পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা
শিল্পী নাজনীন
[লেখক পরিচিতি: শিল্পী নাজনীন। বাবা: খন্দকার আবু ইউসুফ, মা: রোকেয়া খাতুন টুনু। জন্ম ১৪ জুলাই ১৯৮১, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানায়। শৈশব, কৈশোর কেটেছে কুমারখালীর গোসাইডাঙ্গী নামক গ্রামের জল-কাদায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। পেশা শিক্ষকতা। দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক এবং দেশ-বিদেশের অনলাইন ম্যাগাজিনগুলোতে অনেক গল্প প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রথম উপন্যাস ‘ছিন্নডানার ফড়িঙ’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘আদম গন্দম ও অন্যান্য’,’বিভ্রম’ এবং ‘মায়াফুল ও সাপের গল্প’ নামক গ্রন্থ তিনটি ছোটগল্পের। এছাড়া ২০১৮ তে প্রকাশিত হয় ‘তোতন ও ফড়িঙরাজা’ নামক একটি শিশুতোষ গল্পের বই। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘উলটপুরাণ’ প্রকাশিত হয়েছে বইমেলা ২০২৩-এ]
১.
‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…’
আলো নিভিয়ে একমনে গানটা শুনছিল মেঘা। আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে সকাল থেকেই আকাশ ছেয়েছিল, সারাদিন বৃষ্টি ছিল টুপটাপ। সন্ধ্যানাগাদ বৃষ্টিটা আরো ঘন হয়ে নেমেছে। ভারী বৃষ্টি, সাথে যোগ হয়েছে ঝড়ো হাওয়া। মনে হচ্ছে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। মেঘাও কাঁদছে কি? প্রশ্নটা নিজেকে করেই অজান্তে চোখ মোছে মেঘা। এই গানটা তাকে এলোমেলো করে দেয় ভীষণ। মন খারাপ হলে খুব আয়োজন করে এই গানটা একান্তে শোনে সে। এত অসাধারণ একটা গান বাংলা গানের জগতে যুক্ত করার জন্য হূমায়ুন আহমেদকে ধন্যবাদ জানায় চুপিসারে। বাইরে ঘন অন্ধকার। ঝড়ো হাওয়ার আভাসে বিদ্যুৎ গেছে সেই সন্ধ্যায়। আইপিএস চলছে তখন থেকেই। নীলিকে মৃদুলের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে সে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পর্দা সরিয়ে আকাশ দেখছে আনমনে। আকাশ অন্ধকার। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। কাচের ওপারে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ঝাপটা, ঝড়ো হাওয়া। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে গম্ভীর স্বর তুলে। সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে মেঘার। এমন ঝড়-বাদলের দিনে তাদের টিনের চালায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ত, কী এক করুণ, মধুর সুর তুলে বৃষ্টি ঝরত অবিরাম। ঘন সন্ধ্যায় এমন ঝুম বৃষ্টি নামলে কী অদ্ভুত আর অপার্থিব লাগত সেই রাতটাকে তার। মায়ের কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে একমনে বৃষ্টির শব্দ শুনত মেঘা। কল্পনায় সে ভাসিয়ে দিত মনের ভেলা। ইচ্ছে হত অনেক দূরে, দূর আকাশে উড়ে যায় সে, মেঘেদের দেশে গিয়ে দেখে আসে কী এত দুঃখ মেঘের, কেন এত অবিশ্রাম কেঁদে চলে সে, কী এত ফিসফিস কথা কয় উতল ব্যাকুল হাওয়ার কানে! ভাবত আর মনে মনে ভীষণ ভয় পেত মেঘা। তার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল সেই বয়সে যে, তারও জীবন হবে আষাঢ়ের ওই মেঘের মত দুঃখমেদুর। মনে হত তার নামটাই তাকে ডুবিয়ে দেবে দুঃখের অতল সায়রে। মাকে সে অনুযোগ করত সুযোগ পেলেই। কেন তার নাম মেঘা রেখেছিল মা, আর কি নাম ছিল না দেশে! মা ম্লান হাসতেন শুনে। বাদলা দিনে জন্ম বলে ভালোবেসে মেয়ের নাম রেখেছিলেন জাহিদ। বারিষ পেটে আসার পরপরই তারও নাম ঠিক করে রেখেছিলেন বাবা। জাহিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মেয়ের পরে এবার ছেলেই হবে তাদের। শুনে হাসতেন তনি। মেঘা ছিল তার বাবার অন্তরের টুকরো। যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন, মেয়েকে একটুও চোখের আড়াল করতেন না জাহিদ। তবু মেয়েকে ছেড়ে, স্ত্রী তনি আর ছেলে বারিষকে ছেড়ে ঠিকই তো তিনি চলে গেলেন জীবন থেকে পালিয়ে! মেঘার অমন ছেলেমানুষী অনুযোগে তাই মুখে কিছুই বলতেন না তনি। চোখের জল লুকাতেন অনেক কষ্টে। আড়ালে কাঁদতেন মেয়ের অমন অভিমানে। সেই বয়সে অতকিছু বুঝত না মেঘা। যত বড় হয়েছে সে, যত সে জীবন চিনেছে একটু একটু করে, তত সে বুঝেছে অবশেষে, প্রতিটি মানুষই আদতে একটুকরো মেঘ। জীবনের আকাশে সে অন্যের ইচ্ছেয় ওড়ে, ঘোরে, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কখনো টুপটাপ কখনো-বা ঝরঝর ঝরে, তারপর একসময় সে ফুরিয়ে যায়, একসময় সে হারিয়ে যায় জীবনের অন্যপ্রান্তে। শুধু কিছু স্মৃতির ধূলো রেখে য়ায় পৃথিবীর ধূসর পৃষ্ঠায়, সময়ের হাওয়ায় যা আবার মিলিয়ে য়ায় ধীরে। এই পুতুল জীবনে তাই ঝরে পড়াই নিয়তি সবার। মাঝখানের হাসি-গান-কান্নার পাল্লাটা কারো কারো বড় বেসামাল, সামঞ্জস্যহীন হয়, বিশ্রিরকম পক্ষপাতদুষ্টভাবে হেলে পড়ে কোনা একদিকে, এই যা যন্ত্রণার। নইলে তফাৎ কিছুই নেই তেমন। এসব নিয়ে এখন তাই অত আর ভাবে না মেঘা। তবু এমন মেদুর বর্ষায়, এমন অঝর বর্ষণে হঠাৎ হঠাৎ চোখ ভিজে ওঠে অজান্তে, মন কেমন করে। পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ে, ফেলে আসা পথ মনে পড়ে, দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে মন। এই গানটা কেন যে এত প্রিয় মেঘার! কেন যে এমন ভরিয়ে তোলে হৃদয় মন! কী যে এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে দেয় তাকে, গা ছমছমে এক নাম না জানা বোধে ভরিয়ে তোলে হৃদয়। অনেক-অনেকবার, বারবার গানটা শোনে মেঘা। খুব ইচ্ছে করে শ্রাবণকে ফোন দেয়। শ্রাবণ! নামটা তার জীবনে অভিশাপ। তবু কেন যে এই নামটাই ঘুরে ফিরে মনে পড়ে বারবার! কী করছে এখন শ্রাবণ? এই বর্ষণমুখর রাতে, এই অন্ধকারে জানালায় একলা বসে আকাশ দেখতে দেখতে শ্রাবণের মুখটা কল্পণায় আঁকতে চায় মেঘা। ঝাপসা মুখ। অস্পষ্ট। অদ্ভুত! শ্রাবণ কবে ঝাপসা হল তার মনে? সময় তবে এমনই এক অদৃশ্য পলেস্তারা! সযত্নে পুষে রাখা স্মৃতিতেও সে তবে এঁকে দেয় বিস্মৃতির মোহন প্রলেপ! হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নেয় মেঘা। শ্রাবণের নম্বরটা খুঁজে বের করে ফোন দেয় চুপিসারে। পরপর দুবার রিং হতেই রিসিভ হয় ফোন। গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে ওপাশ থেকে, হ্যালো!
ঠিক কতদিন পর কণ্ঠটা শুনল মেঘা? প্রশ্নটা অনর্থক মনে হয় নিজের কাছেই। ওপাশ থেকে তখনো শ্রাবণের কণ্ঠ আসছে, হ্যালো কে বলছেন, প্লিজ?
কথা না বলে গানটা বাজতে থাকা ব্লু টুথের খুব কাছে নিয়ে ফোনটা ধরে রাখে মেঘা। শ্রাবণের কণ্ঠ থেমে যায়। তার নিঃশ্বাসের শব্দ আসে কানে। কত দূরে তবু কত কাছে এখন শ্রাবণ! প্রযুক্তি মানুষকে কোথায় যে পৌঁছে দেবে আরো! ফোন কাটে না শ্রাবণ। চুপচাপ গানটা শোনে ওপাশ থেকে। মেঘা জানে, শুনছে শ্রাবণ। ফোনটা কে করেছে সেটাও সে বুঝেছে নিশ্চয়ই! একসময় এই মেঘার জন্য পাগল ছিল শ্রাবণ। মেঘাও ছিল না কি খানিক? ছিল! তবু জীবন তাদের দুজনের তরী দুকূলে ভিড়িয়ে দিয়েছে। আলাদা হয়ে গেছে পথ। কিন্তু মন? সে বড় অদ্ভুত। একবার কোথাও বাঁধা পড়লে সহজে কি গিঁট ছাড়ে তার! কত বছর যোগাযোগ নাই শ্রাবণের সঙ্গে দশ? পনেরো? অমনই হবে কিছু। কী হবে অত হিসেব কষে! নতুন ফোন নম্বরটা কীভাবে যেন তবু হাতে চলে এসেছে মেঘার। এসেই যায়। পৃথিবীটা ভীষণ ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ। মানুষে মানুষে বাড়ছে যোগাযোগ। বাড়ছে কি? মেঘার তো বরং উল্টো মনে হয়! তার মনে হয় পৃথিবীটা যেমন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, ঠিক তেমনই তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে সম্পর্কের ভাঙন। ধীরে ধীরে একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ, বাড়ছে নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব আর আস্থাহীনতা। বাড়ছে অস্থিরতা। জটিল, যৌগিক আর স্বার্থপরতার রাঙতায় ক্রমশ মুড়ে যাচ্ছে মানুষের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো। মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ছে মানুষের সুন্দর মুখ।
গানটা শেষ হয় অবশেষে। একমুহূর্তও অপেক্ষা করে না আর মেঘা। ওপাশ থেকে আর কোনো কথা ভেসে আসার আগেই কেটে দেয় ফোন। একটু অপেক্ষা করে। শ্রাবণ কি ফোন করবে উল্টে? করবে না, জানে মেঘা। ট্রু কলার ব্যবহার করে শ্রাবণ। সে এতক্ষণে জেনে গেছে কে করেছে ফোনটা। কাজেই ফোন ব্যাক করবে না শ্রাবণ। ফোন করেই বা কী হবে! কথা তো কিছু নাই তাদের! এতগুলো বছর তো চলে গেছে কোনো যোগাযোগ ছাড়া, কোনো কথা ছাড়াই! আর কী হবে কথায়, যোগাযোগে? ভেবেই হেসে ফেলল মেঘা। যোগাযোগ ছাড়াই কাটল কি? তাহলে একটু আগে যে ফোন করল মেঘা, রিসিভ করে চুপিচুপি গান শুনল শ্রাবণ, সেটা তবে কী? যোগাযোগ নয়? পরিচিত দুজন মানুষ খুব আয়োজন করে যদি ভুলে যেতে চেষ্টা করে পরস্পরকে, বন্ধ করতে চেষ্টা করে সব যোগাযোগ, তবে আর কিছু না হলেও চেষ্টাটাই মাটি হয় বরং, মনের মধ্যে জুড়ে থাকা ছায়াটাই গাঢ় হয় আরো! মেঘার চেয়ে বেশি আর কে জানবে এ কথা! মাঝে মাঝে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে মেঘার। মাকে মনে পড়ে অভিমানে, রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মন। মনে মনে চিৎকার করে মেঘা। মাকে চিৎকার করে বলে, কেন এমন যন্ত্রণায় আমাকে তুমি পুড়িয়ে দিলে, মা? কেন এমন করলে? কী ক্ষতি হত তোমার, যদি এক ছাদের নিচেই থাকতাম আমি আর শ্রাবণ? কেন মানলে না? কেন বাধা দিলে? নিজের মনের ভেতরে উথলে ওঠা চিৎকার নিজেই গিলে ফেলে মেঘা। কে শুনবে তার চিৎকার? কে করবে জবাবদিহি? মা তো সেই কবেই জীবনের পালা সাঙ্গ করে চলে গেছেন ওপারে!
বৃষ্টিটা কমে এসেছে অনেকটা। কমে এসেছে বাতাসের তোড়। সাবধানে জানালার কাচ খানিকটা সরিয়ে দেয় মেঘা। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দেয় মুখ, ঠান্ডা হাওয়ায় শীত শীত বোধে কেঁপে ওঠে শরীর। আকাশে তাকায় মেঘা। আকাশ থমথমে। যে কোনো মুহূর্তে আবার ঝরবে ঝরঝর। রাত হয়েছে ঢের। সকালে অফিসে দৌড়াতে হবে, নীলিকে ডে কেয়ারে দিয়ে বের হতে হয় বলে অনেক ভোরে উঠতে হয়, নাস্তা, লাঞ্চ রেডি করে, নীলিকে রেডি করিয়ে নিজেরাও রেডি হয়ে সারাদিনের জন্য বের হওয়াটা অনেক ঝক্কির। রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় যেতে হবে, নীলিকে খাওয়াতেও সময় লাগে ঢের। দরজা খুলে ড্রইংরুমে উঁকি দেয় মেঘা। নীলি কার্টুনে মগ্ন। মৃদুল ফোনে। কত কাছে বাবা আর মেয়ে, তবু কত দূরে! প্রযুক্তি এভাবেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের একান্ত মুহূর্তগুলো, করে দিচ্ছে একা, নিঃসঙ্গ, ভেবে মনটা আরো খারাপ হয় মেঘার।
(চলবে)
*********************