জীবনের গান
মুহাম্মদ ফজলুল হক
এক
অপরিসীম আনন্দ আর উচ্ছাসের মধ্যে বড় হচ্ছে প্রিয়ন্তি। তার জম্ম যেন তার পরিবারের আনন্দ সীমাহীন বাড়িয়ে দিয়েছে। তাকে নিয়ে পরিবারের মাখামাখি রীতিমতো মত বাড়াবাড়ি। অর্থবিত্তের কমতি থাকলে ভালোবাসা, আদর, যত্ন ও স্নেহের কোন কমতি নেই। পিতামাতার কথা বাদ দিলেও চাচা, ফুফু, মামা, খালাসহ পাড়াপ্রতিবেশি আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন তার ব্যপারে অন্ধ। প্রিয়ন্তিকে একটু আদর, একটু ভালোবাসাতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে হয়। ভালোবাসায় মহত্ত্ব থাকে না, স্বার্থ থাকে এ কথা সত্যি হলেও প্রিয়ন্তির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সবাই তাকে স্বার্থহীন পরম মমতা দিয়ে ভালোবাসে। এমন আদর, যত্ন, ভালোবাসা প্রাপ্তিতে প্রিয়ন্তির শিশুসুলভ আচরণ নাকি তাকে দেখে মানুষের মনে জেগে উঠা আপত্য লালন তা নির্ধারণ করা যায় না।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিয়ন্তির গুরুত্ব না কমে বরং বাড়তে থাকে। সে যেখানে যায় তাকে ঘিরে আলাদা বলয় তৈরি হয়। তার প্রয়োজন সবার আগে মেটানো হয়। প্রিয়ন্তি দিনে দিনে তা উপলব্ধি করতে শিখে। তার মনে বার বার প্রশ্ন জাগে সবাই তাকে এত ভালোবাসে কেন? উত্তর পায় না সে। তবে ভালোবাসার প্রতিদানের কথা অনুভব করে।
প্রিয়ন্তির পিতামাতা সহজসরল মানুষ। তাদের নিজস্ব কিছু জমিজমা আছে। এই এলাকা সবজির জন্য বিখ্যাত। মেঘনা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় আলু, পটল, সীম, বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঢেড়শ, কাকরোল, ধুন্দল, ঝিঙ্গাসহ নানাবিধ সবজি ভালো উৎপাদিত হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় হওয়ায় জাতীয় ফল কাঁঠালও ভালো হয়। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সবজি ও কাঁঠাল পাশ্ববর্তী শহরের চাহিদা মিটায়। বাড়ী সংলগ্ন জমি হওয়ায় প্রিয়ন্তির অবাধ যাতায়ত সেদিকে। বিকালে খেলতে যাওয়ার পাশাপাশি দুপুরে পিতার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া তার চাই-ই চাই। পিতাসহ অন্যন্য লোকজন যেন তার জন্য অপেক্ষা করে। তার আগমনে অপেক্ষার পালা শেষ হয়। একযোগে সবাই বলে উঠে, এতদেরি প্রিয়ন্তি! সেই সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। খাওয়া শুরু হলে প্রিয়ন্তি সহযোগিতা করে। তার হাস্যজ্বল উপস্থিতি, ভালো আচরণ কিংবা অজানা কারণে সকলে আনন্দ অনুভব করে।
সমযের সাথে সাথে শিশুবয়স পেড়িয়ে কিশোরী হয়ে উঠে প্রিয়ন্তি। তার কিশোরসুলভ দুরন্তপনায় এলাকাবাসী অতিষ্ঠ না হয়ে আপ্লুত হয়৷ অধিক স্নেহে বিগড়ে না যাওয়ার উদাহরণ যেন সে। ফলে আরো অধিক স্নেহের অংশীদার হয়ে উঠে। ক্রমে সে পরিবার, প্রতিবেশি ছাপিয়ে পুরোগ্রামের প্রিয়জন হয়ে উঠে।
ভিন্নগ্রামে প্রিয়ন্তির নাম ছড়িয়ে পড়ল কি না জানা না গেলেও বিভিন্ন এলাকা থেকে তার বিয়ের সমন্ধ আসতে থাকে। প্রথম দিকে গুরুত্ব না দিলেও শহরের নামদামী এক পরিবারের আবদার ফেরানো যায়নি। কোন এক শুক্রবার শুভলগ্নে সারা গ্রামে আনন্দ ছড়ানো কিশোরী প্রিয়ন্তির বিয়ে হয় আলী পরিবারের প্রথম সন্তান আহমেদ আলীর সাথে। বিয়ে আর মৃত্যু যেন পরিপূরক। মৃত্যুর সাথে সাথে দ্রুত মৃতের দাফন কাফন করতে আপনজন ব্যস্ত হয়ে যায় ৷ তেমনি বিয়ের পর কনে বিদায়ের ঘণ্টাও দ্রুত বেজে উঠে। উভয় ক্ষেত্রে প্রিয়জন বিদায়ে করুণ কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
অদ্ভুদ ব্যাপর হল, প্রিয়ন্তির বিদায়ে কেউ কান্না করেনি। কষ্ট পায়নি। আলাদা আনন্দ অনুভব করেছে। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করেছে, হে দয়ালু। আমাদের প্রিয়ন্তিকে সুখী করো। প্রিয়ন্তির বিদায়ে এলাকাবাসী শূন্যতায় ডুবে যায়। তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বিলম্ব ঘটে। তারা অনুভব করে সুখ তাদের গ্রামে থেকে চলে যাচ্ছে।
দুই
আহমেদ আলী আদতে ভালো মানুষ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তার মধ্যে নেই। সবার উপরে মানুষ সত্য একথা না জেনেও মনে প্রাণে মেনে চলে। বাজারে তার ধানচালের ছোট গদি। ধানচালের ব্যবসাকে সম্মানজনক বিবেচনা করা হয়। স্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এই ব্যবসায় জড়িত। আহমেদ আলীর গদির মালিক হলেও তার ব্যবসা এখনো প্রসার লাভ করেনি। যৌথ পরিবার ও বিয়ের খরচ চালিয়ে কোনরকম চলছে।
বিয়ের পর প্রিয়ন্তি এলো। ছোট্ট সংসার নতুন আলোয় ঝলমল করে উঠল। আহমেদ আলী বুঝেতে পারে, প্রিয়ন্তি শুধু তার স্ত্রী নয় আশীর্বাদ।
প্রথম দেখাতেই আহমেদ আলীকে পড়তে সমস্যা হয় না প্রিয়ন্তির। সাঝানো বাসর ঘরে একটু মজা করতে ইচ্ছে করে। পানি পান করেন ক্লান্তি কেটে যাবে। আহমেদ আলীর দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে প্রিয়ন্তি।
আহমেদ আলী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অপলক তাকিয়ে থাকে। নিষ্পাপ, মায়ামাখানো অনিন্দনীয় মেয়েটির দিকে।
অজু করব আমি। আপনিও অজু করবেন। নীরবতা ভঙ্গ করে আবারো বলে প্রিয়ন্তি।
ঠিক, ঠিক। চলেন। আমার সাথে চলেন। বলে, এগিয়ে আসে আহমেদ আলী।
হয়েছে! আপনি আপনি করতে হবে না।
হেসে উঠে আহমেদ আলী।
সেইথেকে শুরু হয় স্বপ্নময় পথচলা।
প্রেম, বিশ্বাস, পরস্পেরের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে গড়ে উঠে সংসার। প্রিয়ন্তি শুধু স্ত্রী নয় পরিবারের মেরুদণ্ড হয়ে উঠে। তিন ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে তাদের সুখী পরিবার।
প্রিয়ন্তির সাথে মানুষের ভালোবাসা ছিল। সেই মহিমায় নাকি আহমেদ আলীর প্রচেষ্টায় ব্যবসায় প্রসার হতে শুরু করে। টিনের ঘরের স্থলে দালান উঠে। প্রিয়ন্তির হাতে সংসার চলে নিপুণ দক্ষতায়।
পরম মমতায় ছেলেমেয়ে আগলে রেখে সংসার সামলে রাখে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা বড় হয়ে উঠে।
সংসারে অভাব দেখা দেয়। প্রিয়ন্তি কিংবা আহমেদ আলী দিনরাত পরিশ্রম করে অভাব থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখতে। অধিক পরিশ্রমে আহমেদ আলী অসুস্থ হয়ে যায়। গদিঘরে ঠিকমত সময় দিতে পারে না।
ছেলেমেয়েরা বড় হয়, শিক্ষিত হয়। তবে বোধ জম্মেনি। যে শিকড় তাদের দাঁড় করিয়েছে তাদের প্রতি মুগ্ধ ব্যবহার করতে শেখেনি। বড় দুই ছেলে বাবার সঞ্চয় শেষ করে বিদেশ যায়। দ্বিতীয় ছেলে হঠাৎ ফিরে এসে নিজের পছন্দে বিয়ে করে। পিতামাতার মতামত, অসম্মতি মানে না। মেয়ে, যার চোখে পানি দেখলে বাবা-মা সহসা কেঁদে উঠত। যাকে খুশী করার জন্য প্রাণবাজি রাখত সারাক্ষণ। সেই মেয়ে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে।
বড় ছেলে দেশে এসে সবকিছুর জন্য পিতামাতাকে দায়ী করে। পারিবারিকভাবে সে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়। ইতোমধ্যে ছোটছেলেও বড় হয়ে উঠে। অনেক ঘটনার পর সেও বিয়ে করে। বড় ছেলে একদিন অভিযোগ করে তোমরা আমাদের কিছু দিতে পারোনি। জীবন শেষ করে দিয়েছ। একথা শুনে আহমেদ আলী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
বাড়িতে একসাথে থাকা নানাবিধ সমস্যা। সারাক্ষণ সাংসারিক ঝামেলা লেগেই থাকে। ছেলেরা যার যার মত আলাদা হয় চলে যায়। তাদের সময় ভালো চলে। প্রিয়ন্তি ও আহমেদ আলী বাড়িতে একা। তাদের কথা কেউ ভাবে না।
যে বাড়ি ছিল প্রাণচঞ্চল, কোলাহলময় এখন তা নিঃশব্দ। আহমেদ আলীর অসুস্থতা বাড়ে। বুকে চাপ, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট। ডাক্তার বলে, অপারেশন জরুরি। কিন্তু টাকা কোথায়? ছেলেরা তেমন খবর রাখে না। ফোন তোলে না। অর্থাভাবে ভালো চিকিৎসা হয় না আহমেদ আলীর।
দিনরাত স্বামীর পাশে থাকে প্রিয়ন্তি। এই কি জীবন? যে মানুষ তিন দশক আগে প্রতিজ্ঞা করেছিল একসাথে বাঁচবে বলে আজ তাকে একা রেখে সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে ? অথচ তার কিছু করার সামর্থ্য নেই। প্রিয়ন্তি চুপচাপ থাকে সারাক্ষণ। নিয়তি মেনে নিয়ে কষ্ট কম পাওয়ার অভিনয় করে। ত্রিশ বছর যাবত জীবন যৌবন নিংড়ে যাদের লালন পালন করেছে,আজ বিপদের সময়ে তারা এতদূরে। এই সময় দেখবে বলে বেঁচে থাকা!
কোন একদিন ভোরবেলা প্রিয়ন্তি উপলব্ধি করে আহমেদ আলী না ফেরার দেশে। সারা বাড়িতে সে একা। কান্না করে মৃত সংবাদ প্রচার করবে এমন কেউ নেই। জীবন যেন অট্টহাসি! প্রিয়ন্তির কণ্ঠ শুকিয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি বের হয় না। চেষ্টা করেও কাদঁতে পারে না। নিষ্পলক তাকিয়ে রয়। তার জীবনসঙ্গী, তার প্রিয়তম, তার শক্তির উৎস চলে গেছে নিঃশব্দে। বেদনায় নীল হয়ে যায় সে।তার বুকের ভেতর থেকে সময় হেসে হেসে বলে ওঠে, জীবন এমনই! প্রিয়ন্তি, ইহাই জীবন! এই জীবন থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
তিন
বাড়িতে চাঁদের হাট বসে। আহমেদ আলীর অন্তোষ্টিক্রিয়া ধুমধামভাবে করা হয়। ছেলেমেয়েরা শোকে মূহ্যমান। আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর সান্ত্বনায়ও শোক সামলে উঠতে পারছে না। তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত হয়েছে কি না বুঝা না গেলেও তাদের শোকের মাত্রা মানুষের মন কেড়েছে। অবহেলায় পিতার মৃত্যু তরান্বিত হয়েছে বলে যারা মতামত দিয়েছেন তারাও শোক ও মায়ের প্রতি আনুগত্য দেখে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছে।
লোকজন কমতে শুরু করে। প্রিয়ন্তি পুরোপুরি একা হয়ে যায়। বড় ছেলে মাঝে মাঝে বাজার করে দিয়ে যায়। মেয়ে খোঁজখবর নেয়। ভালোই চলছিল একাকী জীবন। প্রিয়ন্তির জীবনে কালো দিন আসে। এক সকালে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যায়। বাঁ হাত অবশ। মুখের একপাশ ঢলে পড়ে।
কথা জড়িয়ে যায়। প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় অবস্থান নেয়। প্রাণচঞ্চল, পরিপাটি, সংসার সামলানো প্রিয়ন্তি আজ নড়াচড়া করতে অক্ষম। মুখের ভাষা অস্পষ্ট। ঠিকঠাক কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে না। চোখদুটো প্রাণের জানালা। আবেগ, কষ্ট, যন্ত্রণা সব সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ বুঝে না চোখের ভাষা।
ঘরের কোণেই দুনিয়া সীমাবদ্ধ। শরীরের একাংশ নিথর। নড়ার শক্তি কালের গহ্বরে বিলীন। চারপাশে মানুষ আছে। শব্দ আছে। কেউ শুনে না হৃদয়ের ভাষা। নিতম্বের নিচে ক্ষত তৈরি হয়। রক্তে ভিজে যায় বিছানা। বারবার ঘোরানো হয়। কোথাও স্বস্তি নেই। মাংসপেশি ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। কাশি উঠলে বুক ফেটে যায়। প্রস্রাবের জন্য টিউব লাগানো। পায়খানার জন্য কারো মুখের দিকে চাওয়া। মুখে কিছু বলতে না পারা। চোখে জমানো অনুচ্চারিত আর্তি। মানুষের স্বাধীনতা এত করুণভাবে কেড়ে নেয়া যায়। প্রিয়ন্তি কখনো ভাবেনি।
বিছানার চাদর বদলানো হয়নি অনেকদিন। চাদরে হলুদ ও বাদামি দাগের ছাপ। সময় যেন নিজ হাতে আঁচড় কেটে গেছে। প্রিয়ন্তির নিথর শরীর বিছানায় পড়ে আছে। নীরব বিস্মৃত ভাস্কর্য। ভেতরে বেদনার নদী। কেউ শুনতে পায় না তার গর্জন। স্ট্রোকের সময় বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, ওষুধ সবই ছিল। সময়ের সাথে হুলস্থুল থেমে যায়।
দীর্ঘদিন শুয়ে থাকায় শরীরের নিচের অংশে ক্ষত হয়। ক্ষত থেকে দুর্গন্ধ ওঠে যা নিজেকে কষ্টের সাথে লজ্জায় ফেলে দেয়। কেউ পাশে বসলে মুখ ফিরিয়ে রাখে। লজ্জা আর অসহায়ত্ব মিলে অদৃশ্য বেড়াজাল গড়ে উঠে চারপাশে। মাংসপেশি দিনকে দিন শুকিয়ে যায়। হাঁটুর নিচে পায়ের পাতা কাঠ হয়ে গেছে। ডান হাত বোঝা। নড়াতে পারে না। স্পর্শ অনুভব করে না। ঘাড় ঘোরালে তীব্র ব্যথা ওঠে। জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে গেছে। ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে। পাঁজরের নিচে চাপা দীর্ঘশ্বাসে লুকিয়ে রয় সকল কষ্ট।
প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। ক্যাথেটার ব্যবহার করতে হয়। বারবার ইনফেকশন হয়। প্রস্রাবের নালিতে জ্বালা। জ্বর আসে মাঝে মধ্যে। মাঝরাতে কাশি ওঠে। কফ বের হতে চায় না। বুক ভেঙে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ফুসফুস ভরে আছে জমানো দুঃখ ও কষ্ট দিয়ে। একদিন নাতনি এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার পা নড়ে না কেন দাদু? উত্তর দিতে পারে না। শিশুর সরল প্রশ্ন ভেদ করে দিয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত অনুভব আর অনুভূতি।
রাত গভীর হলে মনে হয় মৃত্যুই শান্তি। বেঁচে থাকা জীবন নয়। ভোর হলে আবার আশা জেগে ওঠে। জীবন সুখ চায়। হঠাৎ কেউ এসে বলবে ভালোবাসি এখনো। সময় প্রতিক্ষণ পরীক্ষা নেয়। রোজই ভিজে যায় বিছানা! মনে মনে ভাবে সবতো শেষ। শুধু সময়ের অপেক্ষা। যত দ্রুত চলে যাব ততই মঙ্গল। প্রিয়ন্তির সময় শেষ হয় না। মৃত্যু যেন তার থেকে বহুদূরে।
ভর দুপুর। দরজা খোলা। চোখ মেলে দেখে কুকুর ঢুকছে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে। সারা শরীরে শিহরণ জাগে। চিৎকার করে উঠে। মুখে আওয়াজ নেই। সারা শরীর ঘামে। চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। পাশের বাড়ির বৃদ্ধা এসে সান্ত্বনা দেয়। মাগো। কত ভালো মানুষ ছিলে তুমি। তোমাকে এইভাবে দেখে বুক ফেটে যায়। প্রিয়ন্তির চোখ ভিজে ওঠে। কেউ ভালোবাসার কথা বললে চোখে পানি ধরে রাখা যায় না।
সময়ের আবর্তে প্রিয়ন্তির সব সহনীয় হয়ে উঠে। আবার অসুস্থ হয়ে যায় সে। সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। বাম হাত বাম পা সামান্য নড়াচড়া করতে পারে। কোন আক্ষেপ নেই। পৃথিবীর আলো বাতাসের মুগ্ধতায় বেঁচে থাকে সে। কেউ তার নিকটে আসে না। মাথার নিকট খাবার রেখে যায়। বাম হাতে যতটুকু সম্ভব খেয়ে নেয়। দিন কাটে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। সময়ের প্রিয় মুখগুলোর কাছে সে অপরিচিত। তার ঘর দুর্গন্ধময়। বুকের ভেতর চাপ পড়ে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
স্মৃতিতে বেঁচে থাকে প্রিয়ন্তি। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। স্মৃতি আসে ঝাপসা হয়ে। গ্রামের মানুষের ভালোবসা। পিতার কাঁধে চড়া। ছোটবেলায় মাঠে দৌড়ানো। পিতার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া। বিয়ের দিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছাড়া। আহমেদ আলীর সাথে অজু করে ঘরে ফেরা। সন্তানদের প্রথম হাঁটা, কথা বলা, হাসা…।
ধীরে ধীরে ফিরে আসে কঠিন বাস্তবতা। ঘরের প্রতিটি কোণ নিঃসঙ্গতার বাতাসে ভরে যায়। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে। কে যেন বলে উঠে। মন খারাপ করো না। সৃষ্টিকর্তা সব দেখে। চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়। নীরবে, শব্দহীন।
পরিবারের সবাই ভালো। স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে ক্লান্তি জমে। কেউ আগের মতো গল্প করে না। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে না তুমি আমাদের শক্তি। বাহিরে হয়তো রোদ পড়ে, বৃষ্টিও নামে। জানালার দিকে তাকানোর শক্তি কোথায়? পৃথিবী চার দেয়ালে বন্দি। মৃত্যুই কেবল মুক্তি ? তবু অলৌকিক আশায় সে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। কেউ হয়তো আসবে। হৃদয়ভরা ভালোবাসা নিয়ে হাত ধরে বলবে কেমন আছ?
প্রতিদিন একাকীত্ব, অবহেলা, অযত্ন ও হৃদয়ভাঙা স্মৃতির ভেতর দিয়ে দিন কাটে। সবাই যাকে চোখে চোখে রাখত, ভালোবাসত সেই প্রিয়ন্তিকে সময় ভুলিয়ে দিয়েছে। তবু ক্ষোভ নেই, আক্ষেপ নেই, দুঃখ নেই, কস্ট নেই। সব অভিমান দূরে ঠেলে জীবনের গান গায় প্রিয়ন্তি। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সংসারের মঙ্গল কামনায় প্রতিমুহূর্তে সৃষ্টিকর্তায় আশ্রয় খোঁজে।
*************************