“পদশব্দ” উপন্যাসের পাঠ পর্যালোচনা
নুসরাত সুলতানা
সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তাঁর উপন্যাসের ওপর নিবন্ধ পড়ে জানতে পারি “পদশব্দ” একটি নারীবাদী উপন্যাস। এর পরে উপন্যাসটি পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি। আট পরিচ্ছদের এই উপন্যাসটির আখ্যানভাগ, চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, শিল্পরূপে আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আখ্যান ভাগঃ “পদশব্দ” উপন্যাসটির আখ্যানভাগ জুড়ে রয়েছে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র দর্শনের ছাত্রী সালমার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। উপন্যাসের প্রারম্ভেই দেখা যায় সালমা প্রতিদিন বালিশে মুখ গুঁজে তার ঘরে আসা হরেকরঙের প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখে আর পা নাচায়। প্রজাপতি দেখতে দেখতে ভাবে ওর ইচ্ছেগুলো প্রজাপতির মতো। প্রজাপতিগুলো উড়তে পারে ও উড়তে পারে না, এক জীবনে এ ওর ভীষণ দুঃখ। এর ভেতর ভেসে আসে ছোট ভাই সাকিবের স্প্যানিশ গিটারের ফিসফিসানি শব্দ। তখন সে শব্দকে সালমার মনে হয় সাগরের মিষ্টি গান আর ঘরটাকে মনে হয় বিরাট একটা রোদ বোঝাই নৌকা।
সালমার বাবা দর্শনের অধ্যাপক, মা, স্কুল শিক্ষিকা। বাবার অসংখ্য গুনগ্রাহী, ভক্ত, ছাত্র-ছাত্রী যারা বাবাকে প্রসংশায় ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু সালমা নিজের বাবার ভেতরে শ্রদ্ধা বা প্রসংশার কিছু খুঁজে পায় না। কারণ পুঁথিগত বিদ্যা আর প্রথাগত আচরণ কোনোটাতেই সালমার আস্থা নেই। সালমা জীবন এবং মূল্যবোধকে নিজের জ্ঞান আর বিবেকের আলোতে বিচার করতে চায়। আর তার সামনে আদর্শ হয়ে ধরা দেয় দর্শনের প্রভাষক নাসিমা আপা। নাসিমা বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সাব্বিরের সাথে বিয়ে না করে একসাথে জীবন যাপন করছে সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এই যে সমাজকে থোড়াই কেয়ার করে নাসিমা নিজের মতো করে বাঁচতে শিখেছে এই জীবই, এই চড়াই উৎরাই পথেই সালমার মুক্তি আর আনন্দ। নাসিমাকে সালমার মনে হয় একটা প্রস্ফুটিত লাল গোলাপ। কিন্তু বাবা দর্শনের অধ্যাপক হয়েও প্রথাগত সমাজাচরণ তাঁর মজ্জাগত। মা হচ্ছে বাবার কলের পুতুল যেন বাবা যা আদেশ দেন মা তাই করেন। না আছে নিজস্ব রঙ, না আছে গন্ধ। তাই বাবা-মায়ের ভালোবাসা ভেতরে সালমা মুক্তির আনন্দ খুঁজে পায় না, খুঁজে পায় দাসত্বের উৎকট গন্ধ।
রকিব সালমার বন্ধু এবং প্রেমিক। সালমাকে সে খুবই ভালোবাসে কিন্তু জীবনকে রকিবও উল্টেপাল্টে দেখতে জানে না। সমতল পথে প্রথাগত জীবনেই রকিবের আনন্দ। সালমা চায় মাটির মতো উষ্ণতা। কোনো এক রাতে নাসিমা এবং সাব্বিরের এপার্টমেন্টে সারারাত নেশা করে কাটানোর পরে সালমা যখন ফিরে আসে তখন অন্যসবার মতো রকিবও উৎকন্ঠা নিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু সালমার তখন একাকীত্বই আরাধ্য। চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করে রকিবকে। পুতুপুতু আবেগী ভালোবাসায় সালমার একেবারে বিশ্বাস নেই। ভালোবাসা হবে প্রকৃতির মতো উদার আর মাটির মতো উষ্ণ। সালমার বাবা অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরী যখন ব্যর্থ হয় তখন মেয়ের ওপর নিতে চায় চুড়ান্ত প্রতিশোধ। সালমার মত না নিয়েই আয়োজন করে বিয়ের। গয়না বানায়, বাড়ি রঙ করে, বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে ফেলে।
সালমা কিছুই না জানার ভান করে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার শেষদিন রকিবকে বিয়ে করে নাসিমা-সাব্বির দম্পতির বাসায় গিয়ে ওঠে। সেখানেই রচিত হয় সালমা আর রকিবের তরুণ বাসর রাত। লাল গোলাপ সালমার পছন্দের ফুল। সমস্ত বাসর জুড়ে লাল গোলাপের তীব্র গন্ধ। রকিব যখন ঘুমায় সালমার স্বগোক্তি- ” তুমি তো জানো সোজা পথের বদলে চড়াই উৎরাই পথেই আমার সুখ বেশি।…….. আবার যখন পথে নামব, আজকের রাতটা আমি সুগন্ধি পদ্মের মতো হৃদয়ের জলে চিরকালের করে ভিজিয়ে রাখব রকিব।”
অস্থিরতা নিয়ে পায়চারি করতে করতে বাবাকে বলে,”তোমার ব্যর্থতাকে আমি নিজে অতিক্রম করব বলে পথে নেমেছি। তোমার কাছে কোনোদিন পৌঁছাবে না আমার সে পদশব্দ। “
মনস্তাত্বিক ব্যখ্যাঃ পদশব্দ’’ আট পরিচ্ছেদে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী সালমার নাগরিক জীবনের মানসিক সঙ্কট এবং তা উত্তরণের এক বিমূর্ত চিত্রকল্প। দর্শনের অধ্যাপক পিতা এবং মা ও ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে একই ঘরে বসবাস করা সত্ত্বেও নিরন্তর শূন্য থেকে শূন্যতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে শেষে সকল প্রথার দাসত্বের বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে দীর্ঘদহন ও যন্ত্রণার মাঝসমুদ্র পেরিয়ে আত্মঅনুসন্ধানের উপকূলে উপনীত হবার কাহিনী এই উপন্যাস। এই সত্য পরম ভাবে ধরা দেয় সালমার নিজের সাথে বলা কথা-“
আমি জীবনটাকে টুকরো টুকরো ছিন্নভিন্ন করতে চাই। জীবনের পেলব অনুভূতির নীল সরোবরে আমার ঘৃণা “
বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলা কথায় আরও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে সালমার মনস্ততাত্বিক জগৎ।
“আমাকে তুমি জন্ম দিয়েছ বাবা। সে জন্মের শোধ তুলতে চেয়েছিলে তোমার প্রভুত্বের যাঁতাকলে আমাকে পিষ্ট করে। কিন্তু তুমি কী জানো বাবা যারা দাস হয়ে জন্মায় তারা কোনোদিন প্রভু হতে পারে না? তুমি অই মূলটা ধরতে পারোনি। প্রভু হবার আজীবন সাধনা করে তুমি চিরকাল দাস মনোভাব নিয়ে কাটিয়ে দিলে।”
উপন্যাসের আরেক চরিত্র নাসিমার বক্তব্যে ফুটে ওঠে তার স্বাধীনচেতা সত্তার দৃঢ় প্রত্যয়। সালমা যখন বলে, নাসিমাপা অনেকে বলে তুমি এবনরম্যাল। ক্ষুব্ধ কন্ঠে নাসিমা বলে, “যে প্রতি পদে পদে নিজের সঙ্গে আপোষ করে তোরা তাকে বলিস নর্মাল। সেই তো সবচেয়ে বড় এবনরমাল।”
উপন্যাসের শিল্পরূপঃ মাত্র আট পরিচ্ছদের উপন্যাস হলেও “পদশব্দ” উপন্যাসের শিল্পোত্তীর্ণতা বহু উপন্যাসকে ছাড়িয়ে গেছে। দুয়েকটা উদাহরণ দিলেই সেটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে উঠবে। ১. ” কখনো বাড়ি, বাগান সব মুছে গিয়ে এক বিরাট সমুদ্র জেগে ওঠে। হাত-পা শিথিল করে দিয়ে অথৈ পানিতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূর চলে যায় সালমা। রঙবেরঙের মাছ ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে।… মায়াবী এক জগতের মতো মনে হয় সবকিছু “
২. “বেদনহীন ঝরায় কোনো আলোড়ন নেই।”
৩. “মানুষ যখন এতকিছুর স্বীকার করে একটি অন্ধ
অবস্থানের মধ্যে বসবাস করে তখন সেটা তার জন্য এক চরম লজ্জাকর অসুস্থতা”
৪. “যৌবনের গন্ধ কখনো ফুরায় না। সে গন্ধের বৃত্ত ছন্দ রচনা করে। অন্যত্র সুখ খোঁজে। পথে টেনে নিয়ে আসে। ভরিয়ে তোলে নতুন পেয়ালা।”
৫. “জাহিদ চৌধুরীর নামটা ভাবলেই মনে হয় একটা ফাঁকির পাহাড়। লোভের রক্তপিণ্ড। খ্যাতির পঙ্কে ডুবে যাওয়া বাসনা- পোকা।”
পুরো উপন্যাসের শরীর জুড়ে এমন শৈল্পিক চিত্রকল্প বিদ্যমান।
যা ধন্দে ফেলে দিয়েছে : উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সালমা প্রথাসিদ্ধ চিন্তা এবং কাজে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। তার দর্শনের অধ্যাপক বাবার বইসিদ্ধ জ্ঞানার্জিত ডিগ্রি এবং সেই ডিগ্রী কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট সিঁড়ি বেয়ে তড়তড় করে ওপরে ওঠা এসবকিছুই সালমা ঘৃণা করে।
কারণ অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরী বইয়ের জ্ঞান, তথ্য ভেঙেচুরে নিজে কোনো নতুন কোনো তত্ত্বের প্রবক্তা হতে পারেনি। তাই বাবাকে সালমা অসৎ দাসবৃত্তির লোক ভাবে। সালমা পরিবেশ এবং অবস্থানকে করে
নিজেকে এবং চারপাশের পরিবেশকে প্রশ্ন করে নিজেকে চিনতে চায়। কিন্তু বাবা জাহিদ চৌধুরীকে ঘৃণা করলেও তারই প্রশ্রয়ে লালিত -পালিত হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের দায়িত্ব নিজে কাঁধে নেয় না। উপন্যাসের
শরীর জুড়ে দেখা যায় মালি জলিল বাগানে কাজ করে,
ঘরে আছে আনুর মা। স্কুল শিক্ষিকা মা সবসময়ই আনুর মাকে সালমার পছন্দের খাবার রান্না করতে বলে। বাবা সালমাকে খুব আদর করে। এসবকিছুর ভেতরে থেকে জীবন যাপন করে শুধু বিদ্রোহী আচরণ কেবল অর্থহীন আস্ফালন হিসেবে প্রতীয়মান হয়। আবার যখন বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে না করে বেরিয়ে যায় তখনও প্রেমিক রকিবকে বিয়ে করে নাসিমা-সাব্বির দম্পতির বাসায় গিয়ে ওঠে। বিয়ে সমাজের বড় একটি প্রথা, সালমা সেই প্রথারই দ্বারস্থ হয়। আবার সালমার আইডল নাসিমা প্রথমে সাব্বিরের সাথে লিভ টুগেদার করলেও যখনই সন্তান গ্রহণের ভাবনা ভাবে তখন বিয়ে করে। উপন্যাসের প্রথার দাসত্ব বিরোধী দুই নারী চরিত্রের এই প্রথাসিদ্ধ পদক্ষেপ এডভান্স পাঠককে ধন্দে ফেলে দেয়।
উপসংহারঃ সভ্যতার অনিবার্য ক্রমবিবর্তনের ধারায় একসময় লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় দানা বেঁধে উঠলেও বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে নারী-পুরুষ উভয়ের মানুষ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা শ্রেয়বোধ থেকে আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। নারীবাদের প্রয়োগিক অর্থ হচ্ছে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। “পদশব্দ” উপন্যাসটি লিঙ্গ চেতনার জড়তা মুক্ত হয়ে মানসিক জ্যাডা কাটিয়ে মানুষ হয়ে ওঠার আন্দোলনে সচেষ্ট হবার এক শৈল্পিক শব্দস্কেচ।
সেই প্রচেষ্টা কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক এঁকেছেন চমৎকার এবং অভিনব পরাবাস্তব চিত্রকল্প এঁকে এবং শিল্পোত্তীর্ণ করেছেন দারুণ সব শব শব্দ চয়ন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে।
অপেক্ষা, পদশব্দ এবং টানাপোড়েন এই তিনটি উপন্যাস একসাথে প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন। প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। মুদ্রিত মূল্য চারশত টাকা।
নুসরাত সুলতানা
কবি ও কথাসাহিত্যিক
==================