You are currently viewing দ্যা ভেজিটেরিয়ান: হান কাং  || নুসরাত সুলতানা

দ্যা ভেজিটেরিয়ান: হান কাং || নুসরাত সুলতানা

দ্যা ভেজিটেরিয়ান: হান কাং || নুসরাত সুলতানা

২০২৪ এর নোবেলজয়ী কোরিয়ান সাহিত্যিক হান কাং উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ এর জন্য সাহিত্য সমাজে সবচেয়ে বেশি পরিচিত পান। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। উপন্যাসটি ২০০৭ সালে কোরিয়ান ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ২০১৫ সালে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। অনুবাদ করেন ডোবরা স্মিথ।

২০১৬ সালে উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রথম কোরিয়ান ভাষার উপন্যাস হিসেবে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়। যার কৃতিত্ব লেখক ও অনুবাদক দুজনেরই। উপন্যাসটি নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউয়ের ২০১৬ সালের শ্রেষ্ঠ ১০ টি বইয়ের একটি হিসেবে স্থান পেয়েছিল।

ভেজিটারিয়ান উপন্যাসটির আখ্যানভাগ তিনটি পর্বে বিভক্ত। ১. নিরামিষভোজী ২. মঙ্গোলিয়ান দাগ ৩. জাজ্বল্যমান গাছেরা।

প্রথম পর্ব নিরামিষভোজী’তে দেখা যায় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ং হে’কে তার স্বামী ফেব্রুয়ারি মাসের রাত চারটার দিকে ফ্রীজের কাছে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। উপন্যাসে ইয়ং হে’র স্বামীর বয়ানে আমরা পাই- খালি পায়ে, পাতলা গ্রীষ্মের রাত্রিকালীন পোশাক পরে একেবারে সোজা দাঁড়িয়ে যেন আমার বারবার প্রশ্ন করাতেও সে পুরোপুরি উদাসীন। তার আমার দিকে মুখ ছিল না, এবং সে এতটাই অস্বাভাবিকভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে মনে হচ্ছিল কোনো প্রেতাত্মার মতো নি:শব্দে দাঁড়িয়ে আছে। [ পৃষ্ঠা -৯]
ভদ্রলোক যখন তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে? তখন ইয়ং হে বলে -সে একটা স্বপ্ন দেখেছে। এরপর সকালে ঘুম ভেঙে ইয়ং হে’র স্বামী দেখতে পায়- তার স্ত্রী গরু-শুকর এবং প্রায় বিশ হাজার ওয়ানের দামী নোনা মাংস ফেলে দিচ্ছে। স্বামী ভদ্রলোক যখন অবাক হয়ে ফ্রীজ খুলতে যায় তখন দেখে যে এর ভেতর মিজো পাউডার, কুচানো রসুন আর তাজা মরিচ ছাড়া আর কিছুই নেই। ইয়ং হে’র স্বামী চে ইয়ং যখন বলেন – আমি সত্যিই ক্লান্ত। আজ আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও। তখন ইয়ং হে জানায় যে সে ডিমও ফেলে দিয়েছে এবং দুধও ছেড়ে দিয়েছে। স্বামী বেচারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – আমিও কী বাসায় কখনো মাংস খাবো না? স্ত্রী জানায় তুমি তো দুপুরে অফিসেই খাও। রাতে একবেলা সবজি খেয়ে ম্যানেজ করে নেবে। স্বামী বেচারা চিন্তা করেন- কী করে তার স্ত্রী এতটা স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে!

অই রাতে ইয়ং হে স্বপ্ন দেখে একটা গভীর অরণ্যে লাল গোডাউন সদৃশ একটা ভবনে প্রবেশ করে । একটা দীর্ঘ বাঁশের মাথায় এক টুকরো মাংস ঝুলছে। মাংসের টুকরোটি থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। তারপর যতই সে সামনে যেতে চায় ততই দেখে মাংস আর মাংস। তাঁর মুখে রক্ত, কাপড়ে রক্ত শুকিয়ে আছে।

এই অবস্থায় অই উপত্যকার ভেতর দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় অরণ্য খুলে যায়। তারপর সবুজ আলোর দেখা পায়। একটা পরিবার পিকনিক করছে,ছোট শিশুরা ছুটোছুটি করছে। মাংস বারবিকিউ করছে। গান হাসির আওয়াজ কিন্তু ইয়ং হে’র মনে তীব্র ভীতি। তার কাপড়ে রক্ত লেগে আছে। সে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে থাকে যাতে কেউ দেখতে না পায়। অই গোডাউনে সে লাল কাঁচা মাংসের টুকরো মুখে দিয়েছিল। যা তার মাড়ির সঙ্গে চিপে যাচ্ছে, এবং তার মুখের ছাদে রক্ত মাখানো।
এই স্বপ্নের পর ইয়ং হে সব রকমের আমিষ ছেড়ে শাকাহারী হয়ে ওঠেন। এবং এর বিভিন্ন প্রভাব পড়তে থাকে তার দাম্পত্য এবং সামাজিক জীবনে।

ইয়ং হে’র স্বামী মাংস খেতে খুবই পছন্দ করেন এবং ইতিপূর্বে ইয়ং হে দক্ষতার সাথে মাংসের বিভিন্ন পদ রান্না করে দিতেন। সর্বোপরি খুব সাধারণ মানের নারী হলেও স্বল্পভাষী ও অন্তর্মুখী ইয়ং হে এবং তার স্বামী ইয়ং চে’র একটি উষ্ণ দাম্পত্য জীবন ছিল। তারা চমৎকার যৌনতা উপভোগ করতেন। কিন্তু শাকাহারী হয়ে ওঠার পর ইয়ং হে যৌনতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আলাদা রুমে ঘুমাতে শুরু করেন। এবং তার স্বামী মদ্যপ অবস্থায় এসে তার ওপর হামলে পড়ে জোর করে যৌনতা করলেও তিনি লাশের মতো শুয়ে থাকেন । তার স্বামী বিভিন্নভাবেই নিজের জীবনকে অস্বাভাবিক ভাবতে থাকেন এবং তীব্র অসুখী হয়ে উঠতে থাকেন। ইয়ং হে’র ওপরেও নেমে আসে বিভিন্ন সামাজিক এবং পারিবারিক অনাচার। ইয়ং হে তার স্বামীর সাথে অফিসের বসের বাসায় পার্টিতে গেলে সেখানে শাকাহারী হওয়ার কারণে স্বামীর কলিগদের স্ত্রীদের নীরব তামাশা এবং তাচ্ছিল্যের শিকার হন।

চে ইয়ং যখন ইয়ং হে’র পরিবারের সবাইকে বিষয়টি জানাতে শুরু করে তখন সকলে তাকে ফোনে মাংস পরিহার করা থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে। এরপর পরিবার একটি পুনর্মিলনীর আয়োজন করে। সেখানে ইয়ং হে’র মা প্রথমে তাকে মাংস খেতে অনুপ্রাণিত করে এবং জোরাজোরি করে। কিন্তু ইয়ং হে বারবার নীচু কন্ঠে দৃঢ়ভাবে বলে- আমি মাংস খাই না। অবশেষে ইয়ং হে’র বাবা যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের একজন জাঁদরেল যোদ্ধা বীর তিনি জোরপূর্বক ইয়ং হে’র মুখে এক টুকরো মাংস প্রবেশ করিয়ে দেয়। তখন ইয়ং হে ছুরি নিয়ে নিজের হাতের কব্জি কেটে ফেলে। তারপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয়। হাসপাতালে তার মা আয়ুর্বেদ ঔষধ বলে ছাগলের কালো মাংস খেতে দেয়। অই মাংসের গন্ধ যাওয়ার জন্য এর ভেতর ঔষধ মিশিয়ে দেয়া হয়। মা সরে গেলেই ইয়ং হে সব বমি করে ফেলে দেয়। এরপর উপন্যাসের নায়িকার মানসিক বৈকল্য দেখা দেয় এবং স্বামীর সাথে সেপারেশন হয়ে যায়।

দ্বিতীয় পর্ব মঙ্গোলিয়ান দাগ এ দেখা যায় ইয়ং হে’র বড় বোনের স্বামী এক বিচিত্র ধরনের ড্যান্স শো দেখে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে দেখে ইন হে (ইয়ং হে’র বড় বোন) তার পুত্র জিউকে গোসল করাচ্ছে। তখন জিউর নিতম্বে একটা মঙ্গোলিয়ান দাগ দেখতে পায় ইন হে’র স্বামী যিনি জিউর পিতা। মঙ্গোলিয়ান দাগটি দেখে ভদ্রলোক স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন। এই দাগ এখনো আছে? তখন ইন হে বলে আমার কতদিন ছিল মনে নেই। কিন্তু ইয়ং হে’র বিশ বছর বয়স অব্দি ছিল। এরপর ইন হে’র স্বামীর অই ড্যান্স শোয়ের কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে একদল নরনারী শরীরে বিভিন্ন রকম ফুল এঁকে সরল এবং সরাসরি ভঙ্গিতে যৌনকর্ম করছিল। অই শোতে একজন নারীর নিতম্বে একটা মঙ্গোলিয়ান দাগ ছিল।
তখন ইন হে’র স্বামীর মনে হতে থাকে ওই মহিলা নিশ্চয়ই তার শ্যালিকা ইয়ং হে ছিল। তখন ইন’হের স্বামী তার শ্যালিকাকে কল্পনা করে স্বমেহনে মত্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য সেই পারিবারিক পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানে দেখার পর থেকেই ইন হে’র স্বামীর আর নিজের স্ত্রীকে ভালো লাগে না। নিজের স্ত্রীর বিভিন্ন খুঁত চোখে পড়তে থাকে। সারাক্ষণ ইয়ং হে’র সঙ্গে যৌনতার কল্পনায় সে উন্মত্ত থাকে । এরপর সে ওই যৌনতা সমৃদ্ধ ড্যান্স শোয়ের মতো ইয়ং হে’র সাথে একটা ভিডিও ধারণ করতে চায়। সমস্ত শরীরে ফুল আঁকার কথা শুনে ইয়ং হে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এরপর সমস্ত দেহে ফুল এঁকে একজন পুরুষের সাথে যৌনকর্মের দৃশ্য ধারণ করে ইন হে’র স্বামী। কিন্তু অই দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে ইয়ং হে’র প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনেকটা হারিয়ে ফেলে তার বড় বোনের স্বামী। কারণ ইয়ং হে’র শরীর অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাতে বাসায় ফিরে সে কল্পনা করে – যে শরীর একবছর তাকে উন্মত্ত করে রেখেছিল সেই শরীর এত কাছে ছিল এবং তাকে শুধুই তার ব্রাশ স্পর্শ করেছিল। সে রাতে স্বপ্নে দেখে যে যখন তার শ্যালিকার ভেতরে প্রবেশ করে তখন তার ভেতর থেকে এক ধরনের সবুজ তরল বের হচ্ছে। যা ক্ষতিগ্রস্ত পাতা থেকে বের হয়। এরপর ইন হে’র স্বামী নিজের শরীরেও রঙিন ফুল এঁকে শ্যালিকার সাথে যৌনকর্মের ভিডিও ধারণ করে। কিন্তু নিজে এবং ইয়ং হে দুজনেই তার বোন ইন হে’র কাছে ধরা পড়ে যায়। ইন হে দুজনকেই মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এই পর্বে ইন হে’র স্বামীর সাথে তার সেপারেশন হয়ে যায়। কিছুদিন পর ইন হে’র স্বামী মুক্তি পায় এবং পুলিশ হেফাজতে থাকে কিন্তু ইয়ং হে মানসিক হাসপাতালে থেকে যায়।

তৃতীয় পর্বে উপন্যাস পরিনতির দিকে এগিয়ে যায়। এই পর্বের নাম জাজ্বল্যমান গাছেরা। শেষ পর্বে দেখা যায়- ইয়ং হে’র সাথে পরিবারের সকলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও তার বোন ইন হে তার প্রতি মমতাময়ী এবং দায়িত্বশীল আচরণ করে। মানসিক হাসপাতালের খরচও ইন হে বহন করে। একরাতে ইন হে’র ছেলে জিউ যখন অসুস্থ তখন মানসিক হাসপাতাল থেকে তার কাছে ফোন আসে যে ইয়ং হে কে খুঁজে পাচ্ছে না তারা। এরপর খুব দ্রুত সকল ডাক্তার এবং নার্সরা খুঁজতে বেরিয়ে যায় এবং ইয়ং হে প্রবল বেগে বৃষ্টির ভেতর গভীর অরণ্যে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এর অব্যবহিত পরেই ইন হে কে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় ইয়ং হে সকল ধরনের খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর ইন হে হাসপাতালে গেলে ইয়ং হে কে দেখতে পায় হাতের ওপর ভর দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইন হে’র দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে- বোন তুমি কখন এলে? অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বৃক্ষকে নির্দেশ করে বলে- বোন দেখো গাছগুলো আসলে হাতের ওপর উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শরীরে ও শিকড় এবং পত্র গজাবে শীঘ্রই। হাসপাতালের নার্সরা জানায় যে ইয়ং হে খাদ্যনালী থেকেও খাবার গ্রহণ করছে না। আর ইঞ্জেকশন পুশ করতেও দিচ্ছে না। ইন হে তাকিয়ে দেখে ইয়ং হে’র স্তনগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুয়ে থাকা অবস্থায় তাকে একটা ছোট শিশুর মতো লাগছে। মঙ্গোলিয়ান দাগটিও প্রায় মিলিয়ে গেছে। ইন হে যখন বোনকে জিজ্ঞেস করে তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে কেন? ইয়ং হে বলে আমি আসলে গলে যাচ্ছিলাম মাটির ভেতরে। আর অল্প একটু বাকি ছিল। তারপরই আমি মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠতাম। ইন হে বোনকে আবার জিজ্ঞেস করে – তুমি খাও না কেন? তুমি কী সত্যিই মরে যেতে চাও? ইয়ং হে বলে আমার এখন খাবার লাগে না। আমি গাছ হয়ে গেছি। আমার জন্য সূর্যালোকই যথেষ্ট। ডাক্তাররা ইন হে কে জানায় তার বোন ভয়ানক আনারোক্সিয়া এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। ডাক্তাররা যখন জোর করে খাদ্যনালী সেট করে খাবার ইঞ্জেক্ট করতে চায় তখন ইয়ং হে রক্তবমি করে। আর ইন হে তখন বলে আপনারা দয়া করে থামুন। আমাদের তাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিতে হবে। আর এম্বুলেন্স যখন গ্যাস্ট্রো- হেমারেজের সমস্যা সমাধান করে প্রোটিন ইনজেক্ট করতে হবে। এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।

চুকেসাং পর্বতমালার ভেতর দিয়ে এম্বুলেন্সটি যখন এগিয়ে যায় তখন ইন হে বোনকে বলে- সবকিছু সম্ভবত একটা স্বপ্ন। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন সত্যি ভাবি। কিন্তু যখন আমরা জেগে উঠি দেখি কিছুই ছিল না। তাই আমরা একদিন জেগে উঠব। ইয়ং হে তখন নিজের মতো বৃক্ষ দেখে, পাখি দেখে। তখন গ্রীষ্মের আলো তার চোখ ভরিয়ে দেয়। সে আর পাখিগুলোর পাখা দোলানো অনুসরণ করতে পারে না। কিন্তু ইন হে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়, ক্ষুব্ধ হয়ে একটা উত্তর প্রত্যাশা করে।

আমাদের সমাজেও আমরা বহু আগ থেকেই এমন নিরামিষভোজী মানুষ এবং তাদের চারপাশের মানুষদের সহিংস আচরণ দেখতে পাই। মহাত্মা গান্ধী যখন আঠারো বছর বয়সে বিলেতে ব্যারিস্টারী পড়তে যান তখন তিনি মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি মদ, মাংস এবং বেশ্যা বা ভিন্ন নারী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখবেন। কিন্তু গান্ধীর খ্রিস্টান এবং ইহুদি বন্ধুরা তাকে মাংস এবং মদ খেতে বহুভাবে প্ররোচিত করেন। গান্ধী ভেবেছিলেন ভারতবর্ষে ফিরে মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি মাংস খাবেন। কিন্তু ততদিনে তাঁর মা পরোলোকগত হয়েছেন। ফলত গান্ধীর আর মাংস খাওয়া হয়ে ওঠেনি। এমন আরও এক স্বামীকে আমি জানি যিনি দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির জন্য আমিষ পরিহার করতে চান। কিন্তু স্ত্রী স্বামীর এমন শীতল আচরণ নিতে পারেন না। শুরু করেন সহিংস আচরণ। স্বামী আবার আমিষ খেতে বাধ্য হন।

উপন্যাসের চরিত্রায়নের প্রসঙ্গে বলি। প্রধান দুটি চরিত্রই নারী। ইয়ং হে একেবারে সাধারণ এবং স্বল্পভাষী একজন নারী। সেই সুকুমার রায়ের সেই ছড়া নিরুপদ্রব সাপটির মতো..

ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস্‌ফাঁস্‌, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ,
একদম শান্তশিষ্ট, অন্তর্মুখী একজন নারী। কিন্তু এই শীতল চরিত্রের নারী নিজের ভেতরে তীব্র জেদ এবং নিজের সিদ্ধান্ত ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচলতা ধারণ করে তীব্রভাবে। আর সেই সাথে আছে সুতীব্র উপেক্ষার শক্তি। যদিও যোদ্ধা বাবার অতি শাসনের শিকার হয়েছিল ইয়ং হে একেবারে শৈশব থেকেই। আর ইন হে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল নারী। বোনের কারণে সংসার ভেঙে গেলেও বোনকে তিনিই আগলে রেখেছেন। আবার স্বামীর কাছেও তিনি কখনো ফিরে যাননি। তার দোকানের কর্মচারীদের প্রতিও তিনি বেশ দরদী আচরণ করতেন।

এই উপন্যাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এশিয়ার পারিবারিক আগ্রাসন বা ব্যক্তি স্বাধীনতার শুন্যতার কথা। ইয়ং হে একজন বিবাহিত কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তার বাবা জোর করে তার মুখে মাংস প্রবেশ করিয়ে দেয়। আবার উপন্যাসের আখ্যানে ইন হে’র বয়ানে পাই খুব ছোট বেলায় যখন দুই বোন জঙ্গলে হারিয়ে যায় তখন ইয়ং হে আর পরিবারে ফিরতে চায় না। কারণ তার বাবার অতি শাসন।

চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বর্ননা আমাদের ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষন তত্ত্বকেই মনে করিয়ে দেয়। যেমন :ইন হে’র স্বামী তার ব্যাপারে বলে সে একরকম বেশি ভালো যা বিরক্তির তৈরি করে। উপন্যাসের আখ্যান বয়ান দারুণ শৈল্পিক। দৃশ্যকল্প এবং চিত্রকল্পের সম্মিলনে জীবন এবং চরিত্রগুলোকে হান কাং শব্দের রঙতুলিতে এঁকেছেন। সাহিত্যের ইউরোপীয় ধারায় পরিপুষ্ট এই উপন্যাসর আখ্যান বয়ান, চরিত্রায়ন, দৃশ্যকল্প, চিত্রকল্প সবকিছুকেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতার সঙ্কট, পারিবারিক – সামাজিক আগ্রাসন এবং মানুষের বিচিত্র মনস্তত্ত্ব। অবশ্য এই উপন্যাস আমাদের ইকো ফেমিজিনিজমের কথাও মনে করিয়ে দেয়। যেখানে নারী এবং প্রকৃতি দুজনের একাকীত্ব বিমূর্ত হয়ে ওঠে এবং পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের তীব্রতাও স্পষ্টতই ফুটে ওঠে।

অনুবাদের ব্যপারে বলতে চাই- অনুবাদক মাহবুবুল আলম মিঠুন ভবিষ্যতে বাক্যের গঠনে আরও যত্নশীল হবেন। এবং বাক্যের আকাঙ্খা, আসত্তি এবং যোগ্যতার সম্মিলনে সার্থক বাক্য গঠনে সচেষ্ট হবেন।

পরিশেষে বলব ভেজিটারিয়ান কোরিয়ান সাহিত্যে তো বটেই বিশ্বসাহিত্যের এক অনিন্দ্য সুন্দর সংযোজন। আরও বহু বছর ভেজিটারিয়ান মানুষের মনোজগতে রাজত্বব করবে।

***************************

নুসরাত সুলতানা
কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
****************************

Leave a Reply