালকা পরশে কিছুটা আরামবোধ করছিল সে। নিতান্ত প্রকৃতি আর নিজের কথা ভেবে সে বুদ হয়ে গিয়েছিল। পৌঢ়দের গলা শুনে সর্দারনী ঘর থেকে বের হয়। সর্দারনীকে দেখে পৌঢ়রা শান্ত হয় কিছুটা। দু’জন আপন মনে তামাক টানতে থাকে। মোটা গলায় সর্দারনী জিজ্ঞেস করে ,
কল্পনা কি করস ঐখানে? ঘরে আয় কাজ আছে । কল্পনা ডাক পেয়ে চলে যায়। চুল ধরে আনা পৌঢ়া কল্পনার হাটা পথে চেয়ে ফুলতে থাকে আর তামাক টেনে বাতাসে ধূয়া ছড়ায়। পট্টিতে সকালে কেউ তৃপ্তিতে ঘুমাতে পারে না । এমনিতে সারারাত গান-বাজনা আর খদ্দেরের গোলমালে কাটাতে হয় আর সকাল হতে না হতেই বাজারের গান তৃপ্তির ঘুমটুকু কেড়ে নেয় নিষ্ঠুরভাবে। এমনিতে পট্টিতে গান কম চলেনা। গান, নাচ, মদ নিয়ে জমে রাতের পট্টি। দুর-দুরান্ত থেকে আসা খদ্দেররা ঘর ঠিক
করে। দোকানের মতো রয়েছে বেশ কয়েকটি ঘর। থাকার ঘরের সাথে লাগোয়া সেই দোকানে রাত হলে বসে কেনা বেচার আসর । দোকানের কর্তার সাথে খদ্দেররা ঠিক করে হিসাব নিকাশ। হিসাব নিকাশ ঠিক হয়ে গেলে দোকানের ঝাপ বন্ধ করে শুরু হয় জঙ্গলা আসর। হিন্দী গানের জোরালো শব্দ আর শান্তা, কল্পনা, স্বপ্নাদের চটকা কোমরের তিড়িং-বিড়িং নৃত্য। জমে উঠে এভাবে প্রতি রাতের আসর। দোকানিদের আয় এখান থেকে। মদ, গাজা, হিরোইন, ইয়াবা আরও নানান উত্তেজক ঔষধ বিক্রি করে আয় করে তারা। একজনের পেঠের ক্ষুধা আর একজনের দেহের-কী এক বৈপরীত সাদৃশ্য।
পশ্চিমে রেল লাইন থেকে আসা রাস্তাটা সোজা হয়ে ঢুকে গেছে পট্টির ভেতর। পট্রির দরজায় পাহারাদার বসে থাকে। আশরাফ পোদ্দার, জসীম, জব্বার শেখ, সাইফুল এখানকার নিয়মিত পাহারাদার । তারা কখনও পশ্চিমের আবার কখনো পূর্বের গেটে পাহারা দেয়। বড় কর্তারা মাঝে-মাঝে এসে মাল খেয়ে মাল নিয়ে যায়। যেদিন আসে সেদিন সর্দারনীকে ফোন করে দেয় । রাতে কর্তা আর এলাকার দু’একটা গুন্ডা খদ্দের হয় পট্রির । সারারাত মদ, শরীর খেয়ে ভোর হবার আগেই চম্পট দেয়। এরা কাম করে মাগনা। টাকাতো দেয়ই না, বরং রাত্রির ব্যবসার প্রায় অর্ধেক টাকা দিতে হয় তাদের পকেটে গুজে। এরা এমনিতে আসে না, নতুন কোন কল্পনা আসলে এদের আগে খবর দিতে হয়। না হলে শিশু নির্যাতন- রেফ কেস-অপহরণ কতকিছু তো আছেই।

কিশোরী কল্পনাকে এক মহিলা সাভার থেকে এনে এখানে দিয়ে গেছে। যাবার সময় সর্দারনী মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে তাকে। কিশোরী আসার খবর রীতিমতো পৌঁছে গেছে উপরে। তাই ফোন করে
সর্দারনীকে বলে দিয়েছে, রাতে সব ঠিকঠাক করতে। সর্দারনী রীতিমত ব্যস্ত কিশেরীর মন জুগিয়ে চলার জন্য। তার অনেক অভিজ্ঞতা এ কাজে । প্রায় বিশ বছর থেকে সর্দারনী থাকে এ পাড়ায়। চোখ বন্ধ করলে শত শত স্মৃতি তার মাথায় জেগে উঠে। বয়স যখন তার তের কী চৌদ্দ তখন প্রায় অপরিচিত এক লোকের সাথে পরিবার তার বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের কয়েকমাসের মাথায় সেই বরই তাকে শহরে কাজ করার নাম করে এখানে বিক্রি করে দেয়। প্রথম দিকে তার ঘেন্না হতো প্রচুর। রাজি হতে চায়নি। কত কান্নাকাটি করেছে। মা-বাপ, পাড়া-পড়শীর, আল্লাহ-খোদার দোহাই দিয়ে বেঁচে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কোন উপায় হয়নি। উপায়ান্তর না পেয়ে সে নিজেকে সপেঁ দিয়েছিল তীব্র কষ্টের অমানবিক এ পেশায়। নিজেকে তখন এতিম, নি:স্ব, একাকী মনে হয়েছিল তার। অবশেষে হার মানতে হয়েছিল তাকে। শক্ত পেশীর লৌহ খাচা আর খাচার ভেতরে থাকা অতি জঘন্য জানোয়ারটির চোঁঠে নিজেকে অজ্ঞান হয়েও হার মানতে হয়েছিল। আজ বিশবছর পর সেই এখানকার সর্দারনী। তার হাত দিয়ে কত নিষ্পাপ মুখকে সাজিয়েছে সে। কত পবিত্র ঠোঁটে মাখিয়ে দিয়েছে যন্ত্রনার রং- লিপিস্টিক। সর্দারনী নানাভাবে কল্পনাকে এ পথে নামানোর চেষ্টা করে। কিশোরী কল্পনা পাত্তা দেয় না।
সর্দারনীর দগ্ধচোখে কঠাক্ষভাবে কপাল ভাজ করে তাকায় তার দিকে। সর্দারনীর দৃষ্টি এমনিতে আর আট-দশ জনের মত নয় । তার দৃষ্টি কড়া- আগুনের ফুলকি বের হয় তার চোখ দিয়ে । সেই ফুলকির ভয়ে গা ছমছম করে যে কারও । কিন্তু কল্পনার বাল্য চোখ রক্তচক্ষু এতটুকু গ্রাহ্য করে না। কিশোরীর সরল দুটি চোখ সর্দারনীর গলায় রাগ মেশাতে দেয় না। সর্দারনীর মায়া, মমত্ববোধ, নারীত্ব এসব অত্যন্ত বর্জিত, লুপ্ত। নারীর মন, চিন্তা, চেতনা, আচার-ব্যবহারে যে একধরনের নারীত্ব থাকে যার বিন্দুমাত্র ছায়া নেই সর্দারনীর চলাফেরায়। কিন্তু সে আজ অসহায় বোধ করে –অজানা কারনে কিশোরীর প্রতি কঠাক্ষ দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । নিষ্প্রভ হয়ে চোখ নিমীলিত করে চিন্তায় বসে পড়ে বিছানায়।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। জোরে গান বাজতে শুরু করে- আমি ষোল পেরিয়ে গেছি ও বাবুগো, ঐ ছেমরি তোর কপাল ভালো বা তেরি আক্কা কা ই কাজল ইত্যাদি গান। মেয়েরা সাজু-গুজু আরম্ভ করে। ঘরে বসে একেকজন সাজিয়ে দেয় একেকজনকে। নানান সাজে সাজসজ্জা করে মেয়েরা। তাদের পরনে থাকে হাফপ্যান্ট , স্কার্ফ, টাইট জিন্স। গায়ে থাকে ব্লাউজ, টি- শার্ট বা পেছানো ওড়না। শরীর নানা সাজে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গলিতে। মুখে মিশিয়ে দেয়া পাউডার সাদা বাতির আলোতে আরও সাদা হয়। কালো মুখের উপর ঘসে দেয়া সাদা পাউডার স্পষ্টভাবে আলতো হয়ে থাকে। ভাঙা-ভাঙা শরীরে জিন্স, হাফপ্যান্ট বেমানান লাগে। শ্যাম্পু করা তেল না দেয়া ঝরঝরে চুল উস্কু-খুস্কু করে মেলিয়ে দেয় দু’কানের লতির উপর দিয়ে । চোখে লাগানো ভ্রু-পেন চোখের মায়া আটকে রাখে কোঠরের মধ্যে। ঠোঁঠে লেপ্টে দেয়া লালরঙ কতটুকু দৃষ্টিনন্দন তা খদ্দেররাই জানে। সন্ধ্যা পেরুলেই সবাই ব্যস্ত হয়ে যায় নিজেকে মেলে ধরতে। নানা ভঙ্গিতে হেলিয়ে-দুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। বাজারে বিক্রি করতে আনা কাচা তরি-তরকারীর মতো।
সর্দারনীর চোখে কখনো পানি আসেনি। এ রকম কাজেই অভ্যস্ত সে। কিন্তু আজ তার চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। চাদের রুপালি আলো ঠিকরে পড়ছে খালের পানিতে। একাকী টংয়ে শরীর এলিয়ে দেয় সর্দারনী। সে কান দুটি হাত দিয়ে চেপে বন্ধ করতে চায়-চায় পৃথিবীর কোন শব্দ তার কানে না আসুক। হয়তো একটু পরে তার ঘর থেকে ঐ কিশোরী মেয়ের চিৎকার, কান্না ভরা আকুতিতে ভারী হবে আকাশ।

====================

Leave a Reply