You are currently viewing মুক্তির আলোর রথে || রোকসানা পারভীন সাথী

মুক্তির আলোর রথে || রোকসানা পারভীন সাথী

মুক্তির আলোর রথে

রোকসানা পারভীন সাথী

উহ্ মাগো, ও বাবাগো, আল্লাহ্য়ো… আসমানির পিলে চমকানো ঠাঁটা পড়া বাজখাঁই চিৎকারে মিয়াজান লেইনের শুটকি সাহেবের হাফ বিল্ডিং বাড়িটার ঘুম ভাঙে। শুনশান নীরবতা ভেঙে হাই তোলে চোখ রগড়ে ধড়ফড়িয়ে জেগে ওঠে ঘুমন্ত বাড়িটা। মিয়াজান লেইনের গলির ভেতরের গলির গহিনে দুরন্ত আলো-আঁধারির প্রাগৈতিহাসিক আদিম খেলা আর কড়ির রমরমা বেসাতি!
নিয়ামত আলি খোয়ারের মুরগি ধরার আদিম উচ্ছ্বসিত আনন্দে চনমনে উৎসবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত আসমানির শরীরে।
নাইট মেরে সবে বিছানায় বিধ্বস্ত বিমর্ষ দেহ এলিয়ে দেয়,ফুলতোলা তেলচিটে বালিশে মাথা রাখতেই রাজ্যের ক্লান্তি সাঙ্গাষ্টে জড়িয়ে ধরে আজদাহা অজগর সাপের মমতায়।
শরীর বেয়ে তপ্ত বহ্নিশিখার দুরন্ত আস্ফালনের ঘোড়দৌড়! সামনে ধু ধু তেপান্তর। সর্পিল গতিতে এবড়োথেবড়ো পায়ে ছুটছে আজদাহা অজগরের নিষ্ঠুর থাবামুক্ত হতে প্রাণপণে ছুটছে।
ঘামের নহবতখানা বইছে।সপসপে ভিজে একাকার সারা শরীর। চৈত্রের বুকফাটা জমিনের আহাজারিতে কাতরাচ্ছে প্রবল তেষ্টায়! কোনোক্রমেই আজদাহা অজগরের হাতে ধরা পড়লে চলবে না, মা দুর্গার দশভুজার বিশালতার বিরাটত্বে নিজ শক্তিকে স্থিত করে ছুটছে আসমানি অসীমের পানে!

কি কারণে বেজন্মা সাপটি রাতভর দাপাদাপি তাড়িয়ে নিয়ে কোথায় কোন জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো হিসেব নিকেশ মেলাতে পারে না আসমানি! তাজ্জব বনে যায়। ভাবনার অথৈ সায়রে হাবুডুবু খেতে খেতে খেই হারিয়ে ফেলে।
নিজেই নিজেকে চোখ রাঙিয়ে সতর্ক করে, উহুঃ কোনোভাবেই অমনোযোগী হওয়া চলবে না।
একটু বেহিসেবি হলেই আজদাহা অজগরের বিশাল গহবরে চালান হয়ে যেতে হবে!
ছুটছে নাভিশ্বাসে আসমানি কেয়ামতের রোজহাশরের ময়দানে!

ঘুমন্ত আসমানির শরীরে পাক হানাদার বাহিনির পাষন্ডতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিয়ামত আলি!
কিয়ামত সে কিয়ামত তক!
গরম লোহার রড দিয়ে ধুন্ধুমার তালে বেদম পিটতে থাকে আদিম হিংস্রতায়! ঘটনার আকস্মিকতায় আকাশ ভেঙে পড়ে আসমানির মাথায়, জ্বলজ্বলে আক্রোশে থাবা বসায় তপ্ত লোহার রডটি শরীরের গুপ্ত স্থানের আনাচে কানাচে।
জখমি সাপের মতো আসমানির শরীরটা গোল হয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে।তারস্বরে জখমি আর্তনাদে গোটা বাড়ির ঘুম ভাঙে। আসমানির ঘরের পানে ছুটে এসে, পাষন্ড নিয়ামত আলির কিয়ামতের কারিশমা থেকে ছিনিয়ে ঘরের বাইরে শোয়ায়। কাটা মুরগির আস্ফালনের হাহাকার অর্ধচেতন আসমানির বেবশ শরীর জুড়ে!
হাতপাখা চালায় ফুলবানু।ভিজে নরোম কাপড় পোড়া ক্ষতে দিতেই তেলে-বেগুনে চিৎকার আসমানির। কাতরাচ্ছে, গোঙানির শব্দে উঠান ভরে ওঠে।

নিয়ামত আলি ব্যাটা মানুষ। নিজের বৌরে গরম রডের ছ্যাকা দিছে তো কার বাপের কি?
ভাগাইয়া নিয়া আসছে আসমানিরে! আসমানি নিয়ামতের গচ্ছিত সম্পদ।
বৌ কি কুনোদিনো বেটা মাইষের সম্পদ হয় নিহি?
মাগির গুর্দাটা বাঘের গুর্দার চেয়েও বিশাল বড়ো। বড় বাড় বাড়ছিলো ছিনালে! বিরবির করে নিজেকে পোষ মানায় নিয়ামত আলি।

আইজ নাইট মাইরা আইছে আসমানি।নাইট মারলে মাগির গায়ের কাছে মাছিও ভিড়তে পারে না। নিয়ামত আলি তো পানিভাত!
ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের গার্ডের রুমে নাইট শিফট করে আসমানি। সপ্তাহে দু’একদিন বাদে ফি হপ্তায়ই নাইট মারে আসমানি।খরিদ্দার, গাহাক যোগান দেয় নিয়ামত আলি।
সিএনজি ড্রাইভার, মুদিদোকানি,মেসের ছা-পোষা কেরানি, লজিং মাষ্টার, সিটি কলোনির বখাটে মাস্তান,ডাইলখোর, যাত্রাবাড়ি বাস টার্মিনালের নেতা,চুনোপুঁটি থেকে সিটিপল্লির রাঘব বোয়ালদের রোশনাইয়ে আসমানির পাও মাটিত পড়ে না! আসমানির আশনাইয়ের দেওয়ানা – মদিনা হগলে। হাবুডুবু খাবি খায় প্রেমদরিয়ায়।
ডুবসাঁতার কাটে আসমানিতে। ফোটায় সুখের নীলোৎপল!

আসমানির প্রমোদ মঞ্জরির রসে মাতোয়ারা ভ্রমরকুঞ্জ।
আগুন ঠোঁটে গায় :
‘ আমায় ঘুম ভাঙায়া গেলিরে মরার কোকিলে /
আমায় পাগল বানায়া গেলি বসন্তের কালেরে, মরার কোকিলে…. ‘
লক্ষ্মীর সাথে সরস্বতীর কদাচই সাক্ষাৎ মেলে।মৌ মৌ আমোদিত রূপের জৌলুসে বেশুমার যৌবনের উদ্দামতায় উন্মাতাল স্রোতে ভেসে বেড়ায় আসমানি। স্তাবককূল বেশুমার যৌবনরূপ সুধার হিরন্ময় বিভায় লীন আসমানির মনযমুনার রঙ তরঙ্গে। ডালিম রাঙা ঠোঁটে সুরের মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে পড়ে রসিক নাগরের গহিনে, আনাচে কানাচে :
‘ হাজার দর্শক মন মজাইয়া
নাচেরে সুন্দরী কমলা
প্রেমিক পুরুষ রহিম মিয়া
রূপবানে নাচে কোমড় দুলাইয়া…’
শীতলক্ষ্যা নদীর ডানপিটে প্রজাপতি মেয়ে আসমানি।হাটাবো আদর্শ স্কুলের নাইন পাশ দেয়া মাইয়া। লেখাপড়ার পাশাপাশি মিল-ফ্যাক্টরির টুকিটাকি কাজ করে ইনকাম করে।স্বাবলম্বী হচ্ছে আসমানির মতো আশপাশের গ্রামের অসহায় নির্যাতিত মেয়ে – বৌ।
অবসর কাটে ক্রুশের সেলাই শিখে, নকশিকাঁথার সেলাই শিখে রমাকাকির কাছ থেকে। রমাকাকি কোলকাতার মেয়ে। হাটাবো গ্রামের বৌ।
শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী, শ্রীকান্ত, নারীর মূল্য,রবীন্দ্রনাথের ‘ শেষের কবিতা ‘র লাবন্যের, মৃণাল-রতন- হৈমন্তী – কল্যাণী- চন্দরা- শঙ্খমালার স্নিগ্ধতার পারিপাট্যে, প্রাণৈশ্বর্যের সুবাসিত রঙে রাঙিয়ে নিত পরম সুখে।মানস সরোবর ফুলে ফেঁপে প্রাণময় হয়ে উঠছিল পরম পরিচর্যায়।

বানিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা হাতেম আলির চোখে তাকিয়ে স্বপ্নের জগতে পরিভ্রমণ করে আসমানি।মমতার
সরোবরে প্রতিদিন ফোটে মধুবন্তী সুখের শাপলা শালুক।
গ্রামের শিশুদের নয়নমণি হাতেম মাস্টার। মাস্টার’দা সূর্যসেনের দেশপ্রেমের উথাল-পাথাল ঢেউ খেলে যায় হাতেম আলির হৃদয়ের অলিন্দে। ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট মনের মুকুরে গেঁথে দেন দেশপ্রেমের, মূল্যবোধের, সততার,ন্যায়ের, মানবতার,কল্যাণের, আনন্দের আলোকিত মননের রুপোলি জগতের বারতা।
শ্বাসকষ্টে ভুগেন বছরের অধিকাংশ সময়। লাল- কালো চেক মাফলার শোভা পায় সারা বছরই। নিউমোনিয়াটাও শীতের মৌসুমে জাঁকিয়ে বসে রঙ বেরঙের কাশির বহর বুকের কুঠুরিতে।খুক্কুর খুক্কুর কাশি। রাতের ঘুম কেড়ে নেয় বদমাশ কাশির বাহিনি।

গোঁদের ওপর বিষফোড়ার জৌলুসে ঢাক ঢোল পিটিয়ে পৌষের গভীর রাতে হার্টের ওপর একপশলা বজ্রবৃষ্টিপাতে হৃদয় তছনছ করে দিয়ে আসমানিদের সংসারের বারোটা নয়তো চৌদ্দটার পাগলা ঘন্টি বেজে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গোটা সংসার।
ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ভর্তি থাকতে হয় চৌদ্দদিন।কুকুর- বেড়ালের তাচ্ছিল্যে গ্রামগঞ্জের গরিব- গুরবো মানুষকে হাসপাতালের মাটিতে, বারান্দায় লড়াই করে চিকিৎসা সেবা নিয়ে হয়।এসব রোগিদের ওপর দালালচক্রের প্রখর নজরদারি ।
ভোজবাতির ম্যাজিকের দুরন্ত গতিতে ঘটে যায় সব দৃশ্যপট!
পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে দ্রুত।

হাতেম আলির আকস্মিক হৃদরোগের বিপর্যয়তায় স্তম্ভিত আউলাঝাউলা হয়ে ওঠে মাথার আকাশ।
বড় মেয়ে গোলাপির শশুর আদম বেপারিই হাতেম আলি পরিবারের অস্থায়ী অভিভাবক। মাইক্রোবাস থেকে শুরু করে যাবতীয় খর্চাপাতির বন্দোবস্ত করে ফেলে । ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

মিঠাবোর ইমান আলির ছোট ছেলে নিয়ামত আলি ঢাকার গার্মেন্টসে চাকরি করে, কামাইপাতিও ভালো। আসমানিদের বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করে যদি কোনো চান্স মেলে! ভাগ্য সুপ্রসন্ন নিয়ামত আলির,তাইতো ঘটনাক্রমে গ্রামে উপস্থিত ছিল। সুযোগ বুঝে মাইক্রোবাসের সওয়ারি হয়ে গাইড করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার মোক্ষম হাতিয়ার পেয়ে গদগদ খুশিতে আটখানা।
ইমান আলি গ্রামের জমির দালাল।দালালি করে ফোপরদালাল হয়ে রমরমা বেসাতি গেড়ে বসেছে।হাতেম মাস্টারের নখের যুগ্যিও নয়, তবুও কিনে নিতে পারে দিনে দশবার। কিন্তু বিধি হলো বাম, হাতেম মাস্টারদের কখনো কেউ বিকিকিনি করতে সাহস পায় না!
বাংলা মায়ের অকুতোভয় সূর্যতরুণ এরা।দেশমাতৃকার বরপুত্র।
ঘটনাচক্রে ইমান আলির ছোট ছেলে নিয়ামত আলি ঝোপ বুঝে কোপ মারে। আসমানিকে ঘায়েল করে হাতেম আলির সেবা শুশ্রূষাসহ বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতার কুটিল হাত বাড়িয়ে দিয়ে।
হাতেম আলির অধ্যায় শেষ হতেই রাতের আঁধারে ঢাকায় পালিয়ে আসে নিয়ামতের কিয়ামত মার্কা হাত ধরে।
বাকিটা সবই শুধুই দীর্ঘশ্বাস! শুধুই ইতিহাস! পতনের মর্মরধ্বনির আর্তনাদে মুখরিত আকাশ- বাতাস- মৃত্তিকা।

নিয়ামত আলির বেধড়ক লাথিতে ঘোর কাটে আসমানির।
ভূতে পাওয়া ঘোরগ্রস্ত চোখে মিটিমিটি তাকায়। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দম নিতে পারছে না। অক্সিজেনের দলা গলায় কাটার মতো অবরোধ করে রেখেছে । দোর বন্ধ করে রাখে ফুসফুস, যমে মানুষে লড়াই চলছে।
শ্বাসাঘাতপ্রাপ্ত আসমানি অসহায় শুন্যতায় শুটকি সাহেবের হাফ বিল্ডিং বাড়িটির পুরঁনো রড খামচে ধরে। খড়কুটো আঁকড়ে প্রাণে বাঁচতে চাওয়ার মতো দু’হাত বাড়িয়ে দেয় নীলিমার পানে।
আসমানি পালতোলা নৌকোয় শীতলক্ষ্যায় উড়ে বেড়ায়।ঢাকা শহরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শীতলক্ষ্যা তনয়া ডানকিনে, চিংড়ির ঝাঁকের সাথে দৌঁড়োয়।
ঘাসফড়িংয়ের পিছু নেয়।প্রজাপতির রঙিন পাখায় পৌষের সোনামাখা মিঠে রোদের পিঠে দু’হাত বাড়িয়ে উড়ে চলে। নিয়ামত আলির দখলদারিকে চোখ ধাঁধিয়ে ভস্ম তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে
আসমানি হাতেম আলির তর্জনী ধরে এসে ভর্তি হতে চেয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।রোকেয়া হলে থাকার ইচ্ছে আজন্মকালের।রোকেয়া তনয়া হওয়া হলো না এইজনমে!
পাপাকীর্ণ সমাজের বলির পাঠা আসমানি পাড়ি জমায় মহাজগতের পিঠে চড়ে ধানশালিখের হাটাবো গ্রামে।
ভোরের কাক হয়ে শিশিরের টুপটাপ জলে ভিজবে সারা রাত।
পোড়া ক্ষতের প্রশমন হবে কিছুটা! রূপসী বাংলায় বেঁচে থাকার অধিকার বঞ্চিত আসমানি সন্ধ্যার সুদর্শন হয়ে নয়তো চালতা ফুলের সুবাস মেখে ফিরে চলে গন্তব্যের গহিনে।মুক্তির আলোর রথে।
================