পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা || শিল্পী নাজনীন
৫
সন্ধ্যার পর দোকানে ভীষণ ভীড় জমে যায় অনীলের। সুনেত্রা আর সে, দুজন মিলে কাস্টমার সামলেও কুল করতে পারে না বলতে গেলে। পাশেই বড়সর এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। অসংখ্য নারী শ্রমিক কাজ করে সেখানে। সন্ধ্যায় তাদের ছুটি হয়। বাড়ি ফিরতি নারীরা এসে ভীড় করে অনীলের দোকানে। কারো মাথাব্যথা, কারো সর্দি-জ্বর, কারো বুকে ব্যথা, কারো বুক ধরফর, জ্বালাপোড়া আরো অসংখ্যরকম সমস্যা। ওষুধ বেচতে বেচতে অনীল নিজেই যেন বড় ডাক্তার এখন। লক্ষ্মণ শুনেই দিব্যি চোখ বুজে ওষুধ দিয়ে দেয় পটাপট। কোনো প্রেসক্রিপশনেই বালাই নেই। কাস্টমাররাও পরম বিশ্বাসে আসে তার দোকানে, নিজেদের সমস্যার কথা বলে ওষুধ চায়। অনীলের দেখাদেখি সুনেত্রাও বেশ বুঝে ফেলেছে ব্যবসাটা। সে-ও বেশ সামলাতে শিখে গেছে কাস্টমারদের। স্বল্প আয়ের এসব মানুষগুলোর সামর্থ্য নেই চড়া ভিজিট দিয়ে পাস করা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার। ছোটখাট সমস্যায় তারা তাই অনীলের কাছে এসে দাওয়াই খোঁজে। তাতে অনীলেরও উপার্জন হয় দুপয়সা, কাস্টমাররাও উপকৃত হয়। বাসাবাড়িতে কাজ করা কাজের বুয়া, রিক্সাঅলা, ভ্যানঅলা ইত্যাদি নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভরসা করে আসে তার কাছে। সে-ও চেষ্টা করে সাধ্যমত। কোনো কেস জটিল বুঝলে সে পরামর্শ দেয় ডাক্তারের কাছে যেতে। অনেক সময় পরিচিত ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে যতদূর সম্ভব সাহায্য করারও চেষ্টা করে। ফলে তাকে ভরসা করে অনেকেই, তার কাস্টমারের অভাব হয় না কখনো, যেখানে পাশের ফার্মেসিটা মাছি মারে অনেক সময়। গত পনেরোদিন বন্ধ রেখেছিল অনীল তার ফার্মেসি। তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিল সে সুনেত্রা। গয়া, কাশী সব পূণ্যধাম দর্শন শেষে সবে ফিরেছে গতকাল। অনীলের মাথার পেছনে লম্বা টিকি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, সুনেত্রার কপালে বড় করে আঁকা চন্দন তিলক, গলায় প্যাঁচানো রুদ্রাক্ষের মালায় তাকে দেখতে অনেকটা সন্ন্যাসীনী লাগছে। পনেরোদিন পর আজ দোকান খুলতেই উপচে পড়া ভীড় দোকোনে, কাস্টমারদের নানান অনুযোগ-অভিযোগ। সব সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় সে আর সুনেত্রা।
হাজেরা খালা বাসাবাড়িতে কাজ করে সারাদিন, বর কোথায় বিয়ে করে ভেগে গেছিল সেই অল্প বয়সেই, বাসাবাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়ে মানুষ করেছিল খালা খেয়ে না খেয়ে, অতি কষ্টে। তারা সব চোখ ফুটতেই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে মাকে ফেলে। মাযের খোঁজ নেয়ার আর সময় নেই তাদের করো। নিরুপায় হাজেরা খালা এখনো অন্যের বাসায় কাজ করেই পেট চালায়। হাড় জিরজিরে শরীর, শুকনো, বয়সের অকাল বলিরেখায় ভরে ওঠা মুখে রাজ্যের শঙ্কা। কালো চেহারাটা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে আরো। ভীড়ের একপাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল হাজেরা খালা। সুযোগ খুঁজছিল কখন একা পাবে অনীল বা সুনেত্রাকে। ভীড়ের মধ্যেও তাকে খেয়াল করল অনীল। কাজ করতে করতেই গলা উঁচিয়ে বলল, কী গো খালা? কিছু বলবা?
শইলডা খারাপ বাজান। তোমার দোকানে যে ভীড়! কীবা কতা কমু?
তুমি সামনে আসো খালা, বলো কী সমস্যা।
উঁচু গলায় কথাগুলো বলে সামনের লোকজনকে খালাকে এগোনোর পথ করে দিতে বলল অনীল। ভীড় ঠেলে সামনে এসে ভেতরে ঢুকল অতঃপর হাজেরা। কোণায় পেতে রাখা বেঞ্চটায় বসল ঠেলেঠুলে। ডেস্কের ওপর ঝুঁকে তার দিকে মনোযোগ দিল অনীল। কী হইছে খালা? বলো এবার।
শইলডা বালা না বাপ। বুকে ব্যতা, হাত এডি নাড়াইতে পারি না, ভারী লাগে। শইলে বল পাই না, খাইতে পারি না কিছু, খালি গ্যাস অয়, বমি বমি লাগে। শইলে আর যুত পাই না কোনো। আমি বাজান গরিব মানুষ, গতর খাটায়া চলি। এমনে অইলে কেমনে কাম করমু বাসাবাড়িত কও? খামু কী? তোমার দুকানও কতদিন অইল খালি বন্দ পাই, ফেরত যাই আইয়া। কই গেছিলা তুমি বাজান? আমারে বালা দেইখা ওষুদ দেও তুমি, শইলডা য্যান তাড়াতাড়ি সুস্ত অয় গো বাজান।
একটানা কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে হাজেরা।
মন দিয়ে তার কথা শুনে নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ কিছু ওষুধ দিয়ে দেয় অনীল। মুখে খুশি ছড়ায় হাজেরার, তার দৃঢ় বিশ্বাস অনীল ডাক্তারের ওষুধ খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে সে, আবার শরীরে শক্তি ফিরবে তার।
কয় টাকা দেব বাজান?
একশ টাকা দেন খালা।
খুশি মনে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় হাজেরা। টাকাটা ড্রয়ারে রেখে এবার অন্য কাস্টমারদের দিকে মনোযোগ দেয় অনীল। সুনেত্রা তখন অন্য এক কাস্টমারের জন্য নেবুলাইজার মেশিন রেডি করছে। কোনো দিকে তাকানোর ফুরসত নাই আজ। এই কারো প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে ওষুধ দিতে হয় তো এই আবার অন্যজনের রোগের হিস্টরি শুনে ওষুধ ভাবতে হয়। মূলত ওষুধ বিক্রিই অনীলের পেশা হলেও লক্ষ্মণ মিলিয়ে সে যে ওষুধ দেয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব খেয়ে উপকৃত হয় লোকজন, ফলে তারা প্রবল বিশ্বাস নিয়ে আবার আসে অনীলের কাছে। আর অনীল-সুনেত্রা দুজনই খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলে কাস্টমারদের সঙ্গে, মুহূর্তেই মানুষের সঙ্গে খাতির জমাতে তাদের দুজনের কারোরই জুড়ি নাই এ তল্লাটে। যে কারণে তাদের আয়-রোজগার এখানকার অন্য সব ফার্মেসির তুলনায় বেশ ভালো।
কিছুক্ষণ যেতেই সামনের ভীড় অনেকটা পাতলা হয়ে আসে। ফ্যানের নিচে বসে একটু জিরোতে চায় অনীল। যে দুচারজন কাস্টমার আছে এখন, সুনেত্রা একাই তাদের সামাল দিতে পারবে। চেয়ারে বসে সবে বড় করে স্বস্তির একটা শ্বাস ছেড়েছে অনীল, অমনি ডাকটা টং করে কানে বাজল।
দাদা!
শব্দ লক্ষ করে তাকাতেই হাসি গড়াল অনীলের ঠোঁটে।
আরে ভাবি তুমি? তুমি না গেলাগা সব ছাইড়াছুইড়া?
আইসা পড়ছি দাদা। ডিভোছ হই গেছেগা আমগো।
কও কী!
বিস্ময়ে প্রায় ভিমরি খাওয়ার যোগাড় হয় অনীলের্ বছরখানের আগেই আগের পক্ষের এক ছেলেসহ এই নারীকে বিয়ে করেছিল তারই পরিচিত এত অটোচালক। সে লোকটার বউ চার বছরের মেয়েকে রেখে ভেগে গেছিল অন্য কারো হাত ধরে। ফলে এদের বিয়েতে বেশ খুশিই হয়েছিল অনীল। দুজনেরই একটা জব্বর হিল্লে হল, মনে মনে এমনটাই ভেবে নিয়েছিল অনীল। কিন্তু এখন এই ডিভোর্সের খবরে সে তব্দা খেয়ে গেল প্রায়।
কী সমস্যা হইল তোমাগো? এই না বিয়া করলা তোমরা নিজেরা নিজেরা? বছর না গড়াইতেই ডিভোর্স হইল ক্যান তোমাগো?
আর কইয়ো না দাদা। হ্যায় যে খাচ্চরের খাচ্চর এডি তো আগে বুঝি নাই। মিষ্টি মিষ্টি কতা কইছে হ্যায়, আমিও ভুইলা গেছিগা। কামকাইজ ছাইড়া আমি তো হের লগে লগে। খাচ্চইরা ব্যাডা দ্যাশে যাইয়া করছে কী জানেননি? দ্যাশে যাওয়ার চার মাসের মাথায় হ্যায় আরেক বেডিরে বিয়া কইরা ঘরে আনছে জানি কোত্থেইকা।
কও কী ভাবি!
হাচাই কইগো দাদা। পরথম বেডিরে তাড়ানির চিষ্টা করছি, পরে দেহি কাম অয় না। পরে কই যে তাইলে তুইই থাকরে বেডি, আমি যাইগা। শেষে ডিবোর্স দিয়া এই মাসে আবার শহরে আইসা পড়ছি দাদা। মাইনষের বাসায় কাম কইরা খামু তাও বেডার লুইচ্চামি মানতাম না। কী কন দাদা, কতা কি ভুল কইছি?
না ভাবি, ঠিকই কইছ। বেডায় দেহি বিরাট বদ। তয় আমার কাছে ক্যান আইলা এহন?
বিপদে পইড়া আইছি দাদা। ছেড়িডারে একটু দেইখা কিছু ওষুদ দেন হেরে। হের আর দুইদিন দইরা জ্বর।
এতক্ষণে মহিলার সঙ্গে থাকা শিশুটির দিকে চোখ যায় অনীলের। আবার ভিমরি খাওয়ার দশা হয় তার। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে সে বলে, তোমার কথা তো কিছুই বুঝি না ভাবি। হেই বেডার লগে ডিভোর্স হইছে কইলা, তয় তার মাইয়া তোমার লগে ক্যা?
মহিলা একচোট হাসে। তারপর উদাস গলায় বলে, কী করুম দাদা কন। মায়ায় পইড়া গেছি ছেড়িডার। ছেড়িও আমারে ছাড়তে চায় না, আমার লগে লগে হ্যায় গোপনে আইসা পড়ছে, হের বাপে জানলে তো দিত না, হ্যায় তো জানেও না কিছু।
কও কী ভাবি! পুলিশে খবর দিলে কিন্তু বিপদে পড়বা তুমি। চুরি নাইলে অপহরণের কেস দিয়া দিতে পারে কিন্তু!
দূরু দাদা! হেই লুইচ্চা বেডার দইড় জানা আছে আমার! হে এহুন নতুন বউ লইয়া রংঢং-এ ব্যস্ত। মাইয়ার কতা ভাবনের তার টাইম নাই। আর মামলা দিলে দিব। অইসব নিয়া আমি ডরাই না। মাইয়া আমারে ছাইড়া যাইব না পুলিশ এইডা বুঝত না? হেরা কি কানা নি? আপনে ছেড়িরে দেইখা ওষুধ দেন আগে। মাইয়াডা আমার দুইদিন যাবৎ জ্বরে কষ্ট পাইতাছে বহুৎ।
অগত্যা ওষুধ দেয় অনীল। এই দোকানে বসে কতরকম ঘটনা যে দেখতে হয় তাকে, স্বাক্ষী হতে হয় কত আজব সব কাহিনির, সেসবের কোনো ইয়ত্তা নাই। ওষুধ নিয়ে মহিলা বিদায় হয়। অতঃপর বেশ নীরব হয়ে যায় দোকানটা। অনীল ফোনে চোখ রাখে। সুনেত্রা বসে হরি নাম জপতে থাকে একমনে। মনে মনে ছেলে মিঠুনের কথা ভাবে অনীল। এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠেছে মিঠুন, জগন্নাথে পড়ছে। প্রতিদিন এতক্ষণে বাসায় ফেরে মিঠুন, ফেরার পথে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে বাসায় যায় সে। আজ এখনো ফিরল না মিঠুন। গত পনেরোদিন অনীল আর সুনেত্রা বাসায় না থাকায় তার রুটিনে কোনো রদবদল ঘটেছে সম্ভবত, নইলে এতটা দেরি হওয়ার তার কথা নয়। হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ যায় অনীলের। দশটা ছুঁইছুঁই! এত দেরি করে না মিঠুন সচরাচর। ফোন দিয়ে দেখতে হবে একবার, পথের দিকে তাকিয়ে একথা ভাবতে ভাবতেই দূরে লম্বা দুটো ছায়া এগিয়ে আসতে দেখে অনীল। দুজন মানুষের অবয়ব এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রমশ। দূর থেকে অতটা চেনা না গেলেও একজনকে মিঠুনের মত মনে হয় অনীলের। হাত নেড়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তারা। কিছু একটা নিয়ে আলাপ চলছে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে পরস্পর। অবয়ব দুটো আরো নিকটবর্তী হতেই স্পষ্ট চেনা যায় এবার। মিঠুন। সঙ্গে তার বন্ধু বারিষ। ঘামে চকচক করছে তাদের মুখ, চুল উস্কোখুস্কো। মুখে কী একটা উত্তেজনা খেলা করছে দুজনেরই। কি নিয়ে আলাপ করছে ওরা? কেন এত উত্তেজিত? মনে মনে নিজেকেই অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে অনীল। বোকার মত তাকিয়ে থাকে মিঠুন আর বারিষের মুখের দিকে।
******************************
