You are currently viewing পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা || শিল্পী নাজনীন

পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা || শিল্পী নাজনীন

পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা || শিল্পী নাজনীন


অটোতে উঠে বসে অগত্যা শফিক। বাজারের ব্যাগ পায়ের কাছে রেখে শওকতের দিকে নজর দেয় ভালো করে। আগের সেই শুঁটকো মার্কা চেহারায় জেল্লা ফিরেছে ভারি। চকচক করছে ত্বক। গা গতরে উপচে পড়ছে বাড়তি চর্বি। দেখেই বোঝা যায় বেশ আছে শওকত। বিজিবিতে চাকরি করে শওকত, পোস্টিং যশোরের বেনাপোলে। দুহাতে কামাচ্ছে নিশ্চয়ই। অথচ স্কুলে বরাবর পেছনের বেঞ্চে বসত শওকত, এর-তার খাতার দিকে তাকিয়ে থাকত পরীক্ষার সময়। পড়া না পারায় করিম স্যারের নির্দেশে কতবার যে তার কান মলে দিয়েছে তখন শফিক! স্যারদের বেতের বাড়ি আর তীরস্কার-তাচ্ছিল্য ছিল শওকতের নিত্যদিনের সঙ্গী তখন। অথচ সেই শওকতই কি না করিম স্যারের জামাই এখন! করিম স্যার না কি বহু দেন-দরবার করে তবে শওকতের সঙ্গে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন! স্কুলের বন্ধুদের মুখেই এসব শুনেছে শফিক। শুনে হেসেছে আপনমনে। জীবনে টাকাই সব, বুঝেছে অবশেষে। সব শালা বিক্রি হয় টাকার কাছে। সেখানে দুপয়সা মাস-মাইনের করিম স্যারদের আর দোষ কী! পৃথিবী টাকার বশ, চাকচিক্যপ্রিয়। যার হাতে টাকা থাকে তার কাছেই সে নতজানু হয়, বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
টুকটাক কথা হয়, ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়, এতেই গন্তব্য এসে পড়ে, ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ে শফিক।
ভালো থাকিস দোস্ত, ফোন দিস। গলা বাড়িয়ে বলে শওকত। কিছুতেই শফিককে অটোর ভাড়াটা দিতে দেয় না সে।
ওকে দোস্ত, কথা হবে। -বলে বাড়ির পথে হাঁটে শফিক। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বড্ড মন খারাপ হয় তার আজকাল। বন্ধুরা ভালো আছে দেখলে ভালো লাগে ঠিক, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন খারাপের একটা চোরাস্রোতও ভাসিয়ে নেয় তাকে। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিল সে, ছিল ভদ্র, মুখচোরা। রেজাল্টও মন্দ ছিল না সবমিলিয়ে। তবু কেন যেন একটা সরকারি চাকরি সে জোগাড় করতে পারল না কোনোভাবেই। তার টাকার জোড় ছিল না, তদ্বির করারও লোক ছিল না, ফলে বেসরকারি চাকরিতেই থিতু হয়েছিল শেষে। দিনও চলছিল ভালোই। কিন্তু হঠাৎ করেই হানা দিল করোনা মহামারি। বন্ধ হয়ে গেল তাদের কোম্পানিটি। লকডাউনের ধাক্কায় একের পর এক কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন, প্রায় সব অফিসেই লোকবল ছাঁটাই চলছিল সমানে। ফলে নতুন করে কোনো চাকরিতে ঢোকার আর সুযোগ ছিল না তখন। অবশেষে সব ছেড়ে গ্রামে ফিরেছিল শফিক। এখন তাই পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন অস্বস্তি হয়, লজ্জা পায় শফিক। বন্ধুদের সাফল্য তার নিজের ব্যর্থতাকে প্রকট করে তোলে আরো। সে তাই পালিয়ে বেড়ায়। নিজের থেকে, বন্ধুদের থেকেও। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, কেটে গেছে তাল, লয়, বোঝে শফিক। নিজেকে সে তাই আড়াল করে, নিবৃত করে সব কোলাহল থেকে।
বাজারের ব্যাগটা বিজলির হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির পেছনের আমবাগানে বানিয়ে রাখা চরাটের ওপর গা ছড়িয়ে বসে শফিক। আমগাছের ছায়ায় ঢাকা থাকে এদিকটা। ভীষণ গরমেও জায়গাটা তুলনামূলকভাবে শীতল থাকে সবসময়। আগে গ্রামের দুচারজন মুরুব্বি এসে এখানে বসতেন, শফিকের বাবা হযরত আলীর সঙ্গে বসে গল্পগুজব করতেন। এখন আর তারা কেউ এমুখো হন না। হযরত আলী মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে গাঁয়ের মুরুব্বিরা শওকতের সঙ্গে কেমন দূরত্ব রেখে চলেন, আড়ালে তাকে নিয়ে কানাঘুষোও চলে, জানে শওকত। নীরবেই সব হজম করে সে। এটুকু তার প্রাপ্য, সে জানে। যে সন্তান নিজের বাবাকে বউয়ের রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে পারে না, পারে না বউয়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, তাকে তো এটুকু মেনে নিতেই হয়!
জায়গাটা বড় নীরব এসময়। শফিকের সমবয়সী দুয়েকজন হঠাৎ শফিককে এখানে দেখতে পেলে এসে বসে পাশে। একটু আড্ডা জমে তখন। সে-ও কদাচিৎ। বিজলি পছন্দ করে না বলে বেশিরভাগ সময়ই সেসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা থাকে শফিকের। আজ দুপুরটা বড় নিঝুম। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা পাখির কিচির মিচির আর ডানা ঝাপটানির আওয়াজ আর ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এদিকটায়। শাকিব স্কুলে, বিজলি তার বাপের জন্য রান্নায় ব্যস্ত, শ্বশুর মনসুর জামাইয়ের বিছানা দখল করে ভুঁড়ি উঁচিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্তে নাক ডাকাচ্ছেন, দেখে এসেছে শফিক। ইদানীং এই লোকটাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না সে। দেখলেই একটা অশ্রদ্ধা, বিরক্তি দলা পাকিয়ে ওঠে মনের ভেতর। তবু কী করে যে নিজেকে শান্ত রাখে শফিক! কীভাবে যে পারে! নিজেই অবাক হয় নিজের ধৈর্য দেখে।
ও বাজান!
চরাটের ওপর কখন শুয়ে তন্দ্রামতন এসেছিল শফিক। হঠাৎ খুব চেনা কণ্ঠটায় চমকে চোখ খুলে তাকায় সে। মাথায় আধহাত ঘোমটা টেনে তার দিকে ঝুঁকে আছেন মা, বেদানা বেগম!
ধরফর উঠে বসে শফিক। অনেকদিন বাদে মাকে দেখে হতবিহ্বল লাগে তার। হতচকিত শফিক যন্ত্রচালিতের মত বলে ওঠে, কী, মা?
তুই আমাক থুয়ে চইলে যাবি বাপ? অত দূর দ্যাশে যাবি? আমি তোক থুয়ে ক্যাম্মা থাকপ বাজান? তুই কি পারবি অত দূর দ্যাশে য্যায়া থাইকপের? আমার পরানডা যে পুইড়ে যাবি রে! ও শফিক!
বেদানা বেগমের চোখে জল চিকচিক, চিবুক কাঁপে থরথর। টুপ করে কফোঁটা জল ঝরে পড়ে ঝরঝর। দেখে অস্থির হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে যায় শফিক। তখনই সে টাল খেয়ে পড়ে যায় নিচে। মাথার ভেতরটা ভারী লাগে খুব। তারপর ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা কাটে। মনে হয় কী যেন এক ঘোর আচ্ছন করে দিয়েছিল তাকে। মা বেদানা বেগম কখন যে মিলিয়ে গেছেন হাওয়ায়। ঘোর কাটতেই দেখে চরাটের নিচে, মাটির মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। অগত্যা সে উঠে বসে ধীরে ধীরে। হালকা চোট লেগেছে নাকে-মুখে, শরীরে, টের পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে অদূরে ছড়িয়ে থাকা ঝোপের মধ্যে তাকায় শফিক। অযত্নে, অবহেলায় বেদানা বেগমের কবরটাতে ঘোর জঙ্গল জমে উঠেছে কবে, খেয়ালই করেনি একদম। করোনায় কত যে পরিবার ছন্নছাড়া হয়েছিল হঠাৎ! চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরেছিল বটে শফিক, তবে সঙ্গে বয়ে এনেছিল করোনা। কারো কিছুই হয়নি তাতে। মায়ের সেবা-যত্নে সুস্থ হয়ে উঠেছিল অবশেষে শফিক। কিন্তু রাতদিন ছেলের সেবায় লেগে থাকা বেদানা বেগম তাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছিলেন এক সপ্তাহের মাথায়। গ্রামের কেউ দেখতে আসেনি, কোনো জানাজা হযনি, শুধু শফিক আর তার বাবা হযরত আলী বাড়ির পেছনের এই উঁচু জায়গাটাতে কোনোমতে কবরস্থ করেছিল বেদানা বেগমকে। মায়ের কবরটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভীষণ এক কষ্ট অসার করে দিতে চায় শফিককে। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদে। মায়ের এই কবরটা ছেড়ে সে চলে যাবে দূরে, বহুদূরে, ভাবতেই একদলা কষ্ট ঢেউ তোলে তার বুকের নদীতে। তোলপাড় করে ভীষণ। যন্ত্রচালিতের মত উঠে বাড়ির ভেতর থেকে দা নিয়ে আসে শফিক। মায়ের কবরটা সাফসুতরো করতে থাকে দারুণ যত্নে। মনে মনে বলে, আমি তোর অযোগ্য সন্তান মা। স্বার্থপর। আমার জন্যই মরতে হয়েছে তোকে। আমি দূরে চলে যাব মা। অনেক দূরে। তবু ফিরে আসব আমি আবার তোর কোলে। তোর পাশেই ঘুমিয়ে পড়ব আবার পরম নিশ্চিন্তে, দেখিস!
কী বিড়বিড় কইরতেছ তুমি হেনে বসে বসে? আর এই গরমের মদ্যি তুমার এহুন এই কব্বর সাফ করা লাগবি ক্যা, শুনি? কহুনতে ফোন বাইজে যাচ্চে তুমার, শুনতি পাচ্চ না কিচু?
কিডা ফোন করেচে? চমকে পেছন ফিরে উত্তর দেয় শফিক। কবর পরিষ্কার করতে করতে এতটাই মগ্ন ছিল সে যে, বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত ছিল তার। আচমকা বিজলির কণ্ঠে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেযে বলে কথাগুলো। ততক্ষণে ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বিজলি। ভীষণ অবাক হয়ে শফিক স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। আজ দিনটা ভারি অদ্ভুত তো! কী সব ঘটছে সেই সকাল থেকে একনাগাড়ে! মেঘা কেন ফোন দিয়েছে তাকে? মেঘা তো ভুলেও কখনো ফোন দেয় না শফিককে তনি চাচির মৃত্যুর পর থেকে! আজ হঠাৎ কী ব্যাপার?
*******************************

Leave a Reply