You are currently viewing জাতির মৌলিকত্ব, উপরিকাঠামোর উন্নয়ন  এবং ইতিহাসের দায়/ আলী সিদ্দিকী

জাতির মৌলিকত্ব, উপরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং ইতিহাসের দায়/ আলী সিদ্দিকী

জাতির মৌলিকত্ব, উপরিকাঠামোর উন্নয়ন

এবং ইতিহাসের দায়

আলী সিদ্দিকী

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বছরের অপরাপর জাতীয় দিবসের মতো আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। এতে কোনো সমস্যা নেই। জাতির অকুতোভয় সন্তানেরা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বীজ বপন করেছে এবং জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা অর্জনে কামিয়াব করেছে। এই বিশাল অর্জনের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে জাতি উৎসবে মেতে উঠবে-এটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালী জাতির মতো এমন গৌরবগাথা আর কয়টি জাতির আছে? সুতরাং বিজয়ের সকল মাইলফলকে শোকাবহতা ভুলে বাঙালী জাতি উৎসবে মেতে উঠার অধিকার রাখে। এক্ষেত্রে কারো আপত্তি করার অবকাশ নেই।

আজ বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে, বিশাল বিশাল সড়ক-মহাসড়ক, উড়ালসেতু, পদ্মাসেতু, পাতালরেল, মেট্টোরেল হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে, হাজার লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় বাজেট হচ্ছে, ফোর-জি নেটওয়ার্ক চলে এসেছে, জাতীয় অর্থে স্যাটেলাইট উড়ছে, সর্বোপরি প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু আয় দুইহাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে (অবশ্য দরিদ্র মানুষের অবস্থা এক্ষেত্রে গণ্য করা যাবে না। বিদেশে বেগমপাড়া প্রকল্প দ্রুতই প্রসার লাভ করছে।  জিডিপি হলো এক সুচতুর ধাপ্পা), কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে।  অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার সকল ব্রান্ডেড উপকরণে সয়লাব হয়ে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সকল বিপণিবিতান। বাহ্যিক উন্নয়নের চমকে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে মানুষের। জিডিপি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। খাদ্যে হয়ে উঠছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সোনারবাংলা পরিণত হচ্ছে সোনারখনি। হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়ে বাঙালী জাতি আজ পরিপূর্ণতার গর্বে গর্বিত।

আসলে কি বাঙালী জাতি পূর্ণতা লাভ করেছে? উপরিকাঠামোগত উন্নয়নই কি একটি জাতির  পরিপূর্ণতার মাপকাঠি? একটি জাতি তার বিকাশের পথে নিজের সমগ্রতাকে নিয়েই অগ্রসর হয়। জাতির ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-কৃষ্টিই হলো একটি জাতির সামগ্রিকতার অনিবার্য অংশ। জাতি হিসেবে বিকশিত হবার পথের সকল অর্জনকে সমুন্নত রেখেই নিজেকে পরিপূর্ণ করতে হয়। গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালী জাতি কি নিজের রাষ্ট্রিক অস্তিত্বকে নিজস্ব স্বকীয়তা দিয়ে বিকশিত করেছে? না, করেনি।

স্বাধীনতাত্তোর প্রথম কয়েকটি বছর দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের অভাবে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে জাতি পতিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিহীনতা ও মিলিট্যান্ট ফোর্স তৈরি না করে জাতিকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়ার কারনে নিরস্ত্র ও অপ্রশিক্ষিত মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে- যখন যুদ্ধ জনযুদ্ধের দিকে মোড় নেয়ার লক্ষণ পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো তখন তড়িঘড়ি করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো হয়। ভারতের বুর্জোয়া নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের পাতিবুর্জোয়া নেতৃত্বের যোগসাজসে মাত্র নয়মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানীরা পরাজিত হয়। বাঙালী জাতি এক অদূরদর্শী ও অপ্রস্তুত নেতৃত্বে সংকটের গহবরে নিপতিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হায়েনা রাজাকার-আলবদর-আলশামস সদস্যদের বিচার না করাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর চরম রাজনৈতক ভুল। তারা এই দুর্বলতার সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু হয় চরম লুটপাট, মজুতদারী, খুন, গুম, রাজনৈতিক সন্ত্রাস। ক্ষমতাবঞ্চিত ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ভুয়া সমাজতন্ত্রের শ্লোগানে জাসদের নাশকতা, রক্ষীবাহিনীর নারকীয়তা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বামপ্রগতিশীল দলগুলোর বিভ্রান্তি দেশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে। দেশ পতিত হয় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় অনাহারে- অর্ধাহারে। এই অবস্থার সুযোগ নেয় পাক-মার্কিন মদতপুষ্ট মোশতাক-জিয়াচক্র। তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট।

এক টালমাটাল অবস্থার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ অন্দরে পাকিস্তান বাইরে বাংলাদেশী লেবাস নিয়ে কসাই জিয়ার হাতে পড়ে। মেজর জিয়া পাকিস্তানপন্থী আমলা,  দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক দল, এনএসএফ-এর গুন্ডা আর লুটেরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতির মাঠে নামায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কলে কারখানায় যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জিয়ার জাগদল, ছাত্রদল রক্তের বন্যা বয়ে দেয়। দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের দৌরাত্ম্য চরমাকার ধারব করে। একাশি সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনাবাহিনী জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে।

বাংলাদেশ পুনরায় সংকটে পতিত হয় এবং আরেক স্বৈরাচার-পাকিস্তানফেরত জেনারেল এরশাদ বিনা রক্তপাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ স্বৈরাচারী শাসন বলবৎ করে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্রের তকমা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পদদলিত করে। দেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। দীর্ঘ দশবছর এরশাদ তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলনে মোকাবেলা করে ক্ষমতায় টিকে থাকে  এবং একানব্বুইয়ের  গণ অভ্যূথানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যূত হয়।

বিরানব্বুই সাল থেকে বাংলাদেশ শেখ মুজিব-মেজর জিয়া পরিবারের দুই বশংবদ দলের পালাবদলের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছে। উভয় দলেরই এজেন্ডা হলো পরিবার তোষণ ও ব্যক্তিপূজা। মেজর জিয়ার বহুরূপী অধ্যুষিত দলটির ত্রাহি অবস্থা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। গত দেড় যুগের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের এই দলটি যুদ্ধাপরাধীখ্যাত কয়েকজনকে কোরবানী দিলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাষ্ট্রধর্ম প্রত্যাহার করেনি, বাতিল করেনি শত্রু সম্পত্তি আইন, নিরাপত্তা দেয়নি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর, জিয়াউর রহমান আরোপিত বিসমিল্লাহ অবমুক্ত হয়নি রক্তার্জিত সংবিধান, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়নি।

বর্তমান আওয়ামী লীগ শুধু একাত্তর থেকে, বঙ্গবন্ধু থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে চায়- এমন কি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ  জাতীয় চারনেতার নামও উচ্চারণ করতে চায় না। মহাড়োম্বরে মুজিব শতবর্ষ করে কি ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে?

যাবে না। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত জাতিসত্ত্বার জাগরণের স্পন্দনকে যতক্ষণ বাঙালী জাতি তার চেতনায়, জীবনাচরনে, রাষ্ট্রের হৃদপিন্ডে ধারণ না করবে ততোক্ষণ বাঙালী জাতির পরিপূর্ণতা আসবে না। হাজার লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পাচ্ছে দেশ, কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে কিন্তু বায়ান্নের আত্মদানের স্বীকৃতি আজো দেয়া হয় নি। যেমন বেড়েছে ভাষার প্রতি অবহেলা তেমনি চেতনাবিরোধী নাশকতা। বছরে একবার শহীদ মিনারে ফুল দিলেই দায় ফুরোয় না। ভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভাষা শহীদদের স্বপ্নকে, আকাঙ্খাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। বাংলা একাডেমীর একটি কক্ষে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতর্পন সমূহকে অযত্নে ফেলে না রেখে একটা মিউজিয়াম করে আলাদা মর্যাদা দিতে হবে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার যাকে সংরক্ষণ না করলে ইট-কংক্রিট আর লোহা-লক্কড়ের উপরিকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে কখনোই পরিপূর্ণতা অর্জিত হবে না। বিজয় তখনই অর্থবহ হয় যখন বিজয়ের পথরেখা ইতিহাসের পাতায় সুস্পষ্টভাবে আঁকা হয়। বাঙালী জাতির এই মৌলিক কাজটি আজো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

কবি, লেখক ও সম্পাদক, মন-মানচিত্র।