পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা – ২ || শিল্পী নাজনীন
মধ্যদুপুরের খররোদে দাঁড়িয়ে নিজের ওপরই তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে শফিক। মাথার ওপর গনগনে সূর্য রেগে টং হয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে সমানে। পিচঢালা রাস্তা আগুনের হলকা ছাড়ছে হাওয়ায়। এই সময়ে ব্যাগভর্তি বাজার হাতে ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করতে কাঁহাতক আর ভালো লাগে কারো! তার ওপর আবার থলের মধ্য থেকে মাথা বের করে তরতাজা মুরগিটা থেকে থেকেই কোঁকর কোঁ শব্দে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। যন্ত্রণার একশেষ। কিন্তু কী আর করা! বিজলীর কড়া নির্দেশ, এককেজি গরুর মাংস আর একটা ব্রয়লার মুরগি কিনে তবে বাড়িমুখো হওয়ার। তার বাপ এসে হাজির হয়েছে সেই সাতসকালে। বিটকেল লোকটা কাকভোরে হাজির হয়ে সেই যে কানপড়া দিতে শুরু করেছে মেয়েকে, তার আর কোনো ছাড়ান নেই। শফিক ছেলে শাকিবকে জড়িয়ে তখনো ঘুমে। কিন্ত কানের কাছে অনবরত বাপ-মেয়ের ভুজুরভুজুরে সকালের ঘুমটা মাটি করে শাকিবকে ছেড়েই অগত্যা সে উঠে পড়ে শেষে। তাকে উঠতে দেখে শ্বশুরবাবাজি যেন গলে যান স্নেহে। গলাখাঁকারি দিয়ে, কণ্ঠ মোলাযেম করে জিগ্যেস করেন, কেমুন আচো গো বাজান? শইল বালো তো?
সুমন্দির ছাওয়াল আমার! সাতসহালে আয়চে হেনে ফাইজলেমি মারাবের! টাহাপয়সার গুয়া মারা সারা অবিনি এহুন! কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে শুকনো হাসি টেনে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে, জি আব্বা বালো আচি, আপনে বালো তো? -বলেই গামছাটা কাঁধে নিয়ে মালবাড়ির পুকুরের দিকে হাঁটা দেয় শফিক। শালা খচ্চর! এতক্ষণ মেয়ের সঙ্গে বসে তার বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছিল হারামি লোকটা, ভেবেছিল শফিক ঘুমোচ্ছে। আর বিজলিও ঘরের শত্রু বিভীষণ! সে কি না নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকায় বাপের সঙ্গে বসে! শফিককে দূরে সরাতে পারলেই তার যত শান্তি! তবে তাই এবার করবে শফিক। দূরেই সরে যাবে সে। টাকাটাই যখন বিজলির কাছে শফিকের চেয়ে বেশি দরকারি, তখন বিজলিকে ছেড়ে, শাকিবকে ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে, অনেক দূরে চলে যাবে সে। বেছে নেবে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকজীবন। সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে নেয় শফিক। ম্নান সেরে আসতেই গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, শুকনো মরিচ পুড়িয়ে করা আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর মসুরের ডাল দিয়ে একসঙ্গে বাপ মনসুর আর স্বামী শফিককে খেতে দেয় বিজলি। বিজলির খেতে দেওয়ার ধরণ আর শ্বশুর মনসুরের মধুর ব্যবহার দেখেই ঘটনা আঁচ করে নেয় শফিক। মনসুর লোকটা মহা ধুরন্ধর, শ্বশুর হলেও লোকটাকে চিনতে মোটেই বাকি নেই শফিকের। আর মেয়ে তার বাপের চেয়েও এককাঠি সরেস। মুখে মধু ঢাললেও অন্তরে তার স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। করোনায় চাকরি হারিয়ে বাড়িতে ফেরার ছয়মাসের মধ্যে শফিকের অসুস্থ বাপটাকে বাড়ি ছাড়া করেছে বিজলি। তার বাপ এখন মেয়ের বাড়ি পরগাছা হয়ে আছে, যেখানে শায়লার নিজেরই বলতে গেলে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। মুখ বুজে সব সহ্য করেছে শফিক। সংসারে অশান্তি এড়াতে সে বিজলির সব অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নিয়েছে। কিন্তু মনে মনে সে-ও পুড়ছে সেই থেকে। গোপনে প্রতিমাসে বাপের খরচ বাবদ বোন শায়লাকে সে টাকা দিয়ে আসছে। বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার তার মুখ নাই। বোন শায়লাকে বলেছে, আব্বাকে কইস, মনে যিন আমার জন্যি কষ্ট না রাহে। কয়ডাদিন যাবের দে, আমি ইতালি যাওয়ার চিষ্টা কত্তিচি। একবার যাই, তারপর দেহিস কী করি আমি, সপ কিচুর শোদ তোলব তহুন এক এক কইরে।
কিন্তু ইউরোপ যাওয়া মুখের কথা নয়, গুচ্ছের টাকা দরকার, সময়ও লাগে অনেক, তার ওপর আছে টাকা মার যাওয়ার শঙ্কা। একবার দালালের খপ্পরে পড়লে সর্বশান্ত হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না তখন। সব বোঝে শফিক। তবু সে চেষ্টাটা করছিল একান্তে। করোনাকালে চাকরি চলে গিয়ে বেকার হওয়ার পর সে স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে এসেছিল। বাপ-দাদার সম্পত্তি যেটুকু ছিল সেটুকুতে নিজেই শুরু করেছিল চাষবাস। তাতে ভালোই চলছিল দিনকাল, কিছু কিছু হাতেও জমছিল মন্দ নয়। কিন্তু স্বামী খেতে-খামারে চাষবাস করছে, সেটি একদমই পছন্দ নয় বিজলির, তার বাপ মনসুরও এ নিয়ে প্রতিনিয়ত মেয়েকে কানপড়া দেয়, জানে শফিক। তাই সে একান্তে চেষ্টা করছিল ইতালিতে পাড়ি জমানোর। তার বন্ধু আজিম সেখানে আছে ছয়/সাত বছর হল। তার সঙ্গে কথা বলে ইতালিতে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছিল মফিক প্রায় বছরখানেক ধরে। কিন্তু বিজলি আর তার বাপের অত ধৈর্য নেই। তারা চায় ঝটপট কিছু একটা হোক। অল্প পয়সায় বড় মাছ ধরার ধান্দা তাদের। তারা চায় সৌদি আরব যাক শফিক। অল্প টাকায় যাওয়া যাবে, টাকা মার যাওয়ারও ভয় নেই, ভালো বেতন, আর তাতে খুব বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হবে না শফিককে। সৌদিতে বিজলির আপন মামা আছে, তার কোম্পানিতেই কাজ নিয়ে যেতে পারবে শফিক। এ নিয়ে অনেকদিন থেকেই বিজলি আর তার বাপ মনসুরের ঘ্যানঘ্যানানি শুনে আসছিল সে, তবু নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল এতদিন। কিন্ত আজ সাতসকালে বাপ-মেয়ের ফুসুরফুসুর গুজুরগুজুর শুনে মেজাজটাই বিগড়ে গেছে তার। যা থাকে কপালে, সৌদিতেই যাবে সে। বিজলিকে একটা জন্মের মত শিক্ষা দিতে না পারলে তার নামই শফিক না। আর এই খচ্চর লোকটাকেও সে উচিত শিক্ষা যদি দিতে না পেরেছে তো কী বলেছে! ব্যাটা বজ্জাত নিজের মেয়েটার সঙ্গে চক্রান্ত করে শফিকের অসুস্থ, বুড়ো বাপটাকে বাড়িছাড়া করেছে, এর জবাব শফিক সময়মত দেবে বৈ-কি! শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছে সে। ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালায় হাত ডুবিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে কথাগুলো নিজের মনেই ভাবছিল শফিক। বিজলিই নীরবতা ভাঙে অতঃপর। কণ্ঠে মধু ঢেলে বলে, বাজান তুমার সাতে জরুলি আলাপ করার জন্যি এত সহাল সহাল অত দূর পত মাড়ায়া আয়চে, বোচ্চ?
শফিক বুঝেছে বৈ-কি। ভাতের গ্রাসটা গলাধঃকরণ করতে করতে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে সে-ও মিহিন সুরে বলে, কী জরুলি কতা? কন আব্বা। আপনে মুরব্বি, আপনে ছাড়া আর কিডা আচে আমাগের!
শুনে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিজলির মুখ। তার বাপের মুখও আনন্দ ঝলমল। ভাত খাওয়া থামিয়ে তিনি শফিকের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বলেন, তুমাগের চিন্তেই তো রাতদিন করি রে বাপ। তুমরা ছাড়া আমারই-বা আর কিডা আচে কও! এক ছাওয়াল রুমজান, সে-ও তো য্যায়া বসত নেচে শ্বশুরির ভিটেত! বাপ-মার কোনো খোঁজ নেয় না, কোনো দায়-দায়িত্ব রাহে না, তার কতা আর কইবের চাইনে বাজান। তার কতা থাক। তয় বাজান, তুমার মামাশ্বশুরির সাতে কতা কলাম কাইল। সে তো তুমার যাওয়ার ব্যাপারডা মুটামুটি ঠিকঠাকই কইরে ফ্যালায়চে পিরায়। এহুন বাদবাকি তুমার উপর নির্বর কেইরতেচে। আমি কই কী বাজান, তুমি আর অমত কইরে নাকো। রাজি অয়া যাও বাপ। সাদা (সাধা) ঠাহুর পায়ে ঠেইলবের নাই, এইডে গুরুজনেগে কতা। কপালে যদি থাহে তুমি সৌদিত্তেও ইতালি যাইবের পারবা বাজান। আগে সৌদিত যাও, কয়ডা বচর থাহো, টাহাপয়সা জুমায়া সেহুন তুমি ইতালিত যাওয়ার চিষ্টা কইরেনে, না কি বাজান?
এমন কিছুর অপেক্ষায়ই ছিল শফিক। সে মনসুরের কথা শেষ হওয়া মাত্রই বলে ওঠে, জি আব্বা। আপনে গুরুজন। আপনে তো আর খারাপ চান না আমার। আপনে মামার সাতে কতা কয়া ফাইনাল কইরে ফ্যালান আব্বা। আপনেরা সগলেই যেহুন চাচ্চেন আমি সৌদিত যাই, তালি পরে তাই করব আব্বা। আমি সৌদিতই যাব। আপনে মামার সাতে পাকা কতা কন ইবার। মনে মনে অবশ্য সে অন্য কথা বলে। বলে, শালা খচ্চর! মানষির আয়ু কত বচর রে খাটাশ? সারাজীবন কি প্রবাসেই কাটপি আমার?
বাপ-মেয়ে অবশ্য মুখের কথাটাই শুধু শুনতে পায় তার। শফিকের মনের মধ্যে চলতে থাকা পঙক্তিটা অশ্রুতই থাকে তাদের। হঠাৎ ভুতের মুখে এমন রাম নাম শুনে খানিক হকচকিয়ে যায় তারা। একে অন্যের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় প্রথমটায়। কারো মুখেই কথা সরে না যেন। শেষে বিজলি কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বলে, তালি পরে তুমি রাজি হচ্চ তো? সৌদিতই তালি যাবা তো তুমি? আব্বা তালি কতা কবি মামার সাতে?
হ সৌদিতই যাব। নবিজির দ্যাশ। হোনতেই বিসমিল্লা কয়া শুরু করি। পরে যা অওয়ার অবিনি।
আনন্দের আতিশয্যে কী বলবে ভেবে পায় না বিজলি। নিজের কানকে সহসা যেন বিশ্বাস হতে চায় না তার। সে শফিকের পাতে আরেক টুকরো ডিম ভাজি তুলে দিতে দিতে বাপ মনসুরের দিকে তাকিয়ে বলে, কইচিলাম না আব্বা, তুমার জামুই রাজি অবিনি? তুমি আইজই মামার সাতে কতা কও য্যায়া।
বলতে বলতে খুশিতে চোখ মোছে বিজলি। ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছে শফিক। তার ইচ্ছে আপাতত বাপ-মেয়ের সামনে থেকে কাটে। আজকাল আর সহ্যই হয় না তার বিজলিকে। এত কূটিল নারী সে জন্মে দেখেনি আগে। আর এত লোক থাকতে তার ভাগ্যেই কেন এসে জুটল এই বিজলি, কে জানে! ছেলে শাকিব না থাকলে এতদিনে অন্যরকম কিছু ভাবত সে, আলাদা হয়ে যেত বিজলির থেকে। কিন্তু ছেলেকে কষ্ট দিতে মন সায় দেয় না তার। শুধু এজন্যই মুখ বুজে সহ্য করছে শফিক বিজলিকে। শার্টটা গায়ে দিয়ে, পায়ে চটি গলাতে গলাতে সে ভাবছিল বাজারের দিকে গিয়ে এককাপ চা খাবে একা বসে। কিন্তু শফিক বের হবে বুঝতে পেরেই রান্নাঘর থেকে মুখ বের করে গলা তুলল বিজলি, বাজারের দিক যাচ্চ তো? এককেজি গরুর গোস্ত আর এটা বয়লার আনবা। দেরি করবা না বেশি, আব্বা আবার খ্যায়াদ্যায়া চইলে যাবি তাড়াতাড়ি!
বিজলির কথা মনে পড়তেই গায়ে যেন ফোস্কা পড়ে শফিকের। তেতে ওঠা রাস্তায় বাজারের ব্যাগ হাতে ভ্যান বা অটোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে গরমে সেদ্ধ হতে হতে নিজের ওপর আরো বিরক্ত হয়ে ওঠে সে নিজের প্রতি। সে আদতে পুরুষই নয়! তার বাপের কথাই ঠিক, সে আদতে ভেড়া একটা! বউয়ের কথাই যার কাছে বেদবাক্য প্রায়। শালা ভেড়া! বিড়বিড় করে শফিক। তখনই একটা অটো এসে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় তার। একটা হাসি হাসি মুখ পরিচিত স্বরে অটোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে বলে, কী রে শফিক? আছিস কেমন?
চমকে তাকায় শফিক। শওকত! সেই শওকত! কতদিন পর!
*************************
