You are currently viewing ঋতো আহমেদের কবিতা

ঋতো আহমেদের কবিতা

ঋতো আহমেদ

 

[অক্ষমতা ১]

 

(বাঘিনী তার থাবা; উঠিয়ে দিলে; আমার শরীরে

শেষ চিৎকারটাও; থমকে যায়; মুখের ভিতরে। ওরে পোড়া; পোড়ামুখী ওরে—

আমার কোনও ক্ষমতা নেই; কেবল আছে অক্ষমতা। সে বলে,

তবুও আছে; কিছু তো একটা;—আজ রাতে; এই ভেবেই হ; নির্লজ্জ কিছুটা।

রাতভর কামড়াকামড়ি; দেহের; ছিন্নভিন্ন খেলা

এ খেলায়; তোকেই আমার চাই; তুই আমার; চর্বচোষ্যলেহ্য; ভে-বে-লা।)

 

তারপর কখন-যে আমি একটা উপত্যকার মাঝ বরাবর শুয়ে পড়েছি

মনে করতে পারি না। একসময় এতোটাই ক্লান্তি আমাকে বশ করে যে

আমার মাথা আর তুলে রাখতে পারি না। নুইয়ে আসে ঘুমে। দু’পাশে

দুই পর্বতশৃঙ্গকে সাক্ষী রেখে মাথাটা রাখি তার বুকের উপর। মানে ওই

পোড়ামুখী বাঘিনীটার দুই বুকের মধ্যিখানে। মনে করতে চেষ্টা করি

এমন ঘুম আর কবে ঘুমিয়েছি। শেষ কবে আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় এতোটা

উদ্বেল হয়েছিল? কিন্তু আমার ঘুম আমাকে তলিয়ে নেয় অমোঘ অভিকর্ষে।

দেখতে না দেখতে আমি একটা পাতালপুরীতে এসে হাজির হই। যার

মাটিতে কোনও মাটি নেই, ঘাসও নেই, কেবল ধাতু আর ধাতু, উত্তপ্ত

তরল, বেগবান। কিন্তু কোথায় ছুটেছে ওরা? আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে

কোথায়? কোন মোহনার আহ্বান এতোটা সাংঘাতিক হলে এমন হয়!—

 

তবে কি ওই মোহনায় নির্লজ্জের মতো একটা পরাজিত শবের মতো

ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠবো আমি কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে? এমনতর

উদ্বেগ আমাকে শান্তি দেয় না। হাঁসফাঁস করে ওঠে মন। কেউ একজন

আমার পিঠে হাত রাখতেই নরম রশির মতো মনে হয়। ফিরে তাকাতেই

দেখি হাত নয়, একটা কালচে নীল সাপ পেঁচিয়ে ধরেছে। স্মরণ করতে

চেষ্টা করি এই সাপটাই কি সেই সর্প কিনা? যাকে বেহেস্তের বাগানে

মাতা হাওয়াকে ফুসলাতে দেখা গেছিল। কিন্তু আমি, আমি তো আদম নই—

আর এই সাপটাও সফেদ নয়। আমি আদম সন্তান। আমাকেও কেন?

 

আমি একটা ধন্ধের মধ্যে পড়ি। একটা নির্ঘোর বোধ আমাকে নির্বোধ

কোরে তোলে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সর্পের বীভৎস হিসহিস আওয়াজ

আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে থাকে অবিরত। যন্ত্রণায় মাথার ভিতর

কী যেন একটা দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে। আমি তখন দু’কান ঢাকার জন্য

আমার দু’হাতকে ডাকতে থাকি। ততক্ষণে সাপের হিসহিস বেড়ে গিয়ে

ঝিঁঝিঁর আওয়াজকেও ছাড়িয়ে যায়। ওরা কেউ আমার ডাক আর শুনতে

পায় না। অগত্যা কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমি নিজেকে বধির কল্পনা করি,

ভুলে যেতে চাই ধর্মের সমস্ত কাহিনী। ভুলে যেতে চাই উপত্যকার ঢল,

যা আমাকে এখানে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে। আমার কল্পনায় আমি একটা

সৌরমণ্ডল আঁকি। কারণ, আরেকটা সৌরমণ্ডল ছাড়া এই সময়ে হয়তো

আমাকে অর্থাৎ মানুষের সভ্যতাকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

 

কারণ, সাপের হিসহিসের যে ফ্রিকোয়েন্সি, তার যে তিব্রতা ক্রমান্বয়ে

বেড়েই চলেছে, তা একসময় এই সৌরজগৎকে ধ্বংস করে দিতে বাধ্য।

তাই আমি আলোর বিন্দুকে অনুসরণ করে হিগস-বোসনের দুনিয়ায়

এগিয়ে যাই। নির্বিরোধ আমার গতি এখানে খুঁজতে থাকে জীবনের

জন্মের রহস্য। খুঁজতে থাকে পরিত্রাণের উপায়। খুঁজতে থাকি সময়ের

বক্রতার ভিতর কতোটা অসীমতায় লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যৎ। কিন্তু

যখন আমার সামনে চলে আসবে কোনও ইভেন্ট হরাইজন, কিংবা

আমিই হয়তো বেপরোয়া গতির কারণে পৌঁছে যাব ওই সীমার রেখায়

তখন, আমিও কি হারিয়ে যাব অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে? না

আমার দেহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে

হাসতে থাকবে, ওরে বুদ্ধু, তোর মতো অক্ষম পুরুষের ভবিষ্যৎ বলে

 

কিছু নেই, বলবে, ভবিষ্যৎ নয়, তুই তোর অতীতে ফিরে যা। অতীত

একটা থেমে থাকা রেলগাড়ির মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনও স্টেশানে। 

যার প্রতিটা যাত্রীই তোর সহযাত্রী। তাকা ওদের চোখের দিকে। কী

দেখতে পাস? প্রেম প্রীতি আর লঞ্ছনার ঢেউ? হিংসা ’দ্বেষ আর ক্রোধ

নাকি নিজেরই প্রতিচ্ছবি? লোভ লালসা আর রিরংসার আদল। যাদের

প্রত্যেকটি অংশেই এখন বিভক্ত আমি। ভেসে বেড়াচ্ছি অসীম শূন্যে।

মনে হচ্ছে, আমার কোনও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই যে ফিরে যাব ওই

আলোর উল্টো পথে। একেবারে বিগ-ব্যাং পেরিয়ে সৃষ্টির আদিমতম

সময়ে। আমি কেবল চোখের মধ্যে জেমস-ওয়েব টেলিস্কোপ লাগিয়ে

পর্যবেক্ষণ করতে পারি নিজেকে, কেমন ছিলাম, কতোটাইবা পরিণত

আমার আদল। আমাকে এক মহা সত্যের দিকেই কি ঢেলেছে ওরা?—

 

নাকি এক বিস্মৃতির ভিতর থেকে স্মৃতির সংগ্রাম তার ঝাঁপ খুলে দিচ্ছে

অনন্তের? এইভাবে একবার ভবিষ্যৎ আরেকবার অতীত করে করে আমি

যখন সত্যি পৌঁছালাম কোথাও, তখন তাদের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই,

না অতীত না ভবিষ্যৎ। জেগে উঠলাম রুঢ় এক বাস্তবতায়। বর্তমানে—

 

বাঘিনী হুঙ্কার দিয়ে উঠল, আর কতো ঘুমায় মানুষ, জঙ্গলে যাও, তরি-

তরকারি কিছুই নাই। মাছ নিয়া আসবা। আর একটা হরিণের চোয়াল

 

[অক্ষমতা ২]

 

অর্থাৎ আমি একটা মাছ আর একটা হরিণের চোয়াল আনতে বেরিয়ে গেলাম পৃথিবীতে।

সদ্য সকাল। গাছপালার ফাঁক গলে নতুন বউয়ের মতোই উঁকি দিচ্ছে সূর্য। সম্পূর্ণ

প্রকট হবে কিনা বুঝতে চাইছে। বিগত রাতের লজ্জা এখনও রাঙিয়ে রেখেছে প্রত্যঙ্গ।

আমিও চোরাগুপ্তা চাহনিতে দেখে নিচ্ছিলাম তার অপরূপ রূপ। তারপর কর্তব্যকে স্মরণ

করে, তার থেকে চোখ দুটোকে নামিয়ে, চলে যেতে লাগলাম আমার নির্দেশিত গন্তব্যে।

যেখানে একটা হরিণ আর একটা মাছ পাওয়া যাবে। কিন্তু হরিণ আর মাছ তো থাকে

একেবারে দুটি ভিন্ন মণ্ডলে। স্থলমণ্ডল আর জলমণ্ডল। এ কথা আমার মাথায়ই ছিল না।

 

এখন, কোন মণ্ডলে যাই আগে? ক্ষুধার্ত বাঘিনীর কথা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে

স্থলেই যাব। তারপর দ্রাঘিমা হিসেব করে রওনা দিলাম পৃথিবীর দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে।

যেখানে জঙ্গল রয়েছে। গেলেই দেখতে পাব মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খাচ্ছে, প্রস্তর যুগের

সব ঘোড়া। কোনও এক কার্তিকের জোছনার মাঠে, দেখা হবে আমাদের। সেইখানে, 

এক ঘোড়া, খেতে খেতে অকস্মাৎ মাথা তুলে তাকাবে আমার দিকে, চোখে তার বিস্ময়

ভয়: এ কোন আজব প্রাণী, মুখে যার মিথ্যে প্রেম—ছলনার, হাতে হাতিয়ার। আমিও

তাকাব তার দিকে। ভুলে যাব, ঘোড়া নয়, আমি-যে খুঁজতে এসেছি এক হরিণ-চোয়াল।

 

সেখানে, স্থলমণ্ডলের টানা টানা দীঘল দীঘল চোখ ঘুরছে আমার দিকে। আমি কি সেই

ছলনার ছেলে? ভ্রাতার হত্যাকারী ভাই? আবারও এসেছি ফিরে, আরও এক ভ্রাতার

মস্তক আমার চাই? অনড় আড়ষ্ট চারিদিক। আমাকে দ্যাখে। অপলক চোখে। হে দৃশ্য

হে ঈষদুষ্ণ প্রতিবেশ, এ ক্যামন কম্পমান অস্বস্তি এলো! এ ক্যামন অপরাধ আমার!

কী করে বোঝাই আমি, অক্ষম; প্রতিশ্রুতি থাকলেও আমার কোনও প্রতিযোগী নাই।

যার কথা ভাবছো তোমরা, সে আমার পিতৃপুরুষ রে ভাই। আমার কোনও জয়ও নাই

পরাজয়ও নাই—এমনই অক্ষমতা আমার।—শুধুই ভৃত্য আমি মাংসাশী বাঘমানুষের।

 

কিন্তু এ পৃথিবীতে কেউ কি কখনও শুনেছে কারও কথা? আমাকে ধরে নেয়া হল দোষী,

নিয়ে যাওয়া হল বিচারে। আমার হাতের লাঠি আর পকেটের মোবাইল, অস্ত্র হিসেবে

বাজেয়াপ্ত করা হল। ভাবছিলাম চোখের চশমাটাকেও নিয়ে যায় কিনা? তখন তো কিছুই

দেখতে পাব না। হাতি, ঘোড়া, হরিণ কিংবা শেয়াল— সবাইকে একই রকম লাগবে।

কে কথা বলছে কেবল আন্দাজ করা ছাড়া উপায় থাকবে না আমার। অবশ্য এ পর্যন্ত

কেউ কোনও কথাই বলেনি। কারও মুখ থেকে কোনও আওয়াজ শুনতে পেলাম না। সব

ক্যামন নিঃশব্দে চলছে। কিংবা হয়তো বলেছে। প্রস্তর যুগের ভাষার হয়তো ভিন্ন মাত্রা।

 

ভাবতে লাগলাম, কী হতে পারে আমার বিচারের রায়? কিছুই তো করিনি আমি। কিন্তু

শুনছে নাতো কেউ। তবে কি পালাব আমি? দেখলাম, আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উঁচু

কোনও ভূমির দিকে। যেখান থেকে পৃথিবীর অনেকটাই অক্ষিগোলকের আওতায় চলে

আসবে। হতে পারে কেওকারাডং-এর মতো উঁচু কোনও পাহাড় থেকে পতনই হবে

আমার রায়। যেন আমি মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো পৃথিবীটারে দেখে নিতে পারি।

আর, এ’জন্যই হয়তো আমার চশমা ওরা কেড়ে নেয় নি। যেন আমার ভ্রাতার মতোই

আমার মাথাটা অতোটা উঁচু থেকে পড়ে থেতলে যায়। যেন আমি একটা বক্র সময়ের

 

ভিতর আমার ওই ক্ষুদ্র অভিযান শেষে পৃথিবীতেই ফিরে আসি। কিন্তু আমার আত্মা, যে

একটা খুনি, তার কোনও স্থান নেই এই ভূ-মণ্ডলে? সে যেন ফিরে যায় তার প্রভুর কাছে?

ধীরে ধীরে আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে। কী যে করি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আসলে,

সেটাই ছিল প্রথম। এরপর, পৃথিবীতে সময় যতই গড়িয়েছে আমার ভ্রাতারা আরও আরও

নিহত হয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাস ভ্রাতৃ-হত্যার ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাস লালসার

ইতিহাস, রিরংসার ইতিহাস। হরিণ নয়, আমিও আজ সেই ভাইয়েরই চোয়াল সংগ্রহে

বেরিয়েছি। এ আমি জানি। আর জানি বলেই আমার অক্ষমতা আমাকে দ্যাখে আর হাসে

********************************