নুসরাত সুলতানার তিনটি গল্প
ধমনী
রাফিন ও নাহিদ বিকেলে চায়ের দোকানে টোষ্ট বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছে আর উচ্চতর গনিত নিয়ে কথা বলছে। আবার সাথে সাথে দুই বাড়িতে দুপুরে কী রান্না হয়েছে সেটাও বলছে আয়েস করে। নাহিদের বাবা স্কুল শিক্ষক, মুক্ত চিন্তার অধিকারী, আচার-আচরণে প্রাঞ্জল একজন মানুষ। রাফিনের বাবা পুলিশ পরিদর্শক। একটু চুপচাপ, রিজার্ভ। দুজনের দাদাই মুসলিমলীগের সমর্থক। এই দুজনের যৌবনকাল থেকেই দুই পরিবারের বন্ধুত্ব। নাবান্ন, পিঠা-পায়েস, ইদুল ফিতর- ইদুল আযহা সকল উৎসব আয়োজনে দুই পরিবার মিলেমিশে অনন্দে উদযাপন করেছে বরাবর। এভাবে বন্ধুত্ব এসে গড়িয়েছে তৃতীয় প্রজন্ম অব্দি।
সময় টা ১৯৬৬ সাল। চারিদিকে ছয় দফা আর আগরতলা ষড়যন্ত্রের জন্য উত্তাল আন্দোলন চলছে। মুসলিম লীগের সমর্থক হয়েও নাহিদের দাদা গফুর খান তখন বুঝতে পারছেন, বাঙালির ন্যায্য অধিকার স্বাধিকার আন্দোলন। কিন্তু বুঝতে পারছে না রাফিনের দাদা করিম শেখ। পাকিস্তান তার প্রগাঢ় ভালোবাসা।
তাই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতার নদীতে আর আগের মতো জোয়ার আসে না। গফুর খান আর করিম শেখ প্রতিদিন বিকেলে এলাকার চায়ের দোকান আড্ডায় মেতে উঠত। তাদের হাসির শব্দ শোনা যেত আশেপাশের বাড়ির রান্নাঘর অব্দি।
একদিন চায়ের কাপ হাতেই দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই বন্ধুর।
গফুর খান বলে, নব্বই ভাগ বাঙালির প্রাণের আকাঙ্খা স্বাধীন ভূখণ্ড। শুধু অল্প কজন মুসলিম লীগের সমর্থক এই দাবী অগ্রাহ্য করে লাভ নেই। করিম শেখ বলে, তবু ঈমানের জোরে টিকে যাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রিয় পাকভূমি পাকিস্তান। তারপর বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে করিম শেখ গফুর খানকে বলে, তুমিও হিন্দুদের খাতায় নাম লেখাইও না। গফুর খান বরাবরই জানতেন
করিম শেখ জেদী এবং একগুঁয়ে। এমনকি ধর্মান্ধতাও তার মনোজগতে রাজত্ব করে বেশ। এরপর তিনি বুঝে যান এই সুকঠিন সময়ে ছাড়তে হবে পুরনো বন্ধুত্ব! ধীরে ধীরে পিছটান দিতে থাকেন। এইভাবে ধীরে ধীরে দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন শিথিল হতে থাকে ক্রমশ। তবু দুই পরিবারের নারীদের আছে পিঠা বানানোয় হাত লাগানো। প্রয়োজনে মেহমান আসলে ভাত আর তারকারিও ধার করা চলে। কিন্তু একে অপরের চুলে বিনুনি বেঁধে দিতে আর দেখা যায় না।
সময় ৬৬, ৬৮,৬৯ এবং ৭০ এর শরীর বেয়ে নেমে আসে ৭১ এ।
নাহিদ আর রাফিন তখন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র। দুজনেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
নাহিদ পড়াশোনা করে ইতিহাস বিভাগে আর রাফিন পড়ে অর্থনীতি বিভাগে।
দুই পরিবারের কেউই তাদের কলেজে যেতে দিচ্ছে না।
ডানা ভাঙা পাখির মতো ছটফট করে ছেলে দুটো। রক্তে উত্তেজনা, মগজে অস্থিরতা কিন্তু বন্দী জীবন! প্রায়শই দেখা হয় দুই বন্ধুর। বিকেলে এলাকার চায়ের দোকান কিম্বা ফুটবল খেলার মাঠে। দেশ এবং সময় নিয়ে কথা হয় দুজনের। রাফিন আফসোস করে দেখ বাবা আর দাদা কি করছে! শান্তি বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। নাহিদ বলে, দেখিস গ্রামের মানুষের কোনো ক্ষতি না হলেই হয়। আর তুই কখনো এসব জঘন্য কাজ করিস না। দেশ বাদ দিয়ে ধর্ম হয় না।
২৫ শে মার্চের পর দেশের পরিস্থিতিতে নাহিদ অস্থির হয়ে ওঠে। বাবাকে মনের কথা খুলে বলে। বলে, বাবা আমি যুদ্ধে যেতে চাই। দেশমাতা আজ রক্তাক্ত বিবস্ত্র। তাকে ক্ষত-বিক্ষত করছে নেকড়ের দল আর খুবলে খাচ্ছে শকুনিরা। এই পরিস্থিতিতে ঘরে চুপ করে বসে থাকা যৌবনের ধর্ম বিরোধী।
নাহিদের বাবা বুঝতে পারে ছেলেকে আটকে রাখা যাবে না। তাই সম্মতি দেয়। তবে বলে,নাহিদ যেন কাউকে না বলে। পাড়াপ্রতিবেশি জানতে চাইলে বলবে ছেলেকে তার নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
চলে যায় নাহিদ যুদ্ধে। দুই পরিবারের অবিশ্বাস এবার তুঙ্গে উঠেছে। কেউ আর কারো সাথেই তেমন কথা বলে না। গ্রামের অদূরেই আছে পাকিস্তানি ক্যাম্প। রাফিনের দাদা করিম শেখ নিয়মিত পাকিস্তানি ক্যাম্পে হাজিরা দেয়। আর বাবা চুপচাপ থাকে। চেষ্টা করে গ্রামের মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়। কিন্তু মেম্বার করিম শেখের কাছে পরাভূত হয় তার সকল দাবী। মাঝে মাঝেই করিম শেখ রাফিনের বাবার মাধ্যমে পাক আর্মিদের জন্য রান্না করা সুস্বাদু খাবার ও ফলমূল পাঠায়। আর বলে প্রতিদিন একবার স্যারগো কাছে যাবি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জব্বার খানকে করতে হয় কাজগুলো।
গ্রামের তিন-চারজন হিন্দু মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। সহযোগিতা করে রাফিনের দাদা করিম শেখ। গ্রামের বড় বড় ছাগল, ড্যাগা মোরগ, কলার কাদি সব কেটে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি। আর তাদের সহযোগিতা করে দুই রাজাকার ইউপি মেম্বার।
অনেকেই ভয়ে যুবতী মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছে দূরবর্তী আত্মীয়ের বাসায়। ভয়ে ভয়ে দিন পার করে চল্লিশোর্ধ্ব নারীরাও। রাতে কেউই ভয়ে ঘুমায় না। শিশুদের ঘুম দিয়ে বড়রা জেগে থাকে। ভীষণ আতঙ্কে দিন কাটে সাতনরী গ্রামের মানুষদের। খুব শান্তশিষ্ট ভাবে বয়ে চলা একটা নদীর পাশের গ্রামটির মানুষদের ভেতর সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি কিছুরই অভাব ছিল না। পূজা আর ইদ সবই পালিত হয়েছে আপন আলয়ে আনন্দে। সেসব এখন অতীত হতে বসেছে রাজাকার আর পাকিস্তানিদের অত্যাচারে।
এরই মধ্যে নাহিদ একদিন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা কে ছদ্মবেশে পাঠায় গ্রামে।তদের হাতেচিঠি দেয় পরিবারের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে গ্রামের প্রকৃত খবর নিয়ে আসে।
নাহিদের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। মনে মনে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ভাবে- এলাকার মেয়েদের যেকোনো মুল্যে মুক্ত করতে হবে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রাগে, ক্ষোভে এবং প্রতিশোধ স্পৃহায়।
নাহিদ গিয়ে কমান্ডার কে বলে আমার এলাকার মেয়েদের মুক্ত করতে হবে। আমাকে অপারেশন পরিচালনা করার অনুমতি দিন। কমান্ডার বলে, না সেটা নিয়ম নেই। এই সুযোগে তুমি ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে কাউকে হত্যা করতে পারো। সেটা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও নীতির সাথে যায় না। কিন্তু নাহিদ নিজ দাবীতে অনড়। কমান্ডারকে সে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে তাকে অপারেশনের যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য।
অবশেষে ছদ্মবেশে অপারেশন পরিচালনা করতে অনুমতি দেয় কমান্ডার।
নাহিদ যুদ্ধ করছিল ঝালকাঠির সোনাইমুড়ী গ্রামে। গভীর রাতে বিশজন মুক্তিযোদ্ধা সাতনরী গ্রামের পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করে চারজন হিন্দু মেয়েকে উদ্ধার করে। নিহত হয় প্রায় ত্রিশজন পাকিস্তানি আর্মি।
তারপর অভিযান চালায় গ্রামের দুই রাজাকারের বাড়িতে।
ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজ গ্রাম সাতনরীতে অপারেশন পরিচালনা করে নাহিদ। বাবা মাও জানতে পারে না। রাফিনের ঘরে দরোজা ভেঙে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা। অই ঘরের সমস্ত দেয়ালে তিন প্রজন্মের বন্ধুত্বের স্মারক ঝুলানো রয়েছে। এরই মধ্যে একটা ছবি আছে যাতে- রাফিন আর নাহিদ ন্যাংটা। দুই বন্ধু মারামারি করছে আর কাঁদছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা ভয় দেখাতে গুলি চালায় অই ছবিতে। তখন নাহিদ খুব গভীর চোখে তাকিয়ে দেখে ছবিটি। ঠিক তখনই রাফিন তাকায় নাহিদের চোখে। নাহিদ দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। নাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের করিম শেখকে গুলি করতে নিষেধ করেছিল। কিন্ত রমেশ গুলি করে করিম শেখকে। রমেশের বড় বোনকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি আর্মি এবং রাজাকাররা। তার পরই রমেশ যুদ্ধে এসেছে। এই কারণে রমেশ প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় রাফিনের দাদা।নাহিদ কোনভাবেই পরিচয় দিতে পারবে না এই শর্তেই কমান্ডার তাকে পাঠিয়েছে। চলে যাবার সময় রাফিন নাহিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সবটা ঠিক করলেন তো আপনারা! নাহিদ মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায়।
হিন্দু পরিবারগুলো মেয়েদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় না। বাতাস ভারী হতে থাকে হিন্দু মেয়েদের কান্নায় আর অসহায়ত্বে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে।
নাহিদ ফিরে গিয়ে বাবাকে চিঠি লেখে হিন্দু পরিবারগুলো কে বুঝিয়ে মেয়েগুলো কে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে। আরও জানায় কোনো মেয়েকে ফিরিয়ে না নিলে তার ব্যবস্থা যেন নাহিদের বাবা করে।
যুদ্ধ শেষ ফিরে আসে নাহিদ গ্রামে। রাফিন হাসতে হাসতে বলে কিরে নানাবাড়ি বেড়ানো শেষ হল? নাহিদ শুধু মুচকি হাসে। নাহিদ রাফিকে জিজ্ঞেস করে, দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করবি তো? রাফিন বলে, সাথে নিলে অবশ্যই। নাহিদ শুধু বলে দেশটা কি তোর না? এরপর রাফিন গিয়ে নাহিদকে জড়িয়ে ধরে।
কালের পরিক্রমায় নাহিদ কলেজের সহকারী অধ্যাপক আর লেখালেখি করে। রাফিন চার্টার একাউন্টেন্ট। দুজনেরই দুই বাচ্চা। রাফিনের এর দুই ছেলে আর নাহিদের এক ছেলে এক মেয়ে। মাঝে মাঝেই কথা হয় দুই বন্ধুর। রাফিন ঢাকায় থাকে পরিবার পরিজন নিয়ে। প্রায় প্রতি বছরই রাফিন পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসে গ্রামে। নাহিদের ঘরেই থাকে। গ্রামে কেউ আর থাকে না রাফিনের বাবা-মা। নাহিদও প্রয়োজনে ঢাকা গেলে রাফিনের বাসায়ই থাকে। দুই বন্ধুর ছেলে-মেয়েদের ভেতরেও আছে হৃদ্যতা এবং বন্ধুত্ব।
রিদম আর নিলয় দুজনের বেশ ভাব।
হঠাৎ করেই নাহিদের ছেলে নিলয় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানান নিলয়ের হার্টে ছিদ্র আছে। তাকে অনেক কিছু সাবধানে করতে হবে। তবে পাশের দেশ ভারতে নিয়ে হার্ট ট্রান্সফার করতে পারলে বেশ ভালো হয়।
এভাবেই চলে দুই বছর। আচমকা একদিন রাফিন জানায় ওর ছেলে রিদমের জ্বর আসে প্রায়ই ওজনও কমে গিয়েছে অনেক। ইন্ডিয়া যাবে ডাক্তার চেক আপ করানোর জন্য। ইন্ডিয়া গিয়ে ডাক্তার জানায় রিদমের স্টেজ ফোর ক্যান্সার। আর বড় জোর একমাস সময়। ইন্ডিয়া থেকেই রাফিন নাহিদের সাথে কথা বলে। নিলয় কে নিয়ে ইন্ডিয়া যেতে বলে নাহিদকে। শুধু বলে যে, নিলয়ের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে ইন্ডিয়াতে। বাকি কথা নাহিদ গেলে জানাবে। চলে যায় নাহিদ আর নিলয়। রাফিন বলে ডাক্তারের কাছে চল। নাহিদ জানতে চায় কি হবে? রাফিন বলে, ডাক্তারখানা গিয়ে বলবো। পরে রাফিন জানায় রিদমের স্টেজ ফোর ক্যান্সার। আমি চাই রিদমের হার্ট নিলয়কে দিতে। নাহিদ বিষ্ময়ে বিমুঢ়! হাত ধরে, চোখের জলে মিনতি করে বলে, না করিস না! আমি ওর বুকে মাথা রেখে রিদমের হার্টবিট শুনব। নাহিদের চোখ থেকে ঝরে পড়ে ফোঁটায়, ফোঁটায় নোনা কৃতজ্ঞতা।
ম্যাজিকালি মিলে যায় সব। রাফিন, নাহিদ, নিলয়, সবাই দেশে ফেরে শুধু রিদম আসে লাশ হয়ে।
সেই থেকে নিলয় যেমন নাহিদের ছেলে তেমনি রাফিনের ও ছেলে। প্রতিটি ইদ, পহেলা বৈশাখ, জন্মদিন সব উৎসবে নাহিদ যেমন ছেলেকে উপহার দেয়, রাফিনও দেয়। খুব দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং স্বল্পভাষী নিলয়। পড়াশোনা করেছে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেছে নিয়েছে সাংবাদিকতা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছে। প্রায়ই এ নিয়ে কথা হয়।
নিলয়ের গবেষনা বই “রক্তজবা ” প্রকাশিত হয়। আর তাতে অন্যতম রাজাকার হিসেবে নাম যায় রাফিনের বাবার। তারই ভিত্তিতে এরেষ্ট হয় জব্বার খান। জাভেদ এবার গ্রামে এসে সরাসরি নাহিদের বাসায় আসে, বলে তুই যে আমার দাদাকে মেরেছিস এটা আমি জানি।এবার তোর ছেলে এটা কি করলো? আমি আমার ছেলের হার্ট দিলাম ওকে তার এই প্রতিদান! নাহিদ বলে, হার্ট তো তোর ছেলের সে এমন চিন্তা করলো কেন? রাফিন বলে রক্ত তো তোর আর ক্যাম্পে থাকা ঐ বীরাঙ্গনা নন্দিতার যাকে তুই ধর্ম পাল্টে বিয়ে করেছিস। নাহিদ বলে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। ঠিকভাবে কথা বল। রাফিন চটে গিয়ে বলে, তোর রক্ত তাই তোর মতো ই কাজ করলো। রক্ত থেকে কখনো পালানো যায় না। আমি তোদের ঘৃণা করি তোরা আমার দাদা বাবার খুনি!
যুদ্ধ জন্ম
মঞ্চে গম গম কণ্ঠে গোলাম মুস্তাফা পাঠ করে চলছেন; “দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পাড়।”
ফুলে উঠছে কনকের চোয়াল। বজ্রমুষ্ঠি হয়ে যাচ্ছে। পাশেই নীরা বসে খেয়াল করছে কনককে।
মাঝখানে চা বিরতি হলে কনক পরিচিত হয়।
নীরা বলে আপনি তো আবৃতিতে মিশে যাচ্ছিলেন।
কনক লাজুক ভঙ্গিতে হেসে ওঠে। কনকের আকাশী নীল শার্ট, কালো প্যান্ট, চোখে চশমা পরিশীলিত ব্যাক্তিত্ব নীরার ভালো লেগে যায়।
নীরা পড়েছে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। কালো পুথির মালা। বড় কালো টিপ। চোখ লেপ্টে কাজল পরেছে।
দুজনেই সংস্কৃতি মনা।দুজনেই পছন্দ করে গান আর আবৃতি। কনক সমাজ বিজ্ঞানে এম এ পড়ছে আর নীরা বাংলা সাহিত্যে বি এ অনার্স শেষ বর্ষে।
দুজনেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনা হওয়ার কারণেই হয়তো পরিচয় থেকে একটু দ্রুতই প্রেমে জড়িয়ে পরে।
সময়টা ১৯৭০ সাল।এম এ পরীক্ষা শেষ করে কনক বরিশাল হাতেম আলী কলেজে প্রভাষকের চাকরি তে যোগদান করে। এরই মধ্যে নীরার ও এম এ শেষ হয়ে যায়। কনক বাড়িতে নীরাকে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে।
নীরার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ডাগর চোখ আর দীঘল কালো চুল কনকের বাবা মাকে আকৃষ্ট করে।তারপর যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে শোনালো, ” আমি তোমারো সংগে বেঁধেছি আমারও প্রাণ,সুরের ও বাঁধনে”
কনকের বাবা ভূয়সী প্রশংসা করেন, বলেন মা নিয়ে যাবো তোকে আমার বাড়ি।
দুই পরিবারের সম্মতিতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ঘরোয়া ভাবে কনক নীরার আকদ সম্পন্ন হয়। কথা হয় এপ্রিল মাসে নীরাকে তুলে নেয়া হবে। এর মধ্যে কনক আর নীরার দেখা হবে না।
২৫ শে মার্চ ভয়াল রাতের পর এই জনপদের সব মানুষের জীবনের ইতিহাস, ভূগোল সব পালটে যেতে থাকে। কনক ছটফট করতে থাকে দেশের দূরাবস্থায়।
অনেক বন্ধুরা চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর জন্য।
অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করায় কনক।যদিও পাশের গ্রামে তাও সহজে দেখা করার রীতি নেই।এক ছোট ভাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেখা করে একটা গ্রাম্য রেস্তোরাঁয়। জানায় কনকের সিদ্ধান্ত। নীরা বলে আমি তোমার জন্য গর্বিত। বিজয়ী যোদ্ধার বাড়িতে আমি যাব বিজয়িনীর বেশে।
চলে যায় কনক।মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর জন্য।ট্রেনিং শেষ করে বরিশালের ঝালকাঠি তে কনক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দায়িত্ব পায়।সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক।শরতের আগমন।সাদা মেঘ,কাশফুল , জোছনা সব যেন যুদ্ধর ভয়াবহতা ছাড়িয়েও নীরার মনকে অস্থির করে তোলে কনকের জন্য।নীরা শুধু ভাবে কনকের কি একবার ও তার কথা মনে পরে না?!
একরাতে নীরা গুনগুনিয়ে গাইছে” সখী কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রান নাথ আসিতে পারে”।এমন সময় হঠাৎ জানালায় টোকা শুনতে পায় নীরা।রাত ১ টা তখন।কনক যত আস্তে বলা যায় বলে আমি কনক।শুনতে পায় না নীরা। তারপর বলে তাদের ভালোবাসার সাংকেতিক কোড ৭৭৭।নীরা ত্রস্ত হয়ে জানালা খুলে থ! কনক বলে দরজা খুলবে না?! দরজা খোলে নীরা।গ্রামের মানুষ সব রাত ১০ টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে।আর তখন রাত ১.৩০।নীরা কনকের জন্য হাত,মুখ ধোয়ার পানি নিয়ে আসে।রান্নাঘর থেকে ভাত নিয়ে এসে নিজ হাতে কনক কে খাইয়ে দেয়।তারপর মহাকাল এক ঘন্টা থেমে থাকে আদরে আর সংগমে। রাত চারটায় কনক আবার চলে যায়। যাওয়ার সময় দেখতে পায় হিন্দু বিধবা রমলা মাসি। নীরা বুঝতে পারে, রমলা মাসির হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে।চুপ হয়ে যায় রমলা।
মেয়ের হাসিখুশি মুখ থেকে নীরার মা ভাবেন কি হয়েছে মেয়ের কে জানে?!বিধি বাম অক্টোবরের শেষের দিকে মিলিটারি হামলা হয়। নীরা সহ অনেককেই ধরে নিয়ে যায় পাক আর্মি রা। নীরার সামনেই কলুষিত করে জোছনা আর মালাকে।নীরাকে স্পর্শ করতে আসলে নীরা মদের বোতল ভেঙে আঘাত করে পাক মেজর কে।তারপর দৌড়ে পালিয়ে লুকিয়ে ডুব দিয়ে থাকে সামনের ডোবায়।একটু ভোরের আলো ফুটলে চলে আসে বাড়িতে।সব কথা খুলে বলে মাকে।নীরার বাবা পাঠিয়ে দেয় নীরাকে নানা বাড়ি।
নীরাদের বাড়ি থেকে চার গ্রাম পরে কনকদের বাড়ি।কনকদের গ্রামে খবর রটে যায় যে নীরাদের গ্রামে মিলিটারী হামলা হয়েছে এবং অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে।খবর নিতে আসে কনকের বাবা।নীরার মা সত্যি বলেন যে নীরা পাক মেজরকে আঘাত করে চলে এসেছে নীরার কোন ক্ষতি করতে পারেনি।কারণ নীরার মা ভাবেন,যেহেতু সবাই সবকিছু জানেন তাই লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। কনকের বাবা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যান।
ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখ কনক বাড়ি ফিরে আসে।এসে বাবা মাকে জানায় নীরাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে চায়।নীরাকে তুলে নেয়ার জন্য কথা বলতে আসে। এসে কনকের মায়ের চোখে পড়ে নীরার ফ্যাকাশে চেহারা।তিনি নীরার মাকে বলেন,কি হয়েছে আপনার মেয়ের? সে তো গর্ভবতী! নীরার মা বলেন কি বলেন আপনি আপা?! কনকের মা বলেন জিজ্ঞেস করে দেখেন তাকে আপনি? এবার নীরার মা জিজ্ঞেস করেন নীরাকে। নীরা বলে হ্যা সত্যি কিন্তু এ সন্তান কনকের আর কারও নয়।
অবিশ্বাসে কনকের মায়ের চোখ থেকে আগুন বেরুচ্ছে। তিনি বলে বসেন অসভ্য মেয়ে নিজের কলংক এখন আমার ছেলের ওপর চাপাচ্ছো? নীরা বলে আপনি আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করবেন।বাড়ি গিয়ে কনকের মা বলেন, তোর বউ পোয়াতি।বলে ওর গর্ভে তোর সন্তান।তুই কবে গেছিস ওর কাছে? কনক বলে গিয়েছিলাম সেপ্টেম্বর মাসে। কনকের বাবা মা বলে, পিরিতে অন্ধ অইয়া গেছিস? নষ্ট মেয়ে ঘরে আনবি! তুই যে গেছিলি তার কি প্রমান আছে? কনক বলে আমি তো গেছি গভীর রাতে।কেউ কি করে দেখবে?
কনকের বাবা নীরাদের গ্রামের চেয়ারম্যান এর সাথে দেখা করেন।প্রমান করতে বলেন যে এই সন্তান তার ছেলের! চেয়ারম্যান কনকের মতামত জানতে চাইলে, তিনি বলেন আমার ছেলে প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে।আমি অন্য প্রমান চাই।নীরা রমলা মাসির নাম বলে।শালিশ এজলাসে দাঁড়িয়ে রমলা মাসি বলে আমি কিছুই দেখিনি।কনকের বাবা একগাল হেসে বলেন এই নষ্ট মেয়ে আমি ঘরে তুলবো না! দরকার হলে ছেলেকে ত্যাজ্য করবো।
কনকের ভীত, নিষ্পৃহ চেহারা নীরাকে অবাক করে।চলে যায় কনক ও তার বাবা মা।দুইদিন পর কনক খবর পাঠায় গাঁয়ের রেস্তোরাঁয় দেখা করতে চায় নীরার সাথে।কনক বলে তুমি আমাকে জানালে না কেন? আগেই কেন সবাইকে বলে দিলে! তোমাকে আমি বিশ্বাস করি! কিন্তু বাবা মাকে বোঝাতে পারছি না।তুমি বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও।আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাবো।দুই বছর পর তোমাকে নিয়ে যাবো।নীরা শুধু বলে, এজন্যই চুপ করে ছিলে আমি আমার ভালোবাসার সম্পদ বরবাত করতে পারবো না। আর কোনো কাপুরুষের ঘরেও আমি যাবো না।
দুই মাস পরে নীরার বাবা এসে খবর দেয় কনকদের এলাকার চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে কনকের বিয়ে হয়েছে। নীরার চোখে এবার আগুন।চোখের জলে প্রতিজ্ঞা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আর সন্তান কে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তোলার। নীরার বাবা আইনের আশ্রয়ে যেতে চান। নীরা বলে না ওকে আমি জীবন ভিক্ষা দিলাম। নীরার বাবা জানেন সংকীর্ণতা এবং অন্যায়ের সাথে আপোষ কোনটাই তার মেয়েকে দিয়ে হবে না। তিনি পাষানে বুক বেঁধে বলেন ঠিক আছে। তোর মা,আমি, তোর ভাই সবাই আমরা তোর পাশে আছি।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষকের চাকূরীর পরীক্ষা দিয়ে নীরা ৫ ম স্থান অধিকার করে। এরই মধ্যে নীরা পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে।নীরা নিজেই নাম রেখেছে শুদ্ধ।নীরার পোস্টিং হয় ঝালকাঠি জিলা স্কুলে।ছোট ভাই নবাব কে নিজের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।নবাবের লেখাপড়া, শুদ্ধকে লালন পালন বাচ্চাদের ভালোবাসা নিয়ে পড়ানো -সব মিলে নীরার সময় ভালো কাটে।আর মাঝে হারমোনিয়ামটা নিয়ে গাইতে বসে।
শুদ্ধকে নিয়ে বাবা মায়ের বাড়িতে আসলে শুদ্ধ এসে একদিন বলে,মা যুদ্ধ শিশু কারা? নীরা বুঝিয়ে বলে শুদ্ধকে যুদ্ধ শিশু কি এবং কারা! শুদ্ধর মুখমন্ডলে হঠাৎ কালো মেঘ। নীরা বলে কি হয়েছে আমার জানপাখিটার? শুদ্ধ শুধায় নীরাকে,” মা আমি কি যুদ্ধ শিশু? নীরা বলে না! তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।মা প্রমান করা যাবে? নীরা বলে,তুমি এখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়।যেদিন তুমি এম এ পাশ করবে সেদিন প্রমানের জন্য আমি সব করবো।শুদ্ধ বলে ঠিক আছে মা।
শুদ্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল এম এর সার্টিফিকেট নিয়ে এসে নীরার সামনে দাঁড়ায়। বলে মা এবার আমাকে বল,পুরো ব্যাপার টা। নীরার ডায়েরী বের করে শুদ্ধ পড়ে শোনায় সেই রাতের কথা। যে রাতে স্রষ্টা ওকে নীরার গর্ভে পাঠিয়েছেন। তারপর সব কথা নীরা খুলে বলে শুদ্ধকে। শুদ্ধ বলে আমি কনক চৌধুরীর মুখোমুখি হতে চাই। আমি একাই যাবো। নীরা বলে আমি আছি তোমার সাথে বাবা।
কোনো এক সকালে কনক চৌধুরী ক্লাস নিয়ে ফিরছিল। দেখে কলেজ করিডোরে তাঁর মতো মুখমণ্ডলের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধ সালাম দিয়ে সামনে এগিয়ে যেয়ে হ্যান্ডশেক করে বলে আমি শুদ্ধ চৌধুরী, আমার মায়ের নাম নীরা, নানার নাম রহিম খান। নড়েচড়ে বসে কনক বলে, কেন এসেছো! শুদ্ধ সরাসরি বলে সব ভূল মেনে নিয়ে আপনি আমাকে পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিন আর জনসম্মুখে আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চান।
কনক চৌধুরী বলে,দেখো তোমাদের যদি টাকা পয়সা লাগে তাহলে সেটা বল।আমি এমনিই দিয়ে দেবো। তার জন্য ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই। আমি একজন প্রফেসর আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি করো না। শক্ত হয়ে যায় শুদ্ধর চোয়াল।শুদ্ধ বলে কনক চৌধুরী আপনার সাথে কোর্টের এজলাসে দেখা হবে।
মামলা দায়ের করে শুদ্ধ কনক চৌধুরীকে বাদী করে।এছাড়াও আছে কনকের বাবা ও তাদের এলাকার চেয়ারম্যান। বিবাদী নীরা।তিন মাস ধরে চলে কোর্টের শুনানি। শুদ্ধ রমলা মাসি কে এনে হাজির করে।রমলা স্বীকার করে কনকের বাবা টাকা খাইয়ে তার মুখ বন্ধ করেছিলো।মালাকে হাজির করে শুদ্ধ যার চোখের সামনে নীরা পাক আর্মি কে মদের বোতলে আহত করে পালিয়েছিলো।সব স্বাক্ষী প্রমানের পরে শুদ্ধ ডি এন এ টেষ্ট দাবী করে। করা হয় ডি এন এ টেষ্ট। এবার অকাট্য প্রমান হয়ে যায় কনক চৌধুরী শুদ্ধর জন্মদাতা।
বিচারে রায় হয় কনক চৌধুরী নীরার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে আর ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ।
বিচারক নীরাকে কিছু বলতে বলে। নীরা এসে দাঁড়ায় এজলাসে। নীরা শুরুতেই সকল নারী মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধ শিশুদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তার বক্তৃতা শুরু করে।বলে মহামান্য আদালত, ১৯৭১ সালের ৮ আগষ্ট কনক চৌধুরীর সাথে রাত দুইটায় যে সঙ্গমে আমি মিলিত হয়েছিলাম তা যতটা শারিরীক ও মানসিক ছিলো তারও বেশী ছিলো আত্মিক।সেদিন আমার নারী জন্ম পরিপূর্ণতা পাবার অনেকটুকু স্বাদ অর্জন করেছিলো।সেদিন মুক্তিযোদ্ধা কনক চৌধুরী কে ভালবাসা দিয়ে শান্তি দিয়ে আমিও শামিল হয়েছিলাম পতাকা পাবার যুদ্ধে। আর যখন বুঝতে পারলাম আমার গর্ভে কারো উপস্থিতি সেদিন আমি পূর্ণতা পেতে আরও অনেকটুকু এগিয়ে গেলাম।আমার সেই আকাঙ্ক্ষিত সাধনাকেই যখন কনক চৌধুরী ধ্বংস করতে বললো ঘৃনা হল ঐ কলুষিত আত্মাকে।সেদিন যদি আমার শরীর কলুষিত হতোও আমি লুকাতাম না! কারণ তাতে কোন লজ্জা ছিলো না। আমার বাবা সেদিনই কনকের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন যেদিন কনক ২য় বিয়ে করেছিলো। কিন্তু আমি ওকে দয়া করেছিলাম। আর আজ যে আপনি ২৫ লাখ টাকা দিতে বলেছেন সেটা আমি কনক কে দিয়ে দিলাম।আজও তাকে করুনা করলাম।আমি একজন সুখী, সমৃদ্ধ মানবী ;আমি দেশ পেয়েছি, সন্তান পেয়েছি,পেয়েছি প্রিয় প্রজন্মকে মাতৃভাষা শেখাবার দায়িত্ব। আমার কোন অতৃপ্তি নেই।
কনক তাকিয়ে দেখে নীরার দৃঢ়তা আর সাফল্যমন্ডিত চেহারা । আর ভেতরে কোথাও গর্ব হয় নীরার জন্য আবার পরমুহূর্তেই কুঁকড়ে যায় নিজের কূপমন্ডুকতার কথা ভেবে।
কথা শেষ করে নীরা চলে যেতে নেয়,এগিয়ে আসে কনক। অশ্রু সিক্ত নয়নে হাত জোর করে ক্ষমা চাইতে নেয়। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নীরা চলে যেতে নেয়।
পেছন থেকে আসে শুদ্ধ বলে মা আজ সারা বিশ্বের কাছে প্রমাণিত যে; আমার জন্ম যুদ্ধের সময় হলেও আমি যুদ্ধ শিশু নই। আমার কোন অবিশ্বাস ছিলো না।আমি জানি আমার মা মিথ্যা বলতে পারে না! কিন্তু প্রমান দিয়েছি বিশ্বকে যে আমার শরীরে কোন পাকিস্তানির রক্ত নেই।অবিশ্বাসী, কাপুরষ হলেও আমার জন্মদাতা একজন বাঙালী এবং মুক্তিযোদ্ধা।নীরা বলে এভাবে বলো না। সব নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) আমার বোন তারা স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছে আর সব যুদ্ধ শিশু আমার সন্তান লাল সবুজ পতাকা জন্মের সাথে, তাদের জন্ম জড়িয়ে আছে।শুদ্ধ মায়ের পা স্পর্শ করে বলে,তুমি একজন মহান বিপ্লবী নারী। নীরা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কপালে এঁকে দেয় ছোট একটা চুমু।
গিরিবালা
“আমারো দেশেরও মাটিরও গন্ধে ভরে ওঠে সারা মন
শ্যামল-কোমলো বরষ ছাড়া যে নেই কোনো প্রয়োজন ”
গানের সাথে সাথে
মোমের মতো যেন গলে পড়ছে গিরির হৃদয়।
সকালে ছটা বাজতেই শুরু হয় গিরিবালার গানের স্কুলের রেওয়াজ। প্রথমেই শুরু হয়, করো পন আজীবন সৎ পথে থাকবে, চিরকাল সত্য যা তাই শুধু বলবে।”
তারপর একে একে, “ধন-ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এ বসুন্ধরা”, “তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছ নীচে, আমায় নইলে ত্রিভুবনে ঈশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।” হিন্দু-মুসলিম মিলে মোট দশজন ছাত্র-ছাত্রী গিরিবালার। সাতজন ছাত্রী আর তিনজন ছাত্র। গানের রেওয়াজ যখন চলে গিরিবালা তাতে সমস্ত মন-প্রাণ সমর্পণ করে দেন। যেন এটা তার শ্রেষ্ঠ পুজা। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলেই শেখানোর দায়িত্ব দিয়ে দেন নতুন মাস্টার নববী চৌধুরীকে। বয়সের ভারে এখন আর এতটা পারেন না গিরিবালা। গান চলতে চলতেই রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে নিয়ে হাসিমুখে আসে রাব্বি চৌধুরী আসাদ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। রাব্বী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর গান থেমে এলে গিরিবালার হাতে মিষ্টির হাঁড়ি তুলে দিয়ে বলে, গিরি দিদা আমার প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হয়েছে। তারজন্য মিষ্টি নিয়ে এলাম। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে আর আমি দেশের জন্য নিষ্ঠা আর সততা নিয়ে কাজ করব, তুমি দোয়া করো।
গিরিবালা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাব্বী চৌধুরীর মুখমন্ডলের দিকে। তারপর কী যেন চিন্তা করে বলে- ঠিক আছে বাবা আমি আশীর্বাদ করি তুমি যেন সত্যিকারের দেশ সেবক হইতে পারো। রাব্বী চৌধুরী চলে গেলে গিরিবালা সব মিষ্টি ছাত্র-ছাত্রীদের বিলিয়ে দেয় কিন্তু নিজে একটাও মুখে তোলা না। সবাই জিজ্ঞেস করলে বলে, এই মিষ্টি তারপক্ষে খাওয়া সম্ভব না।
প্রাতঃপুজা সেরে , মা সরস্বতীকে প্রনাম করে, হারমোনিয়ামটা ভালো করে ঝেড়ে মুছে রেওয়াজ শুরু করেন গিরিবালা। তারপর ধীরে দই, চিড়া বা কিছু ফলাহার করেন। কিন্তু আজ সেই পুরোনো ঘায়ে কেমন করে আঘাত লাগলো? বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এত হাহাকার সে কেমন করে বাকি জীবন ও বইবে! অবচেতনের কেউ একজন কেবলই বলে চলে,
আমারও তো ঘর হতে পারত, বর হতে পারত, হতে পারত সন্তান- সন্তুতি! এই পোড়া রূপে তো কতজনই পুড়তে চেয়েছে! কিন্তু সব নিয়ে নিল এক প্রস্থ বোবা কাপড়!
কত রক্ত, কত চোখের জল যে তার দাবী ছিল!
ঘরের দাওয়ায় বসা গিরিবালা চোখ থেকে টপটপ করে ঝরতে থাকে নোনাজল। আর মানসপটে ভেসে উঠতে সেইসব থাকে দৃশ্যপট। তারপর মনে পড়তে থাকে সেই আগুন সময়ে পরম স্নেহে যারা প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদের কথাও।
আহা! কী দরাজ গলা আর বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেল জালালুদ্দিন ভাই! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন,
রোযা রাখতেন, আবার পুজার সময় যে নাড়ু, মিষ্টি দিয়ে আসতাম তাও খেতেন। শুধু বলতেন ঠাকুরের প্রসাদ যেন না দিই। বড় ভালোবাসতেন গ্রামের সব মানুষকে! কত সহযোগিতাই না করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। নামেই তিনি শান্তিকমিটির সদস্য ছিলেন। আসলে তিনি শান্তি কমিটিতে নাম লেখাইছিলেন গ্রামকে রক্ষা করা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য। একরাতে তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। দুইজন ছিল আহত। জালালুদ্দিন ভাই আর ভাবী পাঁচদিন তাদের লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের পোষা মোরগ জবাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন। এনে দিয়েছেন ব্যাথার মলম, অষুধ-পথ্য। জালালুদ্দিন ভাইয়ের মুখভর্তি দাড়ি ছিল লম্বা জোব্বা পরতেন, পকেটে থাকত ছোট একটা তাজবীহ আর নামাজ পড়তেন পাঁচ ওয়াক্ত। তাই পাকিস্তানি আর্মি তাকে অবিশ্বাস করেনি।
নিজ মনে স্মৃতি রোমন্থন করে চলে গিরিবালা। সব বীরাঙ্গনাদের জালালুদ্দিন ভাই বোন ডেকেছেন। আমাকে তো বলেই ছিলেন তুই আমার কাছেই থাকবি বোন। ঘরের এক কোনে তুই তোর ঠাকুরের পুজা করবি। আমরা আমাদের মতো নামাজ, রোজা, কোরান তেলাওয়াত করমু। তুই আমাগো হাঁড়িতে না খাইতে চাইলে রান্না করে খাবি। কিন্তু আমাগো পরিবারের অংশ অইয়া থাকপি।
একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গিরিবালা চিড়া ধুয়ে, কলা টুকরো টুকরো করে কেটে বাটিতে নিয়ে দাওয়ায় বসে খেতে নেয়। কিন্তু চোখের জল যেন শ্রাবনের বৃষ্টির রূপ নিয়েছে। আর সেই পুরোনো আক্ষেপ মনে ক্যান গেছিলাম শায়েস্তাবাদ? আমাগো গ্রাম তো ভালোই ছিল
কিন্তু নানাবাড়ি ছিল শকুন রাজাকার গফুর শেখ। গফুর শেখ সব হিন্দু এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মেয়েগুলোকে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে চিনিয়ে দিল।
কুকুরের বাচ্চাগুলো আমাগো নিয়ে গেল পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে। ওহ! কিচ্ছু খাইতে দেয়নাই আমাগো শকুনগুলি। কখনো দিনে দুইটা শুকনো রুটি, অথবা, বিস্কুট, আর বড়জোর পাউরুটি, কলা। অথচ দিনে অন্তত তিনবার একেকজন নারীকে ওরা ধর্ষণ করত!
খুবলে খাইত আমাগো দেহ। সমস্ত কামড়ে কামড়ে দাগ করে দিত!
গোসল করতে পারিনি চৈত্র মাসের টানা কুড়ি দিন।
আমাগো যোনীতে ঘা অইয়া গেছিল! তারপর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মুক্ত করছিল। মুক্তির আনন্দে ফিরে এসে যেই বাবাকে জড়াইয়া ধরতে গেলাম , বাবা দূরে সইরা গেলেন। আমি নিজেরে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! বললাম বাবা আমি তোমার গিরি। যাকে প্রতিদিন তুমি মুখে তুলে খাইয়ে দিতে! আমার গান না শুনে তুমি ঘুমাতে না! বাবা অন্যদিকে ফিরে চোখের জল ফেললেন! আমি যা বোঝার বুঝে নিলাম। গেলাম মায়ের কাছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললাম, মা আমি কী করতে পারি? মা বললেন, তোমারে ঠাঁই দিলে হিন্দু সমাজ আমাদের জায়গা দিবে না! বহুকষ্টে উচ্চারণ করলাম – মা!! তুমিও? আমি কী ইচ্ছে করে কলঙ্ক গায়ে মাখছি? মা বললেন, যাকিছুই হোক তুমি আর আমাগো পরিবারে থাকতে পারবা না।
আর দেশ?? যে দেশ আমার সব নিল, সেই দেশ আমারে কী দিল? চিড়া আর খাওয়া হল না গিরিবালার। উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে সে। এর মধ্যেই চোখ লেগে আসে তার ক্লান্তি-শ্রান্তি, দুঃখ -হতাশা সব ছাপিয়ে গভীর ঘুম নেমে আসে তার চোখে। আর তারপর এক দারুণ সুখ স্বপ্নে সে ডুবে যায়। স্বপ্নে দেখে লাল শাড়ি, আর গা ভর্তি গয়না পরে সে সাত পাক ঘুরছে। শান্তনু পরেছে সাদার ওপর সোনালি কারুকার্য খচিত শেরওয়ানি। শান্তনুকে পুরাই দেবতার মতো লাগছে। সাত পাক ঘোরা হলে শান্তনু মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। স্বপ্নটা দেখেই গিরিবালার শরীর -মন জুড়ে প্রশান্তি বয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই ষাটোর্ধ নিজেকে দেখে আর সেই কিশোরীকে দেখে মানসপটে।
কী গভীর ছিল তার চোখ! গায়ের রঙ ছিল কাঁচা হলুদের সাথে দুধের মিশ্রিত হলুদ রঙের, নাকটা খুব খাড়া না হলেও এবড়োখেবড়ো না।পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি উচ্চতার গিরিবালার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব আর শিল্পিত গানের গলা সবার মুখে মুখে ফিরত। পাকিস্তান ক্যাম্প থেকে ফিরে যখন পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল, শান্তনু ছুটে গিয়েছিল। বলেছিল এখনই মন্দিরে চল আজ এই মুহূর্তে তোমাকে আমি গ্রহণ করব। তুমি আজ শুধু আমার প্রিয়তমা নও আজ তুমি আমার দুর্গা। কিন্তু শান্তনু ছিল ব্রাহ্মণ পরিবারের একমাত্র ছেলে। দুই বোন থাকলেও আর ভাই ছিল না। শান্তনুকে বিয়ে করলে শান্তনুই শুধু পরিবারচ্যুত হবে না, শান্তনুর বাবা-মাও সমাজচ্যুত হবে। গিরি যাকে দেবতা জ্ঞান করে যাকে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে তাকে এবং তার বাবা-মাকে এতবড় বিপদে ফেলতে চায়নি।
তাই শান্তনুকে গিরি বলেছিল, শান্তনু দা তুমি আমার দেবতা, যখন আমার বাবা-মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন তুমি আমার সাথে সংসার করতে চাইছ এই চাওয়াটুকুনই বাকি জীবন আমাকে অনেক আনন্দ দেবে। আমার জীবন চলার পথে আত্মবিশ্বাস যোগাবে। দেবতার সাথে ঘর করতে নেই। তারপর শান্তনুর পায়ে নিজের মাথা ঠেকিয়েছিল, শান্তনু গিরিকে বুকে নিয়ে কপালে এঁকে দিয়েছিল চুমু। আর বলেছিল, দেবতা যখন বলেছই তখন সারাজীবন দেবতার কাছে কিছু চাইতে দ্বিধা করো না। শান্তনুই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে এই গানের স্কুলটি। গিরিকে এখন শুধু শান্তনুই না, বৌদি, দুই মেয়ে সবাই ভালোবাসে। মেয়েরা তো কানাডা থেকে ফোন করে দিব্যি গিরির সাথে বাবাকে নিয়ে মসকারা করে।
শান্তনুর বিয়ের দিন গিরি সারাদিন উপোস করেছে। শান্তনু এসে দেখা করে গেছে বিয়ের দিন। গিরি চোখের জলে, মুখের হাসিতে শান্তনুকে আশীর্বাদ আর ভালোবাসায় শুভকামনা জানিয়েছে।
গিরি এবার ভাবে নাহ, চান করে আজ সে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াবে। অনেকদিন রিক্সাচালক কফিল ভাই আর ভাবীর খোঁজ নেয় না। কী অবস্থায় আছে কে জানে! এক ছেলে, এক মেয়ে কফিল ভাইয়ের। ছেলে-মেয়ে দুজনেরই বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে কিন্তু কফিল ভাইয়ের এই বয়সে রিক্সা চালাইয়া খাইতে অয়। কে জানে কফিল ভাই পটুয়াখালীতে যুদ্ধ করছে? কিন্তু কফিল ভাই তখন সার্টিফিকেট নেয়নি আর এখন সার্টিফিকেট ও নাই, ভাতাও নাই। কফিল ভাই কাউকে ধরাধরিও করে না।
চান করে একটা আকাশী রঙের বেগুনি পাড়ের শাড়ি পরে গিরিবালা যান কফিলের স্ত্রী শিরিন ভাবীর কাছে।
সাথে নিয়েছেন চারটি ডিম, দুটি বেগুন আর এক কাপ মসুর ডাল। গিয়ে কফিলের স্ত্রী শিরিনকে বলে, ভাবী রান্না কর আজ তোমাদের সাথে দুটো খাই। পঞ্চাশোর্ধ শীর্ণকায় শিরিন তখন হাঁস -মুরগীকে খাবার খাওয়াচ্ছিল। গিরিকে দেখে খুব খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, এই আনন্দ কই রাখি? এতদিনে মনে পড়ল? গিরি বলে, ভাবী কফিল ভাই খাইতে আসবে? শিরিন জানায়, হ্যাঁগো আইব। গোলপাতার চালের দোচালা ঘর কফিলউদ্দিনের আর খরের ছাউনি দিয়ে বানানো রান্নাঘর। কিন্তু দুই নারীর চোখে-মুখে সম্প্রীতির, আর মায়ার ঐশ্বর্য ঝরে পড়ছে।
গিরিবালা আর শিরিন হাতে হাতে রান্না করে। শিরিন আতালের একটা বাড়ন্ত মোরগের বাচ্চা জবাই দিয়েছে। আতপ চাল দিয়ে পোলাও রেঁধেছে, ডিম ভুনা করেছে, বেগুন ভেজেছে। কফিল রিক্সা চালিয়ে দুপুরে ঘরে ফিরেই গিরিকে দেখে একটা দরাজ হাসি দেয়। এতদিনে মনে পড়ল ভাইকে? গিরি বলে, আলাদা কইরা কী মনে করন লাগে? আইজকা মন খারাপ খুব তাই আইছি। বাপ-মা ইন্ডিয়া চইলা গেছে এই বিশ বছর তোমাগো আর এই জন্মভূমির মাটি আঁকড়াইয়া ধইরাই তো বাঁইচা আছি কফিল ভাই।
তারপর তিনজন খেতে বসে উঠে আসে সেই আগুন দিনের গল্প। ভাজা বেগুনের সাথে পোলাও ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়েই কফিল গিরিকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করে। গিরিবালা বলে, ওসব শুইনা আর কী করবা কফিল ভাই? তাও যখন জিজ্ঞেস করছ বলি শোন, আসাদ চৌধুরীর কথা তো তুমি জানো। কফিল জিজ্ঞেস করে, কোন আসাদ চৌধুরী? অই যে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেহাইয়া ডাহাতি করছে একাত্তর সনে হেই আসাদ চৌধুরী? গিরি বলে, ঠিক ধরছ কফিল ভাই। কিন্তু কফিল ভাই আমারে একটা কতা কও তো, হেয় কী সত্যই ডাকাতি করছে? কফিল উত্তর দেয় কোনো সন্দেহ নাই। উত্তরের পাড়ার যে বিভু বৌদিরা ইন্ডিয়া চইলা গেছে গভীর রাতে তাগো ঘরের তালা ভাইঙ্গা ঘরের সোনা-দানা, বড় বড় কাসার জিনিস সব ওরা নেছে। হ্যা তো, বিভুগো মোসলমান প্রতিবেশী জাফর হাওলাদার নিজ চোক্ষে দ্যাকছে। অরা পাঁচজন এই কাম করছে। হেরপর, খালের অইপাড়ের সুশান্ত হালদাররা তো ইন্ডিয়া যায়নাই। তাগো ঘরে ওরা ডাকাতি করছে রাজাকার সাইজা নকল দাড়ি লাগাইয়া। কিন্তু বৌদি অগোরে চিন্না ফালাইছিলো।
কিন্তু হেই কতা উঠলো ক্যান? আরও কত কত যে অকাজ-কুকাজ কইরা বেড়াইছে। যারা ইন্ডিয়া গেছে যুদ্ধ করতে তাগো ছাগল, হাঁস, মুরগী সব ওরা জবাই করে খাইছে বেঁচছে। এইডা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু তুমি এই কতা আইজগো উডাইলা ক্যা বুইনডি?
গিরিবালাকে জিজ্ঞেস করে কফিলউদ্দিন। গিরিবালা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চাপা রেখে বলে, অই আসাদ চৌধুরীর ছেলের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস চাকরি অইছে। সেই ছেলে মিষ্টি নিয়ে দেখা কইরা আমারে কয়, গিরি দিদা দোয়া কইরো আমি যেন সত্যি দেশের সেবক হইতে পারি। আমার বাবা দেশ স্বাধীন করছে আর আমি দেশ গড়ব। আমি অই ছেলের মুখের দিকে চাইয়া থাকলাম। কিছু বলতে পারলাম না। হা হা করে হেসে ওঠে কফিলউদ্দিন। বলে, ধুউর দিদি তুমি একটা পাগল! এইরহম আরো ঘটনা হুনলে তোমার চৌক কপালে ওডবে! অই যে মিজান চৌধুরী যুদ্ধ শ্যাষে নানা বাড়ি থেইকা ফিইররা পাকিস্তানিগো ফাইলাইয়া যাওইন্না অস্ত্র টোহাইয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজছে। হেয় তো এহন আওমিলীগের বড় নেতা আর মুক্তিযোদ্ধাগো ফোরামেরও নেতা। এইসব চিন্তা কইরা কী অইবে কও? আমরা যেই দ্যাশ স্বাধীন করছি, হেই দ্যাশ কী আর আছে? ট্রেনিং করছে চুরাশি হাজার আর মুক্তিযোদ্ধা দুইলক্ষ। মোর তো মনে কয় এর মধ্যে অন্তত দশ ভাগ রাজাকার আছে। যারা কোনোদিন সত্যিই বাংলাদেশ চায় নাই। তারা ভাতা পায়, তাগো পোলামাইয়ারা কোডায় চাকরি পায়। আর মোরা যারা হেইসময় সাট্টিফিকেট নেইনায় মোগো ভাতাও নাই কোনো সুবিদাও নাই! এহন মোগো কতা কওয়ার মানুষও নাই! অথচ যে শান্তি বাহিনীতে নাম লেখাইয়াও দেশের সেবা করল, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, খাবার, ঔষধ সবদিয়ে সাহায্য কল্ল তারে আসাদ চৌধুরীরা কী কল্ল বল! কফিলউদ্দিন আফসোস করে বলে, জমি বেচলনা দেইক্কা নিজেগো পার্টির ক্ষমতা কামে লাগাইয়া একাত্তর সালের উদারন আর দাড়ি-টুপি দেখাইয়া তার নামে জামাতে ইসলামির মামলা দিল! ছয়মাস জেল খাইট্টা বাড়ি আওনের এক সপ্তাহের মাতায় জালালুদ্দিন ভাই হাট এটাক কল্ল! আসলে এই অপমান জালাল ভাই মাইন্না নেতে পারে নাই। কী করবা! শ্লেষে উত্তর দেয় কফিলউদ্দিন! আসলে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা তো ছেল এইসব শান্তবাহিনীর সদস্যগো লইজ্ঞাই। এহন বি. এন. পি হেইডার ভুল ব্যাখ্যা দেয়। আসলে একটা কতা কী জানো দিদি! বঙ্গবন্ধু যদি হেই সময় শিয়াল মোস্তাক অগো কতা না হুইন্না তাজউদ্দীনরব লগে দ্যাশ চালাইতো তহেলে হেও পরিবার শুদ্দা মরতে না আর মোগো কপালেও এত দুক্ষ ঘটতে না। মোর ছোড বুদ্ধিতে তো হেইয়াই লয়।
গিরিবালার বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কফিলউদ্দিন বলে, বাদ দেও বুজি, মোরা দ্যাশ স্বাধীন করছি কিছু পাওয়ার লইজ্ঞা না। দ্যাশ স্বাধীন অইছে দ্যাশের পোলাপান লেহাপড়া করে, অফিসার অয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অইছে, আওমিলীগ ক্ষমতায় আইছে, দ্যাশে পদ্মা নদীর উফরে পোল অইছে, আবার বোলে রাস্তার উপরে দিয়া টেরেন লাইন বানাইছে ঢাকায়, টেরেন চলবে এতেই মোরা বহুত খুশি। মোগো ভাতা লাগবে না। দ্যাশটা ভালো চলুক। তুমি খাও দুখ কইরো না। গিরিবালা, কফিল, কফিলের বউ সবাই খেয়ে ওঠে।
খাওয়া শেষ করে পান খাইতে খাইতে গিরবালা জিজ্ঞেস করে কফিল ভাই মাইনুদ্দীনের মা’র খবর কী? চেয়ারম্যান কী হেরে রেশনের কার্ড দেছে? কফিল বলে, হ সবাই তো মেম্বাররে ধরছিল আলি আলি কইররা।
অই বিধবা মহিলার একমাত্র পোলাডা যুদ্ধে গিয়া শহীদ অইছিল। হেরপর বহুদিন মানুষের বাড়ি কাজ কইরা খাইছে । কেউ তারে শহীদের মা হিসেবে জিগায় নাই।এখন আর বয়সের ভারে কাম করতেও পারে না। গিরিবালা তারসাথে যোগ করে এক রাইতে মুক্তিযোদ্ধাগো আশ্রয় দেওনের লইগা সে সারারাত দরজার সামনে আড়ায়াড়ি অইয়া সামনের শুইয়া আছিল। এমন সময় আসে মুক্তিযুদ্ধে একটা পা হারানো
আফসার আলী। এসে বলে, শোন গিরি দিদি এবার আমার নাম উঠছে মুক্তিযোদ্ধাগো খাতায়। এহন আমি ভাতা পামু। গিরি বলে, নাম বাদ পড়ছিল? আফসার বলে, হ বি. এন. পি আমলে। গিরি মনে মনে বলে, পঞ্চাশ বছরেও একটা বিশুদ্ধ তালিকা অইলোনা মুক্তিযোদ্ধাদের! দপ্তরি বশির হাসতে হাসতে এসে কথায় যোগ দিয়ে বলে, আফসার চাচা মিষ্টি খাওয়াইবেন কবে কন। আর মুই যে, মোর মরা মায়ের বুকে তিনিদিন পইড়া থাকলাম, পাকিস্তানি আর্মিরা বাপ, মা সব মাইরা হালাইলো মুই কী পামু? গিরি বশির দুহাত প্রসারিত করে ডাকে, বাজান তুই আমার ধারে আয়।
আসলে অই লাল-সবুজের বোবা কাপড় যদি কতা কইতে পারত আর মাটির বুকে যদি কান পাইত্তা শোনোন যাইত শহীদগো আত্মার কতা তাইলেই না বোঝা যাইত কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার। কে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আর কে ভণ্ড ছদ্মবেশী চেতনা বিক্রেতা!
নুসরাত সুলতানা : কবি ও কথাসাহিত্যিক
=========================