স্বপ্নরা ব্যবচ্ছেদ হয়
জাকিয়া শিমু
আচমকা ভিনদেশী হট্টগোলে অনভ্যস্ত উইলিয়াম কেরি বেশ ঘাবড়ে যায়! একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু সব ঠিকঠাক চলছিল। দেশ ছেড়ে বহুদূরের এই মহাদেশে মার্জিত গোছের একটি দেশিবিয়ের আয়োজনের কোন ঘাটতি ছিল না। যেমন টেবিলভর্তি জিভে জল আনা খাবারদাবার, বড়-কনের বাদশাহী বিয়ের সাঁজগোঁজ,দুপক্ষের লোকদের বাহারি দেশি পোশাকআশাকের ঝকমকা চাকচিক্য এমন কি মৃদু বাজনায় সানাইয়ের সুর- মোটকথা একটি অভিজাত বিয়ের আনুসাঙ্গিকতার কোন কমতি ছিল না। তবে আয়োজনের শুরু থেকে বিয়ের এই অনুষ্ঠানে প্রাণচাঞ্চল্যের মাত্রাছাড়া ঘাটতি চোখে পড়ার মতো ছিল এবং সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই! এবং তা এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অল্প পরিচিত লোকজনও পরিষ্কার টের পেয়েছে!
এমনকি উইলিয়াম কেরি’র পাকিস্থানী বংশোদ্ভূত বন্ধু অর্থাৎ আজকের বিয়ের বর শোয়েব এবং বাংলাদেশী কনে ফাইজার মধ্যে আতঙ্ক ছিল তাঁদের সম্পর্কের শুরু থেকেই। সম্পর্কে এরা তিনজন ভালো বন্ধু এবং হার্ভার্ড ল’ স্কুল থেকে সবেমাত্র পাশ করে কর্মক্ষেত্রে যাই যাই করছে। কেরি, তার প্রিয় দু’বন্ধুর বিয়ের অয়োজনে শুরু থেকে আঠার মতো লেগে আছে যাতে শেষপর্যন্ত কোন ঝামেলা না বাঁধে।
ফাইজার দাদা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। সাত নম্বর সেক্টরের হয়ে। সে বীরত্বগাঁথা ইতিহাস বাংলাদেেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সগর্বে লিখিত আছে। তার দাদা বাংলাদেশের গর্ব। ফাইজা, দাদির কাছে ছোটবেলায় সেসব গল্পকথা শুনে শুনে বড়ো হয়েছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে দাদীর সেসব গল্প। শুধু দাদা কেন! মুক্তিযুদ্ধে দাদার চেয়ে দাদীর ভূমিকা কি কম ছিল। দাদার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাটি তা কি নগদে প্রমান দেয় না!
বর্ষাকাল। আকাশ দখল করে আছে কৃষ্ণবর্ণের অভিমানি মেঘেরা। শুধু কি মেঘের তোরজোড়! একটু পর পর আকাশ ফুটো করে ফোঁটায় ফোঁটায় ভৈরবিরাগে ঝরে পড়ছে ভারি বৃষ্টি বাদল। মুখ্যত বিক্রমপুর নিচু এলাকা। তাই বর্ষাকালে বেশিরভাগ এলাকা ডুবে থাকে পানির নিচে। তারওপর এবার মেঘবৃষ্টির বাড়াবাড়ি চলছে সমানতালে! বৃষ্টির তোরে নদী ফুলেফেঁপে গাঁয়ের জায়গাজমি, ঘরউঠোন সবটা দখল করে নিয়েছে। উঠোনভর্তি পানি, বাতাসে নদীস্রোতের মতো বইছে। নদী এবং ডাঙার তফাৎ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে! এমন ঘোরদুর্যোগকালে ঘরের দরজাজানালা দিনের বেলায়ও খিল ঠেশে বন্ধ রাখা হয়! খুব সাহসীরাও বেড়ার ফুটু দিয়ে বাইরে তাকাতে আঁতকে ওঠে! পাকিস্থানী সেনারা সশস্ত্রসাজে এলাকায় টহল দিচ্ছে! গাঁও গেরামের মানুষ, ইহজন্মে মিলিটারি দেখে নাই। এখন দোর খুলতে চোখে পড়ে,অস্ত্র তাক করে জলজ্যান্ত মিলিটারি জলের ছাদে নৌকোয় ভেঁসে আছে!
পশ্চিমপাড়ার জাহেদার মা,মিলিটারি কী জিনিস বাপের জন্মে দেখে নাই! ভোরসকালে বাহ্যে সারতে ঘরের বাইরে যাবে ভেবে কপাট খুলতে, সামনে দেখে নৌকা ভর্তি মিলিটারি তার উঠানে ভেসে বেড়াচ্ছে! চোখের সামনে একসাথে এত মিলিটারী দেখে,আতঙ্কে গলাছেড়ে এমন চিৎকার দিয়েছে, দম বন্ধ হয়ে নগদে মরেছে!। অবশ্য লোকে বলে ভিন্ন কথা! জাহেদার মায়ের মরার কারন নাকি মিলিটারির ভয়ে নয়! জাহেদার মা সাহসী মহিলা। মিলিটারি কেনো আস্ত রাক্ষসের দলও তাকে টলাতে পারে না। তার সাহসের তারিফ তিন গাঁয়ের মানুষ করে। আসল ঘটনা নাকি নিজের ছেলেকে মিলিটারির সহযোগী দেখে, কষ্ট সইতে না পেরে দম ফেটে মরেছে!
কথা অবশ্য মিথ্যে নয়! গাঁয়ের বহু মানুষ মিলিটারির সাথে আঁতাত করে নিজেদের অপছন্দের মানুষগুলোকে ধরিয়ে দিয়েছে। বিধর্মী কিংবা স্বজাতি কেউ রেহাই পায় নাই! পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেছে, এমন খবরে,পুরোপরিবারকে তুলে নিয়ে শতশত লোকের সামনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছে- এমন নজিরের কোন আকাল নাই দেশে! ভিনদেশী মিলিটারির সাধ্য কী, এদেশের মানুষ চিনে! কে যুদ্ধে গেছে কিংবা কার কোন ধর্ম এসব তাদের জানার কথা নয়। যদি না কাছেরমানুষ এদের চিনিয়ে না দেয়! ফাইজার দাদি, নিজ চোখে এমন অনেক আপনজনকে রাজাকার বনে যেতে দেখেছেন! এরা খামাখা ধর্মের দোহাই দেয়! ভিনদেশী আলখাল্লা পরে, চোখে সুরমা ঘষে! মসজিদের উঠোন যারা কোনোদিন মাড়ায়নি তারা মুখের উপর একগুচ্ছ দাড়ির চাষ করে! এরা আসলে ধর্ম নয়, নিজস্বার্থের ফায়দা লুটাতে পাকিস্থানী সেনাদের হাতের পুতুল হয়ে হাজার হাজার নিরীহজনদের হত্যায় সহায়তা করে! মেয়েদের জোরজবরদস্তিতে তুলে নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়! রাজাকারদের ইশারায় পাকসেনারা মানুষ ধরে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়-যাদের বেশিরভাগ ঘরে ফিরে আসে না, যারা ফিরে আসে তারা আগের সেই মানুষটি হয়ে ফিরতে পারে না। নির্মম অত্যাচারে এরা প্রায় মৃতের সমান হয়ে ফিরে। চোখের সামনে বন্ধু- স্বজনের নির্মমমৃত্যু তাঁদের বাকিজীবনে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
সেসময়ে দাদির কোলে ফাইজার এক বছর বয়সী ছোটো ফুফু। চাচার বয়স সবে দুই আর বাবা পাঁচ বছর বয়সের! দাদি বদ্ধঘরে এসব অভুক্ত বাচ্চাদের আটকে রেখে কোনমতে প্রানগুলো বাঁচিয়ে রাখেন! দাদা ভিতু প্রকৃতির মানুষ। জানালার ফুটো দিয়ে বানেরজলে ভেসে বেড়ানো মিলিটারির ডিঙিনৌকার গতিবিধি দেখে আর ভয়ঙ্কর আতঙ্কে গ্লাসের পর গ্লাস পানি পান করে। ওদিকে বাড়ির পাশে বয়ে চলা নদীতে ভেসে আসে সারি সারি লাশ! কোথা থেকে কে জানে,ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন খবর পেয়ে উড়ে আসে এই এলাকায়। এলাকার টিউবওয়েলগুলো পানির নিচে। খাবার পানি বলতে নদীর সাথে মিশে যাওয়া বর্ষার নোংরাজল। পুরোগ্রামেজুরে চলে কলেরার তাণ্ডব। ফাইজার দাদাও আক্রান্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধমৃত্যুর সাথে যোগ হয় কলেরার মৃত্যু! বাতাস ভারি হয়ে উঠে নিকটজনের লাশের গন্ধে! অসুখবিসুখ, ক্ষুধা আর যুদ্ধের ভয়াবহতায় ঘরবন্ধী মানুষগুলো্র দিবা-রাত্র কাটে ঘুটঘুটে অন্ধকার কবরের মত নিস্তব্ধ যন্ত্রণায়। সমূণখ মৃত্যুভয় গাছের জটার মতো অষ্টেপৃষ্টে ঝাপটে ধরে তাদের।
এমন একটা সময়ে অমাবস্যার রাতে ফাইজার দাদা দাদি আনাড়ি হাতে নাও বেঁয়ে দূরগাঁয়ের এক আত্নীয় বাড়ি আশ্রয় নেয়। জায়গাটি মোটামুটি নিরাপদ। তাদের এলাকার মতো মিলিটারি ঘিরে থাকা নয়। দূরে অবশ্য মিলিটারি ক্যাম্প আছে। কিন্তু দু’দিন না যেতে তাঁরা টের পায়, এ বাড়ির সাথে পাক সেনাদের সম্পর্ক বড়ো মধুর! ফাইজার দাদীর পরিবার এক ভাগাড় ছেড়ে অন্যভাগাড়ে যেয়ে পড়ে! সামনে পেছনে সরবার পথ বন্ধ। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় দাদা ভেঙ্গে পড়লেও এমন এক পরিশ্রিতির মুখোমুখি হতে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়ান! ভীতু দাদার বুকে কোথা থেকে বীরভুমের সাহস জেগে ওঠে!তিনি রাতের অন্ধকারে সে-বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। দাদির সহযোগে এমনতর ঘটনা ঘটলেও,ভোরবেলায় দাদির নিপুণ অভিনয়ের কৌশলে সবাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, মিলিটারি দাদাকে ধরে নিয়ে গেছে!
পাঁচ মাস পর, যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করে দাদা বাড়ি ফিরে আসেন। এই পাঁচমাস দাদীর তিনটি বাচ্চা নিয়ে বেঁচে থাকার গল্প শুনে যে কারো শিউরে উঠার কথা! “অবশেষে তাঁরা স্বাধীন দেশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করিল” আদতে উপন্যাসের শেষ লাইন এর মতো যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের বাস্তব জীবনের গল্প মিলে না! দাদা চাকরি হারালেন! এবং চোখের সামনে ছায়াছবির মতো সমস্ত দৃশ্যপট খুব দ্রুত বদলে গেল! যুদ্ধের সময় অনেকের হাতে অবৈধ অস্ত্র চলে আসে। কেউ কেউ সেসব জায়গামতো জমা না দিয়ে ডাকাতি জোরজবরদস্তি লুটপাটে নেমে যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বেশভূষা বদল করা সেই গিরিগিটিদল,স্বাধীন দেশেও দাপটের সাথে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন কৌশলে কাঁচা টাকার পাহাড় বানাল! লক্ষ শহীদের আত্নত্যাগের বদলে পাওয়া স্বাধীনদেশটি নানান অরাজকতায় ছেয়ে গেল! ফাইজার দাদার মতো বেশিরভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে,মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পর্যন্ত জুটল না! অথচ যুদ্ধবিরুদ্ধ-পার্টি বুক উঁচিয়ে সার্টিফিকেটের সমস্ত সুবিধাদি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং স্বাধীনদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসনে অনায়াসে ঢুকে পড়ে! অথচ একসময় পশ্চিম পাকিস্থানীদের অত্যাচারের জবাব দিতে যারা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করল, পঙ্গু এবং নিঃস্ব জীবন নিয়ে ঘরে ফিরল, তারা স্বজাতির বিশ্বাস ঘাতকতায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে রইল! দাদা ভয়ঙ্কর মানসিক কষ্ট এবং আফসোস নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন! এসব শুধু ফাইজার দাদির মুখের গল্প নয়,এটা আসলে যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেরশের প্রকৃত ইতিহাস!
ফাইজার জন্ম বাংলাদেশে হলেও তার বেড়ে ওঠা এই দেশে অর্থাৎ উত্তর আমেরিকায়। বাবা আমেরিকায় পাকাপোক্ত হয়েছেন,তাও প্রায় বছর কুড়ি কেটে গেছে। তার পরিবার দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে সবসময় বিশেষ যত্নে লালনধারণ করে আসছে। ফাইজা নিজেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনেপ্রাণে ধারণ করে। বাংলাদেশের জন্যে তার পরিবারের মতো তারও হৃদয় কাঁদে। দেশপ্রেমে তার মধ্যে একফোঁটা ঘাটতি নেই। দেশীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে সে তার ভিনদেশি বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের মাঝে তার বাঙালিসংস্কৃতি সহজে ছড়িয়ে দিতে পারছে। বিশ্বায়নের এসময়ে একগুঁয়েমিতে নিজেদের বেঁধে রাখতে প্রচণ্ড অনীহা ফাইজার। তার মতে বহিঃবিশ্বে বাঙালিদের পিছিয়ে পড়ার মূখ্য কারন বাঙ্গালী ক্ম্যুনিটি নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে রাখা। ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বিরোধ কিংবা দূরত্ব রেখে নিজেদের সংস্কৃতিকে অন্যের কাছে পরিচিত করা যায় না। বাবার সাথে তার এ বিষয়ে প্রায়ই কথা হয়। বাবা নিজেও এ বিষয়ে পরিষ্কার নন, কেমন যেন একরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অনেকটা শীতকালীন কুয়াশার মতো তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নিজস্ব পরিচিতির আকালে বিপর্যস্ত ভারাক্রান্ত মন সবসময় মিইয়ে থাকে। অবশ্য মেয়ের কথাগুলো তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। বিশ্বায়নের এ সময়ে সময়সুযোগ মতো যে যার জায়গা বদল করে পুরোপৃথিবীকে একটি এককদেশে রূপ দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবী নামের সে বিশাল দেশের মানুষগুলোর বুকজুড়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির লালনপালন চলছে এবং দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। সংস্কৃতি এমন একটি মাধ্যম যাকে ব্যবহার করে নিজজাতির পরিচয় খুব দ্রুত অন্যজাতির কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আমাদের নিজস্ব বাঙালিজাতিসত্ত্বা পৃথিবীর মাঝে ঠিকঠাক সময়ে প্রকাশ করতে না পারলে আমরা ক্রমেই পরিচয়শূন্য হয়ে পড়ব। নতুন প্রজন্ম সংস্কৃতির এর বাহক, এদের সে সুযোগ না দিলে ভবিষ্যতে বাঙালিজাতি কিংবা আমাদের নিজস্বসংস্কৃতি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে! বাবা স্থিরচোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে একাধারে এসব কথা শোনে যায়। যেন নিজের মেয়ে নয়, ক্লাসে বসে শিক্ষকের বক্তিতা শুনছে! মেয়ের সাথে দ্বিমত করার কোন যুক্তি খোঁজে পায় না কিন্তু তারপরও তার মনের দ্বিধা কাটে না!
ফাইজা আইন বিষয়ে পড়ছিল, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। শোয়েবের সাথে সেখানেই তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। শোয়েব অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিত ছেলে। একসময়ে দুজন দুজনের মনের পিঁড়িতে অনেকটা অজান্তেই বসে গেছে এরা। ফাইজা নিজের ভেতরের চণ্ডাল ইচ্ছেটাকে বাস্তবতায় নিয়ে আসতে বাবা-মায়ের সাথে শোয়েবের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে। শোয়েবের ব্যবহারে তারা মুগ্ধ হয়। কিন্তু ফাইজা যখন শোয়েবের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত পরিবারকে জানায় তখন তারা খুব শক্তভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়! তার একমাত্র কারন, শোয়েব পাকিস্থানী ! বাবার কড়া হুঁশিয়ারি, শত্রুদেশের সাথে সম্পর্ক মেনে নেয়া হবে না! শোয়েবের পক্ষও তথৈবচ। মেয়ের বাড়ি বাংলাদেশে ! মেয়ের সমস্ত যোগ্যতা নিমিষেই পম্পেই নগরীর মতো চাপা পড়ে যায়। তাদের কাছে সমস্তটা ছাপিয়ে মেয়ের জন্মস্থান বাংলাদেশ নামক জায়গাটির প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণার প্রকাশ মুখ্য হয়ে ওঠে!
অথচ পশ্চিম পাকিস্থানের বেশিরভাগ সাধারণ জনগণ, পূর্ব পাকিস্থানের সাথে যুদ্ধের পক্ষে ছিল না। তারা কঠোরভাবে এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাঁদের মতামত বিভিন্নভাবে জানিয়েছে, রাস্তায় মিটিং মিছিল করে ক্ষোভ দেখিয়েছে। সাধারণ মানুষ স্বভাবত যুদ্ধের বিপক্ষে থাকে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার সিকিভাগও সাধারণ জনগণের স্বার্থহাসিলের জন্য হয়নি। সবগুলো যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল দেশপ্রধানের দম্ভ, ক্ষমতা, স্বার্থ। যুদ্ধ, মানুষের সাথে মানুষের হয় না, যুদ্ধ হয়- রাজায় রাজায়, ক্ষমতা দখলের,তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের। ক্ষমতা, স্বার্থ,দম্ভ ভাগাভাগি হয় রাজায় রাজায়, প্রজার স্বার্থ সেখানে অবান্তর। প্রজারা দাবারগুটি, খেলে রাজায় রাজায়। যদিও যুদ্ধের জের পুরোটাই পোহাতে হয় সাধারণ জনগণের, জানে মালে নিঃস্ব হয়ে।
এরপর দুপক্ষ বিয়ে বিষয়ে প্রায় বছরখানিক বেঁকিয়ে বসে থাকে। একসময় আকাশের ঘনকালো মেঘেরপোড় খানিকটা হলেও হালকা হয়ে আসে কিন্তু পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। তারপর অবশ্য দুপক্ষের নিমরাজিতে হলেও বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। এবং বিয়ে উদ্দেশে দেশের বিভিন্ন ষ্টেট থেকে ফাইজাদের নিকটজনেরা তাঁদের বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকে বরের পরিচয় ভোঁতামুখে মেনে নিলেও কেউ কেউ বক্রকথার ঝাঁঝ ঝারতে দ্বিধা করে না। দেশি বিয়ে ঝামেলামুক্ত, নির্ঝঞ্ঝাট হয়েছে এমন উদাহরণ বোধহয় দেশিবিয়ের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে দেখা যায় সমস্যার মূলে থাকে বর- কনের লতায় পাতায় প্যাঁচানো আদলের স্বজনেরা। ফাইজা- শোয়েবের বিয়েও শেষপর্যন্ত তার ব্যতিক্রম হয় না। শোয়েবের এক আত্নীয়, ফাইজার দূরসম্পর্কের মামাকে বাঙ্গাল বলায় মুহূর্তে বিয়ের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ -পাকিস্থানের মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু বেঁধে যায়। একসময় চেয়ার প্লেট ছুঁড়াছুঁড়িও বাদ যায় না। একপর্যায়ে দুপক্ষের বেশিরভাগ লোক অনুষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে যেতে শুরু করে!
এমন বিশৃংখল অবস্থায় উইলিয়াম কেরি অনেকটা হাতজোর করে কোনমতে এদের শান্ত করে। সে অবশ্য গত এক বছর বন্ধুদের সম্পর্কের একটি বিহিত করতে দু’পরিবারের বড়োদের সাথে কয়েক কিস্তিতে কথা বলেছে। সে মৃদুস্বরে এবং বেশ যুক্তি দিয়ে গুছিয়ে কথা বলার দক্ষতা রাখে। দুপক্ষ তাকে বেশ পছন্দ করে এবং এদের কাছে তার একটি সন্মানজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। তার অনুরোধে দুপক্ষের লোকজন হলরুমে দাঁড়িয়ে পড়ে! সে কি বলতে চায় তারা শুনতে ব্যগ্রতা দেখালে কেরি তার ব্যক্তিগত জীবনের একটি ঘটনা বলতে শুরু করে।
“১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ,জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে ধরা হয়। আমার বাবা জার্মান আমার মা পোলিশ এবং আমার বান্ধবী ফ্রেঞ। আমাদের পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারন এবং তার ভয়ানক পরিণতির কথা সবাই জানি। আমরা সাধারন জনগণ, শাসকশ্রেনির কেউ নই! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমাদের দেশগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং পরিণামে আমরা আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি! অথচ যুদ্ধেরকারন আমরা সাধারন জনগণ ছিলাম না, এমনকি আমাদের একফোঁটা স্বার্থ কিংবা আগ্রহ ছিল না। সবযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল জার্মান, পোল্যান্ড, ফ্রান্স এবং তাবৎ দুনিয়ায় সাধারণ মানুষ। তারপরও কোটি কোটি সাধারণ মানুষ সে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে!
যুদ্ধ আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কিছু দিতে পারে না কিন্তু আমাদের নিঃস্ব করে নিয়ে যায় সবকিছু! আমারা সাধারণ মানুষ বেশ বোকা। অযথা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থহাসিলে একে অন্যেকে ঘৃণা করি এবং তা বংশ পরম্পরায় জিইয়ে রাখি! আমি আপনাদের দু’দেশের যুদ্ধের ঘটনা জেনেছি। সব যুদ্ধের মতো এখানেও একই ঘটনা ঘটেছে। সাধারন মানুষ ছিল একান্তই দাবার গুটি। আমরা সচেতন হই। যুদ্ধের মতো এমন জঘন্য ঘটনা পৃথিবীতে আর একটি না ঘটুক। আমার বন্ধুদের এমন সম্পর্ক একই ভুলে ভেস্তে যেতে শুরু করেছে। ভেবে দেখার সময় এসেছে, কার স্বার্থে নিজেদের বঞ্চিত করছি! কেরি’র বক্তব্যে দু’পক্ষের লোকজন মাথা নিচু করে যে যার আসনে যেয়ে বসল। এবং ফাইজা-শোয়েবের বিয়ে হল।
**********************