মরা সাহেবের গেঞ্জি
হিমাদ্রি মৈত্র
(১)
বালিচকের অর্ধেন্দু মন্ডল তার ন্যাংটো বয়সের পাড়াতুতো বন্ধু সুজিত বিশ্বাসের নারকেলডাঙা খালপাড়ের ঝুপড়িতে যখন এসে ঢুকলো, তখন খালের জলে বিকালের রোদটাও মরে গেছে। চারপাশে একটা ঝুজ্কি ঝুজ্কি আলো। ঝুপড়ির বাইরেটা যাহোক, ভিতরটা পরিচ্ছন্ন; একটা কোনায় রান্নার ব্যবস্থা, আরেক দিকে তক্তপোষ – তাতে জনাদুয়েক শুতে-বসতে পারবে। গাঁয়ের লোক এলে সুজিতকে আরোপিত আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হয়। অবশ্য ন্যাড়ার কথা আলাদা, সে মাঝেসাঝেই আসে গ্ৰামের লোকের কাজ নিয়ে। কিন্তু এবারের আসাটা অন্যরকম।
ছোটবেলায় অর্ধেন্দুর বাবা-মা তাকে ধরে বেঁধে ন্যাড়া করে দিয়েছিল। সেইথেকে ও ন্যাড়া, যদিও এরপরেও অনেক ন্যাড়া এসেছে-গেছে। এরা দুজন একসঙ্গে বড় হয়েছে, স্কুলে গেছে, কোনোমতে পাশ করে উঁচু ক্লাসে উঠেছে, মিড ডে মিল খেয়েছে। তারপর যখন সেটা বন্ধ হয়েছে তখনও পড়া চালিয়েছে, পেট ভরার মত খাবার না পেয়েও। দুজনেরই বাবারা অন্যের জমিতে খাটতো আর যে সময় কাজ থাকতো না, বড় শহরের দিকে রোজগারের আশায় চলে আসতো। সে সময় কোনো কোনো দিন বাড়ীতে খাবারের টান পড়ত। ইতিমধ্যে স্কুলের গন্ডী পেরোনোর পর সুজিত একে ওকে ধরে কি করে বা কোলকাতার একটা ছোট কারখানায় মজুরের কাজ জুটিয়ে নিল। অর্ধেন্দু পড়ে রইলো গ্ৰামে। আর কাজের চেষ্টা করতে করতেই কোনোরকমে বারো ক্লাসটা পার করে ফেলল।
ন্যাড়ার টানে সুজিত আগেভাগেই চলে এসেছিল ঘরে, হরিহর আত্মা একসময়ের। যদিও অন্যান্য দিন কাজের পর এদিক ওদিক করে ঘরে ঢোকে। রাস্তার কলে হাতমুখ ধুয়ে খাটের উপর এসে বসল ন্যাড়া। সুজিত ততক্ষণে চা করে ফেলেছে। সঙ্গে মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কা। দুজনে মিলে খাটে বসে পড়ল।
“তুই হঠাৎ মামার কাছে আসাম দৌড়াচ্ছিস কেন?”
“কি জানি, ডেকে পাঠিয়েছে, একজনকে দিয়ে টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছে। কেন, কি বৃত্তান্ত, কিছুই জানিনা।”
“দেখিস রে ভাই, ওখানে সারাদিনই কিসব তাড়াও, খেদাও চলে, জেলে না পুরে দেয়।”
“না রে, মামারা এতোদিন ওখানে আছে!”
” তাতে কি, একজনকে জানি, তার স্বামী, ছেলে মেয়ের এদেশের লোক হতে সমস্যা হয়নি, কিন্তু সে নেই রাজ্যের বাসিন্দা।”
এইসব এটা-সেটা, ভাল-মন্দ গল্পে সন্ধ্যা যখন বেশ ঘনিয়ে এল, সুজিত বলল, “চ, শিয়ালদা মার্কেটে ঘুরে আসি। আবার কবে দেখা হবে!”
শিয়ালদা থেকে সুজিত দরদস্তুর করে বন্ধুর জন্য একটা সুন্দর টিসার্ট কিনল। সাদা, শুধু বুকের কাছে টকটকে লাল ছড়ানো, যেন রক্ত ছড়িয়ে আছে, আর তার মধ্যে কোন ভাষায় কি বা একটা হিজিবিজি লেখা। সেই টিসার্ট দেখে পাশের ঘরের রতন বলল, “এতো মরা সাহেবের গেঞ্জী।”
সেই মরা সাহেবের গেঞ্জী গায়ে দিয়েই সে রাতে অর্ধেন্দু গৌহাটির ট্রেনে চাপল। ওখান থেকেই আবার ট্রেন পাল্টে শিলচর যাবে। থার্ডক্লাসের স্লিপার কোচে প্যাসেজের ধারে নীচের বার্থটা পেয়েছিল অর্ধেন্দু, কিন্তু এক বয়স্কা মাসিমা ওপরের বার্থটা পাওয়ায় তাকে নীচেরটা ছেড়ে দিতে হল। যাই হোক, রাতের বেলা কি আর দেখবে! খাওয়া তো সারা হয়ে গেছিল আগেই, টয়লেটে ঘুরে এসে চটিজোড়া সন্তর্পণে সীটের নীচে ভিতরে ঠেলে উপরে উঠে পড়ল সে। ফ্যানটা ঘুরছিল ভালই,অসুবিধা হবার কথা নয়। অতএব সটান, ওখানে বসে থাকাটা খুব সুবিধার নয়। কখন বা সে ঘুমিয়েও পড়ল।
(২)
মার্ক যখন ডেভেন্টার স্টেশনে নামল, তখন সকাল হয়ে এসেছে। গতরাতে সে আমস্টারডাম সেন্ট্রাল থেকে ট্রেন ধরেছিল। গভীর রাতেই ছিল ট্রেনটা। গতকাল দুপুরে ডেভেন্টারের সাইকিয়াট্রিক হসপিটাল থেকে একটা ফোন পেয়েছিল। সেখানে এক ভদ্রমহিলা আছেন, মিসেস গুলিয়েভা, তার কোনো নাগরিক পারমিট নেই। তিনি আজারবাইজানের নাগরিক, শরণার্থী হয়ে নেদারল্যান্ডে এসেছেন। মানসিক রোগী হয়ে পড়েছেন, কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। সমস্ত রকমের চিকিৎসা হয়েছে। তাকে রাখার মত ভাতাও আর হসপিটাল পাবে না। এদিকে সে কপর্দকশূণ্য আর ডাচ ভাষায় একবিন্দু কথা বলতে পারে না।
মার্ক রিপ্যাট্রিয়েশন দপ্তরের কর্মকর্তা, তার উপর ভার পড়েছে গুলিয়েভাকে তার দেশে ফিরিয়ে দেবার। মার্ক ডেভেন্টার যাবার আগেই গুলিয়েভার ফাইলটা পড়ে দেখেছিল। রগচটা, ঝগড়াটে, মারমূখী মহিলা। এদেশে থাকাকালীন কয়েকবার সাজাও পেয়েছেন। চল্লিশের দশকের এক মহিলা। সত্তরোর্ধ বয়স, স্বামীহারা। স্বামীকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই সে মারা যায়। গুলিয়েভাকে তখন চিকিৎসার কারণে পাঠানো যায় নি।
মার্ক ফাইল পড়ে জানল সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর আজারবাইজান আর আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ লেগেই আছে। এরা সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দা, যুদ্ধ শুরু হতে নেদারল্যান্ডে শরণার্থী হয়ে চলে এসেছিল। তার ভাতা শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকেও ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে সাহায্য করার জন্যই মার্কের ডেভেন্টারে আসা।
বাইরে হসপিটালের একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, সেটা মার্ককে পৌঁছে দিল হসপিটালে। বেশ বড় হসপিটাল, এই প্রথম সে এখানে এল। শহরটাও বেশ, ইৎসেল নদীর ধারে। বহু পুরোন শহর। আলাপ-আপ্যায়নের পর হসপিটালের প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে সে দোভাষীর সাহায্য নিয়ে বসল গুলিয়েভার সামনে। ভদ্রমহিলার বয়স যা লেখা তার চেয়ে বেশীই মনে হল। ” আমার স্বামী মারা গেছে”, এভাবেই শুরু হল কথপোকথন। তার বক্তব্য, তারা একসময় যথেষ্ট বড়লোক ছিল, কিন্তু যুদ্ধ সব কেড়ে নিয়েছে। শেষে পালিয়ে আসতে হয়েছে। তার কিছু পেনশন পাওনা আছে। সে খালি চেঁচাচ্ছিল ‘পেনশন্য়্যা ‘, ‘পেনশনয়্যা ‘ বলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তার নামে ঠিকই বেশ কিছু টাকা জমেছে সোস্যাল ইনসিওরেন্স ব্যাঙ্কে। কিন্তু ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট নম্বর না পাওয়ায় সেটা ট্র্যান্সফার করা যাচ্ছে না। এদিকে আর্মস্টারডাম পুলিশ জানালো গুলিয়েভাকে ধরবার সময় তারা কিছু টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল, সে টাকাও সে ফেরৎ পাবে। পুলিশ তার পাসপোর্টও পাঠালো মার্ককে। দেখা গেল সেটাও বহুদিন রিনিউ হয়নি। ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে, মার্ককে এসব আগে সারতে হবে, তারপর ফেরৎ পাঠানো।
এখন কথা হল আজারবাইজানে গুলিয়েভাকে কার হাতে তুলে দেওয়া হবে! তার স্বামী নেই, কে তাকে রাখবে? অবশেষে শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক সংস্থা জানালো গুলিয়েভার গ্ৰামে তার এক ভাইজি থাকে, তানিয়া। সেই তার দেখভালের দায়িত্ব নেবে। এসব কিছু গুলিয়েভাকে জানানোর পর সে বেশ শান্ত হয়ে পড়ল। যেন উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে এসে জাহাজী সবুজ তীরভূমি দেখছে। মার্কের সাথে তার আচরণও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সে নিজের দেশে ফিরতে পারবে আর বেশ কিছু টাকাপয়সাও পাবে, এসব ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
“আজারবাইজান খুব সুন্দর দেশ, এটা একসময় বিরাট সাম্রাজ্য ছিল। “
এরপর মার্কের কাজ হল সমস্ত সরকারী নিয়মকানুন সেরে ফেলা। আজারবাইজানের বিদেশমন্ত্রক থেকে কাগজপত্র জোগাড় করা হল, যাতে ওদেশে ঢুকতে অসুবিধা না হয়। গুলিয়েভার বয়সের কথা বিবেচনা করে ঠিক হল মার্ক তাকে তার গ্ৰামে দিয়ে আসবে। এরপর মার্ক কথা বলল তানিয়ার সাথে। সে জানাল, তারা উদগ্ৰীব হয়ে অপেক্ষা করছে পিসীর জন্য।
মার্ক তার নিজের আর গুলিয়েভার জন্য বাকুর ফ্লাইট বুক করল। এক সপ্তাহ কেটে গেল, দুজনে রওনা দিল বাকুর উদ্দেশ্যে। গুলিয়েভা শান্ত ভাবে বসেছিল। নিজের দেশ, নিজের লোক, নিজের মাটিতে ফিরছে সে। এর চেয়ে শান্তির কি হতে পারে। সেইখানে সে বড় হয়েছে, তার জীবনের গ্ৰন্থীগুলো সব পড়ে আছে সেখানে – তার পূর্বপুরুষ, জল, হাওয়া, মাটি, ফসল, সেই উদার গ্ৰামজীবন। এতদিন পর! তাই সে শান্ত, সমাহিত। বাকুতে পৌঁছনোর পর ট্যাক্সিতে রওনা দিল পাহাড় পর্বতের মধ্য দিয়ে এক বহুদূরের গ্ৰামে-বারকাবের।
আজারবাইজানে ঐস্লামিক সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে আছে প্রাক্তন সোভিয়েত সংঘের নিদর্শন। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অদ্ভুত সুন্দর এই দেশ। অসাধারন জীববৈচিত্র্যের দেশ এটা। কিছুটা এখনো মনুষ্য বসবাসহীন, জংলী; কিছুটা পুরোন জঙ্গলের অবশেষ। প্রকৃতির নিজের হাতে গালিচা বিছানো। মাঝে মাঝে নদী আর ঝরণা। কোথাও বা জলপ্রপাতের আওয়াজ বনে বনে অনুরণিত হয়ে ফিরছে। কাস্পিয়ান সাগর, ককেশাস পর্বতমালার শিখর আর তার গভীর উপত্যকা আর জঙ্গল নিয়ে আজারবাইজান মার্কের কাছে এক অতুলনীয় সৌন্দর্যের দরজা খুলে দিল। শহুরে মন যেন তৃষিত হয়ে ছিল।
আর্মেনিয়া বর্ডারের ধারে ছোট্ট গ্ৰাম বারকাবের। সেইখানেই গুলিয়েভাদের কয়েক পুরুষের বাস। বহুদিন ধরে আর্মেনিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে অশান্তি চলছে। এখানকার বাসিন্দারা এখন গোলাগুলিতে অভ্যস্থ। একটা সময় বহুলোক ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়েছিল। শরণার্থী জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্প শুনে এখন আর কেউ পালায় না। কোথায় যাবে, কে তাদের মেনে নেবে! তার চেয়ে নিজের মাটিতে মরাও ভালো। মরেও তারা।
গুলিয়েভার বাড়ি অনেক গোলাগুলির ক্ষত বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন অতটা না চললেও সমস্যার সমাধান যে হয়নি, সেটা মনে করাতেই মাঝে মাঝেই ফায়ারিং হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকেই এদের লড়াই শুরু হয়েছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যুরিস্ট পার্টি নিয়ে ঘোরে, তার কাছে মার্ক অনেক কিছু খবর জানল। ও কাজের সূত্রে এসবের আঁচ পেয়েছে, কিন্তু এখন মনে হল যেন উনুনে বসানো কড়াইতে এসে পড়েছে। মাঝে মাঝেই যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হয় শুনে মার্ক একটু আতঙ্কেই পড়ল। কে জানে কি হবে!
দুপুর শেষে গাড়ি এসে থামল বারকাবেরে, গুলিয়েভার বাড়ির কাছেই। গাড়ির আওয়াজেই অনেকে এসে জুটল। সকলেরই ধারণা ছিল সে আর বেঁচে নেই। গুলিয়েভা নেমে এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজছিল। একজন মহিলা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আজারী রমণী, এদের শরীরের গঠন ইউরোপীয় রমণীদের চেয়ে আলাদা। মার্কের নজরে পড়ল নিতম্ব আর বুক ভারী, কিন্ত্ত তুলনায় কোমর অনেক পাতলা। তানিয়া গ্ৰামের মেয়ে। যদিও সোভিয়েতের মধ্যে ছিল, পর্দাণশীন না হলেও ঐতিহ্যকে পুরোপুরি ছাড়েনি। সুন্দর সিল্কের রুমাল দিয়ে মাথা ঢাকা, গায়ে কারুকার্য করা শাল জড়ানো তানিয়াকে দেখতে ভালই লাগে। গ্ৰাম্যতার মধ্যেও যেন একটা প্রাচীন রুচিবোধ ঘিরে আছে। হয়তো বিদেশী অতিথির সামনে আসতে হবে বলেই সে নিজেকে একটু বেশী পরিমার্জিত করেছে। মার্ক খেয়াল করল এলাকার পুরুষরা আধুনিক পোষাকেই স্বচ্ছন্দ।
অতিথি আপ্যায়ণ শেষ হলে মার্ক বিশ্রাম নিতে গেল। শরীর আর দিচ্ছিল না। একটা ছোট্ট ঘর, ছিমছাম। বোঝা গেল এরা মোটামুটি স্বচ্ছ্বল পরিবার। তানিয়ার স্বামী মস্কোতে কাজ করে। তানিয়া সংসার চালায়, ক্ষেতের ফসল দেখভাল করে। তাতেও কিছু আয় হয়। এইভাবেই তাদের সংসার চলে। সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর সীমান্ত সমস্যাতেই তারা জর্জরিত।
মার্কের তাড়া ছিল না। হাতে একদিন আছে। সে আর সেদিন ফিরল না। গ্ৰামের এই মাটির গন্ধ মাখা জীবনকে সে আরো একটু উপভোগ করতে চাইল। সে রাতে তানিয়ার পরিবার তাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করল। সে তানিয়াকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝিয়ে দিল। বলে দিল, গুলিয়েভার ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, তারপর টাকা ট্র্যান্সফার হবে। এসব বুঝে নিতে সময় লাগল তানিয়ার। তাছাড়া তার স্বার্থও ছিল ভাল করে বোঝার। কারণ, এদেশের হিসাবে ভালই টাকা পাবে গুলিয়েভা। গুলিয়েভা ভাইজির সাথে যেসব কথা চালাচ্ছিল, তার মধ্যে ‘পেনসনয়্যা’ কথাটাই মার্কের বোধগম্য হল।
পরের দিন সকালে মার্ক গ্ৰাম দেখতে বেরোল। তানিয়া তাকে বর্ডারের দিকে যেতে বারণ করল। সে চলে গেল জল ধরতে। গ্ৰামের মেয়েদের এইটা একটা বড় কাজ। সুন্দর এই গ্ৰাম। একটা আলাদা টাটকা জীবন, যেন বেঁচে থাকার একটা আলাদা মানে আছে, শহুরে জীবনের বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা নয়। সকালটা এভাবেই কাটল মার্কের। দুপুরে খেয়েদেয়ে রওনা দেবে। সেইমত গাড়ি বলা আছে। তানিয়া যত্নআত্তি যথেষ্টই করল। হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে, হয়তো পিসীর কাছে মার্কের অনেক প্রশংসা শুনেছে।
খাওয়া সেরে মার্ক যখন ঘরে তার জিনিসপত্র গুছাচ্ছে, তখন তানিয়া এসে তাকে একটা প্যাকেট দিল। তাতে একটা টিসার্ট। তার আব্দার এটা নিতেই হবে। যদিও এটা সে তার স্বামীর জন্য কিনেছিল, কিন্তু তাকে এটা নিতেই হবে। নাহলে সে এই গ্ৰামের, এই পরিবারের কি স্মৃতি নিয়ে যাবে! টিসার্টটা মার্ক দেখল, সাদা সুন্দর একটা টিসার্ট, বুকের কাছে কি যেন একটা লেখা।
সেটা পরেই সে রওনা দিল। তাতে তানিয়া খুশীই হল। গুলিয়েভাকে সে বিদায় জানাল। বৃদ্ধার হয়তো চোখটা চিকচিক করে উঠল। সে জানে এই লোকটার চেষ্টাতেই সে তার মাটি খুঁজে পেয়েছে।
রওনা দিল সে আবার বাকু্র দিকে। বাকু থেকে আবার প্লেন ধরে ফিরে যাবে নিজের দেশের মাটিতে। গাড়ির ড্রাইভার তার টিসার্ট দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ওখানে কি লেখা আছে জানেন! আজারী ভাষায় লেখা আছে ‘প্রিয়তম’।
বর্ডারের কাছ দিয়ে যখন তারা যাচ্ছিল তখন হঠাৎ ফায়ারিং শুরু হল। হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ির মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার মার্কের গলায় একটা অদ্ভূত আওয়াজ পেয়ে পিছনে তাকাল। মার্ক তার বুকের কাছটা চেপে ধরে আছে। তারাতারি সে গাড়ি থামাল। পিছনের দরজা খুলে সে যখন মার্ককে বের করল, তখন সব শেষ। সাদা টিসার্টের “প্রিয়তম” লেখাটা রক্তে ভিজে জ্বলজ্বল করছে।
(৩)
ধড়ফড় করে উঠে বসল অর্ধেন্দু। অজানতেই হাতটা বুকের কাছে চলে গেল। বেশ ভেজা, রক্ত না ঘাম। স্বপ্নের মধ্যে উত্তেজনাতে ঘেমে গেছে। ধাতস্থ হতে সময় নিল। দেখল বেশ আলো ফুটে গেছে। শরীরটা কেমন ভারী লাগছে। নীচে নেমে এল। মাসিমার গোছগাছ হয়ে গেছে, সীটে বসে আছেন। তারমানে এনজেপি আসছে। ‘কি হল তোমার, দুঃস্বপ্ন দেখেছ বুঝি! গোঙানির আওয়াজ পেলাম।’
দুঃস্বপ্নই বটে, একটু লজ্জা পেয়ে, একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে সে টয়লেটে চলে গেল। স্টেশন আসতে দেরী আছে। টয়লেটে আয়নায় দেখল হিজিবিজি লেখাটার চারপাশে টকটকে লাল রঙ। ওটা কি তাহলে ‘প্রিয়তম’ই লেখা। মরা সাহেবের গেঞ্জী – রতনের কথাটাই কানে বাজতে লাগল। শরীরটা যেন ছেড়ে দিয়েছে, যেন সব ভারটা নীচের দিকে নেমে এসেছে।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। সকালের স্নিগ্ধ হাওয়ায় ধীরে ধীরে মনটা বশে এল। ট্রেনটা বাঁক নিলে ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছে। সামনে রেলের পাটরী, তার উপর দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে, যেন একটা শুঁয়োপোকা গোগ্রাসে গিলে চলেছে রেলের পাটরী। সে এসে এবার সীটে বসল, গতির উল্টোদিকে। জানলা দিয়ে কাছের জিনিস দূরে চলে যাচ্ছে, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে। তবু ভাল, দূরের জিনিস কাছে এসে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে। সে এক সাধারণ ছেলে। উচ্চাশা বলে কিছু ছিল না। বাংলার গ্ৰামের আরো হাজার হাজার সাধারণ ছেলের মত জীবনটা কেটে যাবে, এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার মত ক্ষমতা তার ছিল না। ট্রেনে যেতে যেতে প্রকৃতির এই রূপরাশি তার মনে যে দাগ কাটবে এমন কথাও নয়। গ্ৰামে থাকতে মনটার যে আলাদা একটা সত্তা আছে, সে কথাও মনে হয়নি। গাছপালা নিয়ে ভেবেছে ফলমূল দেবে কিনা, তাদের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবেনি। আকাশ দেখেছে মেঘবৃষ্টির জন্য, রঙের খেলা উপভোগের জন্য নয়। গ্ৰামের মেয়েরা তার কাছে মাসিমা, কাকিমা অথবা পুঁটু, মণি বা ক্ষেঁদি–তার বাইরে কিছু না। কারো দিকে আলাদা ভাবে তাকানোর কথা মনেও হয়নি। শরীরের খাঁজে ভাঁজে আলাদা মহিমা আছে, সে কথাও ভাবেনি। প্রয়োজন মত এদের বিয়ের সময় পিঁড়ি ধরেছে বা পরিবেশনে হাত লাগিয়েছে। পড়াশোনা করেছে কোনোরকমে উৎরানোর জন্য। সাহিত্যের ভাষা বোঝার মত বোঝা ঘাড়ে নেয়নি। সৌন্দর্যবোধটা বাহুল্য মাত্র। কিন্ত্ত সে এখন ঘোরের মধ্যে। রাতের দুঃস্বপ্ন তাকে মার্ক বানিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ, দেশভাগ, শরণার্থী এসব মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। সে স্বপ্নে যেমন দেখেছে, তেমনি এখন বাইরে তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের সারি, উপত্যকা। তার খাঁজে ভাঁজে পথ করে ছুটে চলেছে তার ট্রেন। হঠাৎ করে যেন তার ভাবনা চিন্তা অন্যরকম খাতে বইতে শুরু করেছে। যেন সে আর কোনোকিছুর নাগাল পাচ্ছে না।
গৌহাটি থেকে রাতের ট্রেনে সে শিলচরে এসে নামল। স্টেশনে তার মামাতো ভাই বটা অপেক্ষা করছিল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যেতে যেতে বটাকে সে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপারে তাকে ছোট মামা ডেকেছে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা এরকম। ছোটমামীর মা বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে মামার কাছেই আছে। কদিন ধরে চেঁচামেচি করছে দেশের বাড়ি যাবে। মরার সময় দেশের মাটিতে, তার নিজের ভিটেতেই মরবে। এখন এখানে কি সব দেশী-বিদেশী পর্ব চলছে, এরা কেউ এখন এখান থেকে বাংলাদেশ যেতে পারবে না। তাছাড়া বুড়ি যেভাবে দেশের বাড়ি, দেশের বাড়ি করছে তাতে সবসুদ্ধু না বিপদে পড়ে। তাই অর্ধেন্দুকে ডেকে পাঠানো। সে দিদিমাকে দেশের বাড়ি পৌঁছে দেবে।
“কিন্তু কার কাছে পৌঁছাতে হবে, কে আছে ওখানে?”
” দিদিমার গ্ৰামে তার এক ভাইজি থাকে, তানিয়া। সেই তার দেখভালের দায়িত্ব নেবে।”
আচমকা আবার বুকের কাছে হাতটা চলে গেল অর্ধেন্দুর।
****************************