পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা
শিল্পী নাজনীন
৮
দিনগুলো ক্রমশ গুমোট হচ্ছে কেমন। শহরের উপকণ্ঠের এই ভেতরকার রাস্তালাগোয়া দোকানটাতে বসেও দিব্যি সেই গুমোট হাওয়ার আভাস মিলছে আজকাল। কদিন হল মিঠুন রাতে বাড়ি ফিরছে না সময়মত। হয় অনেক রাতে ফিরছে, নয়ত ফিরছেই না। চিন্তায়, শঙ্কায় আধমরা সময় কাটছে অনীল-সুনেত্রার। ফোনও বন্ধ রাখছে ছেলে। হুটহাট কোনো অচেনা নম্বর থেকে ফোন দিয়ে ‘ভালো আছি, চিন্তা কোরো না’ বলেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে মিঠুন, দীর্ঘ সময়ের জন্য আবার সে ডুবে যাচ্ছে রহস্যের অতলে। বাড়ি ফিরেও তার আচরণ অদ্ভুত, উত্তেজিত আর অসহিষ্ণু। অনীল কেন যেন পছন্দ করতে পারছে না ছেলের এই হঠাৎ পরিবর্তন। সে নিজে শান্তিপ্রিয় ছাপোষা মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে সে থাকেনি কোনোদিন, মিঠুন থাকুক সেটাও চায় না সে নিজে বা সুনেত্রা কেউই। কিন্তু সবকিছুই তাদের চাওয়ামাফিক ঘটবে এমন নয়। ছেলে বড় হয়েছে, তার নিজস্ব মতামত, পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে, তাতে তো বাধা দিতে পারে না তারা। উচিতও হয়ত নয় সেটা। কিন্তু নিজেদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিরক্তি কিংবা হতাশাই বা কী করে গোপন করবে তারা! এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে সরকারিভাবে, আন্দোলনে ছাত্রলীগকে লাঠিয়াল বাহিনী হিশেবে এবং পুলিশকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। অবস্থাদৃষ্টে ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রতি প্রথমদিকে তাচ্ছিল্য দেখানোয় এখন সরকারের লেজেগোবরে অবস্থা ধরা পড়ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে এখন ভুল করছে সরকার। গতকাল থেকে কথা নাই, বার্তা নাই ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস এ্যাপ সব বন্ধ করে দিয়েছে তারা। কিন্তু এই প্রজন্ম কি এতটাই বোকা? তারা ভিপিএন দিয়ে কাজ সারছে। যে কোনো মুহূর্তে ইন্টারনেট আর মোবাইল ডাটাও বন্ধ করে দিতে পারে সরকার, এমন গুজব ভাসছে হাওয়ায়। সব দেখে মনে হচ্ছে সরকার নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে, হয়ত দেশেরও, ভেবে একান্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অনীল।
চারদিকে কেমন অস্বস্তিকর নীরবতা, জমাট নিস্তব্ধতা, যার ভেতর যেন এক অচেনা চাপা উত্তেজনাও মুখ লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। যেন-বা ওঁত পেতে আছে কোনো ক্ষুধার্ত অজগর, মওকা পেলেই যে কোনো মুহূর্তে যে গিলে ফেলবে পুরো দেশ। অনীলের বুকের ভেতর চাপ লাগে। অস্থির বোধ করে সে। সুনেত্রাকে দোকানে রেখে উল্টোপাশের চায়ের দোকানটাতে গিয়ে বসে অনীল। ভ্যাপসা গরমে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষজন চায়ের কাপ হাতে গল্প করে, আড্ডা দেয়। এখন তাদের প্রসঙ্গ একটাই, দেশের বর্তমান হালচাল। সবার কথার ফাঁকেই টের পাওয়া যায় দুশ্চিন্তা। দেশের অস্থিরতা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। দিনশেষে সবাই শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়।
ইদানীং মিঠুনের হাবভাবও অনেকটাই অপরিচিত লাগছে তাদের। কখনো গভীর রাতে দরজা খোলার শব্দে হকচকিয়ে ওঠে অনিল-সুনেত্রা; কখনো-বা সারারাতের জন্যই গায়েব হয়ে যা মিঠুন। মাঝে মাঝে বন্ধু বারিষকে সঙ্গে নিয়ে ফেরে, দুজন দরজা বন্ধ করে কীসব শলাপরামর্শ করে, দেখে সুনেত্রা ভয়ে আধমরা হয়ে যায়, তার মনে অদ্ভুত সব শঙ্কা ভর করে। আড়ালে কাঁদে সে, জানে অনীল। শান্তিপ্রিয়, নির্ঝঞ্ঝাট আর নির্বিরোধী একজন মানুষ সে, ছেলের এই পরিবর্তন মানতে পারে না কিছুতেই। অথচ সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস হয় না তার।
এই যে ফোন বন্ধ রাখে ছেলে, হঠাৎ হঠাৎ অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে বলে—“ভালো আছি, চিন্তা কোরো না” তারপর আবার মিলিয়ে যায় অন্ধকারে, কথাগুলো ভীষণ নির্লিপ্ত আর সাধারণ, কিন্তু তার ভেতরেও কেমন অদ্ভুত এক রহস্য লুকিয়ে থাকে। একসময় যে ছেলেটি রীতিমত আড্ডা জমাত, গল্প করত, বাবা-মায়ের কাছে মনের সব কথা বলত, এখন সে যেন পুরোপুরি অপরিচিত একজন, অচেনা আগন্তুক কোনো। ওষুধের এই দোকানটা অনীল আর সুনেত্রা দুজনে সামলে যা আয় করে তাতে তাদের ছোট্ট সংসারটা নির্বিঘ্নে চলে যায়। আসছে বছর মিঠুনের পড়াশোনার পা্র্ট ঘুচলে সে তখন কোনো একটা চাকরিতে ঢুকবে, হাল ধরবে সংসারের, এতটুকুই স্বপ্ন ছিল তাদের। বেশি কিছুর আশা তারা করেনি কোনোদিন। কিন্তু মিঠুনের হঠাৎ এই পরিবর্তন তাদেরকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলছে ক্রমশ।
সুনেত্রা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে খুব। বরাবর চাপা স্বভাবের সুনেত্রা মুখে কিছু বলছে না যদিও। সংসারের খুঁটিনাটি, বাজার-ঘর গোছানো, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ- সব তার ঘাড়েই। সাথে দোকানটাতেও সে সময় দেয়, অনীলের সহকারী হিশেবে যতটা পারে করে সে। কিন্তু আজকাল এসব কিছুতেই মন বসে না তারও, খেয়াল করেছে অনীল। দিন-রাত ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করছে। প্রতিবার মিঠুন দরজায় পা রাখলেই তার তীব্র দৃষ্টি তিক্ষ্ণ হয় আরো, কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন আছে কি না, চেহারায় কোনো আতঙ্ক ফুটে আছে কি না, তন্নতন্ন করে খোঁজে। অথচ ছেলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, রুক্ষ গলায় বলে, কী যে বিরক্ত কর তুমি, মা! কী অত দেখ বলো তো!
আহা মিঠুন! কোনোদিন যদি বাবা হোস, তখন বুঝবি মা-বাবার কত চিন্তা হয়!
-বলে ছেলের সামনে থেকে চলে যায়, আড়ালে গিয়ে চোখ মোছে সুনেত্রা। দেশের পরিস্থিতিই তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয় আরো। ছাত্ররা আন্দোলনে নামলেই চড়াও হচ্ছে ছাত্রলীগ আর পুলিশ। টেলিভিশনের পর্দায় রক্তাক্ত ছাত্রদের ছবি, ভয়ঙ্কর সব ভিডিওফুটেজ। দেখে সুনেত্রার বুক কেঁপে ওঠে। যদি মিঠুনেরও এমনটা হয়? -প্রশ্নটা তার নিঃশ্বাস থামিয়ে দিতে চায়।
অনীল এসব খবর পারতপক্ষে দেখে না, এড়িয়ে যেতে চায়, কিন্তু এড়ানো যায় না। চা-দোকানের আড্ডায় বসা মধ্যবয়সীদের আলোচনা জমে ওঠে। ‘এই সরকার আর বিশিদিন টিকব না! তাগো বিদায়ঘণ্টা বাইজা উঠছে! প্রতি পদে তারা ভুল করতাছে। পুরা ব্যারাছ্যারা লাগায়া ফালাইছে’ -টুকরো কথাগুলো কানে আসে অনীলের। সে ভাবনায় ডুবে যায়। গতকাল হঠাৎ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ কোনো ঘোষণা ছাড়া বন্ধ করে দেওয়ায় শুধু যে যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে এমন নয়, বরং মানুষের মনে ভয়ের ছায়া আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আড্ডারত কে একজন হঠাৎ বলে, যা ভাবতাছেন তা কলাম হইব না, দ্যাশের উপ্রে কালা মেঘ নাইমা আইতাছে, শিগগিরই ট্যার পাইবেন আপ্নেরা!
অনীল ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে। কারণ মিঠুনও তো এখন মাঝে মাঝেই বাইরে রাত কাটায়। মুখে সে কিছু না বললেও, অনীল-সুনেত্রা দুজনেই জানে যে, আন্দোলনেই জড়িয়ে পড়েছে ছেলে! পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কী হবে? জেল, কোর্ট-কাছারি, মামলা! ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না ছেলেকে।
মিঠুনের ভেতরেও টানাপোড়েন চলে সকলের অগোচরে। অনীল অতটা বুঝতে না পারলেও, সুনেত্রা কিছুটা টের পায়। ছেলের চোখের ভেতরে সে এক ধরনের তীব্র আলো দেখতে পায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যে আলো বদ্ধপরিকর, সব জঞ্জাল পুড়িয়ে দিতে যে দীপ্র। হয়তো ক্যাম্পাসে কিছু ঘটেছে, হয়তো বন্ধুরা তাকে টেনে নিয়েছে আন্দোলনের ভিড়ে। আবার হয়তো শুধু নিজের অস্থির তারুণ্যই তাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কত কিছুই হতে পারে। মায়ের মন শুধু ছটফট করে অজানা শঙ্কায়, অচেনা ভয়ে।
রাতে মিঠুন অনেক দেরিতে ফিরল আজ। দরজা খুলল অনীল। ছেলের জামায় ধুলো, চোখে লালচে আভা।
কোথায় ছিলি সারাদিন?
প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্নটা সে করল ছেলেকে। মিঠুন চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকাল, থমথমে গলায় বলল, বাড়ির বাইরেও মস্ত একটা দুনিয়া আছে, বাবা। সবসময় চোখ বুজে থাকলে চলবে না। দেখছ না সারাদেশের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছে? আমি কি তাদের বাইরের কেউ? আমি কীভাবে এসময় ঘরে বসে থাকব?
মিঠুনের কথায় অনিলের বুকের ভেতরটা ঝড় উঠল ভীষণ। সে বুঝল, ছেলের পৃথিবীটা বদলে গেছে হঠাৎ। সেখানে প্রবলভাবে জেগে উঠেছে আরেক পৃথিবী, যা রুখবার সাধ্য তাদের নাই।
সকালে পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে, কাছের মোড়টাতে রাতে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে ছাত্রদের। কয়েকজন ছাত্র ধরাও পড়েছে, কয়েকজন না কি আহতও হয়েছে। দোকানে বসে কাস্টমার সামলাতে সামলাতেই অনীল-সুনেত্রা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নীরবে একে অন্যকে পড়ে। দুজনের মনে একটা প্রশ্নই উঁকি দেয়, মিঠুনও কি সেখানে ছিল?
প্রশ্নের উত্তরটা তারা জানে না। মিঠুনও বলে না। শুধু মাঝে মাঝে নিঃশব্দে খাওয়ার টেবিলে এসে সে বসে, চুপচাপ খায়, তারপর উঠে যায় নিজের ঘরে। সুনেত্রা চুপিচুপি ছেলের ঘরে গিয়ে দেখে, টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু পোস্টার, লিফলেট। তার একটাতে লেখা, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’!
বুকটা ধ্বক করে ওঠে সুনেত্রার। লিফলেটের স্লোগানটার দিকে তাকিয়ে গা গুলিয়ে ওঠে তার।
রাতে খাবারের সময় অনীল গম্ভীর স্বরে বলে, বাবা, রাজনীতি করলে করবি, তার অনেক সময় পাবি জীবনে, কিন্তু আগে পড়াশোনাটা তো শেষ কর। জীবনটা এভাবে নষ্ট করে ফেলিস না। আমাদের ভয় হয়, বাবা।
মিঠুন কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে, তোমরা ভয় পাও, তোমরা শুধু ভয়ই পেতে জানো। কিন্তু ভয় পেলে তো কিছুই বদলাবে না, বাবা। এই ঘুণে ধরা সিস্টেমটাকে তো বদলাতে হবে, তাই না? আর সেজন্য আমাদেরই কিছু একটা করতে হবে। অন্তত চেষ্টা তো করতে পারি আমরা!
শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনীল। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
আজকাল সুনেত্রা ঘুমোতে পারে না একদম। সারারাত জেগে থাকে, এপাশ-ওপাশ করে, ছেলের কণ্ঠস্বর তার কানে বাজে। তার মুষ্টিবদ্ধ হাত আর প্রত্যয়দৃঢ় মুখটা চোখে ভাসে। ‘আমাদেরই কিছু একটা করতে হবে!’
এই দৃপ্ত উচ্চারণের অর্থ সে জানে না, শুধু বুঝতে পারে, দিনগুলো আর আগের মতো থাকবে না তার। তার ছেলেটা আর আগের মত লক্ষ্মীমন্ত হয়ে বুকের মধ্যে সেঁধোবে না কোনোদিন, তার চোখে এখন নতুন জগৎ, নবীন স্বপ্ন। বাবা-মার উৎকণ্ঠিত মুখ, জলভেজা চোখ আর ফেরাতে পারবে না তাকে। ভাবতেই জলে ভরে চোখ, কান্নার দমকে হেঁচকি ওঠে তার। লিফলেটে লেখা স্লোগানের কথাটা সে অনীলকে জানায়নি, জানালে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে!
তার মনে হয়, দেশের ওপর যেন অজানা এক ঝোড়োমেঘ জমছে একটু একটু করে। আকাশজোড়া মেঘে ঢাকা পড়েছে আলো, বাতাসে গুমোট অস্বস্তি। মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা। অনীল-সুনেত্রার সংসারও যার ভারে টালমাটাল। তাদের এখন একমাত্র চিন্তা মিঠুনের নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ। কিন্তু মিঠুনের চোখে যে তীব্র আলো, তা নিভে যাওয়ার নয়, বরং মুহূর্তেই তা পুড়িয়ে দিতে পারে বিশ্বসংসার ।
*******************************