চাতকঃ মরমী লোককাব্য ও চাতকচৈতন্য
হেলাল মহিউদ্দীন
“চাতকের প্রাণ যদি যায়,
তবু কি অন্য জল খায়?
উর্ধ্বমূখে থাকে সদাই,
নবঘণ জল চেয়ে”
[লালন ফকির]
প্রতীক্ষার রূপ কী? প্রতীক্ষার রূপকল্পগুলো কেমন? কী এমন বিশেষত্ব লোকজ কবিদের বয়ানে উঠে আসা প্রতীক্ষার রসায়নে? লোক-কবিগণ কেন প্রতীক্ষায় থাকেন প্রিয়সন্ধানে—প্রিয়তম শব্দগুচ্ছের জন্য প্রতীক্ষার মত? কেনইবা প্রিয় শব্দের অপেক্ষায় কোনো অশরীরি অলৌকিক হাহাকারের অংশ হয়ে পড়েন তাঁরা। কেনইবা তেমনই একাগ্র থাকেন যে লোকচক্ষে তাঁরা স্থবির, স্থানু, জড় ও উচ্চাভিলাষহীন গতিহীন মানুষরূপে প্রতিভাত হন? আরো সহজে বলতে গেলে প্রশ্নটি দাঁড়ায়—দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে লোককবিগণ কেন ধীরতা ও স্থিরতায় থিতু থাকতে ভালবাসেন? কেন একান্ত জগতই তাঁদের আসল নিবাস? কোন ভাষাবসতি নির্মাণযজ্ঞে ঋষিবৎ সাধনা তাঁদের? লোক-কবিদের কীভাবে চিনি?
“The slow movement seems, somehow, to say much more.
To watch the rarer birds, you have to go
Along deserted lanes and where the rivers flow
In silence near the source, or by a shore
Remote and thorny like the heart’s dark floor.”
ভারতীয় ইহুদি কবি নিসসিম ঈজকিয়েল তাঁর Poet, Lover, Birdwatcher-এ জানালেন—কবিগণ স্থিতধি মানব। গভীর অভিনিবেশই তাঁদের শক্তি। তাঁরা যেন সময়কেই চিরবিদায় দিয়ে রেখেছেন। যেন কতো শত-সহস্র শতাব্দী পেরোয়। তবু তাঁরা কাল-কালান্তরের হিসেব-নিকেশ-ঠিকুজি সরিয়ে রাখেন অবলীলায়। কারণ, তাঁদের ধ্যান অনুধ্যান জুড়ে থাকে একাগ্রতা। পক্ষীপাঠের অথবা নারীপাঠের মত!
“To force the pace and never to be still
Is not the way of those who study birds
Or women. The best poets wait for words.”
‘পক্ষীপাঠ’ এবং ‘নারীপাঠ’ দুই রূপক। উভয় উপমারই সারকথা ‘গভীর অভিনিবেশ’। কবিদের কবি তাঁরাই, যাঁদের অনিশেষ প্রতীক্ষা থাকে প্রিয় শব্দের জন্য, উপমার জন্য, রূপকের জন্য। তাঁরা ততক্ষণই গতিহীন পড়ে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রিয় রূপকের সন্ধান না মেলে! যেমন, অভিনিবেশ শেষে লালন খুঁজে পেয়েছেন প্রিয় উপমা ‘চাতক’।
“সাক্ষী আছে চাতকরে,
ওসে কোন সাধনে যায় মরে,
চাতক অন্য বারি খায় না রে,
থাকে মেঘের জলের আশায়!”
লোককবিগণ যখনই অস্তিত্বে টের পান প্রিয় রূপকের অনুরণন, তখনই তাঁরা ছুট লাগান অনন্তের সন্ধানে। সে যাত্রা হয় নিরন্তর। বিরতিহীন। তখন আর তাঁরা স্থির থাকেন না। পরমানন্দে মানবজগতের অলি-গলিসন্ধিতে বিচরণ করতে থাকেন। হাতে থাকে আলোকদানি। সেই সত্যের নির্মেদ প্রকাশের সেরা উদাহরণ লালন-কাব্যদর্শন। লালন সাহিত্যের ‘চাতক-নির্ভর’ দার্শনিক উচ্ছ্বাসও যেন ঈজকিয়েল বর্ণিত নারীপাঠের পরমানন্দের মত। শরীরি নারীপাঠ নয়। নারীরূপের কামজমূর্তি-পাঠ নয়, অভিজ্ঞানের আলোকচ্ছটা পাঠ—যা বিমূর্তকে করে দিতে পারে মূর্ত। যা ভাষাহীনকে দিয়ে দিতে পারে ভাষাময়, বধিরকে দিতে পারে বাকশক্তি, দৃষ্টিহীনকে দিতে পারে আলো।
“And there the women slowly turn around,
Not only flesh and bone but myths of light
With darkness at the core and sense is found
But poets lost in crooked, restless flight,
The deaf can hear, the blind recover sight.”
এই আলোর সন্ধানে নিরত লোককবিগণ স্থানু ও স্থবির হয়ে থাকতে দ্বিধান্বিত হন না। যতক্ষণ সংস্পর্শ না মেলে প্রিয় রূপকের, নিরন্তর সন্ধানে যুদ্ধরত থাকেন তাঁরা।
লালন প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে—কোন উপমারত্নটির জন্য ছিল লালনের প্রতীক্ষা ও অভিনিবেশ?
উত্তর—‘চাতক’ রূপকটির জন্য।
“চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালো শশী।
হব বলে চরণদাসী তা হয় না কপাল গুণে”!
একটি গীতের চার স্তবকের চারটিতেই লালন নিয়ে এলেন চাতকের উপমা, তার দুইটি—
“তুমি হে নব জলধর
চাতকিনী ম’লো এবার।
ঐ নামের ফল সুফল এবার
রাখ ভুবনে।”
“তুমি দাতার শিরোমণি
আমি চাতক অভাগিনী।
তোমা ভিন্ন আর না জানি
রাখ চরণে।”
প্রতীক্ষার রূপক ‘চাতক’। এই রূপকজগতের মালিকানা শুধুই একজন ভূস্বামীর। সেই ভূস্বামী ‘লালন ফকির’। এই অভাজনের বিচারে ‘চাতক ফকির’। ‘চাতক ফকির’ নামকরণের কারণ লালন মরমি-দর্শনের মূল শক্তিই ‘চাতক’। লালনের এই চাতক-রূপকের মর্মমূল অনুধ্যান বাংলা সাহিত্য আলোচনায় কখনো গভীর অভিনিবেশে পঠিত হয়নি! হলে দেখা যেত চাতককে কেন্দ্রে রেখে বিকশিত একগুচ্ছ রূপকল্প।
মেঘ। বারি। তৃষ্ণা। প্রতীক্ষা। মিলন-বিরহের রসায়ন। মানব-সন্দর্শন! লোকজিজ্ঞাসার অলংকারশাস্ত্র—
“চাতক বাঁচে কেমনে
মেঘের বরিষণ বিনে!”
অথবা
“চাতক থাকে মেঘের আশে,
মেঘ চলে যায় অন্য দেশে,
বলো চাতক বাঁচে কিসে?”
চাতকচৈতন্যে একাকার হলেন লালন। তারপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একতারা হাতে দুর্নিবার ছুট লাগালেন অনন্তের সন্ধানে। আমরা পেলাম লালন লোককাব্য, যার চারিত্র্য বিশেষভাবে চাতকময়। চাতক-দ্যোতনার সবিশেষ সম্মিলনই লালন মরমিজাগতিক বৈশিষ্ট্য। লালনকাব্যকৃতি সর্বাঙ্গিন চাতক-বিভূতিময়।
“চাতক ম’লে যাবে জানা
ঐ নামের গৌরব রবে না
জল দিয়ে কর সান্তনা
অবোধ লালনে।”
“হায়রে বিধি ওরে বিধি
তোর মনে কী এটাই ছিল
সমুদ্রের কিনারে থেকে
জল বিনা চাতকি মরল?”
কিন্তু আমরা সাহিত্য আলোচনায় অনেকটাই বেখেয়ালি ছিলাম। আলোচনায় আনা হয়নি কেন হাসনের মরমীগাথায় কোড়াপাখি আর ‘হাসনের নাও’এর প্রাধান্য। হাওড় আর ভাটির মরমীসৌন্দর্যকে আমরা পরিবেশবিজ্ঞানের হাতে তুলে দিয়েছি। পাখির রূপকের কথা এলে আমাদের আলোচনা মোড় নেয় প্রণয়াত্মক কাব্যঘরানা আলোচনায়। আমরা ডাহুক, পানকৌড়ি আর হিজলের সঙ্গে পারম্পর্য দেখাতে জীবনানন্দ ঘরাণার বিষাদ-প্রণয়াকূলতা্র পারম্পর্য বা সংস্পর্শ আলোচনায় নামি। সুধীন, বুদ্ধদেব হয়ে আল-মাহমুদ অথবা মান্নান সৈয়দে প্রতিরূপ খুজতে নামি।
এই নেমে যাওয়াটি বিশেষ ধরণের ভ্রান্তিচর্চ্চাই বটে। ইংরেজি ‘রিডাকশনিজম’ [প্রকৃত বাংলা প্রতিশব্দ কী হতে পারে? অবনমন? বৃহত্তর হতে ক্ষুদ্রতর গন্ডিতে নেমে যাওয়া বোঝাতে?] প্রত্যয়টির আলোকে ভ্রান্তিটি বুঝা সহজ। লোকসাহিত্য, মরমিয়া, সহজিয়া কিংবা সুফি ঘরাণার বৈশিষ্ট্যই এরকম যে সেগুলো স্থান-কাল-পাত্রের গন্ডী অতিক্রম করে যাওয়া সর্বজনীন দর্শনকাব্য হয়ে ওঠে। তাই লোকজকাব্যের সঙ্গে আধুনিক কাব্যভাবের তূলনামূলক আলোচনা চলে না। লোককাব্যের মরমি দর্শনের সর্বজনীনতা সাধারণ কাব্যকথার ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে যায় নানারূপে ও মাত্রায়। কখনো ধর্মচিন্তার আদলে, কখনো যুক্তি ও বস্তুজাগতিকতায়। বৈচিত্র্য বিবেচনায় লালনকাব্যও ধর্মাচরণ এবং জীবনাচরণের এক ধরণের শৈল্পিক সংশ্লেষণ। এই সংশ্লেষণ অর্থবহ রূপ পায় ‘চাতক দর্শন’-এর উপর্যূপরি প্রয়োগের মাধ্যমে। ভাববাদী প্রয়োগের ধারায় লালন সুর তোলেন—
“পাপীতাপী করতে তারণ,
নাম ধরেছে পতিপাবন,
সে ভরসায় আছি যেমন,
চাতকরূপে মেঘ নিহারী।”
“চাতক রয় মেঘ ধিয়ান্
চকোর রয় জ্যোৎস্না পানে,
কেউ কেউ পায় কর্মগুণে,
কয়েক জনমে!”
লালনসত্ত্বার গভীর গহীন মানবিক ক্রন্দনের অনুভূতির সঙ্গে আমরা ক্ষণিকেই একাত্ম হতে পারি কেন? কী সেই চৌম্বকটান যা্ হৃদয়াকুল মানবিক ভাবনা্য নাগরিক মনকেও আর্দ্র করে, দ্রবিভূত করে, কোমল করে? কী সেই আকর্ষণ যা মানবকে উন্মন করে তোলে? নিয়ে যেতে চায় আদিবাসমূলে, শিকড়ে, স্বপরিচিতি-সন্ধানে?
সেই চৌম্বক টানটির নাম ‘প্রতীক্ষা’। প্রিয়তম সত্ত্বায় একীভূত হবার প্রতীক্ষা। প্রিয়মুখ দর্শনের—প্রিয়মিলনের অনিশেষ আকুলতা। এই অনুভূতি শুধুই প্রত্যাশা নয়। অপেক্ষা নয়। শরীরী কামনা-বাসনা নয়। এই চৌম্বকটান প্রতীক্ষারও অধিক। আত্মায় অন্তরাত্মা মেলানোর গভীরতর অনুভবে নিত্যনিয়ত ক্রন্দনময় আকুতি। প্রেমাষ্পদের জন্য নিরন্তর অনন্ত অপেক্ষা। সে প্রেমাষ্পদ হতে পারেন হাল্লাজ ও রুমীর পরমাত্মা্য মিশে যাবার জন্য মানবাত্মার আকুতি। বৃষ্টির জন্য চাতকের অধীর প্রতীক্ষার মত। যেমনটি লালন গাইলেন—
“চাতক পাখির এমনি ধারা
তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা।
অন্য বারি খায় না তারা
মেঘের জল বিনে।”
“বিনা নব-ঘন বারি,
পান করে না অন্য বারি,
চাতকের প্রতিজ্ঞা ভারী,
যায় তো জীবন সে তো ভাল!”
“চাতক করে মেঘের ধিয়ান
অন্য বারি করে না পান
ফকির লালন কয় প্রবর্ত প্রমাণ
সাঁইজি সিরাজ যা করে।”
“মেঘ পানে চাতকের ধিয়ান,
অন্য জল করে না পান,
লালন কয় জগতে প্রমাণ,
ভক্তির শ্রেষ্ঠ ভক্তি।”
গভীর সঙ্গোপনে কবিচরিত্রও আসলে চাতকচরিত্রই! কবিচরিত্র তো বটেই, মানবচরিত্রও সেরকমই। কিন্তু সেই কাম্য চরিত্রকে জলাঞ্জলি দিতে দেখেই মরমে মরেছেন লালন। দেখলেন মানবিক সীমাবদ্ধতা ধর্ম-বর্ণ-বিভেদের জালে আটকে রেখেছে সমাজকে। লালন সন্দর্শনের পুরোভাগ জুড়ে একটিই আকুতি—মানুষ যেন এইসব ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে ওঠতে পারে। চাতক যেমন মেঘের জলকে প্যানাসিয়া বা সর্বরোগহর জ্ঞানে প্রতীক্ষ থাকে; একবিন্দু জলেই ঘুচবে সমস্ত বিসুখ—এমন প্রতীতিতে স্বীয় বিশ্বাস-ভাবনায় স্থির থাকে, মানবের কাছে লালনের চাওয়াও সে রকমই। তাই তিনি ছত্র বাঁধেন—
“কখন অমৃতমেঘের বরিষণ,
চাতক স্বভাব জানরে মন,
তার এক বিন্দু পরশিলে,
শমন-জ্বালা ঘুচে যায়!”
“চাতকস্বভাব না হলে,
অমৃত মেঘের বারি,
সে কথায় কি মিলে?”
লালনের অনুজ্ঞায় অনুধ্যানে ‘চাতক’এর উপস্থিতি এতটা দৃশ্যমান কেন?
কারণ, চাতক প্রতীক্ষায় থাকে মেঘের। বারি-বর্ষণের। তাঁর তৃষিত হৃদয় সার্দ্র করতে পারে শুধুই বৃষ্টির জল। খরা-অনাবৃষ্টিতে জমিনে ফাটল ধরলে চাতকের মরমেও ফাটল ধরে। তবু তাঁর সকল একগ্রতা জুড়ে থাকে শুধুই মেঘ। চারপাশেই হয়ত সুপেয় জলের নিঃসীম বিস্তার। তৃষ্ণা নিবারণের জলের কমতি নেই। কিন্তু সকল জলই হৃদয়কে সিক্ত করতে পারে না। তার চাই সেই জল যা তাকে দেবে পূণরুজ্জীবন। শুধু তারপরই সে ডানার খেলায় ভর করে পরমানন্দে উড় বেড়াবে আকাশময়। বারবার ঘুরেফিরে লালনের অনুজ্ঞায় ভর করে চাতকচৈতন্য। অনেকটাই পুণরুক্তির মত। তবু লালনপাঠে সেইসব শব্দপুঞ্জকে দ্বিরুক্তি বা পূণরুক্তি মনে হয় না। তার কারণ, একটি সামগ্রিক দর্শনের উপস্থিতি। শুধু উপস্থিতিই নয়, লালনের কব্যদর্শনে কোনোরূপ বিচ্যুতি অথবা দ্ব্যর্থবোধকতা নেই। বিমূর্ততাও নেই। লালন-সন্দর্শনে সূফি ভাবধারার মত কুহকতা বা প্রচ্ছন্নতাসর্বস্বও নয়।
“চাতক পাখির এমনই ধারা,
অন্য বারি খায় না তারা,
প্রাণ থাকতে জ্যান্ত মরা,
ঐরূপ-ডালে বসে ডাক!”
“চাতকরূপ পাখি যেমন,
করে সে প্রেম-নিরূপণ,
আছি তেমন প্রায়—
কারে বা শুধাই,
সে চাঁদের উদ্দেশ কে কয়?”
কিন্তু জীবন একই বাঁধাধরা ছন্দের আবর্তে থাকে না। প্রতীক্ষার পর কাম্য সুখ ক্ষণিকের উপস্থিতি জানান দিয়ে আবারো হয়ে যেতে পারে অধরা। লালনের অনুধ্যানে সেই পেয়েও না পাওয়ার; মরুদ্যানে এসেও বেদুইনের সতৃষ্ণ রয়ে যাবার হাহাকারও মানবিক সত্যরূপেই প্রতিভাত।
“ও মেঘ হলো উদয়,
আবার লুকালো কোথায়,
পিপাসায় প্রাণ গেল,
চাতক চাতিকার।”
লালন একাগ্রতাহীনতাকে মানবের মানবজনমে ঘুণপোকা হিসেবে দেখেছিলেন। অস্থিরতা, অধৈর্য্য ও একাগ্রতাহীনতাই যে মানবজনমে ক্ষয়রোগের বীজাণু, লালন সেই সত্যকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি চাইতেন মানবজনম চাতকজনম হতে শিক্ষা নিক। সাধক হয়ে ওঠুক। লালন গাইলেন—
“মেঘে কত করে ফাঁকি,
তবু চাতক মেঘের ভূখি
তেমনি নিরীক্ষ রাখলে আঁখি,
সাধক বলে!”
তবে লালন-ভাবনারাশির মূল সমৃদ্ধি প্রেম-এ। প্রেমাষ্পদের জন্য প্রেমির আকুতি ও আকুলতা ঠিক যেন চাতকে্র মেঘের জন্য প্রতীক্ষার মত। লালনের কথা ছুঁয়ে আমাদের মর্মেও গভীর মমতার একটি জায়গা করে নিয়েছে চাতক। নাগরিক গীতিকথায়ও তাই চাতক অনুজ্ঞা হয়ে এসেছে। আধুনিক গানের অন্তরায়ও এভাবেই ফিরেছে চাতক—
“বইছে ঝরছে ঝর্না নদী কতো
চাতকের নেই সেদিকে দৃষ্টি!
তৃষ্ণায় বুক ফেটে মরবে সে
যদি মেঘ না দেয় তাকে বৃষ্টি”।
লালনের প্রেমদর্শনে বরাবরই হাজির রয়েছে চাতক—
“মেঘের জল বৈ চাতক যেমন,
অন্য জল করে না গ্রহণ,
কৃষ্ণ ভক্তজন একাগ্র মন,
কৃষ্ণের লাগি!”
“পুরুষ পরশমণি, কালাকাল তার কিসে জানি,
জল দিয়ে সব চাতকিনী, করে সান্তনা।”
“মেঘে যেমন চাতকেরে, দেখা দিয়ে কলা ধরে,
লালন বলে তাই আমারে, করলেন গৌর বরাবরি!”
পি বি শেলির বিখ্যাত ‘টু অ্যা স্কাইলার্ক’ এবং তাঁর মহাভক্ত টমাস হার্ডির নৈবেদ্যকবিতা ‘শেলি’স স্কাইলার্ক’ কবিতা দুটি সাহিত্যজগতে যে মাত্রায় ও ধরণে আলোচিত হয়েছে, সেই তুলনায় খুব সামান্যই আলোচনায় এসেছে লালনের ‘চাতক’। অথচ দুই কবির স্কাইলার্ককে (ভরতপক্ষী/ চাতক) উপজীব্য করা পশ্চিমা ‘চাতকবন্দনা’ ব্যাপক হলেও সেগুলোর কাব্যকৃতির পরিসর নিতান্তই সীমিত। তাছাড়া কবিতাগুলো রোম্যান্টিক ঘরাণার।
শেলির পর হার্ডির একক কবিতায় পরম্পরা টানার পর আর কোনো নব্যধারায়ও পক্ষীরূপকের তেমন বিস্তৃতি নেই। পরিপূর্ণ কোনো গ্রন্থ নেই যাতে চাতক বা অন্য কোনো পাখি-উপমার বহুল ব্যবহার দেখা যেতে পারে। কীটস এর ‘ওড ট্যু অ্যা নাইটিঙ্গেইল’ কবিতাটি বিষাদ-বিষন্নতার উপমা-রূপক-অলংকারের আকর হলেও ভাব-বিন্যাসের ধরণ তার পরিচিতি দিয়েছে ‘ওড ট্যু মেলাংকলি’ হিসেবে। অনেকেই সেই কবিতায় দুঃখ-ব্যাথার ‘উপশম অনুপান’ (হিলিং প্রপার্টিজ’) খুঁজে পাবার দাবী করেন। কিন্তু যাঁরা কবিতায় দর্শনের খোঁজে নামেন তাঁরা স্বগতোক্তিময়তা ও প্রথম পুরুষে তাঁর কবিতা-কাঠামো আটকে থাকায় নাইটিংগেলকেই খুঁজে পাবেন না।
গ্রীক মহাকাব্যের কল্পজাগতিক ফিনিক্স পক্ষী অবশ্য বিশ্বজুড়ে কাব্যভান্ডারে স্থান করে নিয়েছে নানারকম দর্শনের রূপক হিসেবে। কিন্তু লালন-সাহিত্যে ‘চাতক’ রূপকল্পের একক ব্যবহার সম্ভবত ফিনিক্স পক্ষীর রূপকল্প ব্যবহারের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের হাতে নিশ্চিত গবেষণালব্ধ প্রমান থাকলে হয়ত বলা সম্ভব হত লালন কয় হাজারবার ‘চাতক’ রূপকল্পটির কতোটা বৈচিত্রময় প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে শুধু এটুকুই বলা প্রয়োজন যে লালন দর্শনকাব্যে ‘চাতক’ রূপক ব্যবহারের ধরণ-প্রকৃতি বিষয়ে একটি পুর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রয়োজন। এই নিবন্ধ সেই গবেষণার জন্য উস্কানিমূলক অণুক্রমনিকা মাত্র!
লালনপাঠে বারংবার কেন ফিরি? কেনইবা ‘চাতক’ রূপকের বহু-ব্যবহারও ক্লান্তিকর কিংবা একঘেঁয়ে অনুভূত হয় না? বরং ভিন্ন ভিন্ন অনুজ্ঞায়, ভিন্নতর সৌন্দর্যে নিত্যনতুন রূপে কেনইবা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে? কেনইবা চাতক-অনুজ্ঞার লালন-ভাষা যুগোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে? কারণ লালন কাব্যকৃতির মরমী দর্শনের পরতে পরতে আমরা পাই ঈজকিয়েল বর্ণিত স্থিতধি প্রতীক্ষার ও অভিনিবেশের বিচ্ছুরণ। ঈজকিয়েল যেমনটি লেখেন—
“The hunt is not an exercise of will
But patient love relaxing on a hill
To note the movement of a timid wing;
Until the one who knows that she is loved
No longer waits but risks surrendering –
In this the poet finds his moral proved
Who never spoke before his spirit moved.”
তাঁকে পাবার জন্য সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা। তিনি হতে পারেন প্রেমাষ্পদ। হতে পারেন ঈশ্বর পরমেশ্বর। হতে পারে শুধুই স্বীয়সত্ত্বার নিরন্তর অন্বেষণ-চেষ্টা। সক্রেটিক ‘নৌ দ্যাইসেলফ’ এর মত!