পুচ্ছ-ধারী ময়ূরেরা -৬ || শিল্পী নাজনীন
৬.
অফিসে জোর গুঞ্জন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ক্রমশ শক্তিশালী জনমত গড়ে উঠছে দেশে। সাধারণ জনগণ যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু সরকার জনমতের তোয়াক্কা করছে না একদম। মাত্র বছর কয়েক আগে, দুহাজার আঠারো সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে সব কোটা তুলে দিয়ে আবার সেটা ফিরিয়ে এনে রাজনীতির পালে গরম হাওয়া বইয়ে দেওয়ার মাজেজাটাও ঠিক বুঝতে পারছে না সাধারণ জনগন। তারা কোটাব্যবস্থার একটা যৌক্তিক সমাধানের পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলে দেওয়া হোক, এমনটা সাধারণ জনগণ মোটেই চায় না, বরং তারা চায় কোটার যৌক্তিক হার পুনঃনির্ধারণ। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে তাদের শতকরা হার অনুযায়ী কোটা রাখার পক্ষে তারা। আন্দোলনকারীরাও এমনটাই চাইছে বলছে, কিন্তু সরকার গোঁয়ারগোবিন্দ হয়ে কোটাব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে সাফাই গাইছে দিনরাত। নিজেদেরকে প্রমাণ করতে চাইছে বিকল্পহীন, নির্ভুল, আর অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি হিশেবে। জনগনকে ভাবছে বিরুদ্ধ শক্তি। সংকট ঘনিভূত হচ্ছে ক্রমশ, বাড়ছে জনরোষ, জনগণ সেটা বুঝছে জলের মত, কিন্তু সরকার যেন ঠুলি পরে বসে আছে চোখে। আশ্চর্য! সরকারের মধ্যে কেউ কি নাই, যে চোখে আঙুল দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দেবে? কেউ কি নাই যে দেশের এই সংকটে জনগণের পক্ষে একটি কথাও বলবে কেবিনেটে বসে?
অফিসে বসে এমন সব ভাবনা এলোমেলো করে দিচ্ছিল মিতুর দৈনন্দিন রুটিন। পাশের ডেস্কে তুমুল আলোচনা চলছে এই আন্দোলন নিয়ে। মূলত, দুহাজার আঠারো সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার কোটাসংক্রান্ত যে পরিপত্র জারি করেছিল সেটা এই চব্বিশে এসে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে জড়ো হয়ে শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে এই রায় প্রত্যাখান করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে ১ জুলাই বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে এবং চার দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এবং এই ঘোষণার মাধ্যমেই এবারের মত কোটাবিরোধী আন্দোলন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে পুরো ছাত্রসমাজ। এর মাধ্যমে আবার শুরু হয়েছে এই কোটা সংস্কার আন্দোলন। সমস্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়ে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে আঠারো সালের সরকারি প্রজ্ঞাপনটি পুনঃবহালের দাবি করেছে। কিন্তু ক্রমশ পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে জটিল হয়ে উঠছে দেশের হালচাল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশ। সৌরভ এসএসসি পাস করেছে সবে, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ঝামেলা। সুদীপ্তর এইচএসসি চলছে। মেয়ে অদিতি ক্লাস এইটে। সৌরভের ক্লাস শুরু হতে দেরি হচ্ছে আন্দোলনের জেরে। সে সুযোগ পেলেই আন্দোলনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, সুদীপ্তকে সময়মত হলে পৌঁছতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ছাত্ররা সকাল এগারোটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক তথা ঢাকার প্রধান প্রধান প্রবেশমুখগুলো অবরোধ করে রাখছে। জনজীবনে যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ জনগনের সম্মতি থাকলেও ছাত্রদের এই কর্মসূচিতে জনদূর্ভোগ বাড়ছে। মিতুর মত অনেকেই বিরক্ত হয়ে উঠছে তাতে। তারা কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সমাধানের পক্ষে, কিন্তু জনদুর্ভোগ বাড়ানোতে মনে মনে বিরক্ত। তিনঘণ্টার পরীক্ষা সুদীপ্তর। বাসা থেকে তাকে বের হতে হয় সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে। পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢুকতে হয় সাড়ে নয়টার মধ্যে। ভিড়, জ্যাম সব পেরিয়ে কেন্দ্রে পৌঁছতে জান বেরিয়ে যায় ছেলের। এরমধ্যেই শুরু হয়ে যায় অবরোধ। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরতে পোহাতে হয় নানান ঝক্কি। টানা তিনঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে হয় পায়ে হেঁটে নইলে গুচ্ছের টাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে বাসায় ফিরতে হয় তাকে। রোদে, ঘামে, উৎকণ্ঠায় অতটা পথ পেরিয়ে যখন বাসায় ফেরে, তার দিকে তখন তাকানো যায় না আর। পরীক্ষাকেন্দ্র মহাসড়কের পাশে, ফলে অবরোধে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ তখন, রাস্তায় পিঁপড়ের সারির মত মানুষের ভিড়, গাড়ির স্থবির সারি। সবমিলিযে অভিভাবকেরা অতিষ্ঠ। সরকার কেন ছাত্রদের এই অতিসহজ দাবিটা মেনে নিয়ে জনজীবন সহজ করছে না এমন প্রশ্ন সবার মনে, তারা ত্যক্ত, বিরক্ত। অদিতির স্কুল থেকে ফিরতেও পড়তে হচ্ছে একই বিড়ম্বনায়। ওদিকে বছরের প্রথম থেকেই নানান বিড়ম্বনায় ঠিকমত ক্লাসই হয়নি বছরের প্রথম দিকটাতে, মাঝামাঝি এসে শুরু হয়েছে এই হুল্লোড়। স্কুলে না পাঠালেও চলছে না, আবার পাঠিয়েও শান্তি নেই, বাসায় ফিরতে পড়তে হচ্ছে বিবিধরকম ঝক্কি-ঝামেলায়।
চুপচাপ সহকর্মীদের আলোচনা শুনছিল মিতু। মনের মধ্যে তুমুল অশান্তি তার। সুদীপ্তর আজ পরীক্ষা আছে। একাই পরীক্ষাকেন্দ্রে গেছে ছেলে। সুজন অফিসে। তার সময় নেই বাচ্চাদেরকে দেয়ার মত। মিতুর নিজেরও অফিসে প্রচুর চাপ এখন। ছুটি নেয়ার সুযোগ নেই আপাতত। সন্তর্পণে ঘড়ি দেখল সে। পৌনে দুটো। অদিতির ছুটি হবে এখন। বাইরে তপ্ত জুলাই। প্রচণ্ড গরমে প্রকৃতি পুড়ছে। আন্দোলনের আগুনে পুড়ছে রাজনীতির অঙ্গন। পাশের ডেস্কের মাহরীন আপাকে বলে আস্তে বের হয়ে এল মিতু। সড়ক বন্ধ। অদিতিকে স্কুল থেকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। তার অফিস বাউন্ডারির মধ্যেই বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ সবকিছু। শুধু কিছুটা সাশ্রয় আর সাচ্ছদ্যের লোভে বছরখানেক হল অফিস কোয়ার্টার ছেড়ে বাইরে ভাড়া বাসায় উঠেছে মিতু, এখন মনে মনে নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকে সে, আফসোসে মন পোড়ে ভীষণ। কোন কুক্ষণে যে বাইরে বাসা নিতে গেছিল সে! ভেতরে থাকলে এখন নিশ্চিন্তে থাকতে পারত সে, অন্তত বাচ্চাদের চিন্তায় মাথা খারাপ করতে হত না তাকে। সুজনের অফিস ঢাকায়। আন্দোলনের কারণে তারও অফিসে যাওয়া-আসা কষ্টকর হয়ে উঠেছে খুব। স্কুলগেটের সামনে এসে অদিতির জন্য অপেক্ষা করে মিতু। গেট দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে আসছে। এতজনের ভিড়ে অদিতিকে আলাদা করা মুশকিল। বিশেষত স্কুলড্রেসে সবাইকেই একইরকম লাগে, কাছ থেকে না দেখলে পরিচিতজনকেও খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ভিড় এড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে দাঁড়াল মিতু, যাতে অদিতিই খুঁজে নিতে পারে তাকে। একটু পরেই অদিতি এসে দাঁড়াল পাশে। লম্বায় মাকে এখনই ছাড়িয়ে গেছে মেয়ে। দুপাশে ছড়িয়ে দেয়া বেণীর মাঝখানে কোমল ফুটে আছে তার পদ্মমুখ। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখে ছড়িয়ে আছে দারুণ ঔজ্জ্বল্য। মেয়ের বুদ্ধিদীপ্ত, সপ্রতিভ চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল মিতু। স্নেহ উছলে পড়ল মনে।
সব ক্লাস হয়েছে, মা?
হুম। শুধু অংক ক্লাস মিস গেছে।
কেন? তাহলে যে বললি সব ক্লাস হয়েছে!
অংক বাদে সব হয়েছে। অংক স্যার আজ অসুস্থ। ছুটি নিয়ে চলে গেছে আগেই।
আচ্ছা। চল যাই, দেখি আজ আবার কী অবস্থা রাস্তার।
হাঁটতে হাঁটতে অফিসের গেট পেরিয়ে মহাসড়কে এসে দাঁড়ায় মা-মেয়ে। একপলক তাকিয়ে হতাশ, অসহিষ্ণু চোখে মেয়ের দিকে তাকায় মিতু। অদিতি হাসে। বলে, হেঁটেই যেতে হবে মনে হয় মা! রাস্তার যা অবস্থা!
রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে। আর দুপাশে চলন্ত মানুষের সারি। পা ফেলার জায়গা নেই। সবাই হাঁটছে। অবরোধে সব গাড়ি আটকে পড়েছে রাস্তায়। কিন্তু জীবন কি থেকে থাকে কোনো অবরোধেই? বাধ্য হয়ে মানুষ হাঁটছে অগত্যা। চারলেনেই আটকে আছে সারি সারি গাড়ি। ফুটপাত আর গাড়ির গা ঘেঁষা পিচঢালা খালি রাস্তায় চলমান মানুষের ঢল। রিক্সা চলার মত উপায় নাই। তাহলে দূরের পথ কীভাবে পাড়ি দেবে মানুষ? হাঁটতে হবে। মেয়েকে নিয়ে অতঃপর হাটতে শুরু করল মিতু। প্রায় দেড় কিলো পথ হাঁটতে হবে তাদের। তার নিজের কাছে পথটা খুব সামান্যই। অদিতির হাঁটার অভ্যাস নেই একদম, পথটুকু হাঁটতে খুব কষ্ট হবে তার, ভেবে আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকায় মিতু। অদিতির চোখ-মুখে বিরক্তির লেশমাত্রও নেই। সে উৎফুল্ল বরং। দারুণ ঔৎসুক্যে সে চলমান মানুষগুলোকে দেখছে, হাঁটছে আপনমনে। স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল মিতু। দ্রুত করল গতি। মেয়েকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার তাকে ফিরতে হবে অফিসে। অনেক কাজ জমে আছে ডেস্কে।
*****************************