You are currently viewing পিপুফিশু – ১২ ||  আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু – ১২ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

কিস্তি – ১২

মি. কার্লেও বাবা বটে! 

পুরো রেস্টুরেন্ট মানুষের কোলাহলে গম গম করছে। লিনোরা বলেছে ডানদিকের একেবারে কোণার টেবিলটা আমাদের জন্যে রিজার্ভ করা হয়েছে। আমাদের বলতে আমি, সে ও তার বাবা মি.কার্লে। লিনোরা তো বাবা বলতে অজ্ঞান। বাবা এমন, বাবা তেমন বলতে বরতে সে মি. কার্লেকে আমার কাছে অতি পরিচিত করে তুলেছে। এখন বোঝা যাবে আসলে উনি কেমন, কিভাবে উনি আমাকে গ্রহন করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও উনার পছন্দ অপছন্দকে আমি কেয়ার করি না, তারপরও কেন জানি বুকটা দুরু দুরু করছে। লিনোরার তুলনায় এদেশে আমার যোগ্যতা যে একেবারে ঠনঠন তাতো অস্বীকার করার জো নেই। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোয়ালিফিকেশনকে আমেরিকায় গ্রহন করা হয় না। বাংলাদেশ তো কোন ছার। সেজন্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সার্টিফিকেট চাকুরীদাতারা একপাশে সরিয়ে রেখে বলেন, ইউ হ্যাভ টু গো টু স্কুল হেয়ার। সাদা অর্থে, তোমার সার্টিফিকেট গ্রহনযোগ্য নয়। এখানকার স্কুলে যাও, ইনভেস্ট করো দ্যান চাকুরীর জন্যে এসো। কিন্তু যাকে ইনকাম করতেই হবে তার পক্ষে স্টুডেন্ট হওয়া সম্ভব নয়। আর সেজন্যেই ফ্যাক্টরী থেকে ফ্যাক্টরীতে ঘুরে মরতে হচ্ছে। সে অর্থে লিনোরা অনেক ভাগ্যবতী। অবশ্য লিনোরার মধ্যে আমি এখনো পর্যন্ত কোন রকম অহংবোধের বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। ওকে যেমন মাটির মানুষ মনে হয় মি. কার্লেও নিশ্চয় সে রকম হবেন। শোনা যায়, মেয়েরা স্বভাবতঃ বাবার ধাঁচের হয়। তাহলে বাঁচা গেলো।
লিনোরার পছন্দ মতো আমি একটা ব্লু রংয়ের স্যুট পরেছি, সাদা শার্ট, লালের ওপর সোনালী স্ট্রাইপের টাই আর কালো জুতো। মি. কার্লের নাকি এই কম্বিনেশন হট ফেবারিট। খাওয়ার মধ্যে রেড লবস্টার আর ওয়াইনের মধ্যে জিন তার খুবই প্রিয়। দেখা যাক এখন মি. কার্লে আমার গেটআপ দেখে কি রিএ্যাক্ট করেন।
আমি সটান বিরাট রেঁস্তোরার ডানপাশ ধরে হেঁটে কোণার দিকে এগিয়ে এলাম। এই রেঁস্তোরাটা আমার পরিচিত। লিনোরা, জন আর সিন্ডিকে নিয়ে বার কয়েক এসেছি এখানে। এখানে কয়েকজন বাঙালী সুনামের সাথেই কুকের কাজ করে। আমাকে দেখে তারা হাসি ছুড়ে দেয় কিন্তু কারো সাথে কথা হয়নি তেমন। আমি সচ্ছন্দে কোণার টেবিলের কাছে চলে এলাম। আড়চোখে একবার ঘড়ি দেখে নিলাম, একেবারে রাইট টাইমে পৌঁছে গেলাম। লিনোরা বলেছে, মি. কার্লে নাকি পাঙ্কচ্যুয়ালিটির ব্যাপারে যথেষ্ট কড়া। তার একটাই কথা, ঘড়ির কাঁটা ধরেই আমি সাকসেস পেয়েছি। সো টাইম ইজ মাই মটো। সেটা মাথায় রেখে আমি একটু আগে ভাগেই রেঁস্তোরায় পৌঁছে গেছি। প্রথম পরীক্ষায় পাশ।
কোণার টেবিল থেকে পথের দিকে চোখ মেলে রাখা লিনোরার সাথে চোখাচোখি হলো। সে স্বস্তির এক টুকরো ছড়ালো ছন্দময় ভঙ্গীতে। মি. কার্লে পেছন ফিরে বসাতে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে শরীর দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ স্বাস্থ্যবান। মাথাভর্তি চুল। আমি সপ্রতিভভাবে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ড্যাডি আতিক, লিনোরা মি. কার্লের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
গুড আফটারনুন মি. কার্লে।
গুড আফটারনুন ইয়াংম্যান।

তিনি ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রশস্ত ডান হাত এগিয়ে দিলেন। আমিও হাত বাড়িয়ে শেক করলাম। আসলে মি. কার্লে যথেষ্ট সুপুরুষ। গোলগাল মুখটায় জ্বল জ্বল করছে এক অপূর্ব দীপ্তি। তিনি হাত ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে আমাকে বসতে বলে নিজেও চেয়ার টেনে নিলেন।
তোমাকে দেখার জন্যে আমি গত কিছুদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, তিনি ঝরঝরে গলায় বললেন, এই প্লানেটের অন্যপ্রান্তের এক যুবককে দেখে সত্যি আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।
লিনোরার কাছে আপনার কথা এতো শুনেছি যে, আপনাকে দেখার জন্যে ভীষণ কৌতুহল অনুভব করেছি, আমি যথাসম্ভব উচ্ছ্বাস সংযত রেখে বললাম, দেখে খুব ভালো লাগছে।
আমারো, তিনি আমার দিকে পূর্ণচোখে তাকালেন, তোমাকে তো এই স্যুটে জব্বর মানিয়েছে- ।
ধন্যবাদ।
বাহ, তোমরা যে আমাকে একেবারে ভুলে গেলে ! কপট অনুযোগের গলায় বললো লিনোরা !
শোনো কথা ! মি. কার্লে প্রাণখোলা হাসলেন, তোমার মাঝেই তো আমরা এখন। ইউ আর দ্য হোস্ট। এখন অর্ডার লাগাও।
মেনু আতিক ঠিক করুক, লিনোরা বাম চোখটা সরু করে মৃদু ইঙ্গিত করলো।
নট ব্যাড, মি. কার্লে সায় দিলেন, গো এহেড আতিক –
আমি মেনু বুক টেনে নিয়ে লিনোরার ইন্সট্রাকশন মতো অর্ডার প্লেস করলাম।
খেতে খেতে মি. কার্লে রাজ্যের গল্প ফেঁদে বসলেন। তিনি যে একজন ভালো বলিয়ে তা তার অনর্গল বলার ভঙ্গীতে আর এক গল্প থেকে অন্য গল্পে সাবলীল গতিতে চলে যাওয়া দেখে সহজেই বোঝা যায়। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে তিনি ক্রমশঃ কথা ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশ সমাজ রাষ্ট্র আর গ্লোবাল পরিমন্ডলে। বোঝা গেলো তিনি যদিও ব্যবসা করেন কিন্তু জ্ঞানের পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। অর্থাৎ একজন ভালো পড়–য়া। দেখা গেলো তিনি ভারত উপমহাদেশের বহু বিষয়ে বেশ ভালোই ধারণা রাখেন।
তোমার কি ধারণা, চৌনএনলাই আর কিসিঞ্জার যেমন বলেছিলো, বাংলাদেশ ভারতের ক্যান্সার হবে একদিন, তা কি সত্য হবে ?
হতে পারে, আমি একটু ভেবে বললাম। কারন বিষয়টা আমার কাছে খুব পরিষ্কার নয়। ভাষা ভাষা কিছু শুনেছি। আসলে এসব তথ্য এখন কিছু কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। সব জানিও না। তবুও সাধারণ ধারণা থেকে বললাম, হতে পারে।
কেমন ? মি.কার্লে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
তখন চীন আর আমেরিকা বাঙালীদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে খাটো করে দেখেছিলো, আমি বললাম, কারণ তারা দেখেছেন রাশিয়ার সমর্থনে ভারত বাঙালীদের সাপোর্ট দিচ্ছে, অতএব বাংলাদেশ মেনে নেয়া যায় না।
ওদের রাজনৈতিক দৃষ্টিতে সেটাই সঠিক, মি.কার্লে বললেন, কিন্তু ভারত যে বাংলাদেশকে সাপোর্ট দিলো তা কি করে তার জন্যে ক্যান্সার হবে ?
খুবই সোজা ড্যাডি, লিনোরা জবাব দিলো, বাংলাদেশকে ভারত বিদ্বেষী করে তুলে। কারণ বাংলাদেশ হলো মুসলিম প্রধান দেশ। হিন্দুপ্রধান ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ক্ষেপানো খুবই সহজ।
তা করা হয়েছে পঁচাত্তরে, আমি একটু নির্দ্দিষ্ট করলাম, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির উম্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে।
নষ্ট রাজনীতিকদের নষ্টামী আর কি ড্যাডি, লিনোরা রুষ্টতা প্রকাশ করলো, আমাদের তো এখনো শিক্ষা হয় না যে, দুধকলা দিয়ে যে সাপ পোষা হয় তা-ই ছোবল মারে। এখন যাদের বিরুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে তারা কারা, কাদের তৈরী সেটা সবাই জানে।
বাংলাদেশ এখন অনেক বেশী ভারত বিদ্বেষী, বলা যায় মৌলবাদের উত্থান ভারতের গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি সৃষ্টি করছে, আমি বর্তমান চিত্রের দিকে আলোকপাত করতে চাইলাম।
ভালোই বললে তোমরা, মি. কার্লে ন্যাপকিনে মুখ মুছলেন, আমরা রাজনৈতিক না হলেও যে জ্ঞান রাখি আলোচনায় প্রমাণ পাওয়া গেলো। এটা ভালো। আমি চাই লিনো নিজেকে একজন স্কলার হিসেবে গড়ে তুলুক। তা তুমি কি ওকে রেস্ট অব দ্য লাইফ সহায়তা করতে রাজী আছো ?
ইট ডিপেন্ডস, সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ায় আমি একটু থমকালাম, বিষয়টা দ্বিপাক্ষিক। লিনোর সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো। কিন্তু মুশকিল হলো, এদেশে জামা বদলানোর মতো সবাই বন্ধু বদলায়। লিনো যদি কখনো -।
আশংকা সঠিক, মি. কার্লে ছোঁ দিয়ে কথা কেড়ে নিলেন, আর তাও নির্ভর করে অবস্থার ওপর। তবে কথা হলো, সদিচ্ছা।
আমি ওকে সারাজীবন আগলে রাখতে চাই, আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম, আমাদের এটাই কালচার।
আমারও, মি.কার্লে হাসলেন সুন্দর করে, অনেকটা লিনোরার মতো, আমি কিন্তু এখনো একজনেই অভিভূত আছি।
তা হলে তো আমাদেরও সমস্যা হবে না, আমি হেসে উঠি।
তবে তোমাকে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরী হতে হবে, মি.কার্লে উঠে দাঁড়ালেন, আমার একটা এপয়ন্টমেন্ট আছে, এ ব্যাপারে পরে আলাপ হবে।
একটু ভাবতে হবে, আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
টেক ইউর টাইম ইয়াংম্যান, হ্যান্ডশেক করলেন মি. কার্লে, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। আশা করি লিনোকে তুমি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করবে। সী ইজ মাই এঞ্জেল।

আই উইল, আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম।
সি ইউ স্যূন, বাই বেবি- মি. কার্লে লম্বা পা ফেলে করিডোর ধরে বেরিয়ে গেলেন। আমরা তার চলে যাওয়া দেখলাম। তিনি বেরুনোর দরোজায় দাঁড়িয়ে ফিরে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। আমরাও প্রত্যুৎত্তর দিলাম।
লিনোরা অভিভূত চোখে তাকালো আমার দিকে। আজকের সকল পরীক্ষায় আমি যে পাশ করেছি ওর হাসি তা বুঝিয়ে দিলো। সে আমার একটা হাত টেনে নিলো হাতের মুঠোয়।
তুমি কিন্তু আমাকে হার্ট করেছো, হাসি না মুছেই বলে লিনোরা।
কিভাবে হার্ট করলাম ? আমি বুঝতে পারলাম না।
তুমি কেনো বললে, লিনো যদি কখনো মন বদলায় ?
এটা তো এখানে আকচার হচ্ছে, না কি ?
যদি বলি, তুমিও তো মন বদলাতে পারো, পারো না ? সপ্রশ্ন তাকালো সে।
আমাদের মধ্যে যে বিপরীত কালচারের মিশ্রণ ঘটবে তাতে যদি কখনো সংঘাত সৃষ্টি না হয় তাহলে কোন সমস্যা হবার কথা নয় লিনো, আমি ওর হাতের ওপর আঙুলের ছাপ দিতে দিতে বললাম, তোমাকেও নতুন অনেক কিছু মেনে নিতে হবে।
তুমি আগে আমাকে বাংলা শেখাও, দেখো আমি সব সহজে ম্যানেজ করে নেবো।
দু’দিন পরে হাল ছেড়ে দেবে না তো ?
সেটা সময় এলে দেখতে পাবে, লিনোরার গলায় দৃঢ়তা ফুটলো, আচ্ছা তুমি জিন নেয়ার সময় মুখটা বাঁকা করছিলে কেন ?
অভ্যাস নেই বলে।
ড্যাডি খুব জিন লাইক করে, এখন আরেকটু নেই ?
নেবে ?
অভ্যাস করা দরকার।
লিনোরা দু’জনের জন্যে জিনের অর্ডার দিলো। প্রায় বিকেল পর্যন্ত আমরা মুখোমুখী বসে তন্ময় হয়ে রইলাম। এভাবে বসে থাকার নতুন অভ্যাসটাও আমি সহজে রপ্ত করে নিলাম।

=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=