একগুচ্ছ কবিতা
ফেরদৌস নাহার
রডোডেনড্রন জঙ্গলে
সেই পরিচয়ের প্রথম শব্দটি আজও বহন করি
মোহন লাগে কিনা জানি না। হয়তো তারও চেয়ে বেশি
রডোডেনড্রন জঙ্গলে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম
আমাদের আর কেউ ছিল না, শুধুই ছিলাম পরস্পর
এমন প্রেম চোখেই পড়ে না, এসব ভেবেছি প্রাণভরে
এখনো হয়তো তাই ভাবে কেউ অথবা অনেকে
শুধু বলতে ভালোলাগে বলেই কি বলা,তাই কি ভাবা
আলাভোলা রোদ্দুরে গড়পড়তা অহংকারে
যে জানালায় ফুল হয়ে দাঁড়াত কেউ, তার নাম
মনে আছে কী নেই এসব পুরানো ধাঁধার অভিমান
নতুন কাঁথায় মুড়ে ঠিক এসে সামনে দাঁড়ায়
ভোরের মোরগটা ডেকে উঠলেই চমক ভাঙে
দিনের শুরুতে মন কি বলে যায়- মনে রেখো
রডোডেনড্রন জঙ্গলের কাছাকাছি কিংবা দূরে
ঝরাপাতা ফিরে আসে পাতা কুড়াবার ছলে
জন্মান্ধ নদী
এজন্মে নয় আরেক জন্মে, যখন আপনি ছিলেন উড়ন্ত ঈগল আর
আমি ছিলাম জন্মান্ধ খরস্রোতা নদী
আপনাকে সঙ্গী করে উড়ে যেতে চেয়েছিলাম বিষুবরেখার আকাশে
এসব স্বপ্ন এখন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত, গতজন্মের স্মৃতি বলেই কি
বিজন রোদ্দুর ভেঙে একা একা হেঁটে চলি অজানা পথে
গ্রামের মতো দেখতে, ঠিক গ্রাম নয়, বাড়ির সামনে পুকুরের ছায়া
মাঝরাতের ছায়া, মায়া মায়া। ভুলে গেছি কবে যেন দেখেছি এসব
জন্মান্ধ নদী হয়ে আর জনমে জন্মেছিলাম, পাশে ছিল সাদা ছড়ি
জলের উপরে ছড়ি ফেলে যেতে যেতে ঈগলের পাখা ধরে ফেলি
তখন আকাশে ছিল ঘুড়িদের প্রবল ওড়াউড়ি, সব ছিল, কিছু ছিল না
অন্ধত্ব দূরে বসে দেখেছিল চোখের বিষণ্ন কারসাজি
এখন কিছুই দেখি না
কয়েকশো বছরের পুরানো ডিকস্টা
কবিতাগুলো ভেঙে যাচ্ছে, যা কিছু দিতে চাই তাই ভেঙে যায়
টানা গদ্যের আলখেল্লা গায়ে কবিতারা সটান হেঁটে চলছে
আমার বয়স যখন বৃষ্টিদিন, সাইকেল চালিয়ে যাব বলে
প্যাডেলে চাপ দিয়েছি, সে যাওয়া এখনো থামেনি
ঝরা পাতার সাথে উড়ে উড়ে বৃষ্টি গায়ে মেখে
আমার সাইকেল যায় দূর কোনো পর্তুগিজ শহরে
যেখানে গিটার বাজিয়ে গান গায় কয়েকশো বছরের পুরানো ডিকস্টা
নদীদের নামের আগে মহান শব্দটি যিনি ব্যবহার করেন
তাঁর সন্ধানে কত দিনরাত্রি। এখন কবিতারা ভেঙে যাচ্ছে
গদ্য এসে হাপরে বাতাস নিচ্ছে, আমাদের জানালা ধুয়ে মরুবৃষ্টি
আমি জানতাম এভাবেই পুবের বৃষ্টিরা পথ ভুলে কারো কাছে নয়
কবিতার কাছেই যাবে আর তার হাড় ভেঙে ডুগডুগি বাজাবে।
আজিজ কাজলের কবিতা
সোনালু মৃদু ॥
ভাঙা হারিকেনের মোচড় দেয়া চাঁপা গন্ধের ভাঁজে,
সন্ধ্যার মিছরি মাখা নরম আলো—পাটিগণিত ছেড়ে হঠাৎ কবুতর হয়ে ওড়ে যেতাম ঘন রাতের পল্লবে।
শেফালি নদীর ডোরা ভাঙা জলে, ডুবে আছে মাছ ও মাধুরীর গল্প—মমতা-লেপা দাগগুলা শুকিয়ে ওঠে; শুকনো কান্নার খাঁটি থেকে, স্বাস্থ্যকর প্রোটিনগুলা ফালি ফালি কাটা।
মিউজিয়ামে গিয়ে দেখি, প্রত্যেকটি সরল মানুষের মুণ্ডু আর মগজ-জীবন খুব যত্ন করে সাজানো।
ঢেউ মেহেদি ॥
থামের গলুই ভেঙে খুবলে ওঠে গত-গতরের সহস্র জড়তা, জমা হয় কিছু আলাফালা ভ্রুণ—
তাহারা, এতো ভুল গন্ধ দিনেও খুলে আনে আউশ ধানের থান—মাঝির নোলক ভাঙা উচাটন সুর,
আরও বেশি হয়ে ওঠে দরদি।
এত্তোসব অচেতনায় এখনো মজে আছি সেই-কাছাকাছি; আছে দুর্লভ মেহেন্দি ঢেউ।
তাহারা, তরুণ বোমা—সারা রাত ভরে পাটা-ওতার ঘষা মারে—বেরিয়ে আনে নব-পৃথিবীর ঘুণ, সবল কান্নার জুঁই।
নাগরিক কাশবাস ॥
সিনথেটিক নরম ঘাসে লুকিয়ে আছে মানুষপোকা।পরিবেশবাদী পোকাগুলো ফুটন্ত কড়াইয়ে অঙ্গার হচ্ছে; তাদের রেশমি সুতার বাকল পিষে তৈরি হচ্ছে অনাহূত ঝড়ের ইতিহাস—এখানে নম্র-শরতের কোনো এন্ট্রি নেই।আছে বড় সড় কোনো ফটোফ্রেমের ভ্রম; শুকনা দলা।
কংক্রিট মাচাঙের ভুল ডালে লতিয়ে ওঠি, হয়ে যাই অধীর নাগরিক-ছাওয়াল—শত্রু-ঘন অন্ধকার ছেড়ে দাঁড়াই উঠানে।
শরৎফুলের মৌ-ঘাট ফেলে, গো-ধুলার গরুগুলা বাড়ির কাছে আসছে—এদিকে আবারও ভুল পাঠে লিখে ফেলি শরতের নতুন কবিতা!
হিস্ ॥
ঢেউ-তোড়ে ভেসে যায় পৃথিবীর সমস্ত দ্বিধা ও সন্ন্যাস
কিছু ঢেউ অতল ও অভিজাত
কিছু ঢেউ ক্ষুধা ও ওষুধ—
পৃথিবীর সমস্ত ডালপালা
একটি অন্নভুক পাত্রের পাশেই বসবাস করে।