মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মতাদর্শ হলো ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ
– ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না-থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?
আমার মনে হয় ভালো থাকা আর না থাকাটা অবশ্যই রাজনৈতিক ঘটনা।
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টা্র কথিত “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড” সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
২০২৪ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনটি একটি বহুমাত্রিক লড়াইয়ের সমন্বয়। দীর্ঘ ১৭ বছরের ধারাবাহিক দু:শাসন ও বি রাজনীতিকরণের ফলাফল হিসেবেই এই আন্দোলনের শুরু আর যার পরিণতিটা হলো অত্যন্ত শোচনীয়। আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম দল হয়েও এদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ( শোষণ বঞ্চনার অবসান ও গণতান্ত্রিক ধারা) কে ভূ লুন্ঠিত করেছে বিধায় মানুষ তার সহজাত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তার পতন নিশ্চিত করেছে । বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অবশ্যই মার্কিণ সমর্থনপুষ্ট একজন সর্বজন ব্যক্তি এবং তার এই বক্তব্যের ব্যখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন এবং দিবেন। নিশ্চয়ই জাতি তার বক্তব্যের অর্থগত জায়গাটি খুঁজে বের করবে কোন একদিন। তবে নানান মতাদর্শের ও পথের মানুষদের নানামাত্রিক অংশগ্রহণে এই আন্দোলন সূচিত হয়েছে এবং এখানে স্বার্থন্বেষী মহলেরও যোগসাজস থাকাটা অমূলক নয়। যারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। বরং ভিন্ন পথে নিতে আগ্রহী যার নানামাত্রিক প্রকাশও ইতোমধ্যে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে এটা একটি কোটাবিরোধী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেখানে সাধারণ ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?
৫ আগষ্টের রাজনৈতিক রদবদেলের পর সারাদেশেই একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশে আইনশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই বারবার সামনে চলে আসে। সারাদেশের মানুষই একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন সে সময়টিতে।
জুলাই-অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জুলাই আন্দোলনকে কেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে মূল্যায়ন করতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। জুলাই আন্দোলন কোন মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। আমরা একটা দু:শাসনকে হটিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্যই এ লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। বৈষম্যবিলোপ, গণতন্ত্রহীনতারোধ, জবাবদিহিতা আর রাজনৈতিক পরিবর্তনটিই এখানে মূল্য ছিল।
এত রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। প্রধান উপদেষ্টার বলা ‘রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি’ প্রচারিত হবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
জুলাই অভ্যত্থানের পর থেকে নানান বিতর্কিত বক্তব্য আমরা লক্ষ্য করেছি। এর মধ্যে রিসেট বাটন চাপ একটি উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের নানান স্থাপনা ভাংচুর, মাজারে হামলা, নির্যাতন, খুন, দখল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে হেয় করার নানান অপচেষ্টা করেছি নানান গোষ্ঠী। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবির ও এ সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান বিতর্ক সৃষ্টি করেই যাচ্ছে । বাংলাদেশের কোন বিবেকবান ও মুক্তিযুদ্ধের মর্মধারণ করা ব্যক্তি এই অপতৎপরতাকে মেনে নেয়নি, নিবেও না। মুক্তিযুদ্ধের স্থানে আর কোন কিছুর স্থান হবে না, এ জাতি মানবে না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, সবচেয়ে গৌরবোজ্জল স্মৃতি।
জুলাই-অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে–সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী–যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করতে চায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিরা। তাদের প্রধান লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারণকারী সকল কিছুকে ধর্মীয় কট্টরপন্থা নিয়ে প্রতিস্থাপনের হীন চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই সকল উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বরাবরই চায় বাংলাদেশকে আরেকটি আফগানিস্তান বানাতে। কারণ তাদের মূল মতাদর্শীক জায়গাটিই হলো ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ। তাদের দারা কখনই কোন গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আর তার প্রমাণও আমরা পাচ্ছি সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের উপর যে নিপীড়ন ও নির্যাতন তারা শুরু করেছে তা থেকেই। একটি নারী বিদ্বেশী উগ্রগোষ্ঠী দেশব্যাপী নারীর স্বাধীন চলাচল ও মতপ্রকাশে ভয়াবহভাবে বাধা প্রদান করে যাচ্ছে।
ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইসলামিস্ট দলগুলো কোনভাবেই বহুত্ববাদে বিশ্বাসী নয়। তারা এই গণআন্দোলনে কৌশল হিসেবে বহুত্ববাদের এই শ্লোগানকে মেনে নিয়েছিল কিন্তু মনে ধারণ করেননি। তাদের প্রকৃত স্বরূপ দিনকে দিন বের হয়ে আসছে।
বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?
বাংলাদেশের দ্বিতীয় রিপাবলিক ধারণাটা কি তা এদেশের একজন সাধারণ জনগণকে জিজ্ঞেস করলেই তার উত্তর মিলবে। এক কথায় হাস্যকর ও খুবই হালকা একটা আলাপ এটি। বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ শহীদের রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ । এ নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ এ জাতি দিবেনা। আর যদি কেউ এই আলোচনাকে এগিয়ে নিতে চায়, তারা সুস্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরেুদ্ধে অবস্থান করবে।
দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
লক্ষ লক্ষ মানুষ সাম্প্রতিক গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন যার যার ক্ষোভ, না পাওয়া, শোষণ, বঞ্চনা, ভোটাধিকারহীনতা, বৈষম্যবিলোপের স্বপ্ন নিয়ে। এই আন্দোলনের সবার চাওয়া এক ছিলো না, এখনও এক না। তবে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক, প্রকৃতপক্ষে সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি দেশ হিসেবে দেখতে চাই। ধর্মের নামে, পরিবারের নামে, প্রতিক দিয়ে কিংবা টাকা ও ক্ষমতা দিয়ে যে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই রাজনীতিরও অবসান চাই। একজন সৎ ও দেশপ্রেমীক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থাবান যেকোন মানুষই যেন আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার, নির্বাচিত হওয়ার মতন জায়গায় দাড়াতে পারেন। দেশটা যেন সত্যিকার অর্থেই সকলের দেশে পরিণত হয়। তবে আওয়ামী দু:শাসনের বিচারও হতে হবে এ মাটিতে। যার যে অপরাধ তার বিচার নিশ্চিতও করতে হবে। এক্ষেত্রে দায়মুক্তির কোন সুযোগ নেই।
আপনাকে ধন্যবাদ।
*****************************
ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
ও সম্পাদক, পরিবেশ বার্তা।
*****************************