গ্রহণ লাগা জ্যোৎস্নায়
লিপি নাসরিন
হিম আসছে উত্তরকোণ থেকে। বাতাসে তার ছোঁয়া পেতেই খড়খড় করে উড়ে যায় শুকনো পাতারা। সকালের রোদ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসে বেলা বাড়লে। এখনো কুয়াশা পড়েনি। কচু গাছ বড়পাতাগুলোকে মেলে ধরে উত্তর-পুব কোণা বরাবর রোদ গেলে যেন। এদিকে ওদিকে খুচরো-খাচরা শব্দ ঝপ ঝপ করে। বাসা বাঁধা হয়ে গেছে ঘুঘু পাখিদের।গেল ঝড়ে কোণার নারিকেল গাছটা মাথা মুড়ে একটা শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা হলদে পাখি প্রায় এদিকটা এসে ওর ন্যাড়া মাথায় বসে থাকে। আরেকটু বেলা বাড়লে তরকারি ক্ষেতের দিকে পা বাড়ানোর ভাবনায় মোকাম বসে আছে লেপা বারান্দায় চিকচিক করতে থাকা রোদের ঠিক মাঝখানে। বিড়ির নেশা পায়। নরম রোদে বসে পাতার বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধ মোকামের ভীষণ প্রিয়। কিন্তু এখন উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রোদটা একেবারে যেন লেপের তলে উষ্ণ আদরের মতো লাগছে মোকামের কাছে।
একটা বিড়ি ধরায় দিয়ে যাবা সুমির মা?
চুলায় তখন হাড়িতে টাকি মাছ কষাচ্ছে জ্যোৎস্না বেগম। তাকে আগের পক্ষের মেয়ে সুমির মা বলেই মোকাম ডাকে।
এখন পারবো না, মাছে ঝোল দিয়ে তারপর দিতেছি, ঝটপট উত্তর দেয় সে। মোকামের টাকি মাছ খুব পছন্দ না হলেও শীতকালে বেশি ঝাল দিয়ে জ্যোৎস্না বেগমের হাতের জ্যান্ত টাকি মাছের গা মাখা ঝোল তার ভালোই লাগে। রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি, কেমন যেন ঘুম ঘুম পায় তার। জ্যোৎস্না বেগম চালের মিলে কাজ করে। এই সময় খুব বেশি ব্যস্ত না থাকলেও প্রতিদিন সে মিলে যায়, দু’এক বস্তা চাল যা মিলে আসে তার কিছু তুষ-কুড়া তো পাওয়া যায়। সকালে উঠে তাই তারও খুব তাড়া। টাকি মাছের ঝোলের কথা মনে হতেই মোকামের বিড়ির নেশা কেটে যায়, রোদটা কেমন ঝাপসা হতে হতে ধোঁয়াশা লাগে। বারান্দা থেকে নিচে নামতেই জ্যোৎস্না বেগম বলে ওঠে, কোনে যাচ্ছাও? বিড়ি নেবা না?
মোকাম কী যেন বলতে গিয়েও থেমে যায়। ইদানিং তার সুমির মার কথা বেশ মনে পড়ে। বিয়ের প্রথম দিককার কথা, ভালোই চলছিল সংসার যেমন চলে সবার কিন্তু ছন্দপতনটা লেখাই ছিলো, তাই একটা চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল শান্ত জলরাশির তলায়। মোকাম জোরে জোরে হাঁটে। বড় মিঞাদের বাড়ির প্রায় বান্দা কামাই; সব কাজে মোকামের ডাক পড়ে। ক্ষেত খামার থেকে শুরু করে বিয়ে শাদীর আয়োজনেও। সোজা গিয়ে তরকারির ক্ষেতে নেমে দেখে মাটি প্রায় শুকনো।
পানি তো কাল দিলো আজ এতো তাড়াতাড়ি ক্ষেত শুকিয়ে গেলো কেন মোকাম ভেবে পায় না। শ্যালোতে স্টার্ট দিয়ে মোকাম কোদাল দিয়ে সোজা আইল এলোমেলো করে আবার ঠিক করে। কখনো কোদাল হাতে উঠে দাঁড়ায়, ফাঁকা মাঠে হু হু করে বাতাস বয়। রোদটা একটু একটু করে আবার বাড়তে থাকে। সে কি তারে খুশি রাখতে পারেনি যে সে আরেকজনের সঙ্গে …।
চোখের সামনে এখনো সেই দৃশ্য ভাসে। যাকে সে হাতে নাতে পরপুরুষের সাথে ধরলো তার সাথে সে কী করে সংসার করে? কোদাল মাঠে রেখে উঠে আসে মোকাম। ঘাসগুলো তখনো ভেজা ভেজা। ঘাড়ের গামছা বিছায়ে বসতে না বসতেই জ্যোৎস্না বেগম এসে হাজির।
বিড়ি না নিয়ে এলে যে? তোমার কি শরীলডা খারাপ? বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে আইসো। সুমি বেড়ে দেবানে, আমি কইয়ে আইছি।
সুমি ইস্কুলে যায় নাই আজ?
আজ শুক্কুরবার ইস্কুল যাবে ক্যান? আমি গেলাম, বলে জ্যোৎস্না বেগম হনহন করে হাঁটতে থাকে।,
মোকাম তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ; নিজেকে নিয়ে তার বড় ভাবনা। সুমির মাকে তালাক দেবার পর তার নিজের পুরুষত্ব নিয়ে বড় লজ্জা। রোগা পাতলা মোকাম। বউ যখন পরপুরুষের সঙ্গে শোয় তখন নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পায়।
জ্যোৎস্না বেগমকে নিয়েও তার ভাবনার অভাব নেই। অভাবী ঘরের মেয়ে সে, বাবা নেই। ভাইরা তার সাথে বিয়ে দিলো। জ্যোৎস্না বেগম নাকি তার সাথে বিয়ে করতে চায়নি, সে নিজের মুখেই এই কথা বলেছিল একদিন। বলেছিল, গ্রামের একজনের সাথে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো। তাকেই সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ওদের থেকে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে তাই তার বাবা রাজি হয়নি। মোকামের দুর্বল মন আর কিছু শুনতে চায়নি। জ্যোৎস্না বেগম ডানপিটে মেয়ে অন্তত মোকাম সেটাই জানে, তাই ওর ভয় হয়তো তাদের দুজনের সম্পর্কটা মন ছাপিয়ে শরীরকে বেধেছিল।
বেলা বাড়তে থাকে। মোকাম অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। আজ রাতে সে জ্যোৎস্না বেগমকে আবার পরীক্ষা করবে। বউয়ের তার প্রতি ভালোবাসা আছে কি না মোকাম শরীর ছুঁয়ে বুঝে নিতে চায়।
দেখতে দেখতে বাঁধাকপি আর ফুলকপির ক্ষেত ভেসে যায় পানিতে। মোকাম ধড়ফড় করে উঠে শ্যালো মেশিন বন্ধ করে দিয়ে আসে। ক্ষেত থেকে সোজা বড় মিঞার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না; মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে ঢুকলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। এক বছর হলো জ্যোৎস্না বেগম তার ঘরে এসেছে, এখনো বাচ্চাকাচ্চা হলো না। মোকাম এ কথা তুলতেই জ্যোৎস্না বেগম বলে, আর কিছুদিন যাক তারপর। সুমি আছে না, ঐ তো আমার মাইয়া। মোকামের এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। আজকাল জ্যোৎস্না বেগমের আচরণও যেন বদলে যাচ্ছে। এসব কী যে চিন্তা তার মনের মধ্যে হচ্ছে! আজেবাজে চিন্তা যতই মাথা থেকে সরাতে চায় ততই যেন একেবারে জাপটে ধরে।
মিঞা বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়াতেই , সবার বড় মিঞা গায়ে একটা দামি শাল চড়িয়ে উঠোনের এক কোণায় রোদে বসে ছিলো-মোকামকে বলে, তরকারি ক্ষেতে পানি দেওয়া হলো তোর?
মোকাম এক দৃষ্টিতে বড় মিঞার গায়ে জড়ানো শালটার দিকে তাকিয়ে থাকে, কোন উত্তর না দিয়ে কপালটা একটু ভাঁজ করে পরক্ষণেই মুখে হাসি টেনে বলে, হ চাচা।
যা বাড়ির ভিতরে যা। ভাত খেয়ে তোর চাচির আরো কী সব কাজ আছে করে দিয়ে তারপর বাড়ি যাবি। মোকাম ইতস্তত করে। আজ তার আর কাজ করতে মন চাচ্ছে না। শরীরে উদ্যম নেই যেন।
চাচা, শরীলডা ভালো মনে হচ্ছে না। আজ আর কাম করতি মন চায় না। মোকাম গামছা দিয়ে হাত-পা আবার মুছে নেয়।
তোরা সব সুখের পায়রা হয়েছিস। একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে উঠিস।
মোকাম এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।
মিঞা গিন্নি একজন কাজের মেয়েকে নির্দেশ দেয় মোকামকে ভাত বেড়ে দেবার জন্য। বিরাট রান্নাঘরের বারান্দায় মোকাম পিঁড়ি টেনে বসে। যে দিকে তাকায় তার চোখে কেবল বউয়ের চলে যাওয়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। কাজের মেয়েটার পুরুষ্টু শরীর তার সামনে দিয়ে ঘোরে ফেরে ; বউয়ের চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে মোকামের চিন্তা দখলে নেয় মেয়েটি। মাঝে মাঝে মেয়েটার শরীর হাতড়ায় থালায় ভাতের মধ্যে হাত রেখে, মনের মধ্যে বিড়বিড় করে অন্তহীন ক্ষতের মধ্যে প্রলাপ দেয়। খেতে বসে এরূপ নিষ্ক্রিয় বসে থাকা দেখে মিঞা গিন্নি বলে, কী রে মোকাম, ভাত নিয়ে বসে আছিস কেন? তোর কী শরীর খারাপ? মোকাম উশখুশ করে। স্বভাবসুলভ তাকিয়ে পুরু ঠোঁটটাতে একটু হাসির রেখা টেনে বলে, শরীলডা একটু খারাপ লাগে চাচি।
শীত একটু বেশি পড়ছে তাই মনে হয়। ভাত খেয়ে বাড়ি গিয়ে গায়ে সরিষার তেল মেখে রোদে কিছুক্ষণ বসে থাক, দেখবি ঠিক হয়ে গেছে। একটু মাছ মাংসও তো তোর বউ কেনে না। কেবল শুনি টাকা জমিয়ে জমি কেনে। তা বাপু জমি কার নামে কেনে? তোর নামে দেয় তো নাকি সব নিজের নামে কেনে? মিঞা গিন্নীর এতো কথায় মোকামের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না কেবল বড় বড় ভাতের লোকমা থালা থেকে তার মুখে ওঠে।
সত্যি তো জমি কেনে বউ সব নিজের নামে। জমি বলতে সামান্য কয়েক শতক, সেই কবে এক শতক তার নামে কিনেছিল তারপর আর কোন খবর নেই। মোকাম নিঃশব্দে কেবল খেয়ে চলে। এমন মাছের তরকারি সে কতোদিন খায়নি। কেবল শাকপাতা আর পাতলা ডাল। মেয়েটার কথা মনে হয়। ওর ঠিকমতো খাওয়া হয় না।
বেলা ঝপ ঝপ করে পড়ে আসে। ভাত খাওয়ার পর মোকামের দুচোখে রাজ্যের ঘুম জড়ো হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়। জ্যোৎস্না বেগমকে আর চালের মিলে কাজ করতে দেবে না। সে একা যা আয় করে তাই দিয়ে সংসার চলে যাবে। নিজের এক ফালি জমিতে একখানা ঘর তুলেছে আর কী চিন্তা! জ্যোৎস্না বেগমের ছেলেপুলে হয় যদি তখন কী করে সংসার চলবে? আগে হোক তারপর দেখা যাবে। মোকাম হনহন করে হাঁটতে থাকে কিন্তু সে তেমন আগাতে পারে না, মনে হয় তার পায়ের হাড়গুলো বাঁকা। হাঁটু থেকে দু পা কেমন বেঁকে বেঁকে দুপাশে সরে যায়। ঘাড় থেকে গামছাটা নিয়ে শূন্যে অকারণে একটা ঝাড়া মারে। শীতেও তার পুরু হাতাওয়ালা গেঞ্জিটার নিচে ঘামের অস্তিত্ব টের পায়। মোকাম বাড়ি পৌঁছাতেই জ্যোৎস্না বেগমের দৃঢ় দ্রুত পদক্ষেপ শোনা যায়। আজ মোকাম শ্রুত কথার সত্যাসত্য যাচাই করবে। জ্যোৎস্না বেগমের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। তার চলাফেরার সাথে মোকামের চোখও চলে।
বসে আছো যে? চান করে নাও। সুমি কই? চান করে চারটে মুখে দে আবার আমার ছুটতি হবে।
মোকাম এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে।
আবার কনে যাবা এখন? এই না এলে?
মিলে অনেক ধান এইছে, আজ বাড়ি আসতি রাত হবে। রাতের কথা শুনে মোকামের মাথায় আগুন চড়ে। কিন্তু সে আগুনের সামান্য স্ফুলিঙ্গ চোখ, কান বেয়ে বেশি দূর নামতে পারে না। খুব শান্ত করে বলে, তোমার আর মিলে কাজ করতি হবে না। আমি যা রোজগার করি তাই দিয়ে সংসার চলি যাবে। আর না যায় না যাবে। আধপেটা খেয়ে থাকবো। জ্যোৎস্না বেগম খ্যাক করে ওঠে, তুমি আধপেটা খেয়ে থাকতে পারবা, আমি পারবো না। তোমার মাঝে মাঝে কী হয় কওদিন শুনি। আমার কাজে তোমার এতো আপত্তি ক্যান? মেয়েটার বিয়ে শাদি দিতে হবে না। তোমার অপারেশনের পর তো কাম-কাইজ তেমন করতি পারো না। আর আমার যদি ছাওয়াল মাইয়া কিছু একটা পেটে আসে তার চিন্তাও তো করতি হবে নাকি? এসব আজাইরা কথা থুয়ে চান করতে যাও।
মোকামের মাথাটা কেমন দুলে ওঠে। কতো দিন হয়ে গেলো তার ও জ্যোৎস্না বেগমের মেলামেশা নেই। ছেলে-মেয়ে তাহলে কি আকাশ থেকে পড়বে? মোকামের আরো বেশি ঘুমের ঘোর গাঢ় হয়। জ্যোৎস্না বেগমের জন্য শরীরের মধ্যে কিটকিট শব্দ হয়। বউকে ডাকতে গিয়েও রাতের কথা মনে পড়ে। প্রায় টলতে টলতে ঘরে গিয়ে পুরানো কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।
সেকি? শুয়ে পড়লে যে? চান করবা না? বেলা মাথার পর হুশ আছে তোমার? জ্যোৎস্না বেগম কুড়োর বস্তা বারান্দায় তুলতে তুলতে বলে।
মোকাম কোন কথা বলে না, মুখ থেকে কম্বলটা একটুখানি সরিয়ে বউয়ের ভাব বোঝার চেষ্টা করে। এট্টু আসবা- বলতে গিয়েও থেমে যায়। মানুষের কানাঘুষো মনে পড়ে। মনে পড়ে এক রাতের কথা যেদিন বউয়ের শরীর স্পর্শ করতেই সে ঘুমের ভান করে তাকে সরিয়ে দিয়েছিল। মোকাম বারকয়েক ডেকে নেতিয়ে পড়েছিল। খুব অপমান লেগেছিল তার। প্রথম বউটা চলে যাবার পর যেমন তার পায়ের তলার মাটি সরে সরে যাচ্ছিল, সে রাতেও ঠিক তার তেমন মনে হয়েছিল। মোকামের নিঃশ্বাসে তরঙ্গ ওঠে তবে তা কামোদ্দীপনা সরিয়ে তাকে আরো কুঁকড়ে ফেলে। প্রথম বউয়ের ঘনোশ্বাস ভেঙে ভেঙে সে তরঙ্গে গুঁড়ো হয়ে যায় আর মোকাম লেপের তলায় দুই হাত-পা বুকের কাছে নিয়ে কেবল তাকিয়ে থাকে।
কী হলো, উঠলে না? মোকাম তবু কথা বলে না। আমি মিলে গেলাম। হাঁড়ির মধ্যে আলু ভাতে মাখানো আছে,কড়াইতে তেলাকুচো শাক আর কডা পুঁটি মাছ ভাজা আছে। খেয়ে নিও।
মোকাম বউয়ের যাওয়াকে আটকাতে পারে না। সে জানে পারবেও না কোনদিন। যা দিয়ে মেয়েমানুষকে ধরে রাখা যায় তাতে তার কমতি আছি। সে ভাবে মিলের মালিককে বলবে তার বউকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। সবাই বলে মিলমালিকের সাথে নাকি ওর একটা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক আছে। মিলমালিকের কাঁথার নিচে তাকে নাকি দেখেছিল মিলের আর এক নারী কর্মচারী। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। ঘরের চালে কটা ভাঙা টালিকে ঘিরে পলিথিন টানানো। বাইরের রোদ ঘষামাজা হয়ে পলিথিন ভেদ করে ঘরে ঢোকে। মোকাম অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কম্বল সরিয়ে উঠে বসে। গা দিয়ে ঘাম ছুটতে থাকে। সুমির মা, সুমির মা – বহুদূর থেকে যেন চিৎকার করে ডাকে। জ্যোৎস্না বেগম বারান্দা থেকে নেমে কেবল নিম গাছটা পেরিয়ে পথের মুখে এসে উঠেছে। ডাক শুনে ফিরে গিয়ে দেখে মোকামের শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। কী হলো এতো ঘামতাছো ক্যান? দড়ি থেকে গামছাটা ছুঁড়ে দেয় মোকামের দিকে। মোকাম অবাক হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমার কাছে এট্টু আসবা? এই আহ্বানে জ্যোৎস্না বেগম আড়চোখে তাকায় স্বামীর দিকে।
কী কবা তাড়াতাড়ি কও, মিলে ধান এয়েছে, যাতি হবে তাড়াতাড়ি।
এই ভরদুপুরে যেন লজ্জার মাথা খেয়ে মোকাম বলে যদি এট্টু কাছে থাকতে খানিকক্ষণ। শরীরের মধ্যে কেমন কুটকুট করতাছে। তুমি শুইলে লেপটা আর একটু গরম হতো, বেশ হতো তাইলে।
জ্যোৎস্নার মুখ ম্লান হয়ে যায়। মোকামের স্পর্শ তার সেই প্রথম দিন থেকেই ভালো লাগেনি। কেমন গা ঘিনঘিন করার অবস্থা হয়েছিল। তারপরও শরীরের তাগিদ উপেক্ষা করতে পারেনি কিন্তু দাম্পত্য জীবনের মিলনসুখ সে প্রাণভরে উপভোগ করতে পারতো না কখনো। আর এখন স্বামীর সঙ্গ যে কোন উপায়ে এড়াতে পারলেই যেন বাঁচে। বাইরের ঝকঝকে রোদকে কি বদ্ধ ঘরের অন্ধকার দিয়ে ঢেকে রাখা যায়?
মোকামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জ্যোৎস্না বেগম। তার নাকে বেলি ফুলের সুগন্ধি ভুরভুর করে মোকামের শরীরের ঘামের গন্ধ মাড়িয়ে। ক্ষণকাল পর বলে ওঠে, তোমার কি বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে?
যাও চান করো বলে জ্যোৎস্না বেগম বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায়।
মোকাম অবসন্নের মতো পড়ে রয় কিছুক্ষণ তারপর রান্নাঘর থেকে বহুদিনের পুরানো সাইকেল বের করে চড়ে বসে প্যাডেল মারে মিলের দিকে।
কী গো মোকাম মিয়া, কী মনে করে? জ্যোৎস্না তো একটু আগে এলো। ও জ্যোৎস্না, দেখ মোকাম মিয়া আইছে। আহা! কী দরদ দিয়ে জ্যোৎস্নাকে ডাকলো। তাইলে মানুষ যা বলে তা সত্য। মোকামের মাথাটা যেন ঘুরে ওঠে।
ভাই একটা কথা কইতাম।
আরে মিয়া আও বস, তারপর কও তোমার কী কথা। মোকাম সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখের চকিত চাহনি মিলঘরের দরজা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে। মিল চালুর শব্দের মধ্যেও জ্যোৎস্না বেগম তাদের কথা শুনতে পায়। চালের বস্তা ধরা ফেলে মিলঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে।
মোকাম জ্যোৎস্না বেগমের মুখের দিকে তাকায় তারপর কিছু না বলে আবার সাইকেলের প্যাডেল মারে।
কী হইলো? ও মোকাম মিয়া কী যেন বলতে আইছিলে?
জ্যোৎস্না বেগম আর মিলমালিক দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
সোজা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে থামে বাজারের বড় কাপড়ের দোকানে। বউয়ের শারীরিক গড়ন,গায়ের রঙ আর মুখখানা ভেবে ভেবে একখানা শাড়ি কিনে বাড়ির পথ ধরে।
কনে গিলে মিল থেকে আইসে? আর কী করতি গিলে ওখানে?
মোকাম সাইকেলটা রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে শাড়ির প্যাকেটটা বউয়ের হাতে দেয়,
তোমার জন্যি একখান শাড়ি কিনলাম। তুমি আর মিলে কাজ করতি যাবা না। লোকের তো আর খাইয়ে দাইয়ে কাম নেই, আকথা কুকথা কয়।
জ্যোৎস্না বেগম প্রমাদ গোনে। মিলমালিকের কাছে যাওয়ার কারণটা আগেই ধরতে পেরেছিল সে। কেডা কয়? কয় তো ঐ মাগি। মালিক ওরে খেদাই দেছে মিল থন। মাগি ব্যাপারির বস্তা থেকে চাল চুরি করে আমি এইঠা মালিকরে জানায় দিছি বইলে আমার নামে এসব রটায়। আর তুমিও এক কাঠি সরেস সেসব বিশ্বাস করো।
মোকামের বাঁকা পা দুটো যেন ছটফট করে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে মনে করে কষে দুইটা লাথি দিতে পারলে যেন ওর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমিত হবে। মোকামের পা দুটো সহসাই স্থির হলেও মাথার ভিতর আগুনের ফুলকি ঝরে কিন্তু সে আগুন নীলাভ রশ্মি ছড়িয়ে কেবল নিজেকে পোড়ায় বাইরে তার আঁচ টের পাওয়া যায় না। যে যা পারে বলুক তুমি আর মিলে যাবা না কাজ করতি, ভিতরে ভিতরে পুড়তে থাকে মোকাম।
যাবো যাবো একশ বার যাবো…, সংসারটা কেডা চালায় শুনি। তুমি একটা নিদ্গুণে পুরুষমানুষ। কোন ক্ষমতাটা তোমার আছে শুনি? তোমার কথা শুনলি আমার পিত্তি জ্বলে। জ্যোৎস্না বেগম হিতাহিত শূন্য হয়ে তেড়ে আসে। মোকামের নীলাভ আগুনে এবার কালবৈশাখীর ঝাপটা লাগে।
মোকামের মাথা থেকে খসে পড়ে যেন অন্য আর একজন মোকাম। তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে বলে, মার, মার ,মেরে শেষ করে দে। আর কতো অপমান সইবি? তুই কি কেবল অপবাদ সইতে পৃথিবীতে এসেছিস? সেই রূপটিকে খুব অচেনা লাগে তার, যেন চিরদিন এই রূপটির সে অনুসন্ধান করেছে নিজের মধ্যে। মোকামের চোখ দুটো তীক্ষ্ম ঈগলের চোখে কী যেন খুঁজতে থাকে, তারপর তার চোখে নামে কুয়াশার অস্পষ্টতা। শুধু একটা আর্তনাদ! গড়িয়ে যাওয়া রক্তের মধ্যে কিলবিল করতে থাকে জীবন নামের পোকা।