You are currently viewing আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ প্রেক্ষিত ভাবনা/ অতীশ চক্রবর্তী

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ প্রেক্ষিত ভাবনা/ অতীশ চক্রবর্তী

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ প্রেক্ষিত ভাবনা

অতীশ চক্রবর্তী

আমরা সকলেই জানি যে ১৯৯৯ সালে UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করা হয়ে আসছে। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন ধরণের বিষয়বস্তু বা থিম রাখা হয়। এই বছর, 2022 সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিষয়বস্তু হল, “বহুভাষিক শিক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ”। মানবসম্পদের বিকাশে, মান সম্পন্ন শিক্ষার বিকাশে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার ওপর জোর দেওয়া হবে।  COVID-19 এর কারণে প্রায় দুই শিক্ষাবর্ষে  স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল। শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাধান করার কথা ভাবতে হবে। কিন্তু  প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, অ্যাক্সেসযোগ্য উপকরণ না থাকলে প্রযুক্তি ভিত্তিক সমাধান করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এই পরিকাঠামো গড়ে তোলা সহজ কাজ নয় এবং যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার প্রচারের জন্য প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু ভাষা টিকে থাকলে, ভাষা শেখার আগ্রহ থাকলে তবে তো প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রশ্ন ওঠে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে ভাষায় দশ হাজারের কম মানুষ কথা বলে, সেই ভাষার দ্রুত বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে তো নয়-ই,  পশ্চিমবঙ্গেও বাঙলা ভাষাভাষী মানুষের-র সংখ্যা এর ধারে কাছে নয়। তা’ বলে নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমনোর সময় কিন্তু এটা নয়। মনে রাখতে হবে যে ভারতে ৭৮০টি ভাষার মধ্যে ৬০০টির বিলুপ্তির সম্ভাবনা আছে। আতঙ্কিত হবার মত ভবিষ্যৎ বাণী।  শুধু গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

খুবই ছোট হলেও বাংলাদেশ জন্ম আমি দেখেছি। শুধু ভাষার জন্য, ভাষার বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে একটা দেশের জন্ম হতে দেখা, তার সাক্ষ্মী হতে পারা এ যে কি আনন্দের ব্যাপার তা বলে বোঝাতে পারব না।  সে সময়ের উন্মাদনা, যন্ত্রণা  কষ্ট ভোলার নয় তবু আনন্দের।  ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার যাত্রা শুরু। আমার মনে আছে একসময়ে কলকাতায় কার্জন পার্কের এক কোণায় ভাষা উদ্যানে এই দিবস মর্যাদা সহকারে পালন করা হত, সুযোগ হলেই দেখতে যেতাম। ভাষা আন্দোলন জাতপাত, ধর্ম, শ্রেণী, বর্ণ সব ভেদাভেদ সাময়িক ভাবে মুছে দিয়েছিল। একমাত্র পরিচয় ছিল বাঙ্গালী। সাময়িক বলছি এই কারণে ভাষা আন্দোলনের যে মূল ভাবধারা ছিল তার থেকে আমরা সরে আসছি ক্রমশ। মনে পড়ে, প্রতিবছর এই দিবসে মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনাসভা, কর্মশালা, বিশেষ বক্তৃতামালা ও প্রদর্শনী্র আয়োজন করা হত।

পশ্চিমবাংলায়, বিশেষ করে কলকাতাতে ছোটবেলাতে দেখতাম অবাঙালিরা কষ্ট করে হলেও বাংলাতে কথা বলার চেষ্টা করতেন, বাংলায় থাকলে বাংলা শিখতেন। রাজ্যের বা কেন্দ্রের সরকারী, আধাসরকারী আধিকারিকরা বাংলা শিখতেন, আমরা বাংলাতেই তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি ছিল বিএফসাইডিং রেলওয়ে কোয়ার্টার। পূর্ব, পশ্চিম উত্তর দক্ষিন, সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কর্মচারীরা তাদের পরিবার পরিজনরা এখানে থাকতেন। তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা স্কুলে পড়ত আমাদের সঙ্গে, তাদের বাবা মায়েরাও বাংলা শিখে যেতেন। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে, তারা হিন্দিতে বলেন, নিজ রাজ্য পশ্চিম বাংলায় দাঁড়িয়ে আমাকে বাংলা না বলে হিন্দিতে বলতে হয়, বাংলায় বলতে অনুরোধ করলে উল্টে আমাকে গালি দেবার মত সাহস দেখায় – ভাবা যায় না। অনেকে কটাক্ষ করে নিজের দেশের রাষ্ট্রভাষা জানেন না, এ কি লজ্জার ব্যাপার। এ ব্যাপারে বাঙ্গালিদের কোনও দোলচাল নেই। নিজ রাজ্যে তো রাজ্যের ভাষা ব্যবহার করার কথা। মনে রাখতে হবে ভারতের সংবিধান মোতাবেক ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। এখন বাংলার তরফে কথা বলতে গেলে বাঙালিরাই তেড়ে আসে সবচেয়ে আগে। বাংলা এখন বাঙ্গালীর কাছেই দুয়োরানী। চোস্ত হিন্দি বলতে পারলে বাঙ্গালী গর্ব বোধ করে। মনে করে যে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কিছু করে খেতে পারবে যদি সে চোস্ত হিন্দি বলতে পারে। আগে ছিল রাজ্যের বাইরে গেলে  হিন্দি বলতে লাগত, তার আগে নয়। কারণ তখন রাজ্যের মধ্যে কিছু হলেও এদিক ওদিক টুকটাক কলে-কারখানায় কাজ পাওয়া যেত, উচ্চ শিক্ষিত হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি হত না হলে কেরানির চাকরি একটা জুটে যেত। কৃষি নির্ভর গ্রামীণ বাংলায় মানুষ খেয়ে পড়ে চালিয়ে নিত, বাংলায় কথা বলত। এখনকার মত রাজ্যের বাইরে না গেলে কোনও চাকুরি পাওয়া যাবে না সেরকম এতটা বাজে অবস্থা ছিল না। বাঙ্গালী যদি বাংলায় চাকরি না পায় তাহলে যে ভাষা শিখলে সে ভাল চাকরি পাবে সেই ভাষাই শিখবে। আবেগ দিয়ে তো আর পেট ভরে না! কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তো বলেই গেছেন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। সাম্যবাদী বিদ্রোহী কবি নজরুলের কথায় “ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন”। সেই দুটো ভাত একটু নুন জোগাতে যে ভাষা দরকার মানুষ সেই ভাষা শিখবে। আর আগেও তো অন্য ভাষা আমরা শিখেছি, মুঘল আমলে ফারসি শিখেছে, ইংরাজি আমলে ইংরাজি আর এখন হিন্দি। কিন্তু বাঙ্গালী আগে কখনও নিজের ভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য ভাষা শেখেনি। এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো টিকে থাকতে ইংরাজি পাঠক্রমে চলে যাচ্ছে, নাহলে স্কুলে ছাত্র ভর্তি হচ্ছে না। কারণ মানুষ পকেটে একটু পয়সা থাকলে পারতপক্ষে বাংলা স্কুলে ভর্তি করছে না। মিশনারি স্কুল ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ইংরাজী মাধ্যম স্কুল বা নিদেন পক্ষে  দিল্লী বোর্ডের স্কুলে ভর্তি করছেন, বাংলা স্কুলে নয়। অভিভাবকরাও মনে করেন বাংলাটা না জানলেও চলবে। বহু দিন আগে কলেজ ছাত্র জীবনে আমার এক সংস্কৃত পণ্ডিতের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি ঐ ভাষাতে অসাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু তার ক্লাসে ছাত্র ভর্তি হয় না। শেষমেশ ওনার অবসরের পর কলেজ পদটাই তুলে দিল। কদিন পর এখানে বাংলা-র একই অবস্থা হবে যদি না এখনি আমরা সতর্ক হই। কারণ হিন্দি ভাষাভাষীরা যে ভাবে ব্যাবসা ও অর্থনীতিতে  চালিকা শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভাষার ওপর প্রতক্ষ্য প্রভাব ফেলেছেন, তাতে বাংলা ভাষা শিক্ষার যৌক্তিকতা মানুষ আর অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পারছে না। বিবেকের জ্বালা মেটাতে বছরে একবার রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী এবং ভাষা দিবস পালন করি।  হিন্দিভাষী পুঁজিপতিদের নেক নজরে যে রাজ্য যত পরে পড়েছে, সেই রাজ্যে হিন্দির প্রভাব তত কম পড়েছে বা দেরিতে পড়েছে, যেমন পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি। একে হিন্দি আগ্রাসন বলুন বা না বলুন কিছু যায় আসে না। প্রাদেশিক ভাষাগুলোর গুরুত্ব নিজ নিজ প্রদেশবাসির কাছেই আর থাকছে না। ছেলে বাংলা ভাষায় পড়াশুনো করলে ধরে নেয় মাধ্যমিকে নিশ্চয় কোনরকমে পাশ করেছে, আর মেয়ে হলে তো বিয়ের জন্য ডিগ্রী পেতে এসেছে। বিশেষত নবীন প্রজন্মের মুখে মুখে হিন্দি, ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি বাংলাভাষা চলছে। এপারে যেমন হিন্দির প্রভাব, শুনেছি, বাংলাদেশে শুনি আরবি ভাষার প্রভাব পড়ছে। গুগল (Google search engine) খোঁজ নেয় – জিজ্ঞেস করে – কোন বাংলা? ভারত না বাংলাদেশ। এরকম চলতে থাকে একদিন হয়ত দেখব বাংলা ভাষা দুই দিকে দুই ধারায় প্রবাহিত হবে। 

আমরা প্রবাসী বাঙ্গালীরা যারা বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করি, সেই আমরাও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ধরে রাখতে পারছি না। ব্যয়ঃসন্ধি পর্যন্ত বাবা মা বাংলা নিয়ে জোর করে।  সেটাও আমাদের মধ্যে যে হোম সিকনেস আছে, নসটালজিয়া আছে, লাখ শহিদের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারির তাজা ইতিহাস জানা আছে, যার জন্য আমরা গর্বিত, তার তাগিদে। কারণ এরা বড় হয়ে বাংলা বলবে না। শুধু বাঙ্গালীরা নয়, স্প্যানিশ, জার্মান, রাশিয়ান, ভিয়েতনামী, পোলিশ, হিন্দি, তামিল এবং চাইনিজের মতো “বড় বড়” ভাষার মার্কিন ভাষাভাষী অভিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম আর তাদের নিজ নিজ ভাষাতে থাকছে না, সকলেই ইংরেজিতে চলে যাচ্ছে। আমেরিকাতে এক সময় ৩০০-র বেশী ভাষা ছিল, কমতে কমতে ১৫০তে ঠেকেছে, ২০৫০ নাগাদ তা ২০তে গিয়ে ঠেকবে বলে মনে করা হয়। নাভাজো বলে যে দেশীয় ভাষাটিতে সবচেয়ে বেশী লোক কথা বলে সেই ভাষাও বিপন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ইংরাজি অভিবাসিদের দেশ, তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশীয় ভাষাগুলো তার গুরুত্ব হারিয়েছে। রিজার্ভেশন করে দেশীয় ভাষাভাষীদের জন্য সংরক্ষণ করে তাদের সংস্কৃতি রক্ষা করা হয়েছে বটে কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে এরা না পেরেছে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে, না পেরেছে এরা সেই তৎকালীন সমাজ ব্যাবস্থা থেকে উন্নত হতে। যে কোনও দেশে বড় ভাষা বিশেষ করে রাষ্ট্রপরিপুষ্ট ভাষা ছোটছোট ভাষাগুলিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়। অভিবাসনের দ্বারা একটি গোষ্ঠী তাদের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সুবিধা বা উচ্চতর সামাজিক মর্যাদার লক্ষে বিদেশে গিয়ে তাদের মাতৃভাষার অব্লুপ্তি ঘটায়, তাদের পরবর্তী প্রজন্মে সেই ভাষার মৃত্যু হয়। 

মনে রাখতে হবে যে, ইউনেস্কো 21 ফেব্রুয়ারী, 2009-কে দশম বার্ষিক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি, মাতৃভাষা, ঐতিহ্যপূর্ণ ভাষা এবং বিপন্ন ভাষাগুলির সংরক্ষণের জন্য নিবেদন করে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা থেকে বিরত থাকে। এটা যথেষ্ট ভাববার বিষয়। তারা মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইংরাজি ভাষার দেশ, কাজেই অভিবাসীরা শুধুমাত্র ইংরেজিতে এই দিবস উদযাপন করতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাতৃভাষা দিবসের কোনও কিছুতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করবে। আশঙ্কা এই যে বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা থেকে আগত বহু স্প্যানিশ ভাষাভাষীরা এই দিবস দ্বারা উদ্ভুদ্ধ হয়ে মাতৃভাষায় তাদের অধিকার আন্দোলনে রত হতে পারে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এর মধ্যেই আমেরিকা ও মেক্সিকোর সীমারেখার কাছাকাছি আমেরিকান রাজ্যগুলিতে অনেকে দোকানে পোষ্টার লাগিয়েছে – নো ইংলিশ নো সার্ভিস। একাংশের ভয় স্প্যানিশ ভাষাভাষীরা আমেরিকার জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দিয়ে ইংরাজিকে বাতিল করে দিতে পারে। এই তথাকথিত ইংরাজি রক্ষাকারিরা মনে করে ফোনে কথা বলার সময় যতক্ষণ পর্যন্ত কাউকে “ইংরেজির জন্য ১ টিপতে হবে” এবং বাজারজাত পণ্যে বহুভাষিক লেবেল থাকবে ততক্ষণ বুঝতে হবে ইংরেজি ভাষা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যারা জানেন না তাদের জন্য বলি, এখানে প্রিসেবা পাবার জন্য টেলিফোনে ফোন করা্র সময়ে ইংরাজি বা স্প্যানিশ ভাষা পছন্দ করার সুযোগ থাকে। ১ টিপলে ইংরাজি, ২ টিপলে স্প্যানিশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে এদেশে ইংরাজি রক্ষাকারীদের এখানেই ভয়। তাই যখন বিশ্বজুড়ে ভাষা পেশাদাররা এই দিবসে ভাষাগত বৈচিত্র্য বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে, তখন আমেরিকাতে, মাতৃভাষা দিবসটি হল মাতৃ-ইংরেজিকে রক্ষা করার জন্য, অন্য কোনও ভাষা নয়। শুধু আমেরিকা নয় বহু ভাষাভাষী অনেক দেশেই এই সংশয় বোধ কাজ করে রাজনীতিবিদদের মধ্যে, প্রকাশ্যে তা বলা না হলেও। 

সারা ভারতে তিন হাজারের ওপর মাতৃভাষা আছে, তার মধ্যে ২৩টি সরকার স্বীকৃত। ২৮টি রাজ্য ও ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই সকল বহু ভাষাভাষী মানুষদের বাস। সেই অর্থে বলতে গেলে বহু ভাষাভাষী মানুষ তাদের নিজ নিজ রাজ্যের সরকার স্বীকৃত ভাষায় পড়াশুনা করেন, মাতৃভাষায় নয়। একই ভাবে বাংলাদেশে ৩৮ ভাষাভাষী মানুষ আছেন যারা তাদের মাতৃভাষায় পড়াশুনো না করে তাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলায় পড়াশুনো করেন। বাংলা ভারতের একটি প্রাদেশিক ভাষা। এ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, আসামের বরাক উপত্যকায়, কেন্দ্র শাসিত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা ভাষাভাষীদের বসবাস। আর বাংলাদেশে সংবিধানের তৃতীয় আর্টিকেল মোতাবেক দেশটির রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী। ভারতে হিন্দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার পক্ষে মত দিয়ে থাকলেও, এবং লোকমুখে এবং রাজনীতির খেলায় হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বলা হয়ে থাকলেও, ভারতের কোনও সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা নেই। এখানে বাংলাদেশের সাথে ভারতের একটা বড় তফাৎ। এদেশে ত্রি-ভাষা নীতিতে রাজ্যে পড়াশুনা ও রাজ্য সরকারী কাজে মাতৃভাষা, হিন্দি এবং ইংরাজি যথাক্রমে ব্যাবহার করা হয়। তথাকথিত হিন্দি আগ্রাসনের তা আর সঠিক ভাবে পালন করা হচ্ছে না। বহু ভাষাভাষী দেশগুলোতে প্রত্যেক ভাষার নাগরিকরা আজকের দিনে যদি দাবী করে বসে যে আমরা আমাদের মাতৃভাষাতেই পড়াশুনো করব, সেই অঙ্গীকার, আবেগ যদি তাদের মধ্যে প্রবলভাবে জেগে ওঠে, সে আবেগ ও উদ্দীপনা যদি রাজনীতির হাওয়ায় আরও প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, তখন দেশটির সরকারী পরিকাঠামোতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছায় তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা আছে কিনা সেটা ভাবার বিষয়। আজ যদি পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, মাহ্লি উপজাতিরা এবং বাংলাদেশের চাকমা সহ ২৭টি উপজাতিরা তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় পড়াশুনো ও চাকুরির অধিকারের আন্দোলন করে তাহলে তা বাস্তবায়ন করা কি উপায়ে যাবে বা তা করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকবে কিনা সে নিয়ে ভাবতে হবে। হতে পারে শতাংশের বিচারে  তারা জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ কিন্তু তা বলে কি তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়াশুনো ও চাকুরিতে মাতৃভাষার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হবে? তাহলে এই দিবস যাপনের সার্থকতা কোথায়? আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সময়ে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জটিলতা মাথায় রাখতে হবে। 

বিজ্ঞানের অগ্রগতি যখন ছিল না তখন  পাহাড়ের একধারে একভাষা অন্যদিকে অন্য ভাষা গড়ে উঠত। বিভিন্ন জনপদের মধ্যে সহজ বিনিময় নিয়ত সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, যাতায়াত সম্ভব ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে বানিজ্যের হাত ধরে, পরিব্রাজকদের হাত ধরে, সম্রাটের পৃষ্টপোষকতায় ধীরে ধীরে ভাষার বিকাশ ঘটত। এখন ইন্টারনেটের যুগে, মুঠোফোনে সমস্ত পৃথিবী হাতের মুঠোয়। আন্তর্জাতিক বাজার, তার গ্ল্যামার, চাকচিক্য, আমাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি সব কিছুকে দ্রুত পালটে ফেলে দিতে বাধ্য করছে। এই বিশ্বায়ন বাড়বে বই কমবে না। ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা-বৈচিত্র তাই এখন হুমকির কবলে। বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিবিধতা না থাকলে পৃথিবীটা একঘেয়ে লাগবে। আমার মাতৃভাষা কে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার – আর কারও নয়। সেটা আমরা বুঝব কবে?

একুশে ফেব্রুয়ারী সমস্ত বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গর্ব। ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মান্যতা এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু একটা কথা বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। এই দিবসটি কিন্তু বঞ্চনার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিবসও বটে। সেটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই এই দিবসটির পূর্ণ মুল্যায়ন হবে।