কোনো পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের চরিত্র এমন হয় না
– শাহাব আহমেদ
আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না- থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?
না, ভালো থাকা না থাকা রাজনৈতিক ঘটনা নয়, ব্যক্তিজীবনের ভালো মন্দ ঘটনাগুলো একে গড়ে তোলে, প্রভাবিত করে। দেশের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো অসংখ্য অনুঘটকের একটি মাত্র অর্থাৎ দেশে যখন অস্থিরতা থাকে মানুষ ভালো থাকতে পারে না, সে উৎকণ্ঠিত ও অস্থির থাকে।
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টার কথিত ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
যখন পটপরিবর্তন ঘটছিল, তখন যেভাবে দেখেছি, ঘটে যাবার পরে সেভাবে দেখছি না। দু:শাসন যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, যা হয়ে উঠেছিল আমাদের দেশে, তখন মানুষ তার পরিবর্তন চায়। জুলাই আগস্টের ঘটনাগুলো ঠিক পরিবর্তনের ডাক নিয়ে শুরু হয়নি, যদিও অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সেটাই ছিল, সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সহকারে। ঘটনার গতিপ্রকৃতি, ব্যবহার, ভায়োলেন্স, একই সাথে বিভিন্ন থানায় আক্রমণ ও পুলিশ হত্যা, সরকারি বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া মানুষের পাশাপাশি ছায়া শক্তির হাতে মানুষ নিহত হওয়া এবং সরকার পতনের সাথে সারাদেশে একই দিনে সব মনুমেন্ট, ভাষ্কর্য ও মূর্তি ভেঙে ফেলা, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি ইউক্রেনের ইওরো মাইদান স্টাইলের একটি “কালার রেভ্যুলিউশন” এর হুবহু চিত্র তুলে ধরে। কোনো পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের চরিত্র এমন নয়। মেটিকিউলাস পরিকল্পনার কথাটি সত্য মনে হয়। তার প্রস্তুতি ও ট্রেনিং আমেরিকান দুতাবাসে বহুদিন ধরেই যে চলছিল তার তথ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে বের হয়ে এসেছে এবং আসছে। সুতরাং এই পরিবর্তনটি স্বতস্ফুর্তভাবে হয়নি এবং যে সরকার গঠিত হয়েছে তাও কাকতালীয় নয়। কিন্তু ক্ষমতায় অন্ধ মানুষগুলো এই ষড়যন্ত্র সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে সামান্য কোটা আন্দোলনের সমাধানের দিকে না গিয়ে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ফলে আন্দোলন সেই পরিণতির দিকেই যায়, স্বাধীনতার চেতনার ধাপ্পার আড়ালে ক্ষমতাসীনরা দেশকে যেখানে নিয়ে যেতে চাইছিল।
“জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল?
যাকে আমরা বলি abyss বা সর্বনাশের নিতল গহ্বরে।
আমরা সেখানেই পৌঁছেছি।
তারা সফল হয়েছে, তারা মানে ১৭ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল। এই সাফল্যের শ্লোগান কোনটি? জয় বাংলা? নারায়ে তাকবীর? পাকিস্তান জিন্দাবাদ?
তবে একদল ক্ষমতায় বসে ছড়ি ঘুরিয়ে যত ধরনের অন্যায় আছে তা করবে এবং প্রতিপক্ষ তাদের উৎক্ষাত করে ক্ষমতা দখল করার জন্য মেটিকিউলাস পরিকল্পনা করবে না এমন প্রতিশ্রুতি কেউ দেয়নি। সুতরাং এ খবর শুনে যারা বিস্ময়ের বৃক্ষ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে, ভাঙছে বা ভাঙবে তাদের জন্য করুনা হয়।
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?
স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যদি জনগণের রক্ত ঝরায়, তা আর স্বাধীনতার শক্তি থাকে না, মুখে তারা যাই বলুক। সুতরাং তাদের পতন হওয়া সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে কাম্য ছিল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে শুধুমাত্র লুণ্ঠনের কিছু বেনিফিসিয়ারি ছাড়া। ঘরে যখন আগুন লাগে মানুষ সেই মুহূর্তে আগুনের থেকে রক্ষা পেতে চায়, কোনো চেতনা বা আগামিকাল কী হবে তা নিয়ে ভাবে না। যে ভাবে, সে সেই মুহূর্তে আগুনের লেলিহান জিভের মধ্যে নেই, আছে দূরের কোনো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে। তাদের হাত পা চোখ কান মুক্তিযোদ্ধার তকমা বা টাইটেল থাকলেও তারা বিবেক প্রতিবন্ধী। এবং এই প্রতিবন্ধীরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বলেই তাদের ধারণা হয়েছে যে দেশে গণহত্যা চালানো বা গণহত্যা সমর্থন করার চিরন্তন অধিকার পেয়ে গেছে এবং দেশের মানুষ তা চিরদিনই মুখ বুজে মেনে নেবে।
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?
প্রথমে যখন কোটা আন্দোলন শুরু হয় তখন মনে হয়েছিল যে বিষয়টির সমাধান হয়ে গিয়েছিল তিনবছর আগে, সেই বিষয়টিকে আবার তুলে আনা হয়তো এক দুষ্ট নারীর নতুন কোনো দুষ্ট পরিকল্পনার অংশ। তবু উঠে যেহেতু এসেছে, সংখ্যালঘু উপজাতি এবং নারীদের জন্য সামান্য কোটা রেখে বাকি কোটা তুলে দিয়ে বিষয়টির তড়িঘড়ি সমাধান করে ফেলা উচিত। ১৯৭১ সালে নগন্য কিছু স্বাধীনতা বিরোধী ও শিশুরা ছাড়া দেশের সবাই যুদ্ধ করেছে। অস্ত্রহাতে যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ নয় এবং স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে যে দেশে দারিদ্র, বঞ্চনা ও প্রতারণা এত প্রকট অবশিষ্ট কিছুর মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোনো কোটার দরকার নেই, তাদের কেউ এখন আর স্কুল কলেজে যাচ্ছে না। তারা কোটা পাবার জন্য যুদ্ধ করেনি। তাদের সন্তানদের বা নাতি-পুতিদের জন্য কোটা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নামে অন্য সব ভাওতার মতই অলিখিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বন্দোবস্ত স্থায়ী করা।
পরে যখন রক্তপাত শুরু হল, তখন দ্বিতীয় কোনো চিন্তা ছিলো না, রক্তপাত বন্ধ হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাব্যবসায়ীদের দু:শাসন দূর হোক। কিন্তু যা আমি কল্পনা করিনি বা চাইনি, যে এতদিন সিংহীনির মত গর্জন করেছে সে ইঁদুরের মত পালিয়ে যাবে। এখানেই তার সাথে তার পিতার পার্থক্য, দেশের জন্য যিনি জীবন দিতে দ্বিধা করেননি।
দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকলে এই প্রাণিটি দেশে থাকতো, ঘৃণ্য এরশাদ থেকেছে, ঘৃণ্য সেও থাকতো, জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে দেশের মানুষের পাশেই থাকতো। তাহলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলেও মাঠ পর্যায়ের কর্মিদের নিয়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতো এবং সে যেই পরাজিত শত্রুদের তার উত্তরসুরী হিসেবে এতকাল ধরে তৈরি করেছে তারা খালি মাঠ পেতো না, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বা তাঁর পবিত্র বাড়িটি স্পর্শ করার আগে একশবার চিন্তা করতো। সে জানে না যে, পালানো ইঁদুর জনতার ঘৃণার থুথুতে সাঁতরানো গ্রিজুন।
জুলাই অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
১৯৭১ এবং ২০২৪ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ১৯৭১ সাল ছিল আমাদের স্বাধীকার ও আইডেনটিটি ফিরে পাবার বছর। এত রক্তপাত বাংলার ইতিহাসে আর কখনও হয়নি, এত ত্যাগ বাঙালির এর আগে কখনও করতে হয়নি। আমরা একটি স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতার অবিসম্বিত নেতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
কিন্তু তিনি একাই যুদ্ধ করেছেন, একাই দেশ স্বাধীন করেছেন এবং বাংলাদেশে আর কোনো নেতা ছিলো না, এবং এই দেশটা তারই, তার বিপথগামী সন্তানদের জন্য এই বিকৃতিটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে বিগত ১৭ বছর, কিন্তু সত্য সম্পূর্ণ ভিন্ন, এটা সবাই জানে, একজন ছাড়া। এই বিকৃতির ফল, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হচ্ছে সর্বত্র। পৃথিবী কার্য-কারণ সম্পর্ক মেনে চলে, প্যারানয়া দিয়ে নয়। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় মৃত্যুর কথা বলেছিলেন, প্রথম মৃত্যুর পরে আওয়ামী লীগের কিছু সৎ নেত্রী ও নেতার কল্যানে তিনি আবার বেঁচে উঠেছিলেন তুলনামূলকভাবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই, মনে হয় না দ্বিতীয় মৃত্যুর পরে তা আবার ঘটবে এত দ্রুত।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট হচ্ছে দুর্বহ স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির আরও একটি দিন, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের দিনটির মতই, কম নয় বা বেশিও নয়।
২০২৪ সালকে ১৯৭১ সালের সাথে তুলনা করা বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস বলা হচ্ছে স্বাধীনতার ইতিহাস না-জানা, শেখ হাসিনার শাসনামলে বেড়ে ওঠা এবং মিথ্যার ক্ষার গেলানো নবীন প্রজন্মের মুখ দিয়ে নেপথ্যের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ইতিহাস বিকৃতির বহি:প্রকাশ। এই প্রজন্ম যদি স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে থাকে, তারা যদি “তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার” শ্লোগান দেয় তার দায়িত্ব অন্য কারো কাঁধে চাপানোর আগে বলতে হবে এর সিংহ দায়িত্ব শেখ হাসিনার, কারণ এরা বড় হয়েছে তার আমলে, দিনরাত তার মিথ্যাচার শুনে। সে তা না করলে নতুন প্রজন্ম পরাজিত শক্তির ভাষ্য ও মগজ ধোলাইয়ের খপ্পরে পড়তো না।
এতো রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। রিসেট বাটন চেপে দেয়ার ঘোষণা দেবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
স্বাধীনতার চেতনার শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতার স্টিম রোলার চালানোর সময়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে জনগণের অর্থের অপচয় ও অপহরণ করে মসজিদ মাদ্রাসা বানিয়ে, শিক্ষার কারিকুলাম পরিবর্তন করে ধর্মীয় মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা
হয়েছে নগ্নভাবে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যাতে না থাকে দুর্বৃত্তদের এটা ছিল একটি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতির কন্যা স্বাধীনতা নস্যাত করার এই পরিকল্পনার সভাপতিত্ব ও বাস্তবায়ন কেন করল আমার কাছে তা স্বচ্ছ নয়। হয়তো সময়ই তার উত্তর দেবে।
কোনো দেশের বস্তুগত আপাত উন্নতি দেখিয়ে সম্পূর্ণভাবে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া, তার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেবার চতুর পরিকল্পনার এমন বাস্তবায়ন ইতিহাসের কুটিল ও নষ্টতম নেতা-নেত্রীর দ্বারাই হয়েছে, কোনো দেশপ্রেমিক নেতা এই কাজ কোনোদেশে করেনি।
শূন্যতা থেকে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল আদ্যার জরায়ুতে কিন্তু শূন্য থেকে কোনো সমাজ সৃষ্টি হয়নি, হয় না। ভালোরা যখন মন্দ কাজ করে, তখন মন্দরা এসে রিসেট বাটন টেপার সুযোগ পায়। পূর্ববর্তী সরকার রিসেট বাটন টেপার পূর্বশর্ত ও শক্তি তৈরি না করে গেলে এ কাজটি করা কখনই সম্ভব হয় না।
জনগণের অর্থ অপচয় করে একই সময়ে মসজিদ গড়া ও ভাস্কর্য গড়া দূরদর্শিতার অভাব বা দুষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল করার দুরভিসন্দী। বাংলাদেশ ভাস্কর্যের মূল্যায়ন করার দেশ নয়, তাকে চিরদিনই সরাসরি ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও মিউজিয়াম ভাঙার আমি তীব্র নিন্দা করি কিন্তু আমি বিস্মিত হইনি। কারণ এটাই হবে এই ভয়টা আমার মধ্যে বহুদিন ধরেই ছিল। যারা দেশের সর্বজনীন দুর্বত্তায়ন ও লুণ্ঠনের সময়ে নীরব ছিলেন কিন্তু আজ ছি ছি রি রি করে সোচ্চার, নাকের জল ও চোখের কেতুর মাখামাখি করে ফেলছেন, আমি সেই বিহ্বলিত বন্ধুদের বলি, Don’t pretend like you didn’t see it’s coming.
রাশিয়ায় যখন অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হয় সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি যিনি অক্টোবর বিপ্লবকে গ্রহণ করেছিলেন অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে, লিখেছিলেন The twelve নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা, কিন্তু সেই আলেক্সান্দার ব্লক যখন দেখলেন বিপ্লবের নামে রিসেট বাটন চেপে রাশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সৌকর্য, সৌন্দর্য ও নান্দনিকতাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই কষ্ট ও হতাশায় মাত্র ৪২ বছর বয়সে তার রুগ্ন হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন করতে অস্বীকার করে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়তে শুরু করে, এবং তিনি লেখেন, “সব শব্দ থেমে গেছে, তোমরা কি শুনতে পাও না যে, কোথাও
আর কোনো শব্দ নেই?”
আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি, যারা ক্ষমতায় এসেছে বা আসবে আমি তাদের মুখে আলো দেখি না, দেখি মধ্যযুগীয় অন্ধকার। তারা যাকে সামনে রেখেছে তিনি শিক্ষিত ও বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি কতটুকু বিশ্বস্থ তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, যত সময় যাচ্ছে প্রশ্ন ততই বাড়ছে। কিন্তু তার সভাপতিত্বে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, দীর্ঘ সময় নিয়ে বাধাহীনভাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙা ও একের পর এক যে দু:খজনক ঘটনাগুলো ঘটে চলছে, মনে হচ্ছে না তা নিয়ে তিনি খুব একটা চিন্তিত। তিনি হয়তো শুধুই ‘ডেকোরেটিভ ফিগার’, সিদ্ধান্ত নেয়ার বা দেয়ার মূলব্যক্তি নন। তাকে দিয়ে যাদের কাজ করিয়ে নেয়া দরকার তারাই তা করে নিচ্ছে। এবং দ্রুত নির্বাচন এই শক্তিগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী, সুতরাং যতদিন নির্বাচন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব তারা তাই করবে।
অন্যদিকে বিশ্বাস বা ভরসা করার মত মানুষ আর নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শ্লোগান দেয়া বেশিরভাগ বুদ্ধিবৃত্তির মানুষের মুখগুলো ধারালো দাঁতের বরাহের মুখের মত অনুতাপহীন। তাদের
থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল, কারণ সৌম্য মুখের মন্দের পুজারীরা চিরকালই ঐক্যবদ্ধ।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে- সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী- যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করার কারণেই প্রতিচ্য সামনে এগিয়ে গেছে এবং পৃথিবীকে শাসন শোষণ ও বিকৃত মূল্যবোধ আরোপ করার সুযোগ পেয়েছে। মুসলিম শাসকরা যতদিন রাষ্ট্রচালনায় ধর্মীয় কট্টরদের দূরে রেখেছে, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ধর্মের নাগপাশে বেঁধে না ফেলে বরং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, ততদিনই মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য সঙ্গীত ও সংস্কৃতির আলোতে জ্বল জ্বল করেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে একটি মুসলিম দেশও নেই যেখানে ইওরোপের দরিদ্রতম খৃষ্টান দেশটির সমান মানবাধিকার
বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়।
পিছিয়ে যাবার জন্য ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিকল্প কিছু নেই। আফগানিস্তানে বা ইরানে উদয় হয় না দিনমুনি, অন্ধকার হাঁটে পথে ও ফুটপাতে, সকালে, মধ্যদিনে, সন্ধ্যায় ও মধ্যরাতে।
ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
যে ধর্মটি শুরুর থেকেই একত্ববাদী- বহু পথ বহু মত কখনই সহ্য করেনি, ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সেক্টে ভেঙে গেছে, রক্তারক্তি করেছে এবং এখনও করছে, একে অন্যকে স্বীকৃতি দেয়নি, সহ্য করেনি, তা বহুত্ববাদ দিতে সক্ষম বলে আমার বিশ্বাস হয় না। অথচ আধুনিক যুগ বহুত্ববাদের যুগ, সব মানবগোষ্ঠীকে সমান চোখে দেখার যুগ। সবাইকে সমান অধিকার না দিলে, “ধর্ম ব্যক্তির, রাষ্ট্রের নয়”- এই দৃষ্টি দিয়ে না দেখলে বহুত্ববাদ ফাঁকা শ্লোগান হবে। রাষ্ট্র মানুষ নয়, সুতরাং তা ইসলামী, খৃষ্টান বা হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারে না, কোথাও সেই দাবী কেউ করে থাকলেও তা ভুল, তা গ্রহণ করা হবে ভ্রান্তপথে হাঁটা। ওই পথে বেশি দূর যাওয়া যায় না। এবং নারী মুক্তি বহুত্ববাদের একটি মূল স্তম্ভ হতে হবে, কারণ সমাজের অর্ধেক মানুষ হচ্ছে নারী, তাই “নারী সঙ্গম করার পশু নয়, মানুষ” এই সত্যটি লংঘন করা যাবে না।
বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?
দ্বিতীয় রিপাবলিক আমরা দেখেছি ফরাসি বিপ্লবের পরে, টেররের পরে কাউন্টার টেরর, বিশৃংখলা ও নিরাপত্তাহীনতা, তাই নেপোলিয়নের স্বৈরশাসনের পথ খুলে দিয়েছিল। আমাদের প্রয়োজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় রিপাবলিক নয়, শুধু রিপাবলিক। ৫৪ বছর আগে আমরা স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি এবং শ্লোগান পেয়েছি, স্বাধীনতা পাইনি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল স্বাধীনতা সংহত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং স্বাধীনতাকে বিপথগামী করার সমস্ত শর্তগুলো পুরণ করে সমাপ্ত হয়েছে। আমাদের যা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিতসা, নিরাপত্তা, কথা বলার অধিকার, ট্রাফিক জ্যাম ও চাঁদবাজদের থেকে মুক্তি- আমরা চাই এই অপ্রাপ্তিগুলো নিশ্চিত করা হোক।
খুব বেশি চাইছি?
না, এগুলো মানুষের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার।
ইতিহাস স্পর্শ করার প্রয়োজন নেই, ১৯৭১ কে ২০২৪ দিয়ে গুলিয়ে ফেলার দরকার নেই, সময়ের একটি মাত্র মুখ, সামনের দিকে, সময়ের মুখ পেছনের দিকে ফেরানোর চেষ্টা অপচেষ্টা।
দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাঙলাদেশ দেখতে চান?
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, না- আদর্শ, না-ধর্ম, না-রাজনীতি। মাটি, জল, পরিখা দেশ নয়, দেশ হল সেই ভূখণ্ডের মানুষ। চাই মানুষের মূল্যায়ন হোক তার যোগ্যতা অনুসারে। দুর্বৃত্তদের ক্ষমতায় আরোহণ বন্ধ হোক। স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস থাকুক। মানুষ সে মুসলমান হোক, হিন্দু হোক, খৃষ্টান হোক, বৌদ্ধ বাউল বা বৈষ্ণব হোক তাকে তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে দেয়া হোক। প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো হোক সদ্ভাবের বন্ধু, প্রভু নয়। আমাদের কোনো রাষ্ট্রের সাথেই স্বামী-স্ত্রীর বা নাগর-রক্ষিতার সম্পর্কের প্রয়োজন নেই।
এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের মুখের শ্লোগান থাকুক “জয় বাংলা”, যা সমস্ত বাঙালির আত্মার অনুরণন কিন্তু কোনো দুর্বৃত্তদলের বা তাদের কানা সমর্থকদের মুখোশ নয়।
********************************
শাহাব আহমেদ
কথাসাহিত্যিক
********************************