বৈশাখে রচিত পঙতিমালা
অন্তর চন্দ্র
ব্রহ্মপুত্র স্নান
শুয়ে শুয়ে ভাবা যায়
একটা পৃথিবী
ব্রহ্মপুত্রে ডুব দিয়ে উঠে
কীভাবে সকাল বেলার মেলায়
ভিড় নিয়ে গতরাত্রি যাপন করে;
বালিয়ারি ঘাটে
চিলমারী মেলা হয়ে
গ্রামে-গঞ্জে
পায়ে পায়ে কত
মিটার ক্ষয়ে যায়
একটি দিনের সংহিতা খুলে—
আজিজ কাজল
ফেরাও কুচি
মাটির ভাণ্ডে ফুটছে শাদা ফুলেল ভাত; মেহমান আসবে,
হাঁড়ির গলায় স্নেহের পাটদড়ি বেঁধে, জালা ভরা খেজুর রসে, ইলিশ মাছে,
ভাপাপিঠার বাঁশ-খোলে, মুরগী দুরূস, দই কদলি ভরা মধু মধু হাতে।
আমাদের ফুলের গায়ে ঘা মারে বহুজাত পাখির দানো—
তোমার ছোঁ-ছোবল প্রজন্মেরা করে না কসুর;
তাদের শেকড়ে টান পড়েছে, ফিরছে তারা নিজের ঘটে।
আলী সিদ্দিকী
বৈশাখ কীর্তন
আগুন যখন তোমার কাছে আসবে ছুটে
তুমি তখন বাতাসের কাছে যেও না
বাতাসের সাথে আগুনের বৈরিতা চিরকালীন
বাতাসে ঘটে আগুনের ভয়াল বিস্তার।
সমুদ্র যখন তোমাকে দেখে উত্তাল হয়ে উঠবে
সমুদ্র সান্নিধ্যে যেও না তখন
সমুদ্রমায়া ভয়াবহ দুর্বিনীত আকর্ষণ চিরকাল
মায়ার মোহ অনায়াসে গিলে নেবে তোমাকে।
বৈশাখ আগুন হয়ে আসে পোড়াতে জঞ্জাল
উড়িয়ে নেয় সব পুরাতন জীর্ণশীর্ণ অন্ধকার
অন্ধকার গ্রাস করে নেয় মনন ও মগজ
তুমি অন্ধকারকে কখনোই প্রশ্রয় দিও না।
ঝড়ের আছে নিজস্ব চয়ন ধ্বংসাত্মক স্বভাবে
এই ঝড়ের ভেতর পুঁতে দাও হৃদয়ের মণিমুক্তা
পলির মতো উর্বর হবে তোমার মাটি ও হৃদয়
মাঙ্গলিক হবে তোমার উচ্চারণ মানব বন্ধনে।
এবার বৈশাখের অগ্রভাগে আনন্দ ভজন ঈদ
শতাব্দীর সূর্যগ্রহন বুকে চেপে আলোর স্ফূরণ
প্যালেস্টাইন ভাসছে রক্তস্রোতে নির্বিকার বিশ্ব
তবু নিরানন্দ উচ্চকিত হোক আজ পরমানন্দে।
জিললুর রহমান
সেই অশ্রুবাষ্প
বিস্ময় জাগিয়ে আসে
উৎসব আমেজহীন এ নব বৈশাখ!
এবার বলিনি ‘যাক্ পুরাতন স্মৃতি’,
যাক্ ‘সুদূরে মিলাক্’…
অশ্রু বাষ্পে চারিদিক
ভরে আছে, ঘর ভরা স্মৃতি শুধু
ধূলাসম পড়ে থাকে
কেবল থাকে না সেই প্রাণের মানুষগুলো
যাদের আকুল হয়ে ডাকি
পুত্র জায়া পরিবার সকলেই জানে
আর কেউ তারা ফিরিবে না
তবুও নতুন বর্ষে
আঁকড়ে ধরি আজ কোন
স্মৃতির তর্পনে
আসা পুরাতন পাপ।
সেই অশ্রুবাষ্প এসে
বিমর্ষ নয়ন জলে বিশ্বময়
খায় ঘুরপাক,
কোথা হতে ভেসে আসে
কানে বাজে কোন্ সুদূরের ডাক,
হে বৈশাখ!
হোসাইন কবির
আলো-অন্ধকারে
ঐ তো নদীর ছায়ায়– কেউ হেঁটে যায়
মনে হয় সকাল-সন্ধ্যা
আমাদের সমস্ত সময় স্থির হয়ে ঝিমুচ্ছে একা
স্বপ্নমেঘে আগুন খোলায়
কারা যেন উড়ে উড়ে নিঃশব্দে উধাও
ভাবি, অপেক্ষার বৃষ্টির নূপুর বাজে কি কোথাও
কেবলই মনে হয় –
এক চোখে অন্ধকার আরেক চোখে আলো
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছি কালো
এইচ বি রিতা
বেজে উঠুক ধ্রুপদ সঙ্গীত
নিত্যগামী রথ ফিরেছে নব উদ্দমে
শুকনো গুল্মলতার পুরাতন স্মৃতি মাড়িয়ে
ফিরেছে প্রকৃতির মালা নূতন অঙ্গে
বৈশাখ এসেছে আবেগস্নিগ্ধ অভিষেকে
দূরে থাক বজ্র-বহ্নি, মনের অন্ধকার
আশা-প্রত্যাশার মেঘে মিশে হোক সাক্ষাৎ
বাতাবি ফুলের ঘ্রণে মরে যাক স্বপ্নপোড়া দিন
উড়ে যাক উদাসীন দমকা হাওয়া
ধুলায় ধূসর যত ঝঞ্ঝাট
হিসেব চুকিয়ে বন্দি মানুষ ঘরে ফিরে যাক তৃষ্ণা
আর ক্লান্তির আবরণ ভেঙে
বেজে উঠুক ধ্রুপদ সঙ্গীত রন্ধ্র রন্ধ্র
প্রকৃতিতে পূর্ণ যৌবনে বৈশাখী রঙ ছড়াক
মন পুনর্জাগরণে
শোন হে কালবৈশাখ-
তুমুল নৃত্যে নয়, সাজিয়ে দাও ধরণী প্রাকৃতিক রঙে
রঙিয়ে দাও মানুষের মন
গাছপালা লতাগুল্ম-পাহাড়, নদী, সমুদ্র-
অরণ্যে পোষা পশুপাখি।
তূয়া নূর
ভোর হবে কবে
আকাশ আলো করা একটা মনোরম ভোর
দেখার খুব ইচ্ছা আমার
পাখিদের বুক, মেঘেদের গা আর কাঁঠালের পাতায়
ঝিকিমিকি খেলে যাবে সূর্যের আলো
নির্বাসন থেকে নির্ভয়ে ফিরবে মানুষ ঘরে
শিশুর মৃণাল হাতে তুলে দেবে তার সমস্ত সম্পদ
উদাস আকাশী চোখে ফুল হয়ে ফুটবে অযুত তারা।
সমস্ত মানুষ অনশন ভেঙে মুখে দেবে খেজুর পানি
শোষণের বোঝা ফেলে দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে মানুষ।
খেটে খাওয়া মানুষের মুখগুলো হবে বল্লম হাতে
জীবন যুদ্ধের কারুময় চিত্রকলা
মৃত লাশ গুলো হবে বিপ্লবী যুবক কবি ববি স্যান্ডসের মুখ।
যুদ্ধের মাঠ জুড়ে লাল পদ্মের মতো ফুটবে থোকা থোকা শহীদ মিনার।
পূবের সূর্যটা আত্মীয়ের মতো উষ্ণতা দেবে
মাটির পৃথিবীর নাড়ি কেটে মন খুলবে হাসবে আরেকটা পৃথিবী
কথার ফল্গু ছুটাবে মুখরা রমণীরা।
নাহিয়ান অপু
“বাংলা ছাড়ো”
গর্ব করে বলে লোকে- শুনি! শুনেছি-
“দাদা আমার ছেলেটা বাংলাটা ঠিক জানে না”!
অহংকার যদি থাকে ভিনভাষাতে, বাংলা তবে কি প্রয়োজন?
আরবি শিখো, উর্দু-ফার্সি যা কিছু বলো ইংরেজি জানো সাহেব হতে,
বাংলা শিখে কাজ কি তাতে?
গরীব ভাষা ছোটলোকরা বলে ও ভাষাতে কাজ নেই!
কাজ যদি থাকে ইংরেজিতে! ইংরেজিতে! ইংরেজিতে!
বাংলা বলো? বড্ড বাজে! গরীব আর থেকো না বাপু ইংরেজি শিখো!
ধনী হও! কামেল হও আর্বীতে। হিন্দি বলো তাও কাজের,
হিন্দিও বেশ ভালোও বটে!
বাংলা ছাড়ো বাংলা ছাড়ো,
সময় তো সে অনেক হলো এবার বাপু বাংলা ছাড়ো,
না হয় ভাগো না হয় ভাগো।
মোসলমানের সাচ্চা ভাষা আর্বী তবু বলতে পারো।
খেয়ো না ডাল মাসকলাই আর মুগ মুড়িঘন্টক,
ভর্তা-শাশনী দূরে রাখো দূরে রাখো!
পান্তা তুমি খেয়ো না যেন, পারো তো স্যান্ডউইজ খাও
ভাত-মাছ ও তো তোমার খাদ্য নয়
সাহেব হতে চাও যদি বার্গার খাও, খেতে পারো ফ্রাইড চিকেনও
সাহেব হতে যদি পারো ছাড়ো তবে বাঙালিয়ানা।
পড়তে শিখো গাউন ডিসকোট শাড়িতে আর কাজ কি বলো?
ও তো গ্রাম্য ভূতেরা পড়ে
ভূত না থেকে মানুষ হও মানুষ হতে শর্টস পড়ো!
কোট পড়ো প্যান্টও সাথে।
একতারা-তবলায় কি হবে বলো বাঁশের বাঁশি বাজাবে কেন?
কেনইবা ডুগডুগি-ঢোল? হারমোনিয়াম তবে ছাড়ো
ড্রাম-গিটারে চলছে ভালো মাউথঅর্গানও মন্দ কি?
বলছি তবে বাংলা ছাড়ো! ও কালচারে কাজ কি বলো?
পারো তো ক্রিকেট খেলো জাতীয় খেলা ওই তবে
হা-ডু-ডু তুমি খেলবে কেন?
ফুটবল খেলো ফুটবল খেলো
নৌকাবাইচে কাজ কি বলো? পারো তো বাপু বাংলা ছাড়ো।
গান তুমি শুনবে যখন ভাওয়াইয়া তুমি শুনবে কেন?
পল্লিগীতি-বাউলগানে আছে কি বলো?
ভাটিয়ালিতেই বা আছে কি?
শুনবে তুমি মার্লি-ডিলান জ্যাকসন তুমি ভুলবে কেন?
ভুলতে যদি পারো তবে, বাংলা ভুলে বাংলা ছাড়ো!
বলছি বাপু দেশপ্রেমের বুলি ভুলে বাংলা ছাড়ো না হয় মরো!
বাংলা ছাড়ো! বাংলা ছাড়ো! বাংলা ছাড়ো।
মনিজা রহমান
ছায়া দীর্ঘতর হয়
বহুবার ভুলস্টপে ভুল ঠিকানায় নেমে গিয়েও
অচেনা বাসে চড়ার অভ্যাস যায় না
অচেনা বাস, অচেনা স্টপেজ
নিরুদ্দিষ্ট হতে প্ররোচিত করে বারবার।
এমন ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে
বহু পথ হেঁটে ঘরে ফিরি শেষ বিকেলে
পিছু পিছু ফেরে আমার ছায়া
যে ছায়া গোধূলি বেলায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়-
ঢেকে দেয় লন্ডোম্যাট, গ্রোসারি শপ, পথের ধারে ডাইনারগুলি।
কোনদিন ছায়া আমাকে গিলে খায়
নিঃস্ব রিক্ত হয়ে বসে গুনি নদীর ঢেউ
মালবাহি জাহাজ চলে গেলে নদীতে প্রচুর ঢেউ ওঠে
কবি বলেছিল, প্রবাহমান নদী যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে
আমি তবু অচেনা জাহাজে চড়ার স্পর্ধা করি না
যদি সে জাহাজের নাবিক সমুদ্রে নিয়ে যায়
সমুদ্রে বড় ভয়।
ছায়া এড়াতে রঙীন প্রকৃতি দেখি
এ বছর চেরি গাছে আগেভাগে ফুল এসেছে
আগের বছরেও কি এভাবে গেয়েছিল
বসন্তের আগমনী গান?
মনে করতে পারি না
বরং ফুলের সৌন্দর্য্য দেখায় মন দেই
ফুলের সাথে স্মৃতির সৌরভ ভেসে আসে-
সেই দূর অতীত থেকে
সুখস্মৃতির পাশাপাশি থাকে কিছু দীর্ঘশ্বাস,
বিগত সব অনুভূতিগুলি বড় ক্ষণস্থায়ী ছিল
চেরি ফুলগুলির মতো!
আমি চেনা অচেনা বাসে চড়ে যাই গন্তব্য থেকে গন্তবান্তরে
জানালার কাচে রঙিন আলোর ঝিকিমিকি দেখি
ড্রাইভারের নিরাসক্ত চেহারায় দুর্লভ কৌতুকের ঝিলিক দেখি
যাত্রীদের ফোনালাপে বহু ভাষার রেডিও স্টেশন ঘোরে
শুধু দেখতে চাই না পিছু আসা ছাযাটিকে।
ছায়া এড়াতে বহু পথ ঘুরে বাড়ি ফিরি এখন
সন্ধ্যার গৈরিক প্রকৃতি বৈরাগী হতে প্ররোচিত করে
তবু আমি ঘরে ফিরি
আর সন্তর্পণে লাগিয়ে দেই ঘরের দরজা।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়
ঝিনি চাদরিয়া
এই যে তুমি আমার স্মৃতি তর্পণ কর
ঘাটে ঘাটে উত্তরীয় ভিজিয়ে,
নিংড়ে ফেলে দিয়ে রক্তমাংস সময়,
সযত্নে ছড়িয়ে দাও
সুতোর ফাঁকে লেগে থাকা
আমার অতীত শস্যদানা
সবুজে ভরে যায় পিছনের মাঠ
লোভ হয় ফিরে দেখি,
ঘ্রাণে নিই সুবাসের পরিপক্কতা
কিন্তু আমি যে দিগন্তের দিকে যাবো
সূর্যের আলোয় ধুয়ে নেবো চোখ
জীর্ণ শুদ্ধ উত্তরীয়টি ফিরিয়ে দাও
গায়ে দিয়ে পাড়ি দেবো বাকি পথ
রওনক আফরোজ
হৃদয়ের ঠিকানা
যেখানে মেঘের ছায়া দীর্ঘতর ছিল
সেখানে ঢেউহীন জল সবুজ আলজির দখলে;
পাতায় থাকে না প্রাণ,
ক্লোরোফিল ফিকে হতে হতে মরে যায়;
অসুখের বীজ বাড়ে গতিহীন বাতাসে
জীবনের স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল উঠোন,
বারবার পড়ে যাই,
নিশ্বাস বারবার বন্ধ হয়ে আসে।
তবু আকাশের দরোজা খুলে গেলে
আবার আলো মন ও জানালায়;
পাখি ডাকে, প্রজাপতি ওড়ে,
চপল কাঠবিড়ালি সচেতন নাচে,
ঢেউ খেলে নদী ও উপত্যকায়,
রঙিনঘুড়ি ওড়ে দূর সোনালি আকাশে।
থাক না খোলা ঘরদোর, চিলেকোঠা, করিডোর;
কেইবা এখানে বিনা নিমন্ত্রণে আসে?
কে চুরি করে রোদ, জোনাকি,
আমাদের পারিজাত ভালোবাসা,
কে নেবে গোলাপের সৌরভ
লুটপাট করে কে গোপন এ অনুভব?
কে নেবে বলো দেবদারুর দোলায়িত শাখা,
পরিযায়ী পাখির ফেলে যাওয়া দুটো পাখা!?
খুলে যাক হৃদয়ের সীমানা;
পাবলিক করে দাও আমাদের ঠিকানা।
রজব বকশী
বৈশাখ
সামান্য বাতাসে গাছটার মাথা দুলে ওঠে
গোড়ার নড়ন টের পাওয়া যায়
প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে আগাগোড়ার কী হাল হয়
সে আর বলতে
রুদ্র বৈশাখ নাড়িয়ে যাও
দেখো নির্ভীক পথিক
দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যায়
আঘাতে কীভাবে শক্তি ও সাহস প্রতিঘাত করে
সুমন শামসুদ্দিন
বর্ষ শুরুর গান
নবীন পাতায় বাতাস দোলে,
নাচন লাগে ঋতুর কোলে।
গ্রীষ্মে দমক দিগন্ত আজ,
গগন-ভূমি বিচিত্র সাজ!
বর্ষ শুরুর সূর্য হাসে,
বোশেখ মাসের সজীব ঘাসে।
বৈশাখী ঝড় থেমে গেলে,
ভুবন হাসে কিরণ জ্বেলে।
বাতাস ভরা মধুর সুঘ্রাণ,
মৌসুমি ফল জুড়ায় যে প্রাণ।
নব প্রভাত পাখির গানে,
আনন্দ আজ মুক্ত প্রাণে!
দুঃখবিষাদ দ্বন্দ্ব ভুলে,
ভিড়বো সবাই স্বপ্নকূলে
ঘুচবে সকল ক্লান্তি-জরা,
নতুন বেশে সাজবে ধরা।
বর্ষবরণ ডালা সাজাই,
নতুন দিনের গান গেয়ে যাই।
************************