You are currently viewing দুইটি কবিতা/ মেহেনাজ মুস্তারিন

দুইটি কবিতা/ মেহেনাজ মুস্তারিন

দুইটি কবিতা/ মেহেনাজ মুস্তারিন

পিছুটান
আকাশের নীল রঙ হঠাৎ করে ফ্যাকাসে, কিংবা
ফাগুনের রঙ ধূসর হয়ে গেলে কতবার মনে হয়েছে,
সবকিছুই আমার মতো বর্ণহীন ;
ছাদবাগানের গোলাপ গাছগুলো যখন নেতিয়ে পড়ে
যখন অযত্নে-অবহেলায় ফুলগুলো আর আগের মতো ফোটে না,
অথবা তার গন্ধে থাকে না কোন প্রেম, আর খাঁচায় বন্দী দোয়েল
আগের মতো ডাকতে ভুলে যায়, তখন কতবার মনে হয়েছে,
ভালোবাসা বিহনে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন ;
আমার তখন বড্ড বেশি মরে যেতে ইচ্ছে করে!
ঠিক তখন হয়তো ঝুলবারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে আছি,
অনেকটা আনমনা
বাসাটাও ফাঁকা,
আমার চোখ ছুটে যায় খাঁচায় বন্দী দোয়েলের দিকে
আহা কতদিন ধরে বন্দী! তার চোখের চাহনীতে
মুক্তির আকুতি আমাকে প্রভাবিত করে―
আমি উঠে দাঁড়াই,
আমার হাত ছুটে যায় খাঁচার দিকে,
আমার চোখ সিলিং ফ্যানে আটকে থাকে,
সেখান থেকে জোছনার মতো বাতাস গলে গলে নামছে,
বলছে, উঠে আসো এই জোছনার পথ বেয়ে!
আমি সন্মোহিত হই,
আমার কেন জানি মনে হয়― এভাবে কতদিন কেউ বলে না,
কতদিন কেউ ডেকে বলে না ― বসো পাশে।
আমি উঠে দাঁড়াই,
আমার চারপাশটা কেমন অচেনা লাগে
তখন পিছু থেকে কে যেন হাতছানি দেয়
কত স্মৃতি একসাথে লুটিয়ে পড়ে মনের সীমানায় ;
মরচে পড়া পুরোনো কৌটাগুলো
লবনে চিনিতে জিরা মরিচে মাখামাখি করে শুয়ে আছে রান্নাঘরে,
কোনাভাঙা সেই বাটি
ফেলে দিতে চেয়েও কতবার তাকে রেখে দিয়েছি সযত্নে ,
অ্যালবামে ঘুমিয়ে থাকা পুরোনো কিছু ছবি, অথবা
শোবার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো আমাদের যুগল ছবি, কিংবা
ঠোঁটের কাছে ভেঙে যাওয়া ছোট্টবেলার চিনেমাটির পাখি
তখন সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে
না ছোঁবে না ওই জোছনা!
সহসা আট বছর আগের পহেলা বৈশাখে দেয়া তোমার
নোটবুকটির কথা মনে পড়ে,
তার পাতায় পাতায় কত স্বপ্ন!
আমি খাঁচার দিকে তাকাই,
দেখি, পাখিটি ভুলে গেছে মুক্তির কথা;
আমি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাই,
দেখি, সেখানে কোনো জোছনাধারা নেই।
আমি পেছন দিকে হাঁটতে থাকি
হাঁটতে থাকি
হাঁটতে থাকি
গন্তব্য নিশ্চিত নয় জেনেও আমি হাঁটতে থাকি।
তিন মাস আগের এক বিকেলের কথা
আমার ঘরের সাথে লাগোয়া
একফালি চাঁদের মতো বারান্দা___
খুব একটা যাওয়া হয় না;
যেভাবে রাহুর দশায় পড়ে
জোছনা হারায়,
আমার অবস্থাও তাই;
লোকে বলে, ব্যস্ত মানুষ
আমিও সেটাই বিশ্বাস করি― ব্যস্ততার কী শেষ আছে?
ব্যস্ততা যে ভালো লাগে না, সেটা বলা শক্ত
চারপাশে কত ফাইল, কত চাপ, কত ভক্ত;
তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে পুরোনো দিনের মধ্যবিত্তের মতো ঘরে ফিরে আসি,
সাথে কিছু ফাইল-পত্র। কিছু পুরোনো অভিযোগ আমার নিষ্পত্তির অপেক্ষায়
পড়ে আছে, ফ্রেস হয়ে এসে ডাইনিং চেয়ারে বসে সেগুলোতে চোখ রাখি
অজান্তে চায়ের কাপে চা আসে,
আমি চুমুক দিতে দিতে সুখের ঢেকুর তুলি।
এভাবেই চলছিল বেশ! ওদিকে একফালি চাঁদের মতো
আমার ঝুলবারান্দা তোমার যত্নে টিকে থাকে,
টিকে থাকে
টিকে থাকে
তোমার হাতের ছোঁয়ায় সেখানে ফুল ফোটে, পাখিদের দল বাসা বাঁধে,
আষ্কারা পেয়ে তোমার ছেলেমেয়েদের মতোই তারা কিচির মিচির করে।
আমার কি সময় আছে এতসব দেখার?
তবু বিরক্ত হই, তবু দেখি
তবু দেখে যেতে হয়
ভোরে কি সন্ধ্যায় কি রাত গভীর হলে
তোমাকে সেখানে বসে থাকতে দেখি,
আনমনা___;
মাঝে মাঝে তোমাকে দেখি
মোবাইল ফোনে আঙুল চেপে চেপে লিখতে।
কী যে লিখ ছাইপাশ― এই ভেবে পাশ কাটিয়ে যাই
আমারই ঝুল বারান্দায়
তোমার সময় কাটে, ভোরে কি সন্ধ্যায়
সেখান থেকে ফিসফিস শব্দ ভেসে আসে;
ইদানিং ফেসবুকে পেয়েছে তোমাকে
কী যে আছে সেখানে?
বন্ধুরা বলে, তুমি নাকি দারুন লেখ!
তাই নাকি? আমি মাঝে মাঝে পড়ি বটে, আহামরি কিছু না__
তবু প্রশংসা বলেই হয়তো ইর্ষা জাগে মনে, বিরক্তও লাগে।
তোমাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখি না
না রান্নাঘরে, না শোবার ঘরে, না অফিসে, না ঝুল বারান্দায়
সবকিছুকে অতিক্রম করে যাওয়া এক বিস্ময়
আমাকে ক্লান্ত করে।
আমি মুখ ফিরিয়ে রাখি,
আমার ফাইল-পত্র, নিষ্পত্তির অপেক্ষায় বসে থাকা অভিযোগ
আমার সঙ্গী হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
তারপর আসে সেই বিকেল___
তোমাকে দেখি ভেজাচুলে ঝুল বারান্দায়
দেখি রকিং চেয়ারে দুলছ তুমি,
দেখি পাখিরা হিংসায় মরে যাচ্ছে,
দেখি আকাশের কোলজুড়ে ঘন মেঘ জমেছে,
দেখি বারান্দার ওপাশে যে খোলা মাঠ, সেখানকার সবুজ ঘাস
একবিন্দু শিশিরের প্রত্যাশায় অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে।
আমি অস্থির হয়ে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াই___
আমার অস্থিরতা তোমাকে স্পর্শ করে না,
তোমার চোখ আমাকে দেখে না,
তোমার শরীর রকিং চেয়ারের সাথে দুলতে থাকে
দুলতে থাকে।