নিয়তি
কামরুল হাসান শায়ক
বৃষ্টি পড়ছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের রাস্তা তখন ভিজে চকচক করছে। মাইক্রোবাসের হেডলাইটের আলো বৃষ্টির কণায় ঝিকমিক করে উঠছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে অমিত দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে পুরনো একটি ব্যাগ, চোখে কাঁচঘষা চশমা। তার মুখে সেই চেনা ক্লান্তি—যে ক্লান্তি শুধু দেহের নয়, ভিতরেরও।
সরকারি অফিস থেকে ফিরছে সে। আজও দিনটা আগের মতোই কেটেছে—ডেস্কের ওপর ফাইলের স্তূপ, সই, কপি, নোটিং… তারপর বিকেলের গুমোট কর্মব্যস্ত বৃত্তের অফিস শেষে গেটের বাইরে এই ধূসর বৃষ্টি।
জীবনের প্রতি দিন যেন একই বাক্যে আটকে আছে—“অফিসে যাচ্ছি”, “ফিরছি”, “কাল দেখা হবে।”
কিন্তু দেখা কবে হবে নিজের সঙ্গেই—সে জানে না।
অমিতের বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। মা মারা গেছেন তিন বছর আগে। বাবা আছেন, কিন্তু অন্য সংসারে, অন্য শহরে। বোনের বিয়ে হয়েছে দূরে, রাজশাহীতে। অমিত একাই থাকে—মোহাম্মদপুরের একটা পুরনো বাসার ছাদতলায়, টিনের ঘরে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, সে যেন একটা বদ্ধ অফিসরুমে নয়, সময়ের গহিন ঘরে বন্দি হয়ে গেছে। কলেজে পড়ার সময় সে কবিতা লিখত, গল্প লিখত—‘দেশ বদলাবে, মানুষ বদলাবে’ এমন স্বপ্নে ভরপুর ছিল তার ভিতর। কিন্তু আজ সে কেবল এক নম্বরবিহীন ফাইলের মতো—যে ফাইল কেউ আর খোলে না, তবু ফাইলের বোর্ডে পড়ে থাকে পুরনো কিছু নথি বছরের পর বছর।
বৃষ্টি একটু থেমেছে।
সে ছাতা খুলে হাঁটতে শুরু করল। এমন সময় সামনের ফুটপাথে একটা মেয়েকে দেখল—রিকশা থেকে নেমে ছাতাটা উল্টে গেছে বাতাসে, মেয়েটা হিমশিম খাচ্ছে সেটা ঠিক করতে।
অমিত ছুটে গিয়ে ছাতাটা ধরল, ঠিক করে দিল।
মেয়েটি তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
—ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে হয়তো আজ পুরো ভিজেই যেতাম।
অমিত হেসে বলল,
—ঢাকার বৃষ্টি, নিজের মতোই আসে—জানানো ছাড়া।
মেয়েটিও হেসে ফেলল।
চোখে তার এক অদ্ভুত শান্ত আলো।
পরিচয় হলো—তানিয়া। পাশের অফিসে নতুন যোগ দিয়েছে, একটি এনজিওতে কাজ করে। অমিতের অফিসের ভবনেই তার অফিস, অন্য তলায়।
এরপর ক’দিন এমনভাবে কেটে গেল, যেন জীবন হঠাৎই একটু উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
দু’জনের দেখা হয় লাঞ্চব্রেকে, মাঝে মাঝে রাস্তায়। একসাথে চা খায়, গল্প করে।
তানিয়া জানায়, সে একা থাকে ধানমণ্ডিতে—একটি মহিলা হোস্টেলে। বাবা-মা গ্রামে। কলেজে পড়াকালীন মা মারা গেছেন, বাবা অসুস্থ। তানিয়া তবুও মৃদু হাসে, বলে
—জীবন থেমে থাকে না, তাই না?
অমিত তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে—যেখানে যেন ঝলমল করে এক মৃদু আলো, যার উৎস খুঁজে পায় না।
এক বিকেলে, অফিস ছুটির পর বৃষ্টির দিনে, দু’জন বসেছিল একসাথে ধানমণ্ডি লেকের ধারে।
তানিয়া হঠাৎ বলল,
—তুমি কি ভাগ্যে বিশ্বাস করো?
অমিত একটু ভেবে বলল,
—বিশ্বাস না করলেই বা কী লাভ? আমরা তো সবাই ভাগ্যের চাকায় বাঁধা। কারও চাকরি হয়, কারও হয় না; কারও মা বেঁচে থাকেন, কারও থাকেন না। সবই তো ভাগ্যের খেলা।
তানিয়া মৃদু হেসে বলল,
—তবু আমি বিশ্বাস করি কিছু কিছু সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেই, যা ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে।
অমিতের বুকের ভেতর যেন কারও নরম আঙুল ছুঁয়ে গেল।
তার মায়ের মৃত্যুর দিন মনে পড়ল—ফোন করেছিল মা, সে ধরেনি। বলেছিল, “ফাইল জমা দিই, তারপর কথা বলি।”
আর তারপরই খবর এসেছিল—মা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
তখন থেকে একটাই চিন্তা তার মনের মধ্যে গেঁথে আছে—ভাগ্য মানে হয়তো একবারের ভুল সিদ্ধান্ত, যার পরিণতি আজীবন বহন করতে হয়।
তানিয়া হয়তো বোঝে না, কিন্তু তার এক একটা কথা যেন অমিতের ভিতরের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দেয়।
এভাবেই কয়েক মাস কেটে গেল।
অমিত আর তানিয়া—দু’জনের জীবন এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেল।
তারপর এক সকালে তানিয়া অফিসে এলো না।
না ফোন, না বার্তা।
একদিন, দুইদিন, তারপর সপ্তাহ পার হয়ে গেল।
অমিতের ভেতর অস্থিরতা বেড়ে গেল।
তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার ভেতরের আলো নিভিয়ে দিয়েছে।
দুই সপ্তাহ পর একদিন অমিত জানতে জানতে পারলো —তানিয়া গ্রামে চলে গেছে। বাবা অসুস্থ, তাই সব ফেলে চলে গেছে হঠাৎ।
অমিত অফিসের ফাইল বন্ধ করে এক সন্ধ্যায় ট্রেনে চেপে বসল।
ট্রেন চলল উত্তরের দিকে।
জানালার বাইরে বৃষ্টির রেখা, গাছের সারি, নদীর আলোর প্রতিফলন।
অমিতের মনে হচ্ছিল, সে যাচ্ছে নিজেরই অতীতে, যেখানে কারও জন্য কিছু করার আগেই সময় শেষ হয়ে যায়।
গ্রামে পৌঁছে জানতে পারল—তানিয়ার বাবা মারা গেছেন একদিন আগে।
তানিয়া হাসপাতাল থেকে ফিরেছে মাত্র।
অমিত তাকে দেখতে পেল উঠোনে, কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরে বসে আছে, মাথা নিচু।
তাকে দেখে তানিয়া কিছু বলল না, শুধু তাকাল, আর সেই তাকানোতেই যেন হাজারটা প্রশ্ন মিশে আছে।
অমিত ধীরে পায়ে কাছে গিয়ে বসলো। বললো,
—তুমি বলেছিলে, কিছু সিদ্ধান্ত নিয়তিকে বদলে দিতে পারে।
তানিয়া একচুল হাসল—
—হ্যাঁ, কিন্তু কখনও কখনও নিয়তিই আমাদের এমন পথে নিয়ে যায়, যেখানে সিদ্ধান্ত বলার মতো কিছুই থাকে না।
দু’জন নদীর ধারে হাঁটতে গেল সন্ধ্যায়।
পাখি ফিরছে, গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে।
তানিয়া বলল,
—আমার মনে হয়, জীবন অনেক সময় নদীর মতো—যে স্রোত আমরা ভাবি আমাদের দিকেই যাচ্ছে, আসলে তা দূরের কোনো অচেনা সমুদ্রে মিশে যায়।
অমিত চুপ করে শুধু তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। মনে হচ্ছিল, কিছু বললে সব ভেঙে যাবে।
রাত নেমে এলো। দূরে মসজিদের আজান ভেসে আসছে, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ।
তারা দু’জন বসে রইল নদীর ধারে, কোনো শব্দ ছাড়াই।
অমিত মনে মনে বলল,
“হয়তো এই মুহূর্তটাই আমার নিয়তি—একজন মানুষকে বুঝতে শেখা, ভালোবাসা নয়।”
ভোরের আলোয় ট্রেন ছাড়ল।
তানিয়া গ্রামের পথের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে প্রশান্তি।
অমিত জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ না সেই সাদা শাড়ি দূরের কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।
ঢাকায় ফিরে সে আবার তার ফাইলে ডুবে গেল, অফিসে গেল, বৃষ্টিতে ভিজল, চা খেল। কিন্তু এবার মনে হলো, সবকিছু একটু বদলে গেছে।
বৃষ্টির শব্দ এখন আর কানে লাগে না, মনে লাগে।
আর প্রতিটি ফাইলের নিচে যেন লুকিয়ে আছে একটা প্রশ্ন—
আমরা কি সত্যিই নিজের ভাগ্য লিখি, নাকি ভাগ্যই আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেয় জীবন গল্পের শেষ লাইন?
*************************