অদাহ
শাশ্বত বোস
ছোপ ছোপ নীল রঙের অস্বচ্ছ অন্ধকারটার বুক চিরে লোকগুলো এগিয়ে আসছে, উত্তাপ অনুত্তাপের যাবতীয় ওঠাপড়াকে মুঠো করে সরিয়ে সরিয়ে, খুব ধীর, সতর্ক পা ফেলে। সেই অনিয়ন্ত্রিত যাতায়াতের পথে অগোছালো পা ফেলার সাথে সাথে নদীর পৃথু কর্দম মাটিতে ঝুপ ঝুপ শব্দ হচ্ছে। চিতাটা তখনও জ্বলছে। অমীমাংসিত ভাবনার মত লকলকে আগুণ, আধপোড়া শরীরটাকে ক্ষুধার্ত বনবিড়ালের নির্বিবাদী দিলখুশ আশ্লেষে, চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে যেন! বডি কিছুটা পুড়লে আগুণ নিজে থেকেই নিভে আসে। সেসময় দূর থেকে সরু বাঁশের লগাটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিতে হয়। খোঁচা লেগে বডির গা থেকে পোড়া লাগা মাংস, চর্বি শুদ্ধু উঠে আসে। চারপাশের ভারী হয়ে আসা বাতাসে, চামড়া-মাংস পোড়া কটূ গন্ধটা অফুরন্ত এক মায়ামন্ত্রের উল্লাস তোলে, দেহের অন্তিম শুদ্ধ যাত্রাপথে রীতিমত দৃশ্যের তান্ডব চালায়! ধোঁয়ার সাথে ধোঁয়া পাক খেতে খেতে জড়িয়ে যায়। মনের ভেতর জমে থাকা কিছু স্মৃতিকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরে যেন জন্মজন্মান্তরেও তাদের উৎখাত করা সম্ভব নয়! বিবশ, আঠালো, ছাই রঙা মেঘেরা নদীর বুকের ওপর আর্দ্রতা জড়ো করে। গন্ধটা যেন আরো বিটকেল হয়ে ওঠে! এই সময় অতসী রঙের প্রকৃতি আর ধূসর বর্ণের এই মহাশ্মশানের মাঝে, তেঁতে পুড়ে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া নিজের নিষ্প্রাণ যৌবনকে, শূন্য মস্তিষ্কের আবগারি ঘরে সঁপে দিয়ে একা ঘুমহীন রাত জাগে শোভনা। বেঁচে থাকার রং তখন যেন অনেকটা পচা শ্যাওলার মতো ঠেকে ওর কাছে। নিজের ভেতরটাকেই নির্জন ছমছমে মনে হয়!
এতক্ষণে লোকগুলো যেন ঘর্মাক্ত শরীরে, অলোকিক নীলচে এই রাতের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ওর আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। আকাশে আধভাঙা চাঁদ আড়মোড়া ভাঙে। লোকগুলো কে? কেন, কি মতলবে এই শ্মশানে এসেছে? এসবই বোধহয় জানে শোভনা। আজ অনেকদিন পর মর্গের কাটাকুটি এড়িয়ে একটা বেওয়ারিশ লাশ সরাসরি ওর কাছে এসে পৌঁছেছে। উনিশ কুড়ি বছরের একটা মেয়ের লাশ! তাজা বডি! মনে হয় ডাকলে এখুনি উঠে বসবে! আধভেজা প্লাস্টিকটাতে মুড়ে বডিটা শোভনার জিম্মায় ফেলে রেখে গেছে ওর বাড়ির লোকজন। শেষ সন্ধ্যায় মেয়েটা বিষ খেয়েছে, ক্ষেতের কীটনাশক! একটা মুসলমানের ছেলের সাথে প্রেম করে পোয়াতি হয়েছিল। বাড়ির লোক তাই এসব ঝামেলা আর ঘাড়ে নেয়নি। মেয়েটার বিবর্ণ মায়াভরা মুখটার উপর একটা মাছি এসে বসে। একরকম জীবিত মানুষের প্রতি কর্তব্যের মতো সেটাকে হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয় শোভনা। প্রবীণ এই পৃথিবীর বুকে শুয়ে থাকা মাছরাঙা রঙের এই রমণীর শবদেহটিকে ঘিরে যেন এই মুহূর্তটায় থেমে গেছে সব কিছু। থেমে গেছে, খুব ঝুঁকিপূর্ণভাবে, অনিশ্চিত কোন বেনিয়মে! মেয়েটার মুখের ওপর ফোঁটা ফোঁটা জলের বিন্দু, নিস্তব্ধ! অথচ প্রাণের রং নেই ওতে। সেদিকে চেয়ে একমুঠো কামিনীর গন্ধ আর চাঁপাফুলের মৌসুমী আঘ্রাণে ওর মনে পড়ে যায় এই তেঁতুলিয়া মহাশ্মশানে ওর শুরুর দিনগুলোর কথা। একটা গৃহস্থ ঘরের যুবতী গৃহবধূ থেকে আজ এই শ্মশানের বেওয়ারিশ শবের অন্তিম প্রহরী হয়ে ওঠা অবধি ঘামে ভেজা, নুনে পোড়া, মায়াবী শব্দের সেই গল্পটা জানে ওই জল থৈ থৈ ইছামতী। মনে হয় একমাত্র ওর বুকে ডুব দিলেই বোধয় নিভে যাবে ওর নিজের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা সোনালী আগুনটা। কোন এক আততায়ী রাতের শেষে পুব দিকে উঁকি দিতে থাকা সূর্য্যটা ভোঁতা করে দেবে খোলাবুক কামনার গোপন বল্লমের ধার! এরাই হয়তো এতদিন ধরে কেটেকুটে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওকে নিয়ে এসেছে জীবন উপন্যাসের এই শেষের পাতাটিতে। ঘুম হয়ে থাকা কিছু স্মৃতি যেন হঠাৎ ওর অগোচরেই চাগাড় দিয়ে ওঠে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে, এই অল্প ঠান্ডা রাতে। একটা বাড়াবাড়ি রকমের বৃষ্টি আসবে বলে মনে হয়।
ভাঁটফুলের বনে বোলতায় চাক বেঁধেছে। সন্ধ্যামালতীর হালকা মিষ্টি গন্ধটা যেন এই বাকরুদ্ধ পৃথিবীটার প্রতিটা রহস্য, প্রতিটা আলাদা বেদনাকে আলাদা আলাদা খামে চেপে ভরে চালান করে দিতে চাইছে, নিস্তব্ধ নিঃস্বতার গতিপথ বরাবর। ইছামতীর কালো জলে তখন লোভের সিস্টেম, পেন্সিল স্কেচে এঁকে চলেছে একটা ভাঙা নৌকা আর একটা ভিজে মাটি রগড়ানো সমকোণী সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। যার দুই বাহু এসে ক্রমে মিশে গেছে রুক্ষ্ম, প্রখর এই শোভনাতেই। এই সরীসৃপ ত্রিভুজের দুই বাহু ধরেই ক্রমে উঠে আসে, কাকের মত কুচকুচে অন্ধকার মাখা দুটো ঘর্মাক্ত শরীর। যাদের মধ্যে একজন, সাপের মত হিসহিসে চোখ নিয়ে এসে দাঁড়ায় শোভনার সামনে। হাতের কুড়ুলটা ভিজে মাটিতে পুঁতে দিয়ে বিড়ি ধরায় একটা। শোভনার মুখে জ্বলন্ত কাঠিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “বডি লিতে এসেছি। সর মাগী!” এ দেলদার, মাহিন শেখের লোক। এই পুড়ে যাওয়া মুখ, খোবলানো চোখ, শুকনো চামসে পড়া দাঁতে শ্বাপদের ক্রূর উল্লাস এসবই শোভনার বহুদিনের চেনা! শুধুমাত্র বিরোধী দলের রাজনীতি করার অপরাধে এরকমই এক অনিবার্য্য অপরাধপ্রবণ রাতে ওর স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছিল দেলদার। পরদিন সকালে পাশের রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছিল বডিটা। গলায় ধারাল অস্ত্রের কোপ! চোখদুটো খোবলানো! এটা যেন মানুষ মারার একটা অলিখিত ট্রেডমার্ক এই দেলদারের। বডির চোখদুটো উপড়ে নিজের হাঁ হয়ে থাকা অক্ষিকোটরে রেখে দুনিয়াটা একবার দেখে দেলদার এবং এতকিছুর পরও বডির কপালের ঠিক মাঝখানে একটা নিখুঁত বুলেটের ক্ষত এঁকে দেয়! পারফেক্ট পয়েন্ট ব্ল্যান্ক রেঞ্জ গান শট! একটা বড় গুবরে পোকা মলত্যাগের জন্য গর্ত খুঁড়েছে যেন! ময়নাতদন্তের পর পুলিশ যখন এই শ্মশানে বডি নিয়ে এল তখনও শোভনা মাথায় আঁচল জড়ানো মলিন গৃহবধূ। মাহিনের ভয়ে শ্মশানের ডোম বডিটা পোড়াতে চায়নি। পুলিশও এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। কাঠ জড়ো করে, চিতা সাজিয়ে নিজেই নিজের স্বামীর দেহের সৎকার করেছিল শোভনা! ঘরে তখন ওর তিন মাসের মেয়ে, মাটিতে শুয়ে কাঁদছে, এক ফোঁটা দুধের জন্য!
সেই শুরু! তারপর থেকে অন্তরাত্মার টানেই হোক কিংবা নাম পরিচয়হীন এই সব লাশেদের প্রতি ওর ভিতরে জন্মানো এক আশ্চর্য্য ধরণের, বাদামী রঙের সমবেদনা থেকেই হোক, শোভনা এখন এই শ্মশানে বেওয়ারিশ লাশ পোড়ানোর ‘ডোম’। গলা থেকে লম্বালম্বি চেরা শরীরগুলোকে যখন কেউ শেষ আগুনটাও দেবার থাকে না তখন এই শোভনাই নিজের ভেবে, সব আচারবিধি মেনে, অন্ত্যেষ্টি করে ওদের। ওরাই তখন ওর বাবা-মা-ভাই-বোন, সব কিছু। মাথার ভিতর ঘরভাঙ্গা শূন্যতার মাঝে হরবোলা পোকার গুঞ্জন শুরু হয়! পৌরাণিক অভিশাপের মত মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থায় সেই নিশ্চল, পাষাণ বডিগুলোর সাথে কথা বলে শোভনা! এই সীমাহীন অনস্তিত্ত্বের দুনিয়ায় ওদের সাথে কথা বলার যে আর কেউ নেই।
বেশীরভাগ বডিই আসে রাতের দিকে। অটোপ্সির তীব্র কাটাছেঁড়ার পর শ্মশানে শোভনার জিম্মায় আসার আগে বডিগুলো আবার চেরা হয়, জানে শোভনা! লাশকাটা ঘর থেকে বেরোনোর আগে এদের শরীর থেকে ইন্টারনাল অর্গানগুলো বের করে নিয়ে ভিতরে চালান করে দেওয়া হয়, হেরোইন, গাঁজা, চরস, বুনো ফল! এই শ্মশানে সেগুলো খালাস হয়। তারপর নদী পেরিয়ে সেগুলো পাচার হয় ওপারে। কিন্তু এই বডিটার সাথে এমন কিছু, কিছুতেই হতে দেবেনা শোভনা! হাতের চেলাকাঠটা নিয়ে তেড়ে যায় ও দেলদারের দিকে। এ শোভনা ক্ষিপ্র! ভয়ংকর! চণ্ডালিনী! এক লাথি মেরে ওকে ছিটকে ফেলে দেয় দেলদার। তারপর নিজের সাথে থাকা লোকটার সাহায্যে বডিটা পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় মাথার ওপর। হেরে যাওয়া বাঘিনীর মতো পড়ে থাকা শোভনার দিকে তাক করে পাইপগানটা। হীমশীতল শ্মশানটার বুকে, কুয়াশার সরের মধ্য দিয়ে নেমে আসা, মৃত্যুর গন্ধটাকে বুকে করে ফ্রীজ হয়ে যায় দৃশ্যটা! ততক্ষণে হয়তো একটা ক্লিয়ার ক্লোজ রেঞ্জ গান শটে ছররা বুলেটটা নিখুঁত নিশানায় ফুটো করে দিয়েছে শোভনার বা দিকের স্তন! সূক্ষ্ম বিবেকযন্ত্রের গুপ্ত কুঠুরি থেকে অঝোরে ঝরে গিয়ে কালচে রক্তটা তখন দুধসাদা চাঁদনী রাতে, এই পুণ্য শ্মশানভূমিতে, জটিল জ্যামিতির নাগপাশ এঁকে চলেছে। কেউ তো আর ওকে যত্ন করে তুলে নিয়ে গিয়ে চিতায় শোয়াবে না। আজ পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ওর মেয়েকে ও শিখিয়ে এসেছে বেওয়ারিশ লাশের অন্ত্যেষ্টি কিভাবে করতে হয়। আকাশ উপুড় করা ঘন বর্ষার রাতে ওর মৃত শরীরটা নিয়ে যেন শিয়াল কুকুরে টানাটানি না করে। ওর শবের পাঁজরে যেন ওই লাশকাটা ঘরের ডাক্তাররা, পাংশু হাতে অশুচি কাটাকুটি না খেলতে পারে, শুধু এটুকুই চাওয়া! দেহাতীত অনুভবে, মেরুপ্রভা সাঁতরিয়ে শোভনা, ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ভাবনার রহস্যময় কৃষ্ণগহ্বরে! দেবলোক নেমে আসে হাতের নাগালে। এদিকে বৃষ্টির প্রবল তোরে তখন ভেসে যাচ্ছে মাটির ওপর পড়ে থাকা রক্তের দাগ! ভেসে যাচ্ছে স্নিগ্ধ মাটির গন্ধ! তার ওপর জড়ো করে রাখা মড়া পোড়াবার কাঠ! শুকনো ডালপালা! লাশের বিছানা প্রস্তুত হচ্ছে যেন! এই শোভনা এখন শান্ত, সমাহিত। শুধু তার ভাঙ্গন বুকে কান পাতলে শোনা যাবে একটা ক্ষীণ শব্দ, “মা”!
***************************