You are currently viewing ধর্ম || শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

ধর্ম || শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

ধর্ম
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

র্ম হলো সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। ধর্ম মানুষকে অতিপ্রাকৃত, আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক সত্তার সাথে সম্পর্কিত করে। ধর্ম এমন একটি জীবনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেখানে পবিত্র, শ্রদ্ধার যোগ্য বিষয় থাকে। ধর্ম মানুষের জীবন ও মৃত্যুর চূড়ান্ত উদ্বেগের সমাধান করে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সংজ্ঞা ভিন্ন হতে পারে। নৃবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাস’ হিসেবে দেখেন। ধর্মের সঙ্গাকে অনেকেই এভাবে বলেন, ১. ধর্ম হলো এমন একটি ব্যবস্থা যা অতিপ্রাকৃত, অতীন্দ্রিয় ও আধ্যাত্মিক উপাদানের সাথে মানুষকে যুক্ত করে। ২.ধর্মকে একটি পবিত্র বা পরম মতবাদ বা জীবনাদর্শ হিসেবে দেখা হয়। ৩. ধর্মে এমন কিছু বিষয় থাকে যা পবিত্র, আধ্যাত্মিক বা বিশেষ শ্রদ্ধার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ৪. ধর্ম প্রায়শই আধ্যাত্মিক সত্তা বা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
ড. আহমাদ মাহমুদ আল-বারবারী, আদ-দীন বাইনাল ফারদ ওয়াল মুজতামা (কায়রো : মাকতাবা মিসর, তা.বি., পৃষ্ঠা-৪৩ বলা আছে যে, ধর্ম এমন এক অদৃশ্য বোধ শক্তির নাম, যে শক্তি মানবীয় অন্তরে জাগ্রত হয়ে মানবাত্মাকে এক মহান স্রষ্টার সন্ধানে তাড়িত করে। সঙ্গে সঙ্গে এ শক্তি মানব অন্তরে এমন এক বিশ্বাসের জন্ম দেয়, যা ব্যক্তিকে স্রষ্টার সঙ্গে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। এরই ধারাবাহিকতায় যে শক্তি ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতি, নৈতিক উন্নতি সাধন এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সংহতি স্থাপন করে ব্যক্তির জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তা-ই ধর্ম।
প্রমোদ বন্ধু সেন গুপ্ত, ধর্ম দর্শন (কলিকাতা : ব্যানার্জী পাবলিশার্স, ১৯৮৯ খ্রি.) পৃষ্ঠা-৮০ থেকে জানা যায় যে , সংস্কৃত ভাষায় ‘ধৃ’র সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয়যোগে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।এর ধাতুগত অর্থ হলো, যা ধারণ করে তাই ধর্ম। অন্তর ও বাইরে মিলে মানুষের জীবনের পূর্ণ সামঞ্জস্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে। ধর্ম মানুষের সামাজিক জীবনের বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
বাংলা অভিধানে ধর্ম শব্দটি সৎ কর্ম, নিয়মতান্ত্রিক আচার, রীতি-নীতি, ঈশ্বর, পরকাল এবং অলৌকিক বিশ্বাস ও উপাসনা প্রণালীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়।
মানুষের লিখিত ইতিহাসের বয়স ৫০০০ বছর হলেও ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকগণ মানব ইতিহাস রচনা ও গবেষণার সময় তার আগের মানুষদের মাঝেও এমন কিছু আচারানুষ্ঠানের দেখা পেয়েছেন যে গুলোর মাধ্যমে পবিত্র বলে পালন করত সে যুগের মানুষ। অনেক সমাজতাত্ত্বিক ধর্মের অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। তন্মধ্যে, ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইমের সংজ্ঞাটি বিশেষ ভুমিকা রেখেছে, তা হলো,
ÒA religion is a unified system of beliefs and practices relative to sacred things… beliefs and practices which unite into a single moral community.all those who adhere to them.Ó
ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।
ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম ক্রিয়াবাদী তত্ত্বের আলোকে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, সামাজিক ঐক্য ও সংহতি টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা ও পাপবোধের ব্যাপারে সচেতনতা ও ভীতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ধর্মের উৎপত্তি। বিশ্বের প্রসিদ্ধ ধর্মগুলোর উৎপত্তির পটভূমি ও ইতিহাসের পাশাপাশি মানব ইতিহাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণের আলোকে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন যে বিশৃঙ্খল সমাজকে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ রকমের অবস্থা থেকে উদ্ধার করে একটি শৃঙ্খলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজে ধাবিত করার একটিই মাত্র উপায় ছিলু মহাজাগতিক, পবিত্র ও অতিপ্রাকৃত শক্তির অবতারণা করা, যেটিতে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকে একটি দলভুক্ত হবে এবং কিছু নির্দেশমালা মেনে চলবে কঠোর ভাবে। বিশ্বাসীদের দ্বারা আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে ধর্ম আরো মূর্ত রূপ ধারণ করে। ডুর্খেইমের মতে ধর্ম মূলত চারটি ক্রিয়া বা Function সম্পাদন করে। তা হলো,১. শৃঙ্খলা বিধান করে।২. পারস্পরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করে ৩.সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন করে ৪.প্রফুল্লতা দান করে। ডুর্খেইমের ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত এ মতবাদটি ঋজু এবং সাবলীল। এ মতবাদে আধ্যাত্মিক চেতনাকেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
ধর্ম একটি মৌল ও সর্বজনীন মানবীয় প্রতিষ্ঠান। ধর্মের অস্তিত্ব নেই বা ছিল না, এমন কোন মানব সমাজের কথা জানা যায় না। ধর্ম মানুষের সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সাধারণভাবে বলা যায়, ধর্মের সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের এমন এক শাখা যা ধর্ম এবং ধর্মীয় বিষয়াদির উপর নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে তা বোঝার চেষ্টা করে। এই বিদ্যা কোন নির্দিষ্ট মূল্যবোধের অধীনে থেকে ধর্মের বিচার করে না। যেমন— ‘এই ধর্ম সঠিক আর ওই ধর্ম বেঠিক’। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা অগুস্ত কোঁতে এর মতে, ধর্ম হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ,এখানে কোন ধর্মকে খাটো করে দেখা হয় নাই।
ধর্মীয় ধারনাগুলোর প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েক হাজার বছর আগে মধ্য ও নিম্ন প্যালিলিথিক যুগে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ প্রায় ৩০০,০০০ বছর আগে ধর্মীয় ধারনার প্রমাণ হিসাবে হোমো স্যাপিয়েনদের কবরস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। ধর্মীয় ধারনার অন্যান্য প্রমাণ আফ্রিকায় পাওয়া যায়, যার মধ্যে মধ্য পাথর যুগে হস্তনির্মিত বিভিন্ন প্রতীকী । বিজ্ঞানীরা সাধারণত ধর্মীয় ধারনার প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে উর্ধ-প্যালোলিথিক (৫০,০০০-১৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যুগ থেকে পাওয়া বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় ব্যাখ্যা করে থাকেন। সেই যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর সাথে সম্পর্কিত উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে সিংহের মত দেখতে মানুষ, শুক্রের মূর্তি, চাউট গুহার সমাধি, গুহা চিত্র ইত্যাদি।
ঐতিহাসিকরা ৯০০ থেকে ২০০ বিসিইকে অক্ষীয় যুগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন জার্মান-সুইচ দার্শনিক কার্ল জ্যাসপার্স (১৮৮৩-১৯৬৯)। জ্যাসপার্সের মতে, ইতিহাসের এই যুগে “মানবতার আধ্যাত্মিক ভিত্তি স্বাধীনভাবে এবং একসঙ্গে গড়ে উঠে। এই ভিত্তি মানবতার মাঝে এখনও বিদ্যমান রয়েছে।” ইতিহাসবিদ পিটার ওয়াটসন এই যুগকে মানবতার দর্শন বিদ্যার গঠনের সময় হিসেবে উল্লেখ করেন, এগুলোর মধ্যে ছিল পার্সিয়া এবং কানানে একশ্বেরবাদ, গ্রীসে প্লেটোবাদ, ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম, চীনে তাওবাদ ও কনফুসিওবাদ। এই বিষয়গুলো কিছু সময়েই শিক্ষার বিষয় হয়ে যায়- যেমন বৌদ্ধ ধর্ম ছড়াতে আশোকার ভূমিকা, বা খ্রিস্টান ধর্ম গঠনে প্লেটোবাদের ভূমিকা। ভারতে বিসিই ৯ম শতাব্দীতে জৈন ধর্মের উৎপত্তি হয় সাথে পার্শবানাথ এবং এটির অহিংস দর্শন গড়ে উঠে। বিশ্ব সর্বত্র ধর্ম প্রচার গুলো হয়েছে মধ্যযুগ থেকে , ১. পাশ্চাত্য বিশ্বের খ্রিস্টিয়করণ ২. বৌদ্ধদের পূর্ব এশিয়ায় প্রেরণ ৩.ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্মের পতন ৪. মধ্য প্রাচ্য, কেন্দ্রীয় এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারত ও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে ইসলামের প্রচার।
ইসলাম ধর্মের প্রচারকাল শুরু হয়েছিল ৭ম শতকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে এবং এরপর থেকে এটি আরব উপদ্বীপ থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
১৩শ শতাব্দীর শুরুতে, দিল্লী সালতানাত দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর অংশে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাজ্য হিসাবে আবির্ভূত হয়। দিল্লী সালতানাত মুহাম্মাদ ঘুরির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দিল্লী সালতানাত পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম রাজ্য হয়ে ওঠে। ১১শ এবং ১২শ শতাব্দীতে, তুর্কি রাজবংশগুলো আনাতোলিয়ায় (বর্তমান তুরস্ক) সার্বজনীন রোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে জমি জয় করে নেয়। । ১৩শ এবং ১৪শ শতাব্দীতে, মঙ্গোল এবং তৈমুর লং-এর আক্রমণ এবং ব্ল্যাক ডেথের মহামারি মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশকে দুর্বল করে দেয়। মঙ্গোলরা ১৩শ শতাব্দীতে পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অংশ জয় করে নেয়। এই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় মালি সাম্রাজ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা সালতানাতের মত শক্তিশালী মুসলিম শক্তিরও উথ্থান ঘটে। মালি সাম্রাজ্য ছিল একটি শক্তিশালী আফ্রিকান সাম্রাজ্য যা ১৩শ থেকে ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ১৬শ শতাব্দীতে, উসমানীরা তুরস্ক, মুঘল ভারত এবং সাফাভীয় সাম্রাজ্য, ইসলামী যুগের রাষ্ট্রগুলো বিশ্ব শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই রাজ্যগুলো শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং বিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
মধ্যযুগের অনেক ধর্মীয় কার্যক্রম রহস্যবাদকে আরও জোরদার করেছে। যেমন ক্যাথারবাদ এবং পশ্চিমে এই ধরনের আন্দোলন, স্পেনে ইহুদি, ভারতে ভক্তি আন্দোলন এবং ইসলামে সুফিবাদ। খ্রিস্টানদের খ্রিস্টানবাদ এবং ইসলামের তওহীদ এ একেশ্বরবাদকে উল্লেখ করার মত। হিন্দু ব্রাহ্মণদের মাঝে একেশ্বর বিশ্বাস শুরু হয় আদি শঙ্কর এর শিক্ষার মাধ্যমেযা ছিল ৭৮৮-৮২০ সালে। ১৫ থেকে ১৯শতকে ইউরোপিয় উপনিবেশ স্থাপনের কারণে সাহরাণ আফ্রিকাসহ আমেরিকাতে, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপাইনে খ্রিস্টান ধর্ম ছড়িয়ে যায়। ১৫শতকে প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কার হয়। তখন মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) এবং জন ক্যালভিন (১৫০৯-১৫৬৪) এর নেতৃত্বে হওয়া খ্রিস্টধর্ম-সংস্কার আন্দোলন ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৮শতকে ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতা দেখা যায়, যা ১৭৮৯সালের ফরাসি বিপ্লব এর পরে শুরু হয়। ২০শতকের পরে ইউরোপের বেশি দেশে ধর্মরাষ্ট্রের পতন ঘটে।
২০০১সাল হতে লোকজন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আবিষ্কার ও প্রমাণের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে। ২০০০সালের জানুয়ারিতে, বিলিফনেট ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠিত হয়, আর পরের বছর, প্রতি মাসে এটির প্রায় ১.৭মিলিয়ন পরিদর্শক ছিল। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ধর্ম গুলো পারস্পারিক প্রতিযোগিতাও করে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ধর্মপালনকারীদের মাঝে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
*********************************

Leave a Reply